আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস পর্ব-৬+৭

0
1518

#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্বঃ ৬
নুরুল আলম দোতলার অফিস থেকে তিন তলায় এসেছেন। আলমারি থেকে প্রয়োজনীয় কিছু কাগজ পত্র বের করতে হবে। তাকে বেশ বিচলিত দেখাচ্ছে। প্রয়োজনীয় কাগজগুলো আলমারিতে আছে কিনা তা নিয়ে মনে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বিষয়টা এমন নয় যে তিনি এসব দরকারি কাগজ পত্রের বেলায় আগোছালো। মূল বিষয়টা হচ্ছে তিনি যথেষ্ট ভুলো মনের মানুষ। কোন কাগজ কোথায় রেখেছেন তা মনে করতে পারেন না। রায়ার ঘরের দরজা খুবই অল্প পরিসরে খোলা। তার ঘর পেরিয়ে বেডরুমে যেতে হয়। আলমারিও সেই ঘরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়ের ঘরের দরজা খোলা থাকলেও নুরুল আলম সরাসরি ভেতোরে তাঁকান না। মাথা নিচু করে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। দরজায় ঠক ঠক করে টোকা দেন। নরম গলায় বলেন,
‘রায়া মা কি ব্যস্ত? ভেতোরে আসবো?’
ভেতোর থেকে রায়ার মিষ্টি কন্ঠে সম্মতি ভেসে আসে। নুরুল আলমও ঘরে ঢোকেন। আজকেও তিনি তাই করলেন। এই ব্যস্ততার মধ্যেও তার মেয়ের সাথে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছে। তিনি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে টোকা দিয়ে বললেন,
‘রায়া মা কি ব্যস্ত নাকি? ভেতোরে আসবো?’
ভেতোর থেকে উত্তর এলো,
‘এসো বাবা।’
দরজা পুরোপুরি খুলতেই নুরুল আলমের বিস্ময় সীমা ছাড়িয়ে গেলো। রায়া শাড়ি পড়েছে। আয়নার সামনে বসে সাজুগুজু করছে। হঠাৎ এত আয়োজন করে সাজগোজের কারণ কি হতে পারে! আজ কি বিশেষ কোনো দিন? কিন্তু ক্যালেন্ডারে এমন কোনো চিহ্ন তো খুঁজে পান নি! অফিস ঘরের উত্তরের দেয়ালে একটি ক্যালেন্ডার ঝুলিয়ে রাখা আছে। গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর ওপর লাল রঙের দাগ রয়েছে। এরকম কোনো দাগ আজকে চোখে পরে নি।
আজ রায়ার জন্মদিনও নয়। দিনক্ষণ মনে না থাকলেও নুরুল আলমের এটা মনে আছে, রায়া জন্মেছিলো কনকনে ঠান্ডায়! এমন ভ্যাঁপসা গরমে নয়। এমন বিশ্রি গরমে গায়ে একটা সূতাও সহ্য হয় না সেখানে রায়ার শখ করে শাড়ি পরাটা নিঃসন্দেহে যুক্তিহীন। তাছাড়া রায়া একদমই গরম সহ্য করতে পারে না তাহলে এই কাঠফাটা রোদ্দুরে সে শাড়ি পরেছে কি উপলক্ষে? নুরুল আলম চোখ ছানাবড়া করে বললেন,
‘কি রে? এই গরমের মধ্যে শাড়ি পরেছিস কেনো?’
‘এমনি বাবা। ইচ্ছে হলো তাই পরলাম।’
‘এই অসময়ে তোর শাড়ি পরার অদ্ভুত ইচ্ছে কেনো হলো?’
‘অদ্ভুত ইচ্ছেগুলো অসময়েই হয়। সময় মেনে হলে তো আর তাকে অদ্ভুত বলতে পারবে না।’
‘তাও ঠিক।’
‘তুমি এই অসময়ে ওপর তলায় কি মনে করে?’
