#আড়ালে তুমি
পর্ব ১৪
লেখকঃ শাহরিয়ার কবির নীল
আজকে সবাই মিলে এক সাথে বসে আছি। রিফাত বোনকে নিয়ে আছে আর আমার কাছে আমার ছেলে আছে৷ বর্না আপু বারবার মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আমি এবার ভাবলাম ওদের সারপ্রাইজ দেওয়ার সময় চলে এসেছে। আমি রফিক ভাইকে আমার কাছে ডাকলাম। ওনি আমার কাছে আসা মাত্রই আমি আমার ছেলেকে ওনার কোলে তুলে দিলাম৷ রফিক ভাই আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। বর্না আপু বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। আসলে বাচ্চাকে কাউকে কোলে দেওয়ার একটা ধরন আছে। তবে আমি যেভাবে দিয়েছি তাতে মনে হতেই পরে যে আমি ওদের দিয়ে দিলাম।
আমিঃ ভাইয়া আমি চাই আমার এই ছেলের দায়িত্ব আজ থেকে তুমি নাও।
রফিক ভাইঃ মানে? কি বলছিস তুই?
আমিঃ আমি বলতে চাইছি আমার ছেলেটাকে তুমি আর আপু নিজের মতো করে বড় করো। তুমি তাকে নিজের পরিচয়ে বড় করো।
রফিক ভাইঃ এটা তুই কি বলছিস ভাই? এটা হয়না।
আমিঃ দেখো আমার দুইটা সন্তান আছে। আমি তাদের দায়িত্ব নিলাম আর তুমি আমার ছেলের দায়িত্ব নাও।
বর্না আপুঃ নীল দেখো এটা হয়না। বাবা মায়ের আদরের বিকল্প হয়না৷
আমিঃ দেখো আপু তোমরা তো চাইছিলে এতিম খানা থেকে বাচ্চা এনে নিজের পরিচয়ে বড় করতে। তার বদলে তুমি আমার ছেলেটাকেই নিজের পরিচয় দাও? আর বাবা মায়ের আদরের কথা বলছো? আমি জানি এটা তোমাদের থেকে ভালো কেউ ওকে দিতে পারবেনা।
বর্না আপুঃ এটা হয়না নীল। আমরা তোমাদের সন্তানকেই নিজের মনে করে বড় করবো। তবে আমাদের পরিচয়ে বড় করতে পারবোনা।
আমিঃ আচ্ছা আমি কি তোমাদের কোনোদিন পর মনে করেছি? আমার ছেলেটাকেও তোমরা অনেক আদর দিয়েছো। তাহলে আমার এই ছেলেটাকেও দিয়ো।
বর্না আপু এবার শিলার দিকে তাকালো। শিলার চোখ দুটি ভেজা। হাজার হলেও নিজের সন্তান। নিজের সন্তান অন্য কারও পরিচয়ে বড় হবে এটা মেনে নেওয়া কঠিন। নিজের চোখের সামনে অন্য কাউকে বাবা মা ডাকবে এটা অনেক কষ্টের। তারপরও তাদের সুখের কথা ভেবে আমরা এটা করতে চাইছি। আল্লাহ আমাদের ঘরে তিনটা সন্তান দিয়েছেন। তাদের ঘরে তো একটাও নেই। তাদের মুখের হাসির জন্য কষ্ট মেনে নিব। তাছাড়া এমন অনেক আছে যারা নিজেদের বোন বা ভাই নিঃসন্তান থাকলে তাদের জন্য তাদের অন্য ভাই বা বোন আলাদা ভাবে একটা বাচ্চা নিয়ে তাদের লালন পালন করতে দেন।
( এটা বাস্তাবে আমার পরিবারে সাথেই হয়েছে। আমার বড় মামার সন্তান না হওয়ায় ছোট মামা তাদের জন্য একটা সন্তান নিয়ে লালন পালন করতে দিয়েছেন। )
বর্না আপু শিলার দিকে আর শিলা বর্না আপুর দিকে ছল ছল চোখে তাকিয়ে আছে। শিলা নিজেকে সামলে নিয়ে বললো
শিলাঃ দেখো আপু আমার নিজের কোনো বোন বা ভাই নেই। আর তুমি তো আমার বড় বোনের মতোই। একজন মায়ের মতো সেবাযত্ন করেছো আমার। তাহলে আমি এতটুকু বিশ্বাস করতেই পারি যে আমার সন্তান তোমার কাছে কোনোদিনও অসুখী হবেনা। ছোট বোন হিসেবে আমার ছেলেটাকে তোমাদের জন্য উপহার দিলাম৷ ছোট বোনের উপহার নিবেনা?
বর্না আপু এবার কান্না করে দিলেন। আন্টি আর আমার শাশুড়ীও কান্না করছেন। রফিক ভাই আর বর্না আপুর চোখের পানি আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতার। শিলা আর আমার চোখে সন্তান দেওয়ার, আমার শাশুড়ী আর আন্টির চোখে আমাদের উদারতার জন্য। রিফাত শুধু দেখছে তবে কিছু বুঝতে পারছেনা। নীরবতা ভেঙে আমি রফিক ভাইকে বললাম
আমিঃ তবে আমাকে একটা কথা দিতে হবে।
রফিক ভাইঃ কি কথা?
আমিঃ সারাজীবন আমাদের সাথে থাকতে হবে৷ আল্লাহ যতদিন হায়াৎ রেখেছেন ততদিন আমাদের নিজের ভাই বোন মানতে হবে৷ ১ সেকেন্ডের জন্যও আমাদে পর ভাবা যাবেনা। আর ছেলেটাকে জীবনেও যেকোনো পরিস্থিতিতে কষ্ট দিতে পারবেনা৷
আমার কথা শুনে রফিক ভাই ছেলেকে আন্টির কোলে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলেন। বর্না আপুও শিলাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো।
রফিক ভাইঃ জানিনা মায়ের পেটের ভাইও এতোকিছু করে কিনা। তুই আমাকে নিজের পরিবারের অংশ বানিয়েছিস, একবার ভাই বলাতে বড় ভাইয়ের আসনে বসিয়েছিস আর আজকে নিজের সন্তানকেউ আমার কাছে দিচ্ছিস। আমি জানিনা কিভাবে তোর ঋণ শোধ করব। তবে আমি কথা দিচ্ছি তোর ছেলের গায়ে কোনোদিন ফুলের টোকাও পড়তে দিবোনা৷
বর্না আপুঃ জানিনা বোন জীবনে কোনো ভালো কাজ করেছি কিনা। তবে আমার কপাল অনেক ভালো যে তোমাদের সাথে পরিচয় হয়েছে। নিজের বোনও হয়তো এই কাজ করতনা৷ এই জীবন দিয়েও যদি কোনোদিন তোমাদের কাজে আসতে পারি তবে ২য় বার ভেবে দেখবোনা৷
বর্না আপু আন্টির কাছ থেকে ছেলেকে নিয়ে তার কপালে গভীর ভাবে একটা চুমু দিলো। চোখে পানি তার। মাতৃত্বের খুশি তার চেহারায়। এদিকে আমাদের এই কাজে শাশুড়ী আর আন্টিও অনেক খুশি। আমার মেয়ের নাম দিলাম আমার আর শিলার নামের সাথে মিল রেখে রাখলা নুসাইবা নাসরিন নীলা। ছেলের নাম রফিক ভাইয়া রাখলো জিসান মাহমুদ।
আমার মেয়েটাকে নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকে রিফাত। শিলা এখন আমার দুই সন্তানকে সামলায়। বর্না আপুও অনেক খুশি। অনেক যত্ন করে। ভাই বোন দুইজনকেই রিফাত অনেক ভালোবাসে। তবে বোনের প্রতি কেয়ার বেশি।
অফিসের দুটো শাখা তৈরির কাজ একেবারে শেষের পথে। একটা করলাম ঢাকায় আর একটা কক্সবাজারে। কোম্পানির অগ্রগতি আগের তুলনায় অনেক বেশি। হাবিবুর স্যার আমাদের সাথে দুটো ডিল সাইন করেছেন। আমাদের সাথে তাদের পার্টনারশিপটা অনেক সুন্দর ভাবে জমে গেছে।
বরাবরের মতোই আজকেও অফিসে ছিলাম। বিকাল ৩ টায় শিলা ফোন দিলো। খেয়াল করার সাথে সাথে ফোন ধরলাম৷ ধরেই শুনতে পেলাম ওর কান্না মাখা শব্দ। এতে অনেকটা ঘাবরে গেলাম।
আমিঃ শিলা কি হয়েছে কাঁদছো কেনো?
শিলাঃ নীল আন্টি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তুমি আর ভাইয়া জলদি চলে আসো।
আমিঃ কি? কোথায় তোমরা?
শিলাঃ উনাকে নিয়ে হাসপাতে যাচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো।
আমিঃ আচ্ছা টেনসন করোনা। আমি আসছি।
আমি রিফাত ভাইকে বলতে যাবো তার আগেই উনি আমার কেবিনে হাজির।
রফিক ভাইঃ নীল তাড়াতাড়ি চল মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেছে।
আমিঃ আপু ফোন দিয়েছিলো তোমাকে?
রফিক ভাইঃ হুম। তাড়াতাড়ি চল।
আমরা আর দেরি না করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম৷ হাসপাতালে গিয়ে দেখি সবাই মিলে কান্না করছে। এমনকি রিফাতও কান্না করছে। নানি নানি বলে আন্টিকে জ্বালিয়ে মারে। এদিকে আমাদের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাও কান্না করছে কারণ তাদের মায়েরা তাদের দিকে খেয়াল করছেনা। আমি শিলাকে শান্তনা দিয়ে বললাম
আমিঃ শিলা কিছু হবেনা৷ তুমি শান্ত হও প্লিজ।
শিলাঃ জানো আমার চোখের সামনেই ছিলেন আন্টি। আমি ওনার জন্য চা আনতে গিয়েছিলাম৷ এসে দেখি উনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। ( কান্না করে)
আমিঃ কান্না থামাও কিছু হবেনা। এদিকে যে নীলা কান্না করছে এদিকে খেয়াল আছে তোমার?
শিলাঃ সরি আমি খেয়াল করিনি। আচ্ছা তুমি একটু ডাক্তারের সাথে কথা বলে দেখোনা।
আমিঃ বলছি বলছি।
এদিকে রফিক ভাই বর্না আপুকে শান্তনা দিচ্ছেন।
রফিক ভাইঃ দেখো বর্না মায়ের কিছু হবেনা। প্লিজ তুমি নিজেকে সামলাও।
বর্না আপুঃ মায়ের কিছু হবেনা তো? ( কান্না করে)
রফিক ভাইঃ আল্লাহর উপর ভরসা রাখো আর কান্না থামাও। জিসান কান্না করছে কিন্তু।
বর্না আপু এবার একটু শান্ত হয়ে জিসানের দিকে খেয়াল করলো। ডাক্তার কিছু পরীক্ষা করতে দিয়েছিলো। সেগুলোর রিপোর্ট আসতে একটু দেরি হয়। রিপোর্ট আসার পর আমরা ডাক্তারের সাথে দেখা করতে গেলাম।
রফিক ভাইঃ ডাক্তার সাহেব আমার মায়ের কি অবস্থা?
ডাক্তারঃ দেখুন ওনার হার্টে ব্লক ধরা পড়েছে। দ্রুত অপারেশন করতে হবে। দেরি করলে সমস্যা হতে পারে।
রফিক ভাইঃ তাহলে অপারেশন করুন।
ডাক্তারঃ দেখুন হার্টের ব্লক নিরাময়ে সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো রিং পরানো। আমরাও সেটাই করতে চাই। আপনারা কি বলেন?
আমিঃ আপনাদের যেটা ভালো আর নিরাপদ মনেহয় সেটাই করুন৷
এরপর আরও কিছু কথা বলে চলে আসি। ডাক্তার অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করে। সবাই বাইরে বসে আছি। নীলা আর জিসান ঘুমিয়ে গেছে। রিফাত আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। রফিক ভাই হাঁটাহাঁটি করছে।
৩ ঘন্টা পর ডাক্তার বের হয়ে আসলেন। তাকে দেখা মাত্রই ভাইয়া তার কাছে ছুটে গেলো।
ভাইয়াঃ ডাক্তার কেমন আছেন উনি?
ডাক্তারঃ চিন্তার কোনো কারণ নেই উনি এখন ভালো আছেন। তবে এখন থেকে নিয়মিত কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। একটু পর আমার কেবিনে আসুন। আমি কিছু ওষুধ লিখে দিবো সেগুলো নিয়ম করে খাওয়াবেন।
আমরা সবাই মিলে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠলাম। আন্টির সাথে ২ ঘন্টা পর দেখা করতে পেলাম। যদিও এখনও জ্ঞান আসেনি। আরও ২ ঘন্টা পর জ্ঞান আসলো। যাক আল্লাহর রহমতে এখন সব স্বাভাবিক আছে।
২ দিন পর উনাকে নিয়ে বাসায় আসলাম তবে এখন থেকে ১ মাস মতো বেড রেস্টে থাকতে হবে। চর্বি জাতীয় খাবার মোটেও এলাউ না। ২ দিন ভালো মতো অফিস করা হয়নি। তাই আজকে থেকে আবার শুরু করলাম।
সময় আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চোখের পলকেই যেনো সময়গুলো কেটে গেলো। আরও ৬ মাস চলে গেলো জীবন থেকে। এখন আমার মেয়েটা খিল খিল করে হাসে। আর সেটা দেখে রিফাতও হাসে। বোন তো না যেনো তার কলিজার টুকরা সে। শিলা, রিফাত দুজন মিলে সব সময় আদর করে আগলে রাখে। বর্না আপুও জিসানের অনেক খেয়াল রাখেন।
আজকে অফিসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ ছিলো। ফিরতে রাত হলো। রফিক ভাই আজকে একটু আগেই চলে গেছে। আমার যেতে দেরি হলো। বাড়ি গিয়ে দেখি কোনো আলো জ্বলেনা। মনেহয় সবাই কোথাও গিয়েছে। কিন্তু গেলে তো আমাকে একবার বলতে পারতো। যাই হোক কিছু না ভেবে বাড়ির লাইট অন করতেই চমকে গেলাম৷ লাইট অন করার সাথে সাথে সবাই মিলে বলে উঠলো Happy Birthday to you. তারমানে আজকে আমার জন্মদিন? যদিও আমি নিজেই জানিনা আমার জন্ম তারিখ তবে সার্টিফিকেটে দেওয়ার জন্য তো একটা ডেট লাগবে তাই দিয়েছিলাম। সেই হিসেবেই হবে হয়তো। বাড়ির ভিতরটাও সুন্দর ভাবে সাজানো। অনেক খশি হলাম আমি। একটু পর কেক কাটলাম কেটে সবাইকে খাইয়ে দিলাম।
রাত ১১ টা। আমি ছাদের দোলনাতে বসে আছি। আমার কাঁধে মাথা দিয়ে আছে শিলা৷ সময়টা অনেক ভালো লাগছে৷ নিরবতা ভেঙে শিলা বললো
শিলাঃ আচ্ছা নীল আজ তোমার জন্মদিন তুমি আমার কাছে কি চাও?
আমিঃ আমার আবার কি লাগবে?
শিলাঃ কিছু লাগবেনা?
আমিঃ আমার জীবনের সবচাইতে বড় গিফ্ট তো তুমি। আমার মতো একজন এতিমকে এতো ভালোবেসেছো, আমার জন্য এতো ত্যাগ স্বীকার করেছো আর আমাকে পিতা হবার আনন্দ দিয়েছো তুমি। রাস্তা থেকে উঠিয়ে রাজার আসনে বসিয়েছ। এর বাইরে আমি আর তোমার কাছে কি চাইতে পারি। তবে এখন তুমি একটা কাজ করতে পারো।
শিলাঃ কি কাজ?
আমিঃ আমার সাথে এই সময়টা উপভোগ করতে পারো। দেখো আজকের চাঁদ, তারা সবকিছু যেনো মনোমুগ্ধকর একটা পরিবেশ তৈরি করেছে। এই সময়টা বার বার আসেনা। আজকের রাতটা এভাবেই কাটিয়ে দাও এটাই চাই।
শিলাঃ তোমার সাথে এরকম হাজার হাজার রাত কাটিয়ে দিতে রাজি আছি। জানো সেদিন তোমার একটা কথাতে আমি অনেক বড় আঘাত পেয়েছিলাম।
আমিঃ কোনদিনের কথা বলছো?
শিলাঃ মনে আছে সেদিন কক্সবাজার থেকে ফিরার সময় কি বলেছিলে?
আমিঃ কি বলেছিলাম?
শিলাঃ বলেছিলে আমি নাকি তোমার থেকেও ভালো কাউলে পেয়েছি বলে তোমাকে ছেড়ে চলে গেছি। তুমি কিভাবে বলেছিলে কথাটা?
আমিঃ আমি জানতাম তুমি ওই কথা শুনার পরই কোনো না কোনো কান্ড করবে। আর আমার ধারণাই ঠিক হয়েছিলো। সেদিনই তুমি আমাকে মেসেজ পাঠাও। আর আমিও তোমার সমানে ছটফট করার নাটক করছিলাম।
শিলাঃ তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো?
আমিঃ অনেক বেশি যা পরিমাপ করা যাবেনা।
শিলাঃ আমিও তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি।
আমিঃ আমি জানি জানু।
শিলাঃ জানো আমার একটা ইচ্ছা আছে জানিনা সেটা পূরণ করা সম্ভব কিনা।
আমিঃ তোমার ইচ্ছা অপূর্ণ থাকবে আর আমি এটা হতে দিবো? আমার জীবন যদি নিতে চাও বলো এখনি দিয়ে দিবো।
শিলাঃ তোমার এসব ছাড়া মুখে কোনো কথা থাকেনা? তোমার আর আমার জীবন একটাই৷ মরতে চাইলে মরে যাও আমিও ছেলে মেয়েদের পরোয়া না করেই মরে যাবো। ( মুখ গোমড়া করে)
আমিঃ এমনি মজা করে বলছিলাম জানু এই কান ধরলাম আর কোনোদিনও এসব কথা মুখে আনবোনা।
শিলাঃ মনে থাকে যেনো।
আমিঃ আচ্ছা। তোমার ইচ্ছার কথাটা বললে না তো।
শিলাঃ আমার অনেক ইচ্ছা গ্রামে একটা বাড়ি করার। ছুটির সময় সেখানে গিয়ে কাটিয়ে আসব। আশে পাশে গাছপালা থাকবে, বাড়ির পাশে একটা পুকুর থাকবে, পুকুরের ধারে বসে তোমার কাঁধে মাথা রেখে বসে থাকবো চুপ হয়ে।
আমিঃ আচ্ছা এসব বাদ দিয়ে চলো নিচে যায়। অনেক ঘুম আসছে।
দেখলাম শিলার হাসিমুখটা নিমিষেই কালো হয়ে গেলো। ও হয়তো ভেবেছে আমি ওর কথায় গুরুত্ব দেইনি। দুইদিনের মধ্যেই শহর থেকে খানিকটা দূরে একটা গ্রামে জমি নিয়ে সেটা শিলার কথা মতো তৈরি করবো। কালকেই রফিক ভাইয়ের সাথে কথা বলব এই ব্যাপারে। হাজার হলেও বউয়ের আবদার না রেখে পারি?
পরেরদিন অফিসে বসে কাজ করছি। তবে আজকে কাজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেছে। তখন রফিক ভাইকে কথাটা বলার জন্য ডাকলাম। রফিক ভাই আমার কেবিনে এসে বলল
রফিক ভাইঃ নীল ডেকেছিস?
আমিঃ ভাইয়া বসো। কিছু কথা বলার জন্য ডেকেছি।
রফিক ভাইঃ কি কথা?
আমিঃ আসলে ভাইয়া শিলা একটা জিনিস চেয়েছে সেটার ব্যাপারে কথা বলতে চাই।
রফিক ভাইঃ কি চেয়েছে?
আমিঃ আসলে ওর নাকি ইচ্ছা গ্রামের দিকে একটা বাড়ি করার। তাই আমি চাইছিলাম যে আশেপাশের কোনো গ্রামে একটা বাড়ি করবো।
রফিক ভাইঃ আচ্ছা তাহলে কালকে এই রকম একটা গ্রামের খোজ করে অফিস ২ দিন ছুটি দিয়ে বাড়ি করার জন্য ভালো লোকেশনের খোজ করব।
আমিঃ অনেক ভালো বুদ্ধি। আচ্ছা আজকে কি আর কাজ বাকি আছে?
রফিক ভাইঃ না প্রায় সবার কাজ শেষ।
আমিঃ তাহলে সবাইকে ছুটি দিয়ে দাও আজকে। আর পরের দুইদিন ছুটি থাকবে এটাও সবাইকে বলে দাও। তবে ১ দিনের কাজ দিয়ে দাও। বাসায় বসে ২ দিনে কাজ করবে। আজকে বাসায় গিয়ে একটু আরাম করে কালকে সুন্দর একটা গ্রামের খোজ করে বের হবো আমাদের কাজ করতে।
রফিক ভাইঃ আচ্ছা।
অফিস ছুটি দিয়ে দিলাম। আমি আর রফিক ভাই বাসায় চলে গেলাম৷ তবে বাড়ি পৌছে দেখি পার্কিং এর জায়গাতে একটা অচেনা গাড়ি। বাড়িতে কি কেউ এসেছে তাহলে?
ভিতরে ঢুকে তো আমি অবাক। কারণ ঢুকে দেখি আগের অফিসের বস বসে আছেন। আমি উনাকে দেখেই তাকে সালাম দিলাম৷
আমিঃ আসসালামু আলাইকুম স্যার৷
বসঃ ওয়ালাইকুম আসসালাম। আর স্যার বলছো কেনো? আমাকে আংকেল বলো
আমিঃ জ্বী আংকেল। কেমন আছেন আপনি?
আংকেলঃ আলহামদুলিল্লাহ৷ ভালোই আছি। তুমি কেমন আছো?
আমিঃ আলহামদুলিল্লাহ স্যার আমিও ভালো আছি৷ হঠাৎ চলে আসলেন আগে জানলে আজকে অফিস যেতাম না।
আংকেলঃ আসলে ঢাকায় এসেছি ২ দিন হলো। আমার মেয়েটাও ছিলোনা আর থাকতেও ভালো লাগছিলো না তাই ভাবলাম তোমাদের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে আসি।
আমিঃ যাক ভালোই করেছেন আপনাকে দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। তা আপুকেও নিয়ে আসতেন।
আংকেলঃ আসলে ওর শরীরটা ভালোনা তাই তাই ওকে নিয়ে আসিনি।
আমিঃ আচ্ছা আংকেল আমি ফ্রেশ হয়ে আসি তারপর সবাই মিলে গল্প করব।
আংকেলঃ আচ্ছা যাও
আমি রুমে গিয়ে জামা কাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসলাম৷ শিলা রান্নার কাজ করছে জিসান নীলকে নিয়ে খেলছে, জিসান ঘুমিয়ে আছে। আমি আংকেলের সাথে কথা বলার জন্য বসলাম।
আংকেলঃ তা তোমার অফিসে কাজ কেমন চলছে?
আমিঃ আলহামদুলিল্লাহ আংকেল। ভালোই চলছে আর এখন প্রফিট ভালো আসছে৷ সাথে বড় একটা কোম্পানির সাথে ২ টা ডিল সাইন করে এখন কাজ অনেক ভালো চলছে।
আংকেলঃ মাশাল্লাহ। আসলে তোমার কাজই এমন সবাই পচ্ছন্দ করে।
আমিঃ সব আল্লাহর ইচ্ছা।
আংকেলঃ ঢাকায় এসে চলে যেতাম তবে তোমার ছেলে মেয়েকে দেখার জন্য আরও দ্রুত চলে আসলাম৷
আমিঃ আপনি যখন খুশি আসবেন৷ শিলার জন্য আপনি যা করেছেন তার জন্য সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকবো।
আংকেলঃ এসব বলে ছোট করিওনা বাবা। আসলে ওকে নিজের মেয়ের মতোই দেখেছি।
আমিঃ আচ্ছা আংকেল কথাই কথাই তো আপনার নাতি নাতনি সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করা হলোনা৷
আংকেলঃ আমার তো নাতি হয়েছে। শিলাকে ফোন দিয়ে বলেছিলাম।
আমিঃ হয়তো ও আমাকে জানাতে ভুলে গেছে৷ ওনাদের নিয়ে আসলে অনেক বেশি খুশি হতাম। সবাই মিলে একটু আনন্দ করতাম।
আংকেলঃ আবার নিয়ে আসবো। আসা যাওয়া লেগেই থাকবে।
আমিঃ জ্বী আংকেল।
তারপর আরও কিছুক্ষন কথা বললাম। আংকেল আমার মেয়েকে নিয়ে কিছুক্ষন আদর করলো। রিফাতের জন্য অনেক গুলো চকলেট আর খেলনা নিয়ে এসেছেন। জিসানের জন্যও অনেক কিছু নিয়ে এসেছন। রাতে সবাই মিলে মজা করে খেলাম৷ আংকেলকে একটা রুমে থাকতে দিলাম৷
পরেরদিন আমরা অফিসের নাম করে আশেপাশে সুন্দর একটা গ্রামের খোজ করতে থাকলাম। রাজশাহী শহর থেকে কিছুটা দূরে একটা গ্রামের খোজ পেলাম। ৮০ কিলোমিটার দূরে যেতে ২ ঘন্টা মতো লাগে। গ্রামটা অনেক সুন্দর। গ্রামে গিয়ে একটা সুন্দর লোকেশন খুজতে লাগলাম৷ তবে বেশিক্ষন খুজতে হয়নি। শিলার স্বপ্নের মতোই একটা জায়গা পেলাম। আশে পাশে গাছপালা, বাড়িঘরও আছে। পাশে একটা পুকুর। ছোট একটা দালান বাড়ি করা। জমি বিক্রয় করা হবে দেখে সাথে সাথে জমির মালিকের সাথে যোগাযোগ করলাম৷ কিছু কথা বলে সেদিনের মতো চলে আসলাম৷ ওনার সাথে কথা হয়েছে যে কালকে এসে সব কাগজপাতি চেক করে কালকেই জায়গাটা কিনে নিবো।
আংকেল এখনও বাড়িতল আছেন। কালকে চলে যাবেন। আমি বাড়ি পৌছে সোজাসুজি রুমে গেলাম৷ গিয়ে দেখি রিফাত নীলাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। এটা দেখে অনেক বেশি ভালো লাগলো। ভাই বোনের ভালোবাসা দেখে বুকটা জুড়িয়ে গেলো। ফ্রেশ হয়ে রিফাতের পাশে বসালম
আমিঃ কি করছো তুমি বাবা?
রিফাতঃ ভাইকে ঘুম পাড়িয়ে এসে আপুকে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম৷ আচ্ছা বাবা আপু কখন কথা বলবে. আমাদের স্কুলের যাদের বোন আছে তারা তো কথা বলতে পারে, হাটতেও পারে। আমাকে কখন ভাইয়া বলে ডাকবে?
আমিঃ ডাকবে বাবা। এখন তো ও অনেক ছোট আরেকটু বড় হোক তখন তোমাকে ভাইয়া বলে ডাকবে।
রিফাতঃ আচ্ছা। আমি আপুকে আর ভাইকে একসাথে চকলেট খাইয়ে দিবো।
আমিঃ আচ্ছা তুমি খাইয়ে দিও। একটু বড় হোক তখন তুমিই খাইয়ে দিবে।
রিফাতঃ আচ্ছা বাবা।
কতটা নিঃস্বার্থ রিফাতের ভালোবাসা। একবার ভাইয়া ডাক শুনার জন্য কত আগ্রহ। রিফাত ওর ভাই বোনের জন্য পাগল। প্রতিদিন ভাইকে ঘুম পাড়িয়ে দিবে তারপর বোনকে ঘুম পাড়িয়ে দিবে৷
রাতে সবাই মিলে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম৷ পরেরদিন আংকেলকে বিদায় জানিয়ে আবার সেই গ্রামে গেলাম। গিয়ে তার সাথে জমির দাম নির্ধারণ করে কাগজ পত্র ভালো ভাবে দেখে নিলাম৷ কয়েকদিন সময় লাগবে নিজের নামে করে নিতে। উনাকে অর্ধেক টাকা দিয়ে এসেছি। এর মাঝে একজনকে জমির লোকেশন অনুযায়ী বাড়ির ডিজাইন করার দায়িত্ব দিলাম। বাড়ির যাবতীয় কাজ অতী শীঘ্রই শুরু করে দিবো যাতে ৬ মাসের মধ্যেই কমপ্লিট হয়ে যায়।
পরদিন থেকে অফিস শুরু হলো। আগের মতো কাজ করতে লাগলাম। এভাবে কাটলো ১ মাস। এর মাঝে সুন্দর একটা বাড়ির ডিজাইন সিলেক্ট করে তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করার কথা বললাম। শিলার জন্মদিন ৮ মাস পর আর সেইদিনই ওকে সারপ্রাইজ দিবো বাড়িটা।
ছেলে মেয়ে আর বউয়ের দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসা দিয়ে দিনগুলো এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন পরেই আবার রোজা শুরু হবে। রোজার কারণে অফিসের কাজের টাইম ২ ঘন্টা কমিয়ে দিলাম। রোজার মাত্র ২ দিন বাকি। রোজার প্রথম দুইদিন অফিস বন্ধ রাখার ঘোঘনা দিলাম।
আজ থেকে রোজা শুরু হবে৷ সেহেরির সময় শিলা আমাকে জাগিয়ে দিলো৷ সেহেরি করে আমি আর রিফাত ভাই দুইজন মিলে ফজরের নামায পড়তে গেলাম৷ নামায শেষে এসে দেখি শিলা কোরআন তেলাওয়াত করছে। ওর গলা তো এমনিতেই সুন্দর তারওপর কোরআন তিলাওয়াত শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমি গিয়ে ওর পাশে বসে তেলাওয়াত শুনছিলাম৷ তেলাওয়াত শেষে একটু ঘুমালাম।
এভাবে ২০ রমজান পার হলো। প্রতি ১০ রমজান পর মসজিদে ইফতারের ব্যবস্থা করেছি শেষের ২ দিনও মসজিদে ইফতারের ব্যবস্থা করবো।
২৪ রমজানে অফিস ছুটি দিলাম সাথে সবাইকে ঈদের শুভকামনা জানিয়ে বেতন সহ ভালো একটা বোনাস দিলাম।
কালকে ঈদ৷ রাতে শিলা আমাকে মেহেদি দিয়ে দিলো। সাথে ছেলে মেয়েকেও মেহেদি দিয়ে দিলো। রিফাত ওর ভাই বোনকে মেহেদি দিয়ে দিবে বলে জেদ করলেও শিলা দিতে দেয়নি।
সকালে আমি রফিক ভাই, রিফাত তিনজন মিলে নামায পড়তে ঈদগাহে গেলাম৷ বের হবার সময় সবাইকে সালাম দিয়ে বের হয়েছি।
এভাবেই দেখতে দেখতে ৬ মাস পার হলো এর মাঝে কোরবানির ঈদও অনেক ভালোভাবে পার করেছি। বাড়ির কাজও শেষ এখন রংয়ের কাজ চলছে। শিলার জন্য খুব দ্রুত বাড়িটা করলাম। এখন নীলা আর জিসান হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায় আর রিফাত আর খিল খিল করে হাসে।
কালকে শিলার জন্মদিন৷ রাতে বাড়ি এসে একটা প্ল্যান করালম৷ প্ল্যান অনুযায়ী পরেরদিন ওকে কৌশলে নতুন বাড়ি নিয়ে যাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।
পরেরদিন বিকালে বাড়ি আসার পর ফ্রেশ হয়ে ওকে দুটো কফি আনতে বললাম৷ কিছুক্ষন পর নিয়ে আসলো। ও কফি রাখলো আমি ওকে ভিতরে পাঠার জন্য বললাম চিনি কম হয়েছে৷ ও চিনি আনতে গেলে ওর কাপে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিলাম৷ কফি শেষ করার পর ও বলল ওর মাথা নাকি কেমন করছে৷ একটু পর ও ঘুমিয়ে গেলো। ওকে ধরে নিয়ে গাড়িতে বসালাম৷
৩ ঘন্টা পর ও চোখ খুললো। চোখ খুলার পর ও অচেনা জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করলো। আমি ওকে ছাদে নিয়ে গেলাম। তারপর ও বাড়ির চারপাশে হা করে তাকিয়ে আছে……………..
চলবে…………..