#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্ব: ৮
রুদালি ব্যাগ গোছাচ্ছে। আজ রাত এগারোটায় তাদের ট্রেন ছাড়বে। এত রাতে ট্রেন জার্নির বিষয়টা কোনোভাবেই সাহেলার পচ্ছন্দ হচ্ছে না। অবশ্য পচ্ছন্দ না হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে যে এলাকাগুলো পরে সেই এলাকাগুলো ভালো না। রাতের নীরবতাকে কাজে লাগিয়ে ট্রেনে চলে ডাকাতি। ছোট খাটো জিনিসপত্রের জন্য মানুষ মেরে পর্যন্ত ফেলে। কত অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ খুঁজে পাওয়া যায়। পরিবার থেকে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি ছাপানোর পূর্বেই হয়তো তাদের দাফনের কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। নতুন বৌকে নিয়ে ট্রেন ভ্রমণ শুধুমাত্র ঝুঁকিপূর্ণ নয়, যথেষ্ট ভয়ের। তারপরেও অর্ণব কি মনে করে ঝুঁকি কাঁধে নিয়ে ট্রেনের টিকিট কেটেছে তা সাহেলা বুঝতে পারছে না। তার সকল সন্দেহ ইংগিত করছে রুদালির দিকে। নিশ্চয়ই এই মেয়ে কোনো তালগোল পাঁকিয়েছে! ছেলের মাথায় ট্রেন জার্নির ভূত চাপিয়ে দিয়েছে। রমজান আলী কি ভাবছেন তাকে দেখে আঁচ করা যাচ্ছে না। তিনি আপাতত নিষ্ক্রয় পদার্থের মতো আচরণ করছেন। অর্ণবের কক্সবাজার যাওয়া নিয়ে তার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যাতায়াতের মাধ্যম নিয়ে তিনি কতটা খুশি বা অখুশি তা ঠাহর করা কঠিন।
রুদালি লাগেজের একপাশে তার কিছু শাড়ি গুছিয়ে রাখলো। আরেকপাশে রাখলো অর্ণবের টি-শার্ট আর প্যান্টস। দু একটি ফর্মাল শার্ট নিবে কিনা তা নিয়ে রুদালি বেশ দ্বিধায় পরে গেলো।লাগেজ এর চেন লাগানোর আগে কিছুক্ষণ সে চুপ করে ভাঁজ করে রাখা কাপড়গুলোর দিকে তাঁকিয়ে রইলো। কেমন অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে তার। এই অনুভূতি ব্যক্ত করার মতো নয়।
শেষ বিকেলে অর্ণবদের বাড়ির সামনে প্রাইভেট কার এসে থামলো। এখন তারা ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবে। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে উঠবে। অর্ণব রুদালিকে তাড়া দিতে লাগলো।
‘তোমার গোছানোর কাজ শেষ হয়েছে তো?’
‘হুঁ।’
‘তাহলে আর দেরী করো না। চলো বের হই।’
‘চলেন।’
‘এই তুমি কি আমাকে আপনি করেই বলবে নাকি?’
‘হুঁ।’
‘আমরা না বন্ধু? বন্ধুকে কেউ আপনি করে বলে নাকি?’
‘তুমি করেও তো বলে না। ‘তুই’ করে বলে। আপনাকে অবশ্যই আমি তুই করে বলতে পারবো না?’
অর্ণব গলা পরিষ্কার করে বললো,
‘আমার ব্যক্তিগত সমস্যা ছিলো না। কিন্তু মা বাবা শুনলে কি ভাববেন!’
‘সেজন্যই আপনি করে বলছি।’
‘আচ্ছা। আপনি- বলেই সম্বোধন করো। এখন চলো।’
অর্ণব লাগেজ হাতে নিয়ে বের হলো। রমজান আলী এবং সাহেলা ছেলে আর ছেলের বউকে বিদায় জানাতে নিচে নেমে এলো। গাড়িতে ওঠার আগে রুদালি উবু হয়ে শশুড় শাশুড়ির দোয়া নিলো। সাহেলা ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললো,
‘সাবধানে থাকিস। আর ট্রেনে উঠে আমাদেরকে জানিয়ে দিস। যেখানে বিমানে করে অল্প সময়েই সরাসরি কক্সবাজার যাওয়া যায় সেখানে কেনো ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেতে হবে আমার মাথায় ধরে না। রাস্তাঘাট ভালো না কিছু না। টেনশনে রাতে আমার ঘুমই আসবে না।’
রমজান আলী স্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
‘আহা করছো কি এসব? থামো না। যাওয়ার সময় যতসব অলক্ষুণে কথাবার্তা! বাবা, তুই যা। বৌমার খেয়াল রাখিস। সাথে নিজেও সতর্ক থাকিস। আল্লাহ ভরসা।’
অর্ণবও নিচু হয়ে মা বাবাকে পা ছুঁয়ে সালাম করলো। তারপর গাড়িতে উঠে বসলো। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিলো। অর্ণব জানালার গ্লাস নামিয়ে হাত নাড়াতে থাকলো।
দুই ঘন্টার মধ্যে গাড়ি টাংগাইল সদর ছাড়িয়ে ঢাকায় প্রবেশ করলো। চারিদিকে তখন গাঢ় অন্ধকার জেঁকে বসেছে। তবে শহুরে আলো এই অন্ধকারের পরোয়া করে না। দিনের চেয়ে রাতেই যেনো রাস্তায় শহুরে মানুষদের আনাগোনা অধিক। কমলাপুর পৌঁছানোর আগে গাড়ি থাময়ে রাতের খাবার খেয়ে নিলো তারা। ট্রেন আসার দুঘন্টা আগেই রেলস্টেশনে পৌঁছে গেলো। প্ল্যাটফর্মে প্রচুর ভীড়। কিছুদূরে ভার্সিটির একঝাঁক ছেলেমেয়ে হাসাহাসি করছে। এরা সবাই এক রঙের টি শার্ট পরেছে। মেয়েরাও সালোয়ার কামিজের ওপর টি শার্ট পরেছে। প্রত্যেকের টি-শার্ট এর পিছে লিখা ‘জবিয়ান’। ছেলেমেয়ে গুলো সম্ভবত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের। রুদালির হঠাৎ মনে হলো পড়াশোনার বিষয়ে এখনো তার অর্ণবকে কিছু বলা হয় নি। গতকাল রাতে বলতে চেয়েছিলো। কিন্তু বলা হয়ে ওঠে নি। অর্ণব টিকিট কাউন্টার থেকে ঘুরে রুদালির পাশে এসে বসলো। রুদালি একটু সময় নিয়ে নিজের ভেতোর কথাগুলো গোছালো। কিভাবে শুরু করবে। কথার অভিগমনের সাথেও মতের অথবা দ্বিমতের সম্পর্ক রয়েছে। অভিগমন ভালো হলে অনেক সময় মানুষ খুব সহজে রাজি হয়ে যায়। তেল মালিশের ঝামেলা থাকে না। তাছাড়া তেলিয়ে কথা বলার স্বভাবও রুদালির নেই। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্ণবের দিকে তাঁকালো। কিন্তু তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অর্ণব বলে বসলো,
‘রুদালি, চা খাবে? ওই দেখো রেল লাইনের ঠিক পাশে চা বিক্রি করছে। চলো চা খেয়ে আসি।’
রুদালি বিস্মিত চোখে অর্ণবের দিকে তাঁকিয়ে আছে। তার বিস্ময়ের কারণ চা খাওয়ার প্রস্তাবটি নয়। কারণ হলো, এই চিত্রটিও রুদালির কল্পনায় আঁকা ছিলো। ঠিক রেল লাইনের কিণারায় দাঁড়িয়ে একসাথে চা খাবে দুজন। সে এবং তার ভালোবাসার মানুষ। রুদালি একদৃষ্টিতে অর্ণবের দিকে তাঁকিয়ে আছে। অর্ণব দু তিনবার তার হাত রুদালির চোখের সামনে আনা নেওয়া করলো। রুদালি এক ভাবেই তাঁকিয়ে আছে। এবার অর্ণব তার চোখের সামনে তুড়ি বাজালো। রুদালি চমকে উঠলো।
‘কি ব্যাপার? কি ভাবছো?’
রুদালি অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
‘না কিছু না।’
‘চা খাবে?’
‘হুম খাবো। চলেন এগোই।’
অর্ণব খুব যত্ন করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। ‘সুউউউপ সুউউউপ’ জাতীয় শব্দ হচ্ছে। অন্য কেউ এভাবে শব্দ করে চা খেলে রুদালির মেজাজ চটে যেতো। কিন্তু অর্ণবের ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে না। সে খুব মনোযোগ দিয়ে শব্দটা শুনছে। এত কোলাহলের মাঝেও কত স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে!