‘কেনো আমি এসময় ওপর তলায় আসতে পারবো না?’
‘পারবে না কখন বলেছি? অবশ্যই পারবে। কিন্তু তুমি প্রয়োজন ছাড়া কখনো তিন তলায় আসো না। সারাদিন দোতলায় কাটিয়ে দাও। সেজন্য জিজ্ঞেস করলাম।’
নুরুল আলম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
‘একটা দরকারি কাগজ খুঁজতে এসেছি। কিন্তু কই রেখেছি মনে করতে পারছি না।’
রায়া হাসলো। এ হাসিতে জয় মিশে আছে। হয়তো তার গগণা ঠিক ছিলো বলেই ঠোঁটের কোণে এই জয়মিশ্রিত হাসি।
‘তোমার প্রয়োজনীয় কাগজ অবশ্যই এঘরে নেই।’
নুরুল আলম অপ্রস্তুত হয়ে বললেন,
‘না তা নেই। আলমারি অথবা ওয়ারড্রবে আছে বোধ হয়!’
রায়া আবার হাসলো। মুখে হাসি নিয়েই পুনরায় সাজগোজে ব্যস্ত হয়ে গেলো। নুরুল আলম মেয়েকে বিদায় জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে শোবার ঘরে ঢুকলেন। আলমারির সবগুলো ড্রয়ার চেক করলেন। কিন্তু সেই কাগজ খুঁজে পেলেন না। এরপর তিনি ওয়ারড্রবে অভিযান চালালেন। দ্বিতীয় ড্রয়ারে কাগজটা পাওয়া গেলো। তার চোখেমুখে প্রশান্তি নেমে এলো। তিনি কাগজটা নিয়ে দুই তলায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সিড়ি দিয়ে নামার সময় হঠাৎ ঘূর্ণি হাওয়ার মতো একটি কথা তার মাথায় ঘুরতে লাগলো। একটু পরেই তার মেয়ের হোম টিউটর আসবে। রায়ার শাড়ি পরার সাথে হোম টিউটর আসার কোনো সম্পর্ক নেই তো?

রায়ার ঘরের পড়ার টেবিলের সামনে বিশালাকৃতির একটি দেয়াল ঘড়ি। রায়া আজ বারান্দায় না দাঁড়িয়ে দেয়াল ঘড়ির সামনে বসে আছে। আজও সে অন্যদিনের মতোই অভ্রর জন্য অপেক্ষা করছে। তার জন্যই শাড়ি পরেছে। এত সুন্দর করে সেজেছে। কলিং বেল বাজলো। রায়া এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে দৌঁড়ে দরজা খুলতে গেলো। রায়ার বিপরীতে অভ্র দাঁড়িয়ে আছে। চোখদুটো গণগণে লাল। হাতে সেই কাপড়ের ব্যাগ। রায়া কাপড়ের ব্যাগটার দিকে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে থেকে অভ্রকে সালাম দিলো। ভেতোরে আসতে বললো। কিন্তু অভ্র যেনো সেকথা শুনতেই পেলো না! সে সালামের উত্তরও দিলোনা। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
‘তোমার বাবা কোথায়?’
রায়া ঢোঁক গিললো। স্যার হঠাৎ বাবার কথা কেনো জিজ্ঞেস করছে? সে হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘দোতলায়। কেনো স্যার?’
‘কেনোর উত্তর আমি অবশ্যই তোমাকে দিবো না।যাকে দেওয়া প্রয়োজন তাকেই দিবো। তুমি এই ব্যাগটা নাও।’
অভ্রর এমন ব্যবহারে রায়া ভয় পেয়ে গেলো গতকালকের বিষয়টা নিয়ে কি স্যার রাগ করেছে? কিন্তু রাগ কেনো করবে? রায়া বুঝতে পেরেছিলো স্যার না খেয়ে আছে। তার কষ্ট লেগেছে। তাই তার ভাগের খাবারটুকু সে স্যারকে দিয়ে দিয়েছিলো। সত্যিটা বললে স্যার রাগ করতেন। কাজেই রায়া একটু মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। তাই বলে এখন বাবার কাছে বিচার দিতে হবে? রায়া ব্যাগ হাতে নিয়ে বললো,
‘স্যার ভেতোরে আসবেন না?’
