#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্বঃ ৪
নুরুল আলম তার শাড়ির দোকানে বসে আছেন। এই শহরে তার তিনটে শাড়ির দোকান আছে। প্রতিটি দোকানের নামকরণ করা হয়েছে তার মেয়ের নামে। রায়া ফ্যাশন-১, রায়া ফ্যাশন-২, রায়া ফ্যাশন-৩। আবার কালি বাড়ি রোডের পাশে সেদিন নতুন একটি মার্কেট উদ্ভোধন করা হয়েছে। মালিক নুরুল আলম। এই মার্কেটের নামও রায়া মার্কেট। অজ্ঞাত কারণে তিনি কাজের ক্ষেত্রে মেয়ের নাম ব্যবহার করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। সচরাচর তার দোকানে বসা হয় না। প্রতিদিন দুইবার করে এসে ঘুরে যান। বেচাকেনার খবরাখবর নেন। প্রয়োজনে কর্মচারীদের ওপর চেঁচামেচি করেন। বাকিসময় বাসাতেই থাকেন। দোতলার অফিস রুমে বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেন। ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে কথা বলেন। মাঝে মাঝে গভীর রাত পর্যন্ত তাশ খেলা চলে। পাশাপাশি মদ্যপানও চলে। আজ দোকানের একজন কর্মচারী আসে নি।আরেকজনকে পাথরাইল পাঠানো হয়েছে। নতুন শাড়ি কিনে আনতে। পাথরাইল থেকে কম দামে শাড়ি কিনে শহরে দ্বিগুণ দামে বিক্রি করা যায়। এতে লাভ হয় বেশি। তাই নুরুল আলম আজ দোকান খুলেছেন। রাজকীয় ভঙ্গিতে ডিভানের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছেন। এমন সময় পাশের দোকানের শফিউল আসলো।
‘বেঁচা কেনা কেমন চলে আলম ভাই?’
‘দোকান খুললামই একটু আগে। এখনো কোনো কাস্টমার আসে নাই। বাইরে দাঁড়িয়ে আছো ক্যান? ভেতোরে আসো।’
শফিউল ভেতোরে ঢুকলো। ছোট গদিযুক্ত চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
‘দোকান ফাঁকা কেনো? বাকি লোকজন কই?’
‘সালাম রে পাথরাইল পাঠাইছি। কালাম আজকে আসে নাই। মা অসুস্থ্য। বাড়িতে গেছে।’
‘পাথরাইল পাঠাইছেন? শাড়ির অর্ডার আছে নাকি?’
‘হ। ওই যে মুন্সি ভাই আছে না? উনার মেয়ের বিয়া। হলুদের জন্য একরকম পঁচিশটা শাড়ি অর্ডার দিছে। পাথরাইল থেকে করাইয়া আনতাছি।’
‘আকুর টাকুর পাড়ার মুন্সি ভাই?’
‘হ।’
‘ভালো করেই চিনছি তারে। এই বিয়ার পেছোনের ঘটনা কি জানেন?’
নুরুল আলম দাঁত খোঁচানো বাদ দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘কিসের ঘটনা?’
শফিউল বললো,
‘মেয়েরে তো সে এখনি বিয়ে দিতো না। বাধ্য হয়ে দিতেছে। বাসা থেকে এক ছেলের সাথে বের হয়ে যেতে নিছিলো। ধরা খাওয়ার পর এই বিয়ের আয়োজন।’
‘হায় হায়! বলো কি? কোন ছেলের সাথে?’
‘হোম টিউটরের সাথে। অল্প বয়সী ছেলে ঠিক করছিলো মেয়েরে পড়ানোর জন্য। একদম জায়গা মতো হাত দিছে।’
‘সর্বনাশ! ছেলে কি পড়তেছে?’
‘সাদাত কলেজ থেকে অনার্স পাশ করছে। এখন মনে হয় চাকরি খুঁজতেছে।’
‘এত বড় ঘরের মেয়েকে এই ছেলের সাথে বিয়ে দিতাছে? তাও এত ধুমধাম কইরা?’
‘কি আর করার আছে বলেন ভাই? আমরা বাপরা তো নিজেগো মেয়েদের কাছে অসহায়! পালায়ে গেলে সম্মান নিয়া টানাটানি। বোঝেন নাই?’
