ইমপারফেক্ট কাপল পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0
3322

#ইমপারফেক্ট_কাপল
#পর্ব_০৬ ( শেষ পর্ব)
#লেখা_রিমি_ইসলাম

রাত বারোটা পাঁচ। তিথি এসেছে পাঁচ ঘন্টা পূর্বে। এযাবত একটা কথাও তার সাথে হয়নি। কত জিজ্ঞেস করলাম, কেন এসেছে? জরুরী প্রয়োজন না কি? কে শোনে কার। তিথি আমার দিকে না তাকিয়ে বার বার ঘড়ি দেখছে। যেন বিশেষ কোনো মুহূর্তের জন্য অধীর অপেক্ষায় বসে আছে। আশ্চর্য মেয়ে তো! কথা নেই বার্তা নেই হুট করে আমদানি হয়ে আবার মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইল? এদিকে আমি ফ্রাসটেটেড হয়ে বোমা হয়ে উঠছি। যে কোনো সময় তিথির উপর বুম করে ফাটবো।
ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় বারোটা বাজতেই তিথি লাফ দিয়ে উঠে বললো,
— অদ্রি চল তো ছাদ থেকে ঘুরে আসি।

আমি হতবিহ্বল। এই না এতক্ষণ একটা কথাও বলছিল না। হুট করেই কথা বললো তাও আবার আবদার করে বসলো মাঝরাতে ছাদ ভ্রমন!
আমি ক্যাটক্যাট করে বললাম,
— পারবো না।

— আজব!! চল না একটু হাওয়া খেতে খেতে গল্প করা যাবে।

আমি দু’দন্ড ভেবে নিয়ে তার প্রস্তাবে রাজি হলাম। অনেকদিন ছাদে যাই না। একা গেলে বোর লাগে। নুক্তা তো মাত্রাতিরিক্ত বোরিং বলে সেও কখনো যায় না।
— আচ্ছা থাম চা করে নিয়ে তারপর যাই।

— না না, চা- টা লাগবে না। ছাদে ভূত থাকবে। আর ভূত আমাদের চা খেতে দেখলে আফসোস করে জানতে চাইবে তার জন্য কেন আনা হয়নি।

— কি বাজে বকছিস? আমাদের ছাদে ভূত নেই।

তিথি শুনলো না। একপ্রকার টেনে জোর করে ছাদে নিয়ে গেলো। রাতের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে চাঁদ খানা অনুপস্থিত থাকায় চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কোথাও কিছু দেখতে পেলাম না। আশেপাশের বিলিং গুলো অধিকাংশই আঁধারে ঢাকা। ব্যতীক্রম দুই একটা ছাড়া। আমাদের দুই তলা বাড়ির সামনের দোতলা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে একটা তীক্ষ্ণ আলো এসে চোখে লাগছে। তাই পারতপক্ষে যেদিকে গেলে আলোটা না লাগবে সেদিকটাই যেতে লাগলে তিথি গরগর করে বললো,
— ওইদিকে কিছু নাই। এখানেই যা দেখার দেখবি। সামনে তাকিয়ে থাক।

তিথির সাথে এতদিন কোনো যোগাযোগ ছিল না। আজ হঠাৎ সে এলো তার উপর শুরু থেকে যে আচরণ গুলো করছে, তাতে ওকে স্বাভাবিক মানুষ বলা চলে না। আমি অনিচ্ছায় সামনের দিকে তাকালাম। ছাদের আলো ছাড়া অন্য কিছু নজরে পড়লো না। হঠাৎ সিঁড়ি ঘর থেকে একটা মুখ উঁকি দিলো ছাদের উপর। আমরা অনেকটা দূরত্বে থাকায় মুখটা স্পষ্ট নয়। তার উপর মাথায় হ্যাট পরায় মুখের অর্ধেক ঢাকা পড়েছে।
তিথির দিকে তাকাতেই দেখি ও মিটি মিটি হাসছে। এবার সন্দেহ হলো ওর বয়ফ্রেন্ড নয় তো? হতেও তো পারে! তাই বোধ হয় এত রাতে জোর করে ছাদে ধরে এনেছে।
আমারো সামনের বিল্ডিংয়ের ছাদটায় দৃষ্টি হানলাম গভীরভাবে। একটা অচেনা মুখ নিচে থেকে কিছু একটা তুলে হাতে নিলো। আরে
হ্যাঁ, অনেকগুলো বোর্ড। যাতে কি কি সব লেখা রয়েছে। প্রথম একটা বোর্ড তুলে ধরলো আলোর সামনে বরাবর যেনো স্পষ্ট আমরা দেখতে এবং পড়তে পারি।