‘না। আমি আর তোমাকে পড়াবো না।’
রায়ার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। সে কপাল কুঁচকে বললো,
‘কিন্তু কেনো? গতকাল তো আমার সবগুলো অংক ঠিক হয়েছিলো। আমি ঠিকমতো পড়াশোনা করছি তো!’
অভ্র রায়ার কথা পাত্তা না দিয়ে বললো,
‘তোমার বাবাকে বলে দিও আমাকে এমাসের অনারিয়াম অর্ধেক দিলেই চলবে।’
রায়া ছলছল চোখে বললো,
‘স্যার, আমার সামনে পরীক্ষা। আপনি আমাকে এখন পড়ানো বাদ দিয়ে দিলে আমি এবারো পরীক্ষায় পাশ করতে পারবো না।’
অভ্র নিচু স্বরে বললো,
‘তোমার বাবাকে কথাটা বলতে ভুলো না।’
‘স্যার..’
‘তোমার জন্য শুভ কামনা রইলো। আসছি।’
অভ্র আর এক মুহুর্তও দেরী করলো না। সেই স্থান ত্যাগ করলো। রায়া ঠোঁট বারবার উল্টে আসছে। চোখে দিয়ে অনবরত পানি পরছে। নির্ঘাত গতকালকের বিষয়টা নিয়ে স্যার রাগ করেছেন। নিজের ওপর নিজের রাগ উঠছে রায়ার। সে ধরাম করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে প্রথমে রান্নাঘরে গেলো। আজকেও সে অভ্রর জন্য খাবার আলাদা করে রেখেছিলো। কাঁদতে কাঁদতে বাটি থেকে সেগুলো প্লেটে বেড়ে ফেললো। তারপর নিজের ঘরে চলে গেলো। বালিশ মুখে চেপে হুঁ হুঁ করে কাঁদলে লাগলো। স্যার কি একটুও বোঝে না তার অনুভূতিগুলো? ইচ্ছে করে এমন করে? সত্যিই কারো ভালো চাইতে নেই। ফলাফল- হীতে বিপরীত হয়।

অভ্রর হাতে একটি টিউশনই ছিলো। সেটাও আজকে নিজে বাদ দিয়ে এলো। কোনো উপায় ছিলো না। রায়া যে তার ওপর যথেষ্ট দুর্বল সেটা অভ্র জানে। কিন্তু এই দুর্বলতা দিন দিন বৃদ্ধি পাক তা সে চায় না। সুন্দর জিনিসগুলো আপাদমস্তক থাকে মায়ায় পরিপূর্ণ। একবার মায়ার মোহে পরে গেলে সেখান থেকে বের হয়ে আসা কষ্টসাধ্য। কাজেই মায়ার মোহে পরার ইচ্ছে অভ্রর নেই। মধ্যবিত্তদের হারিয়ে যেতে হয় হাজারটা না এর ভীড়ে। একটি হ্যাঁ ছিনিয়ে আনতে করে যেতে হয় দীর্ঘ লড়াই। তারা চাইলেই প্রেমে পরতে পারে না। তারা চাইলেই একটি সুন্দর সংসারের স্বপ্ন দেখতে পারে না। মায়ার পিছুটান ভুলে নিষ্ঠুর বাস্তবতার বেড়াজাল টপকানোর প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে হয় তাদের। তারাই পরিবারের মূল হাতিয়ার। নিজেদের ইচ্ছেগুলো ভুলে মা বাবার ইচ্ছেগুলোকে প্রাধান্য দেওয়ার অপর নামই মধ্যবিত্ত। অভ্রর মাথায় চিন্তারা ঘুরপাক খাচ্ছে। আবার নতুন করে টিউশন খুঁজতে হবে। গ্রামে টাকা পাঠাতে হবে। নিজেরও তো একবেলা খেয়ে বাঁচতে হবে! গতকাল রায়ার দেওয়া খাবার সে খায় নি। ফেলেও দেয় নি। পার্কে ছোট্ট একটি বাচ্চা ভিক্ষা করে বেড়াচ্ছিলো। অভ্র বাচ্চাটিকে পাশে বসিয়ে তার মুখে নিজ হাতে ভাত তুলে খাওইয়ে দিয়েছে। তার নিজের পেটেও ক্ষুধার আক্রমন ছিলো ভয়ংকর। তবুও রায়ার দেওয়া খাবার সে মুখে নেয় নি। মধ্যবিত্তদের অহং এর পাল্লা বেশ ভারী হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, শুধুই কি অহং এর জন্য খাবারের সাথে অভ্রর বিরোধীতা? নাকি নতুন করে কারো প্রতি আবেগের আগমনের গন্ধ তাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে? হয়তো অভ্র তার জীবনে কোনো দ্বিতীয় রুদালি চায় না। নতুন করে কাউকে ভালোবাসতে চায় না। অভ্র মনে মনে রুদালির কথা ভাবছে। কাউকে খুব বেশি ভালোবাসলে তাদের মধ্যে অদৃশ্য এক যোগাযোগ ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়। ট্যালোপেথি টাইপ। সম্পর্ক থাকাকালীন এরকমটা কত হয়েছে! একদিন রাতে ঘুমের মধ্যে অভ্র স্পষ্ট শুনতে পেলো রুদালির কন্ঠস্বর। ফিসফিস করে তাকে বলছে,
‘এই তুমি কি ঘুমাচ্ছো? আমি বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে আছি। কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে! তুমিও আসো না! একসাথে জ্যোস্না পোহাই।’
অভ্র ধড়মড় করে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। তার মনে হলো রুদালি যেনো মাত্র তার কানের কাছে নিচু স্বরে কথাগুলো বলে গেছে। বারান্দায় গেলেই তাকে পাওয়া যাবে। এক মুহূর্ত দেরী না করে অভ্র হলের বারান্দায় চলে যায়। রুদালি নেই। কিন্তু সত্যিই আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ। জ্যোস্নার আলো ভেঙ্গে পড়ছে। প্রকৃতি যেনো সে আলোয় স্নান সেড়ে নিচ্ছে! অভ্র রুদালিকে ম্যাসেজ পাঠায়,
‘কি করছো?’
উত্তর আসে,
‘বারান্দায় বসে জ্যোস্না পোহাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম তুমি থাকলে মন্দ হতো না।’
অভ্র বিস্মিত হয়। কতটা আত্মীক সম্পর্ক গড়ে উঠলে একজনের মনের কথা অপরজনের কাছে কোনোরকম যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়াই পৌঁছায়? এখন অবশ্য শত চেষ্টা করেও রুদালির মনের কথা সে জানতে পারছে না। তাদের মাঝের সেই ট্যালোপেথি মনে হয় আর কাজ করে না। সেদিন সাহস করে রুদালির হাত ধরলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো? অভ্রর মাথাব্যথা শুরু হয়েছে। অতিরিক্ত চিন্তা মাথাব্যথার কারণ। শহরে আজ অভ্রর কোনো কাজ নেই। তাই সে হলের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলো। সাড়ে চার কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেঁটে এসেছে। সাড়ে চার কিলোমিটার হেঁটেই আবার ফিরবে। প্রতিদিন নয় কিলোমিটার পথ হাঁটা অবশ্যই স্বাস্থ্যকর নয়।

#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্বঃ ৭

অভ্রদের ভার্সিটিটা খুব সুন্দর। মূল গেট দিয়ে ভেতোরে ঢুকতেই বাম পাশে ছোট্ট একটি পুকুর। পায়ে হাটা রাস্তার দুইপাশে মাঝারি আকারের গাছ। পুকুর পারের রাস্তাটুকু পেরোতেই চোখে পড়বে ‘প্রত্যয় ৭১’ ভাস্কর্য। ভেতোরে আবার ছোট্ট একটি জমিদার বাড়িও আছে। অভ্র অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে। মোবাইলে ব্যালেন্স নেই। টাকার অভাবে রিচার্জ করার উপায়ও নেই। অথচ বাড়িতে ফোন করা প্রয়োজন। মা-বাবার খোঁজ নেয়া প্রয়োজন। নয়তো মা ঠিক বুঝে ফেলবেন অভ্রর হাত খালি। অন্যের চোখকে ধূলো দেয়া সহজ। কিন্তু মায়ের চোখকে ধূলো দেয়া যায় না। কিছুদূর হেঁটে যেতেই অভ্রর চতুর্থ বর্ষের মকবুল ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। মকবুল ভাই তাদের হলেই থাকে। অভ্রদের ঠিক দুই ঘর পরে। অভ্র তাকে সালাম দিলো,
‘আসসালামু আলাইকুম মকবুল ভাই।’
‘কে অভ্র নাকি?’