ঘন্টাখানিকের মধ্যে ট্রেন এসে পৌঁছালো। রুদালি ভেবেছিলো অর্ণব মনে হয় ফার্স্ট ক্লাস কোনো বগি সংরক্ষণ করেছে। কিন্তু সে তা করে নি। তাদের সীট ট্রেনের একদম মাঝের বগিতে। এখানে দুটি করে সীট পাশাপাশি। সাত নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেন ছেড়ে দিলো। রুদালি জানালার কাছে বসেছে। তার জীবনের প্রথম ট্রেন জার্নি ঠিক তার কল্পনার মতো করেই শুরু হবে রুদালি কখনো ভাবে নি। অবশ্য সেই যাত্রাপথে তার সাথী অভ্র না হয়ে অন্য কেউ হবে তাও সে কখনো ভাবে নি! অর্ণব বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিলো। রুদালি জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাঁকিয়ে আছে। ট্রেনের ঝিকঝিক শব্দের মোহ বেশ ভালোভাবেই কাবু করেছে তাকে। ক্যান্টিনবয়রা কিছুক্ষণ পরপর খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে। কেউ চা কফি খাবে কিনা। অনেকে চা কফির পাশাপাশি বিভিন্ন ফাস্টফুড আইটেমের কথাও জিজ্ঞেস করছে। হকারদের ব্যবসাও বেশ জমে উঠেছে। অর্ণব মোবাইলের কাজ শেষ করে বড় করে শ্বাস ফেললো। তারপর রুদালির দিকে তাঁকিয়ে বললো,
‘কেমন লাগছে ট্রেন জার্নি করতে?’
রুদালি ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
‘ভালো।’
অর্ণব চারিদিকে তাঁকিয়ে বললো,
‘চিৎকার চেঁচামেচি বেশি তাই না?’
রুদালি বললো,
‘হুঁ।’
‘একবার ফার্স্ট ক্লাস বগি নিতে চেয়েছিলাম। পরে ভাবলাম থাক। আমি যদি বেশি আবেগী হয়ে যাই! তার চেয়ে বরং তুমি আমাকে ভালোবাসার পরেই আমরা ফার্স্ট ক্লাস বগি রিজার্ভ করে দূরে কোথাও ঘুরতে যাবো। সেদিন আবেগী হলেও ক্ষতি নেই। কি বলো?’
প্রশ্নটা করেই অর্ণব হেসে ফেললো। রুদালিও প্রত্যুত্তরে হাসলো। মনের গহীন থেকে উপলব্ধি করলো তার পাশে বসে থাকা এই ছেলেটা সত্যিই মন্দ নয়।
(চলবে..)
#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্বঃ ৯
ট্রেন চলছে তার আপন গতিতে। রুদালির মাঝে খানিকটা ঝিমুনি ভাব চলে এসেছে। অর্ণবও কোনো কথা বলছে না। ল্যাপটপ অন করে বসে আছে। সম্ভবত অফিসিয়াল কাজ করছে। রুদালির শরীর ধীরে ধীরে ছেড়ে দিচ্ছে। চোখের পাতাগুলো এক হয়ে মিলছে। এক পর্যায়ে সে সত্যিই ঘুমিয়ে গেলো। অর্ণব তখনও ল্যাপটপে মগ্ন। গভীর মনযোগ দিয়ে একটি মেইল লিখছে। হঠাত তার কাঁধে কারো মাথা এসে ঠেকলো। সে হকচকিয়ে পাশে তাকালো। রুদালি ঘুমাচ্ছে। চুল বাঁধা। তবুও চলন্ত ট্রেনের বাতাসে তার সামনের দিকের কয়েকটা চুল এলোমেলো ভবে উড়ছে। শ্যাম্পুর খুব ক্ষীণ ঘ্রাণ পাওয়া যাচ্ছে। সেই ঘ্রাণ নাকে এসে লাগতেই কেমন নেশাগ্রস্ত হয়ে গেলো অর্ণব। সে বুক ভরে শ্বাস নিলো। দীর্ঘায়িত শ্বাস। একবার নয়। দুবার নয়। বার বার। বারবার সে মাতালের মতো রুদালির চুলের ঘ্রাণে হারিয়ে যেতে লাগলো। কি আশ্চর্য! মেয়েটা কি শ্যাম্পুতে কোনো মাদকদ্রব্য মিশিয়ে রেখেছে? আফিম জাতীয়? নয়তো এমন আসক্তি ছুটে চলছে কেনো শরীরের প্রতিটি কোণে? অর্ণব ল্যাপটপ বন্ধ করে ব্যাগে রেখে দিলো। মেইল পরে পাঠালেও চলবে। কিন্তু এরকম আবেগপূর্ণ পরিবেশ একবার হারিয়ে গেলে ফিরে না আসার সম্ভাবনা প্রকট। তাই পরিপূর্ণতার সাথে উপভোগ করাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত।
ট্রেনে যাতায়াতের সময় দুইপাশে নানাধরনের প্রাকৃতিক দৃশ্য চোখে পরে। কিন্তু রাতের জার্নিতে সেসকল দৃশ্য ভুঁজার উপায় নেই। ট্রেন যখন মেঘনা রেইলওয়ে ব্রিজের ওপর দিয়ে চলতে শুরু করলো তখনই আকাশ ফুঁড়ে শুরু হলো বৃষ্টি। অর্ণব পরে গেলো মহা ঝামেলায়। রুদালি এখনো গভীর ঘুমে। ট্রেনের জানালা লাগিয়ে দিতে হবে। মেয়েটাকে ডাকতে ইচ্ছা করছে না। এদিকে চিন্তা করার সময়ও নেই। বৃষ্টির বেগ ট্রেনের গতির বেগকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। উপায় না দেখে অর্ণব খুব সাবধানে ট্রেনের জানালা লাগিয়ে দিতে হাত বাড়ালো। এতো সাবধানতা অবলম্বনেও বিশেষ কোনো লাভ হলো না। রুদালি ঠিকই জাগনা পেয়ে গেলো। অর্ণবও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে ঠিক সামনে নিলো। হেসে বললো,
‘বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিলো বুঝলে। তাই জানালা লাগিয়ে দিলাম’।
রুদালি উত্তর না দিয়ে একটু নড়েচড়ে বসলো। তার শাড়ির আচল ভিজে গেছে। ট্রেনের জানালায় টিপ টিপ শব্দে বৃষ্টি ফোটা আছড়ে পরছে। আচমকা রুদালি কাশতে শুরু করলো। অর্ণব ব্যস্ত হয়ে রুদালির দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিলো। সে ঢকঢক করে হাফ লিটার বোতলের অর্ধেক পানি শেষ করলো। বৃষ্টির পানি মাথায় লাগলেই রুদালির প্রচন্ড মাথা ব্যাথা হয়। এখনো হচ্ছে। সে করুন চোখে অর্ণবের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘আমি কি এক কাপ কফি পেতে পারি?’
অর্ণব অবাক হয়ে বললো,
‘কথাটা এতটা আনুষ্ঠানিকতা মিশিয়ে না বললেও চলতো’।
‘আমি আনুষ্ঠানিকতা মিশিয়ে কোথায় বললাম?’
‘এই যে বললে, আমি কি এক কাপ কফি পেতে পারি? এটাই আনুষ্ঠানিকতা। বন্ধুত্বের সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকতা কিন্তু মানানসই নয়’।
‘তাহলে আমার কিভাবে বলা উচিত ছিলো?’
‘অনেকটা এভাবে, আমি এক কাপ কফি খাবো। দ্রুত ব্যবস্থা করুন’।
‘ঠিকাছে। আমি এক কাপ কফি খাবো। একটু দ্রুত ব্যবস্থা করুন’।
অর্ণব হেসে ট্রেনের ক্যান্টিনে চলে গেলো। রুদালি মনে মনে হাসলো। ছেলেটা একটু পাগলাটে ধরনের। এরকম পাগলাটে ধরনের ছেলেরা বউকে প্রচন্ড ভালোবাসতে জানে। আচ্ছা, অর্ণব যদি রুদালির জীবনে দুটো বছর আগে আসতো তাহলে হয়তো রুদালির জীবনটা অন্যরকম হতো। অর্ণবই হতো তার প্রথম ভালোবাসার মানুষ। রুদালি সিদ্ধান্ত নিলো সে আর রাতে ঘুমাবে না। এরকম বৃষ্টিভেজা রাত জেগে কাটানোর মাঝে অন্যরকম আনন্দ আছে।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ট্রেনের দুই পাশে এখন শুধু সবুজ আর সবুজ। এদিকেও মনে হয় রাতে বৃষ্টি হয়েছে। গাছপালা সব ভিজে আছে। রোদের মৃদু আলোয় চিকচিক করছে গাছের পাতাগুলো। মাঝে মাঝে কিছু ফসলি জমিও চোখে পরছে। কোনো সন্দেহ নেই ট্রেন এখন সীতাকুন্ডের আশেপাশে। থেকে থেকে মাঝারি আকারের পাহাড়। ধোঁয়াশার মাঝে শির উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দুই পাহাড়ের মাঝের ভি শেপের জায়গা থেকে চলছে সূর্যের উঁকিঝুঁকি। আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। রুদালির ঠোঁট অল্প অল্প কাঁপছে। হিমশীতল বাতাসে সে যেনো জমে যাচ্ছে। ফুলতোলা চাদরটা বড় লাগেজের ভেতোর। বেশ কয়েকটি শাড়ির নিচে। এখন লাগেজ খুলে চাদর বের করা সম্ভব না। বিষয়টা অর্ণবের দৃষ্টিগোচর হলো। সে তার কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা শার্ট বের করলো। কিছুটা কুঁচকে আছে। তবে কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে। রুদালি কিছু বুঝে ওঠার আগেই পরম যত্নে শার্টটি তার গায়ে লেপ্টে দিলো অর্ণব। রুদালি বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকালো। অর্ণব ফিসফিস করে বললো,
‘এখন ঠান্ডা একটু কম লাগবে’।
কথাটা শুনে রুদালির চোখ ভিজে উঠলো। পুরোনো কোনো স্মৃতি তার গহীনে কড়া নাড়লো। বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের একটি উক্তি আছে। History repeats itself. ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। সত্যিই তাই। কোনো এক শীতের সকালে অভ্রও তার গায়ে একখানা পুরোনো ব্লেজার চাপিয়ে দিয়েছিলো। রুদালি চোখ দুটো বড় বড় করে জিজ্ঞেস করে,
‘ব্লেজার কোথায় পেলে?’
অভ্র সহজ কন্ঠে উত্তর দেয়,
‘কিনেছি।’
‘কোথা থেকে?’
‘কোনো শো রুম থেকে কিনেছি এমন ভাবার কারণ নাই। রাস্তার পাশে বড়লোকদের ব্যবহৃত ব্লেজার সস্তায় বিক্রি করছিলো।সেখান থেকে কিনে নিয়েছি।’
পুরোনো স্মৃতি গুলো কেনো যে বারবার ফিরে আসে!
রুদালি পাহাড় দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে বলে উঠলো,
‘জায়গাটা ভীষণ সুন্দর’
অর্ণব রুদালির উদাসীন চেহারার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘সামনে স্টেশন। তাহলে চলো এখানেই নেমে যাই?’
রুদালি হেসে বললো,
‘মন্দ হবে না বলেন? খানিকটা এডভেঞ্চারও হয়ে যাবে!’
‘বুঝে বলো। এখানে কিন্তু ফাইভ স্টার হোটেল নেই, ম্যাডাম’।
‘আমার কোনো সমস্যা নেই। বাকিটা আপনার ইচ্ছা’।
অর্ণব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো,
‘একটা শর্ত আছে’।
‘কি?’
‘মা বাবাকে কিন্তু বলতে পারবে না।’
‘কেনো? আপনি ভয় পান নাকি?’
অর্ণব অসহায় কন্ঠে বললো,
‘বাবাকে পাই না। বাবা আমার অনেক ভালো একজন বন্ধু। তবে মাকে ভীষণ ভয় পাই। ছোট বেলায় বেতের বাড়ি কম পরে নি তো। সেখান থেকেই ভয় ঢুকে গেছে’।
অর্ণবের কথা শুনে রুদালি মুখ চেপে হাসতে লাগলো। অর্ণব মুখ শক্ত করে বসে রইলো।
সীতাকুন্ড রেলস্টেশনে এসে ট্রেন থামতেই অর্ণব রুদালিকে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি ম্যাডাম? তৈরি তো? নাকি মত পাল্টিয়েছেন?’
রুদালি বসা থেকে দাঁড়িয়ে বললো,
‘মত পাল্টাই নি। আমি তৈরি’।
রুদালি আর অর্ণব ট্রেন থেকে নেমে গেলো। জায়গাটি রুদালির অপরিচিত। সীতাকুন্ডে অর্ণবও আগে আসে নি। নতুন একটি জায়গায় নববিবাহিত এক দম্পতীর এই এডভেঞ্চার উতকন্ঠিত বটে তবে কম হৃদয়গ্রাহী নয়!
(চলবে…)
লিখা: আতিয়া আদিবা