বড় বড় হরফে লেখা,
১ম বোর্ড,
” অদ্রিজা ফর ইউ।”

আমার হৃদপিণ্ডে ধামাকা হলো জোরালো। এটাতো আমার জন্য। কিন্তু কে করবে এমন?
২য় বোর্ড ধরলো,
” হয়তো আমি পারফেক্ট নই। হয়তো তোমার পছন্দের মানুষও নই। কিন্তু তবুও আমি তোমার হাতটা চিরকালের জন্য ধরতে চাই। জানি না কেনো। কিন্তু তোমাকে আমার চাই।”

তৃতীয় বোর্ড,
” প্রথম দেখায় তোমার প্রেমে পড়েছি। অনেক রুড বিহেভ করেছিলাম তার জন্য স্যরি। কিন্তু কি করবো বলো? লেডিস ওয়াশরুমে অমন উদোম শরীরে থাকলে নিজেকে কনট্রোল করা যে কত কঠিন তুমি আর বুঝবে কি! যাই হোক, তোমার ফিগার মারাত্মক! মনে করো না আমি আবার খারাপ ছেলে। আমি অসম্ভব ভদ্র ভালো ছেলে। নাহলে ওইদিন অনেক কিছুই হতে পারতো।”

৪র্থ বোর্ড,
” তুমি ঝাল সহ্য করতে পারো না বলে আমি এখন ঝাল খাওয়া একদম ছেড়ে দিয়েছি। বরাবরই আমার ঝাল খাবার পছন্দ। কিন্তু প্রিয়তমর পছন্দের কাছে নিজেকে নত হতে তো হবেই। তোমাকে আমি আজীবন শুধু মিষ্টি খাওয়াবো। বাইরের মিষ্টি, আমার মিষ্টি সব মিষ্টি খাইয়ে তোমার ডায়াবেটিস করে দিবো। রাগ করো না। জাস্ট ফান। মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয় না। আর আমার মিষ্টি তো স্যুগার ফ্রি।”

৫ম বোর্ড,
” তুমি শপিং মলে পড়ে গিয়েছিলে। বিশ্বাস করো আমার তখন মনে হয়েছিল সব কটা ফ্যানকে বেধোম ক্যালাতে। তাদের জন্য তোমার শরীরে একটা আঁচড় লেগেছে। অথচ তোমাকে একটু যত্ন করে হাত ধরে তুলবার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তুমি যে কত লজ্জা পেয়েছিলে আমার চোখ এড়ায়নি। আই প্রমিজ, এরপর থেকে তুমি পড়লে কোলে তুলে নিবো। ”

৬ষ্ঠ বোর্ড,
” তোমার গলার আওয়াজ দারুণ! একটু ভয়েস হাই করলেই আমার তালে গাইতে পারবে। আমি আছি কেন? শিখিয়ে পড়িয়ে ওস্তাদ করেই তোমাকে ছাড়বো। তবে শর্ত সাপেক্ষে শিখাবো। আমাকে ছাড়া অন্য কারোর সামনে গাইবে না। রাজি?”

৭ম বোর্ড,
” এত কথা বলছি। বিরক্ত হচ্ছ না কি? ভুলেও বিরক্ত হবার ভুল করো না। তাহলে আবার ট্রিট চেয়ে নিবো। আচ্ছা বাদ থাক,মূল কথা আসি।
তোমার ট্রিট কিন্তু এখনো দেওয়া শেষ হয়নি। প্লিজ লাস্ট একটা ট্রিট দাও? বিনিময়ে পুরোজীবন তোমার কাছে কখনো ট্রিট নিবো না প্রমিজ। ”

৮ম বোর্ড,
“অদ্রিজা, তুমি আস্ত আমার কলিজা। তাই কলিজা বাদ পরলে তো আমি সোজা ওপরে পৌঁছে যাবো। তাই এইটাই শেষ আবদার। না করলে এই দোতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে জান দিয়ে দেবো। ”

তারপর আর কোনো বোর্ড নেই। আমার চোখে আকাশ ভাঙা পানির ধারা বয়ে যাচ্ছে। জীবনে কারো কাছে এতটা অমূল্য হবো কখনো কল্পনা করিনি। এতটা ভালোবাসার মানুষ জীবনে আসবে!
অনেকটা সময় পার হবার পর শেষ একটা বোর্ড ধরলো অর্ক।
হ্যাঁ অর্ক। এতগুলো কথা শুনে আপনারাও নিশ্চিত বুঝেছেন এটা অর্ক ছাড়া আর কেউ না।

৯ম বোর্ড,
” অদ্রিজা মাই ড্রিম, উইল ইউ গিভ ইওর হ্যান্ড টু মাই হ্যান্ড? উইল ইউ ম্যারি মি? ”

আমি স্তব্ধ। বাকরুদ্ধ। শ্বাস আটকে আসতে চাইছে কান্নার দমকে। এতটা আনন্দ হচ্ছে যা বলার বা লেখার কোনো সঠিক উপমা খুঁজে পাচ্ছি না। ধারণা করুন, মানুষ সুখকর স্বপ্ন দেখার পর যখন ঘুম ভেঙে মনে করে তখন কতটা তীব্র আনন্দ বোধ করে। কিন্তু কাউকে বলতে গেলে গুছিয়ে বলা হয়ে ওঠে না। আমার মুহূর্তও ঠিক একটা সুখকর স্বপ্নের মতো।

অর্ককে আর দেখলাম না। চারপাশে তাকিয়ে দেখতে না পেয়ে কেমন অস্তির হয়ে উঠছি। সে আসছে না কেন? এভাবে চরম ক্ষণে ফেলে চলে গেল? ঠিক তখনই পেছন থেকে কেউ একজন আমাকে গভীর আবেশে জড়িয়ে ধরলো। চোখ বন্ধ করে জানি এটা অর্ক ছাড়া কেউ নয়।
তার শরীরের ঘ্রান তার উপস্থিতির কথা জানান দিচ্ছে।
আমি সামান্য নাটক করে বললাম,
— আপনাকে বিয়ে করতে বয়েই গেছে। আপনি আর আমি হলাম ইমপারফেক্ট কাপল। একজন উত্তর মেরু তো আরেকজন দক্ষিণ মেরু।

—- চুম্বকের উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরুকে আকর্ষণ করে কাছে টেনে নিতে পারলে আমরা পারবো না? জীবনের সব জার্নি যে পারফেকশন দিয়ে শুরু হবে কে বলেছে? আমরা না হয় ইমপারফেক্ট থেকেই পারফেক্ট হবার জার্নি শুরু করবো। এখনো বলবে না?

আমি অর্কর হাতটা ছাড়িয়ে ওর দিকে ঘুরে ওর গাল দুটো টেনে বলি,
—- এত সুন্দর করে কেউ বুঝালো আর আমি মানবো না তা হয়! বুঝলে মাই বেটার হাফ?

অর্ক অগোছালো ভঙ্গিতে মাথা চুলকায়। তারপর আমার সাথে সেও হাসিতে যোগ দেই। পেছন থেকে তিথি হেসে বললো,
— উইশ ইউ টু আ ভেরি হ্যাপি লাভ জার্নি।

আমি আর অর্ক একে অপরের দিকে চেয়ে নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে গেলাম। এইতো শুরু আমার পারফেক্ট কাপল হবার জার্নি।

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে