#ইতি_মাধবীলতা
#পর্ব_২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
বরণ পর্ব সমাপ্ত হলো কোনো বাঁধা ছাড়াই। নিলাংসু ও মাধবীকে বসার ঘরে আনা হয়েছে। জমিদার বাড়ীর প্রতিটা ঘরই বিশাল আকারের। আর বসার ঘরটা যেনো রাজা-মহারাজাদের ঘরের মত। মাথার উপরে রাজকীয় সিলিং, বিশাল ঝাড়বাতি আর নকশা করা পাখা। সবমিলিয়ে, এ বাড়ির বউ হওয়া যেকোনো মেয়ের জন্যেই আশির্বাদ। তবে, সেই আশীর্বাদ মাধবীর জীবনে শুধুই এক দুঃস্বপ্ন বই আর কিছু নয়। মাধবীর চোখে মুখে রাগের উত্তাপ। আজ নিশ্চয়ই তার রাগের উত্তাপ সবাইকে ছারখার করে দিবে।
কিন্তু বিপত্তি সাধলো যখন জমিদার গিন্নি মাধবীর কপালে চন্দনের ফোঁটা দিতে যাবেন, তখন। জমিদার গিন্নি চন্দন আঙ্গুলের ডগায় নিয়ে মাধবীর কপাল স্পর্শ করবেন তার আগেই মাধবী তার হাত আটকে দিলো। মাধবীর এহেন দুঃসাহসীক কাজে বসার ঘর এক মুহূর্তের জন্যে নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। সবার চোখ যেন তাদের কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। জমিদার গিন্নি আগুন চোখে তাকালেন মাধবীর পানে। মাধবী যথাসম্ভব নম্র কণ্ঠে বলল,
— দয়া করে আমার সাথে এসব নিয়ম পালন করবেন না। আমি এখনো এসবের জন্য প্রস্তুত নই।
মাধবীর কণ্ঠে নম্রতা। অথচ, তার কণ্ঠে এত রাগ, এত হিংস্রতা জমিদার বাড়ীর সবার রুহ কাঁপিয়ে তুললো। একটা সামান্য বেদের মেয়ের এ কি স্পর্ধা! একেবারে জমিদার গিন্নির উপর তর্ক করছে? সবার সামনে মাধবী কর্তৃক এহেন অপমানে জমিদার গিন্নির মুখ লাল টকটকে হয়ে গেলো। সম্পূর্ণ গা রি রি করে জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেলো। তিনি নিলাংসুর দিকে চেয়ে দাঁতে দাঁত খিঁচলেন। মাধবীর কপাল থেকে হাত নামিয়ে বরণ ডালা দাসীর হাতে সোপর্দ করে হনহনিয়ে বসার ঘর পরিত্যাগ করলেন। মাধবীর এহেন কাজে নিলাংসু নিজেও বেশ অপমানিত হলো। সে মাধবীর হাতের বাহু নিজের বলিষ্ট হাতে চেপে ধরলো। মাধবী ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলেও মুখশ্রী স্বাভাবিক করে তাকালো নিলাংসুর পানে। নিলাংসু কণ্ঠে অসীম রাগ নিয়ে বললো,
— এমনটা না করলেও পারতে। সামান্য চন্দনের ফোঁটা কপাল স্পর্শ করলে তোমার আহামরি কোনো ক্ষতি হয়ে যেত না।
মাধবী কয়েকপল নিলাংসুর দিকে চেয়ে রইল। নিলাংসুর চোখ বেয়ে যেনো রক্ত গড়াচ্ছে। মাধবী সেই রক্ত দেখে একটুও বশীভূত হলো না। সে জোরপূর্বক নিজের বাহু থেকে নিলাংসুর হাত ছাড়িয়ে নিলো। নিছক হেসে বললো,
— আমি জানি কোনটা আমার জন্যে ক্ষতি কোনটা আমার জন্যে ভালো। আপনার এ নিয়ে মাথা ব্যাথা না করলেও চলবে।
নিলাংসু ক্ষেপলো খুব। কিন্তু আশপাশ থেকে জমিদার বাড়ির মহিলাদের কানাঘুষা শুনে সে নিঃশ্বাস আটকে সব সহ্য করে নিলো। তবে মাধবীর কানের কাছে উত্তপ্ত শ্বাস ছেড়ে এ কথাটি বলতে ভুললো না সে, ‘ একবার ঘরে এসো। এ কাজের জন্যে তোমায় বহুত মাসুল গুনতে হবে। ‘
______________________________
আজ রবিবার কথাটা মাথায় আসতেই মাধবী একপ্রকার সম্বিত ফিরে পেলো। আজ মাধবীর পূঁজো করার দিন। এতক্ষণ বারান্দার আরাম কেদারায় বসে ও ভাবনায় মশগুল ছিলো।
মাধবী আর কালবিলম্ব করলো না। বরং, বাথরুমে গিয়ে পবিত্র হয়ে জমিদার বাড়ির পূঁজো ঘরে প্রবেশ করলো সে।
জমিদার বাড়ীর এক দাসী এ ঘরের পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। মাধবীকে গীতা পাঠ করতে দেখে দাসির চোখ যেন কপাল স্পর্শ করলো। সে মুখে হাত চেপে ধরে বিড়বিড় করলো,
— শিব, শিব, শিব। এ কি অলুক্ষুনে কাণ্ড। বড় কত্তি পূঁজো ঘরে গেচেন? ও গিন্নি মাআ….
জমিদার গিন্নিকে খুঁজতে খুঁজতে সে ঘর প্রস্থান করলো দাসী। আজ এই মহা পাপের খবর তো গিন্নি মাকে জানাতেই হবে!
— গিন্নি মা, গিন্নি মা? শুনেচেন ওদিকে কি হইচে?
জমিদার গিন্নি তখন নিজ ঘরে বসে ধর্মীয় বই পাঠ করেছিলেন। দাসির গলা শুনে তিনি বিরক্ত হলেন খুব। হাত উঁচিয়ে দাসিকে জায়গা প্রস্থান করতে বললে দাসি দেরি না করে বললো,
— বড় কর্তি পূঁজো ঘরে পূঁজো করছেন, গিন্নি মা!
‘ মাধবী পূঁজো করছে ‘ বাক্যটা শুনে জমিদার গিন্নির চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গেলো। তার চোখে আগুন খেলা করে উঠলো। শরীরে অসংখ্য লাভা ছড়িয়ে পড়তেই জমিদার গিন্নি রক্তচোখে তাকালেন দাসির দিকে। উনার এমন জ্বলন্ত রাগ দেখে দাসি ভয়ে রীতিমত গলে গেল। একপাশে তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল নতমুখে। জমিদার গিন্নি একরত্তিও কথা বাড়ালেন না। তিনি বই পাঠ বন্ধ করে চুম্বন খেলেন। অতঃপর তা একপাশে রেখে ছুটলেন নিলাংসুর ঘরের পানে। আজ এর একটা বিহিত করেই ছাড়বেন তিনি। কি পেয়েছে কি এই মেয়ে? জমিদার হিন্দু বাড়িতে পাপ লাগানোর সাহস কে দিল তাকে?
#চলবে