❤#ইচ্ছে_ডানা
#অন্তিম_পর্ব❤
রাজীবের ফোনটা রাখার পর সৌরিতা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল ছাদের কার্নিশ ধরে। বুকের ভিতরে ধুকপুকুনিটা অসম্ভব রকমের বেড়ে গেছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সৌরিতার মনের ভিতর এতটুকু কষ্ট হচ্ছেনা। ও ভেবেছিল এই অসাধ্য সাধনটা ও কিছুতেই করতে পারবেনা, অনেক সমস্যা হবে। কিন্তু না, এরকম কিছুই হলনা। এটা কি ভীষণ স্বাভাবিক বিষয়? ঐষনাকি বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাত সহ্য করে করে সৌরিতা আজ এরকম অবস্থায় পরিণত হয়েছে! রাগ-দুঃখ, কষ্ট-অভিমান কোনো কিছুই যেন আর বিচলিত করে না তাকে। কোনো অনুভূতি না হলেও, একটা প্রশ্নের উত্তর বড্ড ভাবাচ্ছে সৌরিতাকে। সেটা হল, মানুষ ভালোবাসার জন্য এতকিছু করে বসে, এত ঘটনা ঘটে, তার নিজের সাথে ও ঘটেছে, সে নিজেও তো একসময় রাজীবকে ফিরে পাওয়ার জন্য কত কিছু করেছে, কাকুতি মিনতি থেকে চোখের জল…..কোনো কিছুরই কম ছিলনা সেখানে। কিন্তু তারপরে কী হল?? এখন এই মুহূর্তে এসে দাঁড়িয়ে তো তার রাজীবের প্রতি আর সেরকম কিছুই অনুভূতি আসছেনা! হ্যাঁ খারাপ লাগা রয়েছে সামান্য ঠিকই….কিন্তু ব্যস ওটুকুই। তার থেকে আর বেশি কিছু না….
ফোনের স্ক্রিনে সৌরদীপের নামের উপর হাত দিয়ে আলতোভাবে ছুঁয়ে, ইয়ারফোনটা কানে দিল সৌরিতা। অন্যদিন হলে, ফোন করার আগে ও অবশ্যই জিজ্ঞেস করে নিত, কিন্তু আজ করলনা। আজ সমস্ত নিয়মের বিরুদ্ধে চলে যেতে ইচ্ছে করছে ওর। কে কী ভাবল, বা বলল সেসবের তোয়াক্কা না করেই যেন এগিয়ে যেতে চাইছে মন। অথচ এই অনুভূতিটাই যদি আজ থেকে কয়েক বছর আগে হত, তাহলে হয়তো বাবা মায়ের মতের বিপক্ষে গিয়ে,রাজীব নামের কোনো মানুষ তার জীবনে আসতোই না। জীবন টা অন্যরকম হলেও হতে পারত। কিন্তু তা যখন হয়নি বাস্তবে, তাই আর বিশেষ ভেবে লাভও নেই বোধহয়……
বেশ কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরে ঘুম জড়ানো গলায় সৌরদীপ ওপাশ থেকে ফোনটা ধরল। ধীরগলায় সে বলল,
-” হুমম বলো, আমি জানতাম তুমি ফোন করবে”
-” মানে??”
-” মানে জানতাম তুমি ফোন করবে, বলো। যা যা বলার আছে বলো। সব শুনছি”
-” সৌরদীপ ! তুমি কি কিছু বুঝতে পেরেছ?? আমি কী বলতে চলেছি, সেই ব্যাপারে??”
-” হুমমম অবশ্যই, গত কয়েকদিন ধরে তোমার কথাবার্তা, ব্যবহার, সেই ইঙ্গিতই করছে।”
-” তাহলে বলো, কী বলতে চলেছি??”
-” এই যে তুমি একটু আলাদা থাকতে চাও, সবকিছুর থেকে দূরে যেতে চাও। তাই তো??”
সৌরদীপ ভীষণ স্বাভাবিক ভাবে উত্তরটা দিল। এত বেশি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উত্তর দিল, যে সৌরিতা প্রচন্ড অবাকই হয়ে গেল, ও যা যা বলবে ভেবেছিল সবকিছু কেমন যেন ওলোট পালোট হয়ে গেল। কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে, কাঁপা কাঁপা গলায় সৌরিতা বলে উঠল,
-” তু-তুমি কী করে জানলে??”
-” কারণ জীবনটা-বাইরের জগতটা আমি তোমার থেকে একটু হলেও বেশি দেখেছি, চিনেছি…… আর তার থেকেও বেশি ভালোভাবে তোমাকে বুঝেছি। তাই বোধহয়”
-“বেশ সব যখন জেনেই গেছ, বুঝেই গেছ, তাহলে তো আমার আর সেক্ষেত্রে নতুন করে কিছু বলার নেই।হ্যাঁ আমি একা থাকতে চাই, একটা সম্পর্ক ভুলতে আরেকটা সম্পর্ককে আঁকড়ে ধরতে চাইনা। আর কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে চাইনা।”
-” বেশ, যাও। আমি তো প্রথম থেকেই বলেছি যে কোনো বাধা কোনোদিনই দেবনা। তোমার ইচ্ছেটাই সব।”
-” তুমি কোনো বাধাই দেবেনা?”
-” না, তোমার ইচ্ছাই শেষ কথা”
-” ওহ আচ্ছা”
-” কেন তুমি কি চাও আমি বাধা দিই? আটকে রাখি তোমাকে?”
সৌরদীপের এই কথাটা শুনে যেন সামান্য শিউরে উঠল সৌরিতা। শব্দ দিয়েও যে শরীর স্পর্শ করা যায়, সেই অনুভূতিটা বোধহয় এই প্রথমবার বুঝতে পারল সে।
মুখে সে যাই বলুক, ও মন থেকে কেন না জানি একটা ইচ্ছে প্রবল হয়ে উঠতে লাগল, যাতে সৌরদীপ ওকে কোনোভাবে বাধা দেয়, ওর চলে যাওয়াটাকে আটকে রাখে। কেন হঠাৎ এরকম একটা অদ্ভুত ইচ্ছে তার সাথে শুরু করেছে, তা বোঝা গেলনা। তবে মনের ইচ্ছা যতই যেরকম হোক না কেন, মুখে তা প্রকাশ করা একেবারেই বারণ, সৌরিতা নিজেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ নিজের কাছে সেক্ষেত্রে। তাই অদম্য ইচ্ছেটাকে দিয়েই, সৌরিতা তাড়াতাড়ি করে সৌরদীপের কথার উত্তরে বলল,
-” না তা চাইনা, এমনিই মনে হলো বললাম। বাদ দাও। আমি এর থেকে ভালো সিদ্ধান্ত সত্যিই আর নিতে পারছিনা। প্লিজ ”
-” হুম, আমি বুঝতে পারছি তোমার অবস্থাটা। তবু একটা কথা জিজ্ঞেস করব তোমাকে, উত্তর দেবে?”
-” হ্যাঁ বলো”
-“নিজেকে কষ্ট দিয়ে জোর করে, এরকম করে কি সিদ্ধান্ত নেওয়ার খুব প্রয়োজন আছে??”
-” নিজেকে কষ্ট দিয়ে মানে?”
-” এই যে সবার থেকে দূরে সরে গিয়ে, একা থাকার চেষ্টা করছ, এটাই বলছি। আমাকে অন্তত একজন বন্ধু হিসেবেও পাশে রাখতে পারতেনা?”
-” আমি জানিনা, প্লিজ, আমাকে আর বিভ্রান্ত করোনা। আমি চাইনা তোমার প্রতি দুর্বল হতে, আমি চাইনা আর কারোর সাথে নিজের জীবন জড়াতে। প্লিজ,সৌরদীপ”
থাকতে না পেরে শেষে গলাটা কান্নায় বুজে এল সৌরিতার। রাজীবের সাথে কথা বলার সময় ঠিক যতটাই নিজেকে শক্ত রেখেছিল, এখন ঠিক ততটাই দ্রুতগতিতে যেন ভেঙে পড়তে লাগল সে। তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা সামলানোর জন্য চোখ মুছে সে আবার বলল,
-” আর কিছু বলবে তুমি???”
-” হুমম বলব, এটাই বলব যে, তুমি ছাড়তে চাইলেও আমি তোমাকে একা ছাড়ব না। আজ একটা সত্যি কথা বলতে চাই তোমাকে, সৌরিতা আই ডোন্ট নো হোয়াই, বাট আমার মনে তোমার প্রতি হয়তো কোনো ফিলিংস চলে এসেছে, যেটা আমি আটকাতে পারিনি, খুব স্পষ্ট ভাবেই বললাম কথাটা। ডোন্ট মাইন্ড”
-” হয়তো??? মানে তুমি নিশ্চিত নও??”
-” হুম নিশ্চিত নই, যা মনে হল বললাম। বাদ দাও, তুমি এটা বলোতো, যে ভবিষ্যত নিয়ে কী ভেবেছ?? মানে এর পরে কী করবে না করবে, সেই ব্যাপারে বলছি”
-” আপাতত একটা চাকরির চেষ্টা করব, এম এস সি টা করা যায় কিনা দেখি।”
-” তারপর??? পড়াশোনা বাদে বাকি সময়টুকু কী করবে? একা থাকবে সারাক্ষণ?”
-” তুমি কি আমাকে দুর্বল করে দিতে চাইছ সৌরদীপ?”
-“না, জাস্ট জিজ্ঞাসা করছি, একজন না একজনকে তো লাগে, জীবনে আঁকড়ে ধরার জন্য, তাই না? প্রেমিক-প্রেমিকা হোক বা মা বাবা, বা ছেলে মেয়ে, কেউ অন্তত থাকবে, সেটাই বলছি…..”
-” বেশ, আমি তবে কাউকে দত্তক নেব। কত কত অনাথ ছেলেমেয়েরা কাউকে মা বলে ডাকবে বলে অপেক্ষা করে, সেখানে কাউকে একজনকেও নিশ্চিত জীবন দিতে পারলেও, আমার খুশি”
-” বাহ্, বেশ ভালো সিদ্ধান্ত, ঠিকই আছে। তাহলে আর কখনো ফোন বা কোনো যোগাযোগ করতে পারব না আমি, তাই তো ?”
-” হুমম”
-“ওকে। বেশ, সাবধানে থাকো তাহলে। কখনো কোনো প্রয়োজন হলে, জানাতে দ্বিধা করোনা। কেমন?? রাখছি তবে ”
-” হুমম”
সৌরিতা আর কিছু বলার আগে ওপাশ থেকে শব্দ করে ফোনটা কেটে গেল। এতকিছু করতে করতে কখন যে সময় গড়িয়ে গেছে অনেকটা, তা খেয়ালই করেনি সে। সকালের রোদ চড়াভাবে গায়ে পড়েছে। ভ্রু কুঁচকে একবার আকাশের দিকে বহু কষ্টে তাকালো সৌরিতা। কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবার পর, ধীরপায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল সে। আকাশের রোদ-ঝলমলে ভাব তখন কীসের ইঙ্গিত করছে কে জানে!
**********
সময়ের স্রোত যে কখন কীভাবে বয়ে যায়, তা বোধকরি কিছুতেই বোঝা হয়ে ওঠেনা আমাদের। নানাদিকে নানারকম গতিপথে জীবন বয়ে চলার পর, প্রায় সাড়ে তিন বছর পেরিয়ে গেছে সৌরিতার জীবনে। এই তিনবছরে অনেক কিছু ঘটে গেছে, বহু উত্থান পত্তন সহ্য করে সৌরিতা আজও বেঁচে আছে। তবে সেই আগের সময় আর আজকের মধ্যে আকাশ পাতাল না হলেও,পার্থক্য ঘটে গেছে অনেকটাই। আগের মত একটুতেই ভেঙে পড়া, দিশেহারা হয়ে যাওয়া সেই সৌরিতা আজ থেকে এক সন্তানের মা। আজকের পর থেকে ওর জীবনে আরেকটা নতুন অধ্যায় শুরু হল, আরো একটা নতুন জীবনের দায়িত্ব ওর জীবনে যোগ হল। অনেক আইনি ঝামেলা ঝঞ্ঝাট পেরিয়ে আজকের দিনটাকে নিজের করে পেয়েছে সৌরিতা। আনন্দে চোখের জলটা যেন কিছুতেই ধরে রাখতে পারছেনা ও।
চোখের কোণের জলটুকু মুছে নিয়ে কোলে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত বাচ্চাটার দিকে তাকালো সৌরিতা। কত্ত নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে মেয়েটা। মাত্র একবছর বয়সে ওর মা বাবা দু’জনেই মারা যায় একটা অ্যাকসিডেন্টে। তারপর থেকে একবছর এই হোমে থেকেছে ও, দূর-সম্পর্কের আত্মীয় স্বজন কয়েকজনের খোঁজ পাওয়া গেলেও কেউই সেরকম উদ্যোগ নেয়নি বাচ্চাটির দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারে। বেচারা জীবনের শুরুতেই এত আঘাত পেয়েছে, অথচ তা বুঝতেও পারেনা। আর যাতে কখনো বুঝতেই না হয়, সেই জন্যই তো এই পদক্ষেপটা নেওয়া। হোমে এসেই এই মিষ্টি মুখের মেয়েটাকে পছন্দ হয়ে গিয়েছিল সৌরিতার, আর সাড়ে তিন বছর আগে সৌরদীপকে দেওয়া কথাটা আজ পূর্ণতা পেল, সত্যি সত্যি। তবে হ্যাঁ, সেই মুহূর্তে রাজীবকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটা যে একেবারেই সঠিক ছিল, কোনো ভুল ছিলনা তাতে, তা ইতিমধ্যে ভালোভাবে টের পেয়ে গেছে সৌরিতা।
সেদিনের পর সৌরিতাকে বোঝানোর জন্য মাত্র একবারই ফোন করেছিল রাজীব, তাও সেটা বোঝানো ছিল নাকি হুমকি ছিল, তা নিয়ে সন্দেহ আছে সৌরিতার। শুধুমাত্র অধিকার রক্ষার তাগিদে কিছুতেই সৌরিতাকে ডিভোর্স দিতে চায়নি রাজীব। এই নিয়েও কম ঝামেলা সহ্য করতে হয়নি সৌরিতাকে, কিন্তু তা সত্ত্বেও দাঁতে দাঁত চেপে সবটা সয়ে গেছে সে। আর তার সুফলই পেয়েছে পরে। মাত্র একবছরও পেরোয়নি, রাজীব আবার বিয়ে করেছে। নাহ্, ওর নতুন জীবনের জন্য কোনো খারাপ লাগা নেই সৌরিতার, শুধু এটা ভেবেই সে অবাক হয়ে যায়, যে একটা মানুষ কীভাবে নিজের দোষ থাকা সত্ত্বেও, সবকিছু এতসহজে অন্য কারোর উপর সেই দোষ চাপিয়ে, সমস্ত কথা ভুলে গিয়ে এত তাড়াতাড়ি নতুন জীবনে চলে যেতে পারে??? কই সৌরিতা তো পারেনি! চেয়েছিল, তাও পারেনি…. কেন পারেনি??? এতটাই কি কঠিন ছিল সবটা??বোধহয়…
রিমঝিমের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন কথা ভাবতে ভাবতে এমনভাবে হারিয়ে গিয়েছিল সৌরিতা, যে পিছনে কখন যে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে তা বুঝতেও পারেনি। চেনা কন্ঠস্বরটা শুনে চমকে পেছনে তাকিয়েই একগাল হেসে ফেলল সে। সৌরদীপ আজকেও তার পছন্দের সেই শার্টটাই পরে এসেছে, ছেলেটা যে এত পাগল তা আগে কে জানত! তবে এই ছোটো ছোটো পাগলামি গুলোর জন্যই হয়তো আজকে একটু প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস পারে সৌরিতা, অত তাড়াতাড়ি রাজীবের বিয়ের খবর শুনেও নিজেকে সামলে রেখেছিল, বেঁচেছিল, জীবনের পথে এগিয়ে যেতে পেরেছিল। সৌরদীপ ছিল বলেই হয়তো, আজ রিমঝিম কে এত প্রতিকূলতা পেরিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের কোলের কাছে পেয়েছে সে। কোনো অধিকার না দেখিয়েও কীভাবে পাশে থাকা যায়, তা বোধহয় সৌরদীপকে না দেখলে জানা হতনা সৌরিতার, কিছুতেই না।
সৌরদীপ সানগ্লাসটা খুলে, নিজের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে সৌরিতার পাশে গিয়ে বসে, ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
-” তুমি কি বাড়ি যাবেনা? এখানেই বসে থাকবে?”
-” না যাব, কিন্তু রিমঝিম এই সবে ঘুমোলো, তাই একটু পরে উঠব ভাবছিলাম। তুমি কি কোথাও বেরোবে নাকি?”
-” না , এই আপনাকেই আনতে এলাম। আপনি আর আপনার মেয়ে, দুজনেই এখন ভি আই পি, গেস্ট বলে কথা”
-” দূরর, সবসময় ইয়ার্কি”
হাসতে হাসতে আলতো করে সৌরদীপের পিঠে একটা হাত রাখল সৌরিতা। ঘামে ভিজে গেছে পুরো জামা, আর এই অবস্থায় এখানে বসে বসে হাসছে ছেলেটা। এত্ত অদ্ভুত ছেলে না, সত্যি! সৌরিতার হাসির দিকে তাকিয়ে সৌরদীপ প্রথমে কী একটা যেন ভাবল, তারপর ভীষণ সিরিয়াস মুখ করে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
-“তোমাকে একটা কথা বলব? অনেক দিন ধরেই বলব ভাবছিলাম, যদি রাগ না করো”
-“কী কথা??”
-” তুমি রিমঝিমের মা তাই তো?”
-” হ্যাঁ কেন??”
-” আর ওর বাবা?”
-” মানে ? আমি তো বলেই ছিলাম সিঙ্গেল মাদার এর কথা, তাহলে??”
-” সে তো পরিস্থিতি আলাদা হলে হত। কিন্তু তোমার কি মনে হয়না? যে রিমঝিমের মায়ের পাশাপাশি জীবনে বাবারও প্রয়োজন আছে? ওকে একটা সুস্থ জীবন তো দেওয়া যেতেই পারে তাই না?? ”
-” কিন্তু তুমি কী বলতে চাইছ?”
-” হ্যাঁ, বলছি। আমাকে এতটুকু অধিকার কি তুমি দিতে পারোনা? তোমার জীবনে, এতদিন পরেও কি তোমার এতটুকু বিশ্বাস অর্জন করতে পারিনি??”
-” সৌরদীপ!! তুমি সেদিন আমার জন্মদিনে তারমানে এটাই বলতে চেয়েছিলে??”
-“হ্যাঁ, কিন্তু আমি অপেক্ষা করছিলাম রিমঝিমের জন্য, ওর আসার অপেক্ষতেই ছিলাম। এখন তো আর কোনো আপত্তি নেই, আর কতটা দূরে গেলে তবে তোমার কাছে আসা যাবে বলতে পারো?”
-” তাহলে শুধু এর বাবা হওয়ার জন্যই তুমি এই বিয়ের সম্পর্ক চাইছ?”
-” নাহ্, তোমার জন্যও চাইছি। আজ আর আমার বলতে কোনো আপত্তি নেই, আমি তোমাকে তোমাক ভালবাসি সৌরিতা। এবার বলো, তুমি কতদিন নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রেখে দেবে এভাবেই??”
সৌরদীপের কথার কোনো উত্তর না দিয়েই মাথাটা নীচু করে নিল সৌরিতা। সত্যিই এই মুহূর্তে ওর বলার মতো আর কিছুই নেই। কী জবাব দেবে সে? আর বলার মত কিছু কি আছে?? সৌরদীপের সব কথাটাই অকাট্য। যেই মানুষটা এতদিন এভাবে ওর পাশে ছিল, সে কি এতটাও বিশ্বাসের অযোগ্য হতে পারে?
ওকে চুপ করে থাকতে দেখে সৌরদীপ একহাতে রিমঝিমের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে, আরেক হাতে সৌরিতার হাতটা আলতো করে ধরে বলল,
-” আজকেও বলতে এত আপত্তি?”
এতক্ষণ পরে মুচকি হেসে সৌরিতা মাথা নীচু করেই উত্তর দিল,
-” মেয়ের আপত্তি না থাকলেই হলো, মায়ের কোনো অসুবিধা নেই”
-” মানে ? সত্যি?? সৌরিতা,তুমি সত্যি বলছ?
-” রিমঝিম আমার কোলে আছে কিন্তু, ওকে ছুঁয়ে নিশ্চয় আমি কোনো মিথ্যে কথা বলবনা।”
সৌরদীপ উত্তেজনায় আর বসে থাকতে পারলনা। নিজের বয়স, চারপাশের জায়গা সব কিছু ভুলে গিয়ে, একঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে সে প্রায় চিৎকার করেই বলল,
-” আজই তোমার বাড়ি যাব, ওয়েট। আমি একটুও দেরী করতে চাইনা। একটুও না।”
-” আরেহ্ আস্তে। ঘুমোচ্ছে তো নাকি, আর এত না লাফিয়ে চলো, বাড়ি যেতে হবে। সকাল থেকে কিচ্ছু ভালো করে খাইনি। চলো”
-” হুমম চলুন”
রিমঝিমকে আলতো করে শুইয়ে কাঁধের পিছনে ওর মাথাটা রেখে, পিঠে চাপড় মারতে মারতে উঠে দাঁড়ালো সৌরিতা। আজ আর কোনো সংকোচ করলনা সৌরদীপ। উঠে দাঁড়িয়ে সৌরিতার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে চেপে ধরল সে। একসাথে পা বাড়িয়ে, হেঁটে গেল ওরা গাড়ির দিকে। এখনও অনেক পথ চলা বাকি,
মনের ভিতরকার ইচ্ছেডানা গুলো একে একে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য,এভাবে হাতে হাত রাখাটা ভীষণই প্রয়োজন। পিছনে ছায়াপথের মতো পড়ে থাক না অন্ধকার অতীত গুলো……
( সমাপ্ত)