নুরুল আলম ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,
‘তা ঠিক।’
‘রায়া মামণি কেমন আছে?’
‘ভালো আছে।’
‘পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন? এবার পাশ না করলে কিন্তু কোনো গতি নাই!’
নুরুল আলম অপ্রস্তুত হয়ে বললো,
‘ভালো একজন শিক্ষক রেখে দিছি। বাকিটা আল্লাহ ভরসা।’
‘ভালো করছেন। তা শিক্ষক কি জোয়ান নাকি বয়স্ক? বয়স্ক হইলে সমস্যা নাই। জোয়ান হইলে সমস্যা। বিরাট সমস্যা!’
নুরুল আলম ইতস্ততভাবে বললেন,
‘বয়স তো অল্পই। ভাসানীতে পড়ে। থার্ড ইয়ারে।’
শফিউল কপাল ভাঁজ করে বললো,
‘তাহলে তো চিন্তার বিষয়। চোখ কান খোলা রাইখেন।’
নুরুল আলম কোনো উত্তর দিলেন না। শফিউল হাই তুলে বললো,
‘আমি যাই আলম ভাই। দোকানে কিছুক্ষণ সময় দিয়া বাসায় যাবো গা।’
‘আরেকটু বসো। চা খেয়ে যাও।’
‘না, ভাই। এখন আর চা খাবো না। অন্যদিন খাবো নি। আপনারে তো দোকানে পাওয়াই যায় না। মাঝে মাঝে এমনেই আইসা বসে থাইকেন ‘
‘আচ্ছা।’
শফিউল চলে গেলো। নুরুল আলম চিন্তিত মুখে আবার দাঁত খোঁচানো শুরু করলেন। মেয়ের হোম টিউটরকে নিয়ে তার চিন্তা হচ্ছে। এত অল্প বয়স্ক ছেলে ঠিক করা মনে হয় উচিত হয়নি।
রায়া তিন তলার বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অভ্র আসার সময় হয়ে গেছে। এই ছেলেটা প্রতিদিন কাটায় কাটায় দেড়টার সময় রায়াদের বাসায় আসে। এক মিনিট এদিক সেদিক হয় না। একটা মানুষ কিভাবে একদম ঠিক সময়মতো কারো বাসায় পৌঁছাতে পারে রায়া ভেবে পায় না। সে অনেকদিন খেয়াল করেছে, দেড়টা বাজার দুই মিনিট আগে তাদের বাড়ির সামনে রিক্সা এসে থামে। অভ্র কখনোই নিচে থাকা অবস্থায় উপরে তাঁকায় না। ভাড়া মিটিয়ে মাথা নিচু করে শান্ত ভঙ্গিতে সরাসরি গেট দিয়ে ঢোকে। কিন্তু আজকে দেড়টা বাজার দুই মিনিট আগে কোনো রিক্সা রায়াদের বাসার গেটের সামনে থামলো না। এমনকি ঘড়ির কাটা দেড়টা পেরিয়ে গেলো, কিন্তু অভ্র নিখোঁজ। রায়া কপালে ভাঁজ ফেলে দাঁড়িয়ে আছে। হাজারটা প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে কি আজকে স্যার আসবেন না? যদি নাই বা আসেন তার কারণ কি? স্যার তো খুবই স্ট্রিক্ট একজন মানুষ। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলেন। কোনো কারণ ছাড়া পড়ানো বাদ দিবেন না। গতকাল যে বললেন, তিনি আর পড়াবেন না – কথাটি কি সত্যিই বলেছিলেন? রায়া এক প্রকার ভয় পেতে শুরু করলো। যদি প্রকৃতপক্ষেই আর পড়াতে না আসেন? রায়ার প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজেকে সামলানোর। ঘড়ির কাটা আরো পনেরো দাগ এগিয়ে গেছে। রায়ার চোখ ছলছল করছে। সে আশা ছেড়ে দিলো। বারান্দা থেকে ঘরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু যেতে পারলো না। হঠাৎ দমকা হাওয়ায় সেই চিরচেনা সস্তা পারফিউমের গন্ধ তার নাকে আছড়ে পড়লো। সে থমকে দাঁড়ালো। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে পুনরায় গ্রিলের কাছে গিয়ে দেখলো অভ্র আসছে। তবে রিক্সায় করে নয়। পায়ে হেঁটে।
অভ্র শুকনো মুখে বসে আছে। রায়া খসখস করে বিরামহীন অংক কষে যাচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে অভ্রর দিকে তাঁকাচ্ছে। স্যারের সাথে খেঁজুরে আলাপ করতে ইচ্ছা করছে তার। যদি বকা দেয়? দেখে তো মনে হচ্ছে স্যারের মন আজ ভালো নেই। কিছুক্ষণ উশখুশ করে সে বললো,
‘স্যার আপনি আজকে পায়ে হেঁটে কেনো এসেছেন?’
‘হাঁটলে শরীর ভালো থাকে। কাজেই আমি মাঝে মধ্যে পায়ে হেঁটে আসার চেষ্টা করি।’
রায়া জানে স্যার মিথ্যা কথা বলছে। তার ইচ্ছে করছে স্যারকে থামিয়ে দিয়ে বলতে, আপনি মিথ্যা বলছেন। আমি প্রতিদিন এই ভর দুপুরে আপনার জন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি। আপনি রিক্সায় করে আসেন। পায়ে হেঁটে আসেন না। এর সাক্ষীও আছে। কে জানেন? ওই কারেন্টর তারের ওপর বসে থাকা কাকটা। কাকটাও প্রতিদিন একই সময় আমার মতো কারো জন্য প্রতীক্ষায় ব্যস্ত থাকে। কিন্তু রায়া এসব তার স্যারকে বলবে না। সে ক্ষণিককাল চুপ থেকে আবার জিজ্ঞেস করলো,
‘স্যার?’
‘বলো।’
‘আপনার কি মন খারাপ?’
‘না।’
‘আপনাকে চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আপনার মন খারাপ।’
অভ্র জবাব দিলো না। মুখ বন্ধ করে রইলো। রায়া উত্তরের জন্য বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। কিন্তু লাভ হলো না। সে পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
‘স্যার?’
‘বলো।’
‘আপনি কি সকাল থেকে না খেয়ে আছেন?’
‘না।’
‘আপনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে আপনি সকাল থেকে না খাওয়া।’
অভ্র কঠিন গলায় বললো,
‘আমার চেহারা নিয়ে গবেষণা না করে যদি তুমি অংকগুলো ঠিকভাবে করো অনেক বেশি খুশি হবো।’
রায়া নিচু গলায় বললো,
‘সর্যি স্যার।’
অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে বাইরে তাঁকালো। সত্যিই সে সকাল থেকে না খেয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই দুশ টাকা গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছে। হাতে এখন মাত্র পঞ্চাশ টাকা আছে। টানা দেড় ঘন্টা হেঁটে রায়াকে পড়াতে এসেছে।সন্ধ্যায় হলে ফিরে হালকা কিছু খেয়ে নিবে। একবেলা খেয়েও দশদিন কাটবে কিনা এই নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। রায়া অংক শেষ করে অভ্রকে খাতা দেখালো। অভ্র গম্ভীর মুখে বললো,
‘আজ তো দেখি সবগুলো অংক হয়েছে! ভেরি গুড। কিছু হোমওয়ার্ক লিখে দিচ্ছি। এগুলো করে ফেলবে।’
রায়া হেসে বললো,
‘আচ্ছা’
অভ্র হোমওয়ার্ক লিখে দিয়ে বললো,
‘আমি তাহলে উঠি আজকে।’
‘একটু বসেন স্যার। দরকার আছে।’
‘কি দরকার?’
‘একটু অপেক্ষা করুন। বলছি।’
রায়া অভ্রকে বসিয়ে রেখে রান্নাঘরে গেলো। একটি স্টিলের বাটিতে একজনের সমপরিমাণ ভাত এবং তরকারি বাড়লো। তারপর কাপড়ের ছোট্ট ব্যাগে ভরে রুমে ফিরে এলো। অভ্রর দিকে ব্যাগটি এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘বাবা, আপনাকে এটা দিতে বলেছে।’
অভ্র অবাক হয়ে বললো,
‘এটা কি?’
‘জানি না। আমাকে বলে নি। শুধু বলেছে আপনাকে দিতে।’
‘ঠিকাছে। আমি আসছি।’
অভ্র চলে গেলো। রায়া দরজা লাগিয়ে দিতেই তার গাল গড়িয়ে কয়েক ফোটা পানি পড়লো।
অভ্র পার্কের কোণায় বড় গাছটার নিচে বসে আছে। রায়ার দিয়ে দেওয়া ব্যাগটি সে এখনো খুলে দেখে নি। এখন দেখতে ইচ্ছে করছে। সে ব্যাগ খুলে একটি স্টিলের বাটি আবিষ্কার করলো। খুলে দেখলো বাটিতে ভাত আর আলু দিয়ে রান্না করা মাছের ঝোল। অভ্র হতভম্ব হয়ে বসে আছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে তার। আচমকা দিব্যদৃষ্টিতে সে যেনো দেখতে পেলো, রায়া চোখে জল নিয়ে তার দিকে তাঁকিয়ে হাসছে। কি মায়াবী লাগছে তাকে দেখতে!
(চলবে…)
লিখাঃ আতিয়া আদিবা
#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্বঃ পাঁচ
রমজান খানের বাড়িতে গত এক সপ্তাহ ধরে আত্মীয়দের সমাগম ছিলো। থাকবে নাই বা কেনো? বিয়ে বাড়ি কখনো জনমানবশূন্য হয় না। আজ অবশ্য পুরো বাড়ি খালি। এর পেছোনেও কারণ আছে। বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর বাড়ি জনমানবপূর্ণ থাকে না। নতুন বউকে অপরিচিত মানুষগুলোর সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। নয়া পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হয়। তার বড় ছেলের বউ রুদালিকে এখন সেই সময় দেওয়া হচ্ছে।
রমজান সাহেব বারান্দায় বসে পেপার পড়ছেন। চশমা ছাড়া পেপার পড়তে তার সমস্যা হয়। এখনো হচ্ছে। অক্ষরগুলো স্পষ্ট নয়। আংশিক ঝাপসা। চোখে প্রেসার পরছে। ভুলবশত চশমা সাথে করে নিয়ে বারান্দায় আসা হয় নি। সম্ভবত বিছানার ওপর ফেলে এসেছেন। এখন চেয়ার ছেড়ে উঠে চশমা নিয়ে আসতে ইচ্ছা করছে না আবার এ অবস্থায় পেপার পড়েও শান্তি পাচ্ছেন না। রমজান সাহেবের এই টানাপোড়নের সময় হাতে চায়ের কাপ নিয়ে প্রবেশ করলো রুদালি।
‘বাবা, আপনার চা।’
রমজান সাহেব হাসিমুখে পেপার ভাঁজ করতে করতে বললেন,
‘এই দেখো! মা তুমি কষ্ট করে আবার চা আনতে গেলে কেনো? কমলাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই হতো।’
রুদালি ইজি চেয়ারের পাশে রাখা ছোট্ট টেবিলে চা রাখলো। মাথার ঘোমটা ঠিক করে বললো,
‘কমলাই নিয়ে আসছিলো। ভাবলাম আমি দিয়ে যাই।’
‘বেশ করেছো। এসো আমার পাশে এসে বসো। ওই যে ওদিকে ছোট্ট টুল আছে। ওটা নিয়ে এসে বসো।’
রুদালি রমজান সাহেবের পাশে গিয়ে বসলো। পরম মমতায় তার মাথায় হাত রাখলেন রমজান। নরম গলায় বললেন,
‘মা, তোমার এ বাড়িতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?’
‘না বাবা।’
‘বাড়ির জন্য বেশি মন খারাপ লাগছে?’
রুদালি চুপ করে রইলো। রমজান সাহেব বললেন,
‘এটাই প্রকৃতির নিয়ম বুঝলে মা? মেয়েদের জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিবর্তন হলো বিয়ে। এসময় নিজ পরিবারকে ফেলে নতুন পরিবারের অংশ হতে হয়। সংসারের দায়িত্ব তাদের নিজ কাঁধে তুলে নিতে হয়। সযত্নে নতুন পরিবারের মানুষগুলোর খেয়াল রাখতে হয়। এতদিন তুমি শুধুমাত্র কারো মেয়ে ছিলে। এখন তুমি একই সাথে কারো বউ আবার এই সংসারের কর্তীও বটে। অনেক দায়িত্ব তোমার। পুরুষ মানুষ হলো সংসারের পণ্যাগার। তোমার প্রয়োজনের যোগান দিবে। কিন্তু সেই পণ্যগুলো দিয়ে কারূকর্ম করবে তোমরা মেয়েরা।’
রুদালি নিচু স্বরে বললো,
‘আমার জন্য দোয়া করবেন বাবা। আমি যেনো সব দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারি।’
‘অবশ্যই পারবে। তোমার ওপর আমার আস্থা আছে। অর্ণব কি এখনো ঘুমাচ্ছে?’
রুদালি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
‘ও ঘুম থেকে উঠলে আমার সাথে একটু দেখা করতে বলবে। কেমন?’
‘জ্বি বাবা। আমি বলবো।’
‘ঠিকাছে মা। তুমি তাহলে যাও।’
রুদালি উঠে চলে যেতে নিলো। এমন সময় রমজান সাহেব তাকে পুনরায় ডাক দিলেন।
বিচলিত কন্ঠে বললেন,
‘বিছানার ওপর চমশাটা মনে হয় ফেলে এসেছি। বয়স হয়ে গেছে তো চশমা ছাড়া পেপার পড়তে সমস্যা হয়! তুমি কি একটু কষ্ট করে চশমাটা দিয়ে যাবে মা?’
‘এখুনি দিয়ে যাচ্ছি।’
রুদালি রমজান সাহেবকে চশমা দিয়ে শোবার ঘরে চলে এলো। অর্ণব এখনো ঘুমাচ্ছে। রুদালির তাকে ডাকতে ইচ্ছে করছে না। অর্ণবের সাথে সে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। চায়ের কাপটা বিছানার পাশে রেখে জানালার পর্দা সরিয়ে দিলো রুদালি। ফিনকি দিয়ে ঝলমলে রৌদ্র ছড়িয়ে পরলো ঘরের প্রতিটি কোণায়। জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দক্ষিণের আকাশ দেখতে লাগলো সে। বেখেয়ালি মনে কত ভিত্তিহীন প্রশ্নেরা ভীড় জমায়! ঠিক যেমন এখন তার মনে জমাচ্ছে।
অভ্র কেমন আছে? কি করছে? রুদালির কথা ওর মনে পড়ছে কিনা? – এজাতীয় প্রশ্নগুলো এখন ভিত্তিহীন। রুদালির জীবনে এখন অভ্র নামটি জুড়ে থাকা উচিত নয়। সে এখন তার জীবনে মৃত ফুলের মতো। শত পানির ছিটে দিয়েও আগের মতো সতেজ করা যাবে না। ধীরে ধীরে পঁচে যাবে। একসময় দুর্গন্ধ বেরুবে। বাস্তবতা মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় ডুবে থাকতে হবে রুদালিকে। এই প্রচেষ্টার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল দুরূহ। তবুও প্রচেষ্টায় ত্রুটি রাখা যাবে না। রুদালির অন্যমনস্ক ভাব কেটে গেলো কারো ভরাট কন্ঠ শুনে।
‘গুড মর্নিং, রুদালি।’
রুদালি পেছোন ফিরে তাঁকালো। অর্ণব জাগনা পেয়ে গেছে। মাথার চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। চেহারায় প্রফুল্ল ভাব।
‘সেইম টু ইউ।’
‘তোমার নাম নিয়ে চমৎকার দুই লাইন কবিতা মাথায় এসেছে। শুনবে?’
রুদালির কবিতা শোনার প্রতি এক ফোটা আগ্রহও নেই। তার পরেও শোনাতে যখন চাচ্ছে ভদ্রতাসূচক শোনা যেতে পারে। সে বললো,
‘শুনবো।’
‘মেয়েটির নাম রুদালি।
ডিম খায় হালি হালি।
কবিতাটা মজার না? হা হা হা।’
রুদালি মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো। রাগে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। এরকমও কবিতা হয়? অর্ণব এখনো হেসেই চলেছে। রুদালি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
‘বাবা আপনাকে তার সাথে দেখা করতে বলেছে।’
‘কোন বাবা?’
‘কোন বাবা মানে? আপনার বাবা!’
অর্ণব অসহায় কন্ঠে বললো,
‘না মানে এতদিন বাবা ছিলো একটা। এখন বাবা হলো দুইটা। তাই কনফিউজড হয়ে গেছিলাম। শশুড়দের বাবা কেনো বলা হয় কোনো আইডিয়া আছে তোমার?’
‘না।’
‘আমারো নেই। তবে শশুড়দের বাবা বলা উচিত নয়। বলতো কেনো?’
‘আমি জানি না। আপনি বলুন।’
‘শশুড়কে বাবা বললে তার মেয়ে সম্পর্কে আমার বোন হয়ে যাবে না? হা হা হা।’
রুদালি নিজের রাগ দমিয়ে রেখে ঠান্ডা গলায় বললো,
‘আপনার চা ঠান্ডা হয়ে যাবে।’
‘সমস্যা নেই। চায়ের মজা দুই ধরনের চেম্পারেচারে পাওয়া যায়। জানো কি কি?’
‘না।’
‘একটা হলো গরমে। ধোঁয়া ওঠা গরমে। আরেকটা হলো ঠান্ডায়। বরফ জমা ঠান্ডায়। মাঝামাঝি অবস্থায় থাকলেই সমস্যা। মাঝামাঝি অবস্থা কোনটা বুঝেছো তো? নাতিশীতোষ্ণ যেটাকে বলা হয়।’
‘আপনার চা এখন নাতিশীতোষ্ণ অবস্থায় আছে।’
অর্ণব চিন্তিত মুখে বললো,
‘তাহলে কি করা যায়?’
‘ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে আসবো?’
‘নিয়ে আসো। সকাল সকাল ঠান্ডা চা খাই। আরাম লাগবে।’
রুদালি দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বের হলো। এই ছেলে কি পাগল? কি সব আজগুবি কথা বলছে তখন থেকে? শেষ মেষ কিনা বাবা তাকে এরকম একজন পাগলের হাতে তুলে দিয়েছে! রুদালির কান্না পাচ্ছে। নিজেকে কোনোভাবে সামলিয়ে সে বরফ আনতে গেলো।
রমজান সাহেব এখনো বারান্দায় বসে আছেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তার বেশিরভাগ সময় কাটে বারান্দার ইজি চেয়ারটায় শুয়ে অথবা বসে। সকালের শুরুটা হয় পেপার পড়ে। পেপার পড়ার পর এক ঘন্টা বিরতি। এই সময়টা তিনি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকেন। গুন গুন করে গানের সুর তুলেন অথবা কাজী নজরুল ইসলামের কোনো কবিতা আবৃত্তি করার চেষ্টা করেন। আজকে তিনি কোনো গানও গাইছেন না, কবিতাও অবৃত্তি করছেন না। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। অর্ণবের ডাকে তিনি চোখ মেলে তাঁকালেন,
‘বাবা আমাকে ডেকেছো?’
‘হুঁ। দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? পাশে এসে বোস।’
অর্ণব বাবার পায়ের কাছে মেঝেতে বসতে বসতে বললো,
‘কি হয়েছে? হঠাৎ এত জরুরী তলব?’
‘বলছিলাম যে তোর নতুন বিয়ে হলো, বউ কে নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরে আসলে ভালো হতো না?’
অর্ণব নিচু স্বরে বললো,
‘বাবা, ও নতুন আমাদের বাসায় এসেছে। আমার সাথেও খুব অল্প সময়ের পরিচয়। এর মধ্যে দূরে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়াটা কি উচিত হবে।’
‘আরে বেটা, সেজন্যই তো বলছি দুজনে আলাদা কিছু সময় কাটিয়ে আয়। মেয়েটাকে দেখে আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে খুব কষ্টে আছে! স্বামী স্ত্রী একে অপরের আয়নার মতো। এই সম্পর্কের মাঝে কোনো গোপনীয়তা থাকবে না। তোর উচিত মেয়েটার সাথে একটু ফ্রি হওয়া। তার জন্য একান্ত সময় প্রয়োজন। বৌমাকে নিয়ে দূরে কোথাও ঘুরে আয়।’
‘ঠিকাছে। আমি রুদালিকে বলে দেখছি।’
‘কোথায় যাবি আমাকে জানাস।’
অর্ণব হাসি চাপিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
‘কেনো? তুমিও মাকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমা পালন করতে যাবে নাকি?’
রমজান খান খপ করে ছেলের কান ধরে ফেললেন।
‘কি বললি? দিন দিন বেশি পাকনা হয়ে যাচ্ছিস। তাই না?’
‘উফ। বাবা! সর্যি সর্যি। খুব লাগছে! কানটা ছাড়ো। আর বলবো না। ভুল হয়ে গেছে।’
রমজান সাহেব ছেলের কান ছেড়ে দিলেন। অর্ণব কান ডলতে ডলতে বললো,
‘আর একটু জোরে ধরলে নির্ঘাত কান ছিঁড়ে যেতো।’
রমজান সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন।
রুদালি বিছানায় অর্ধেক গা এলিয়ে দিয়ে একদৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাঁকিয়ে ছিলো। অর্ণব ঘরে ঢোকায় সোজা হয়ে বসলো। অর্ণব একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বললো,
‘বাবা বলছিলো দূরে কোথাও গিয়ে ঘুরে আসতে। তোমার কি পচ্ছন্দের কোনো জায়গা আছে?’
রুদালি কপালে ভাঁজ ফেলে বললো,
‘দূরে কোথায় যাবো?’
‘শহরের বাইরে। এই ধরো চট্টগ্রাম, সিলেট, কক্সবাজার যেখানে তোমার ইচ্ছা।’
‘কেনো?’
‘কেনো আবার! বিয়ের পর স্বামী স্ত্রী কেনো ঘুরতে যায় জানো না? মধুচন্দ্রিমা পালন করতে।’
রুদালি একথা শুনে কিছুটা হাত পা গুটিয়ে বসলো। অর্ণব বিষয়টা বুঝতে পেরে বললো,
‘রুদালি। তুমি যেমনটা ভাবছো আসলে তেমনটা না। আমার যদি ওসবের প্রতি আগ্রহ থাকতো তাহলে আমি এই দুইদিনে অন্তত তোমাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করতাম।’
রুদালির চোখ এবার ভিজে উঠলো।
‘দেখো আমি বুঝি। সবকিছুতেই একটু সময় দিতে হয়। তাছাড়া আমরা দুজন দুজনকে এখনো ভালোমতো চিনি না। যেহেতু সারাজীবন একসাথে থাকায় আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সেহেতু দুজনকে চেনাটাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তুমি আমাকে বন্ধু হিসেবে দেখতে পারো। আর একজন বন্ধুর সাথে দূরে ঘুরতে যাওয়া অন্যায় নয়।’
রুদালি এবারো কিছু বললো না। মানুষটা আসলেই তাকে এই দুইদিন স্পর্শ করে নি। শুরু থেকেই সে তার সাথে খোলামেলা ভাবে কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু এভাবে কয়দিন? একদিন না একদিন তো স্বামীর অধিকার ঠিক চেয়ে বসবে। সেদিন কি রুদালি পারবে তাকে আটকাতে? একজনকে ভালোবেসে আরেকজনের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করতে? অর্ণব কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
‘আমি তোমাকে জোর করছি না। তোমার সিদ্ধান্তকে আমি যথেষ্ট সম্মান করি। তুমি যা বলবে তাই হবে। তুমি সময় নিয়ে ভাবো কেমন? আমি আসছি।’
অর্ণব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। রুদালি পুনরায় খাটে হেলান দিয়ে জানালার বাইরে তাঁকালো। তার সমুদ্র পচ্ছন্দ। অভ্রর সাথে কত প্ল্যান করেছে! বিয়ের পর সমুদ্রের পাড়ে বসে তারা মেতে উঠবে জ্যোস্নাবিলাসে। চাঁদের আলোয় সমুদ্রের কালো জল চিকচিক করবে। একটু পর পর ঢেউ এসে ছুঁয়ে যাবে তাদের পা। সেই ঠান্ডা পানির সংস্পর্শে কেঁপে উঠবে দুটো শরীর। অভ্র আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে রুদালিকে।উষ্ণতায় বন্ধ হয়ে আসবে তার চোখ। তারা হারিয়ে যাবে অন্য এক জগৎে।
চলবে
লিখা: আতিয়া আদিবা