‘জ্বি ভাই।’
‘কই গেছিলি?’
‘একটু শহরে গেছিলাম ভাই।’
‘তোর চেহারা এমন শুকনা শুকনা লাগতেছে কেন? চোখমুখ দেখি একদম বইসা গেছে!’
অভ্র চুপ করে রইলো। এই মানুষটির চোখেও ধূলো দিয়ে লাভ নেই। মিথ্যা বললে ঠিক বুঝে ফেলবে। তাই চুপ করে থাকাটাই শ্রেয়। মকবুল কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
‘দুপুরে খাইছোস?’
অভ্র নিচু স্বরে বললো,
‘না ভাই। ক্ষুধা নাই।’
মকবুল উঁচু গলায় বললো,
‘কানটার নিচে থাপ্পড় লাগাইলে ঠিকই ক্ষুধা লাগবে। চল আমার রুমে চল।’
অভ্র বাঁধা দিয়ে বললো,
‘না ভাই। সত্যি আমার ক্ষুধা নাই।’
‘আরে তুই দেখি দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাইতেছিস! বড় ভাইয়ের মুখে মুখে তর্ক করস!’
‘সর‍্যি ভাই।’
‘হুঁ। হইছে। এখন আয় আমার সাথে।’
মকবুল বগলদাবা করে অভ্রকে নিয়ে হলে ফিরে এলো। ক্যান্টিন থেকে ভাত কিনে আনলো। অভ্রর পাতে ভাত বেড়ে দিয়ে খাটের নিচ থেকে ঝুড়ি বের করলো। ঝুড়িতে দুটো আম পাওয়া গেলো। একটি আমে পোকা। অপরটি ভালো। ভালো আমটিকে দুইখন্ড করা হলো। আমের আঁটি অভ্রর পাতে দেওয়া হলো। অভ্র সামান্য আপত্তি করলো। মকবুল শুনলো না। বোতলে একটুখানি দুধ ছিলো। সেই দুধটুকুও ভাগাভাগি করে নেওয়া হয়। তাদের দুপুরের খাবার আম দিয়ে দুধ ভাত। পাকা আমের সময় এই খাবার বড়লোকদের বাড়িতে ডিনার টেবিলে প্রায় প্রতিদিনই খুঁজে পাওয়া যায়। মকবুল বড়লোক না। তার বাবা গ্রামের সরকারি স্কুলের একজন সাধারণ কেরানি। তাই তার খাওয়ায় কোনো বাছবিচার নেই। বড়লোকদের মতো প্রতিদিন সে আম-দুধ খেতে পারে না। দুদিন আগে সে গ্রাম থেকে ঘুরে এসেছে। ফেরার দিন মকবুলের মা পরম যত্নের সহিত ব্যাগে তিনটে আম ভরে রেখেছিলো! এক বোতল গরুর খাঁটি দুধ ছেলের হাতে দিয়ে বলেছিলো, ‘বাজান আমে দুধে মিশাইয়া খাইয়ো?’
মকবুল অশ্রুসিক্ত চোখে মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছে,
‘খামুনি মা।’
মকবুল জানে মা নিজের ভাগের আমটুকুও চটের ব্যাগে রেখে দিয়েছে। মকবুলদের জীবনে মায়ের ভালোবাসার প্রকাশ এমন করেই হয়। খাবার সামনে পেয়ে অভ্র এক মুহূর্ত দেরী করে না। গোগ্রাসে গিলতে থাকে। ক্ষুধার কুটকুটানি থামতেই চাইছে না। এক গামলা ভাত খেলেও যেনো থামবে না! মকবুল খাওয়ার মাঝে শুধুমাত্র একবার অভ্রর দিকে তাঁকালো। বারবার তাঁকিয়ে ছেলেটাকে সে লজ্জায় ফেলতে চাচ্ছে না। পেটের ক্ষুধা মেটাক না সে প্রাণভরে!

আম দুধ খেয়ে মাতাল হয় এমন মানুষ দুনিয়াতে আছে? অবশ্য মকবুল তো মানুষই। ভিন্ন গ্রহের কোনো প্রাণী নয়। মাতাল হওয়ার জন্য তার কোনো নেশাদ্রব্যের প্রয়োজন পরে না। সে আম দুধ খেয়েই টাল হয়ে যায়। অদ্ভুতুড়ে আচরণ শুরু করে। অকারণে হাসে। হাসতেই থাকে। আবার হঠাৎ করেই খুব গম্ভীর হয়ে যায়। আশেপাশে কেউ থাকলে তার সাথে যুক্তিতর্কে মেতে ওঠে। রুমে কেউ না থাকলে অন্য রুম থেকে জুনিয়রদের ধরে নিয়ে আসে। সিনিয়র হিসেবে উপদেশ দেয়। সব উপদেশ তিনি দেন তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে। তার এই উপদেশপর্বে বেশিরভাগ ছেলেদেরই কোনো আগ্রহ থাকে না। তবুও বড় ভাই বলে মুখ শক্ত করে তার সামনে বসে থাকতে হয়। আজকে মকবুলের রুমে অভ্র আছে। কাজেই উপদেশ দেয়ার জন্য অন্য রুম থেকে কাউকে তুলে আনার দরকার নেই।
‘বুঝলি অভ্র? এ দুনিয়ায় মানুষের সুসম্পর্ক টিকা থাকে টাকায়। তোর টাকা নাই, মানে তোর সম্মানও নাই। একসময় দেখবি তুই নিজেও নাই! হা হা হা…’
হাসি থামিয়ে আবার মকবুল বলা শুরু করলো,
‘আমার চাচা। দুবাই থাকে। আমার বাপ নিজে টাকা পয়সা ধার দেনা কইরা তারে বিদেশ পাঠাইলো। সেইখানে গিয়া চাচা ধীরে ধীরে ব্যবসা শুরু করলো। লাভও করলো। এখন আমার বাপেরে সে চিনেই না। এর থিকা কি বুঝলি? যারে সাহায্য করবি সে তোরে আজ বাদে কাল ঠিকই ভুইলা যাবো। হা হা হা।’
অভ্র চুপ করে মকবুলের কথা শুনছে। তার সবগুলো কথাই সত্যি। শুধু সত্যি নয়। নিখুঁত সত্যি। মানুষ মাতাল অবস্থায় যুক্তিহীন কথা বলে। কিন্তু মকবুল ভাই মানুষটা আলাদা।

.
রুদালি রান্নাঘরে তার শাশুড়ির হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিচ্ছিলো। সাহেলার অবশ্য নতুন বউয়ের রান্নাঘরে আসাটা পচ্ছন্দ হচ্ছে না। রান্নাঘরের কাজ তিনি আর কমলা মিলেই গুছিয়ে ফেলেন। তার মনে হচ্ছে এই মেয়েটা খুব দ্রুত এই সংসারের ওপর খবরদারি শুরু করে দিবে। হয়তো বলবে_ আজ এই পদটা রান্না না করে ওই পদটা রাঁধলে ভালো হবে। জানালার পর্দাগুলো এই রঙের না হয়ে অন্য রঙের হলে ভালো হবে। অথবা ড্রইং রুমের সোফার জায়গা পরিবর্তন করতে বলবে। আসবাবপত্র এদিক সেদিক করবে। মোটকথা তার গোছানো ঘর বাড়ির ওপর হস্তক্ষেপ করবে।
এজাতীয় চিন্তাগুলো সাহেলা ইচ্ছা করে করছে না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার মাথায় ঘুরঘুর করছে। তিনি সবজি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করলেন,
‘বাড়িতে রান্নাবান্না করতে?’
রুদালি নিচুস্বরে বললো,
‘করেছি। কিন্তু খুব কম। সারাদিন তো ভার্সিটিতেই থাকা হতো।’
সাহেলা খুব বিশ্রিভাবে ‘ওঁ’ বললেন সাথে তাচ্ছিল্যভরা কন্ঠে হাসলেন।
‘মেয়েদের পড়াশোনা করে আসলে লাভ নেই। শেষ মুহুর্তে এসে এই হেঁসেল ঠেলতে হয়। জজ ব্যারিস্টার আর হওয়া হয় না।’
রুদালি তার শাশুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে মরিচ বেছে রাখছিলো। তার মুখে এমন কথা শুনে সে কিছুটা থমকে গেলো। গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ হতে রুদালির এখনো দুবছর বাকি। বিয়ের সময় সে একটি মাত্র শর্তই ছুঁড়ে দিয়েছিলো। তার পড়াশোনায় কোনো ব্যাঘাত ঘটানো চলবে না। রুদালির বাবা তাকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, পড়াশোনার ক্ষেত্রে ছেলেপক্ষের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এখন তার শাশুড়ির কথার হাবভাব যথেষ্ট সন্দেহজনক। এবিষয়ে অর্ণবের সাথে কথা বলতে হবে। কিন্তু সেতো এখন বাইরে। ফিরবে রাতে। দিনের বাকি সময়টুকু রুদালির যথেষ্ট উদ্বিগ্নচিত্ত হয়ে কাটলো।

রাতে অর্ণব বাড়ি ফিরলো দুটো ট্রেনের টিকিট হাতে। রুদালির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
‘তুমি তো আর জানালে না কই যাবে। তাই নিজের থেকেই ঠিক করে ফেললাম। দেখো আমাদের ভ্রমনস্থান কোথায়।’
‘চট্টগ্রাম! আমরা চট্টগ্রাম যাচ্ছি?’
‘প্রথমে চট্টগ্রাম তারপর কক্সবাজার। কি ভালো হবে না?’
রুদালি বেশ অবাক হলো। সে কখনো ট্রেন জার্নি করে নি। প্রয়োজনে বাসে চড়ে যাতায়াত করেছে। তার খুব ইচ্ছে ছিলো বিয়ের পর ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে সে দীর্ঘ ট্রেন ভ্রমণে বের হবে। তাদের গন্তব্যস্থান হবে কক্সবাজার। যেহেতু ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের সরাসরি ট্রেন নেই। তাই তারা আগে চট্টগ্রাম যাবে সেখান থেকে বাসে করে কক্সবাজার। অর্ণব চাইলেই বিমানের দুটো টিকিট কেটে ফেলতে পারতো। কিন্তু সে তা না করে ট্রেনের টিকেট কেটেছে। আশ্চর্যজনক বিষয়! ঘটনাটি পুরোপুরি কাকতালীয় হিসেবে বিশ্বাস করতেও রুদালির কষ্ট হচ্ছে।

(চলবে…)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে