আষাঢ়ের তৃতীয় দিবস পর্ব-২+৩

0
1916

#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্বঃ দুই

রায়ার বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় নেমে কিছুদূর এগোতেই অভ্রের ফোন বেজে উঠলো। স্মার্টফোনের যুগে তার হাতে নকিয়া এগারোশো। এই ফোনটি সে ব্যবহার করছে ভার্সিটিতে ওঠার পর থেকে। বার কয়েকশো হাত ফসকে বাটন ফোনটি পরেও গিয়েছে। কিন্তু ফোনের গায়ে সূক্ষ্ম আঁচড় ছাড়া কিচ্ছু লাগে নি। অভ্র মনে করে, এই ফোনের প্রাণ কৈ মাছের প্রাণের মতো। আরো কয়েকশো বার হাত ফসকে পড়বে, কিন্তু মৃত্যুবরণ করবে না। ব্যাটারি ঢিলে হয়ে ফোন অফ হয়ে যাবে। কিন্তু ডান দিকের বাটন চাপলেই সেই চিরচেনা ‘টিং টিটি টিং’ শব্দে দুটো হাত হ্যান্ডশেক এর জন্য এগিয়ে আসবে। ফোন বেজেই চলেছে। অভ্র ফোন রিসিভ করলো। তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অপর পাশ থেকে মেয়েটা ফুঁপিয়ে বলে উঠলো,
‘আমাকে ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছে।’
অভ্র শান্ত গলায় বললো,
‘সেতো দুই দিন পর পরই আসে। কাঁদার কি আছে?’
‘তারা আজই আমার বিয়ে পড়িয়ে ফেলতে চাইছে।’
‘মানে?’
‘এত কিছু খুলে বলার মতো পরিস্থিতিতে নেই আমি অভ্র। প্লিজ তুমি কিছু একটা করো।’
‘আমি কি করবো?’
‘তুমি এখন কোথায় আছো?’
‘পোস্ট অফিসের সামনে।’
‘তুমি ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। এক পাও নড়বে না। আমি এখুনি আসছি।’
লাইন কেটে গেলো। টুট টুট শব্দ হচ্ছে। অভ্র ফোন কানে ধরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। যে মেয়েটার সাথে তার মাত্র ফোনে কথা হলো তার নাম রুদালি। মেয়েটাও অভ্রের সাথে একই ভার্সিটিতে পড়ে। তবে এক ব্যাচ জুনিয়র। গত দুবছরে তাদের প্রেমের সম্পর্ক বেশ পোক্ত হয়ে গেছে। সবকিছু ভালোই চলছিলো। কিন্তু কয়েকমাস ধরে মেয়ের বাবা রহমান সাহেব রুদালির বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন। একেকদিন একেক ছেলের ছবি নিয়ে মেয়ের সামনে হাজির হন। মাসে অন্ততপক্ষে দুবার ছেলের বাড়ির লোকজন আসে রুদালিকে দেখতে। কিন্তু প্রতিবারই রুদালি বিয়ে ভেস্তে দিয়েছে। এই কাজটি সে করেছে খুবই ঠান্ডা মাথায়। একবার পাত্রের সাথে রুদালিকে আলাদাভাবে কথা বলতে পাঠানো হলো। একথায় সেকথায় রুদালি জিজ্ঞেস করলো,
‘আপনি সিগারেট খান?’
ছেলে উত্তর দিলো,
‘না। আমি কোনোপ্রকার নেশা করি না। যারা নেশা করে তাদেরও ঘৃণা করি।’
রুদালি তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বললো,
‘যারা সিগারেট খায় না তাদের আমার পুরুষ মানুষ বলেই মনে হয় না! তাছাড়া জামাই সিগারেট না খেলে আমি সিগারেট খাবো কার সাথে?’
‘বলেন কি? আপনি সিগারেট খান?’
‘জ্বি খাই তো! ফুড়ফুড় করে ধোঁয়া ছাড়ি। আপনি দেখবেন? দেখতে চাইলে দেখাবো। তবে একটা শর্ত আছে। একথা কিন্তু বাবাকে বলা যাবে না। আপনার আর আমার মধ্যে গোপন রাখতে হবে। ভেরি সিক্রেট।’
পাত্র পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছে বললো,
‘না মানে কিভাবে দেখাবেন? আপনার কাছে এখনো সিগারেট আছে নাকি?’
রুদালি এদিক সেদিক তাঁকিয়ে পাত্রকে ইশারায় কাছে ডাকলো। নিচু গলায় বললো,
‘আছে। ব্যাগে। ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরা আমার জন্য আলাদা ভাবে সিগারেট কিনে আনে। ক্যাম্পাসে তো খাওয়া যায় না। মেয়ে মানুষ বলে কথা। বাসায় লুকিয়ে খাই।’
পাত্র হতভম্ব হয়ে রুদালির দিকে তাঁকিয়ে রইলো। পরের দিন পাত্রপক্ষ রহমান সাহেবকে ফোন করে সোজাসুজি জানিয়ে দিলেন, এই বিয়েতে তারা আগ্রহী না।
আরেকবার পাত্রকে রুদালি ভয়ংকর একটি প্রশ্ন করে বসলো।
‘আপনি ব্লু ফিল্ম দেখেন?’
প্রশ্ন শুনে পাত্র বিষম খেলো। এ কেমন মেয়েরে বাবা? লাজ লজ্জা নেই নাকি? মেয়ে মানুষ কখনো এজাতীয় প্রশ্ন করে? বহু কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে সে বললো,
‘জ্বি না। এসব পঁচা জিনিস আমি দেখি না। চোখের জ্যোতি নষ্ট হয়।’
‘ইসসি রে! মিস করে ফেলেছেন। বিরাট মিস। জীবনের অর্ধেক স্বার্থকতা আপনার এ জায়গাতেই শেষ।’
পাত্র চোখ বড়বড় করে বললো,
‘আপনি দেখেছেন?’
‘স্কুলে থাকতেই দেখেছি। আমার এক বান্ধুবীর এন্ড্রোয়েড ছিলো। ওর বাবা অনেক বড়লোক তো! দেশের বাইরে থেকে এন্ড্রোয়েড আনিয়েছিলো। এখন তো আমার নিজেরই এন্ড্রোয়েড আছে। বান্ধুবীর প্রয়োজন পরে না।’
কনে দেখার বাকি সময়টুকু পাত্র মুখে কুলুপ এঁটে বসে ছিলো। পরেরদিন অজ্ঞাত কারনে পাত্রপক্ষ বিয়ে ভেঙ্গে দেয়। রুদালি জানতো এভাবে সে বেশিদিন নিজের বিয়ে আটকিয়ে রাখতে পারবে না। তার বাবা হয়তো কিছুটা হলেও আঁচ করতে পেরেছেন। তাই পাত্রের সাথে এবার তাকে আলাদাভাবে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয় নি। সরাসরি বিয়ে পড়িয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

অভ্র এখনো পোস্ট অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাতঘড়ির দিকে তাঁকিয়ে দেখলো তিনটা বাজে। কিছুক্ষণ আগেও রোদে সবকিছু ঝলসে যাচ্ছিলো। হঠাৎ করেই আবহাওয়া বদলে গেছে। কোথা থেকে যেনো কালো মেঘগুলো এসে জড়ো হয়েছে অভ্রের মাথার ওপর। কিছু সময়ের ব্যবধানে নিশ্চিত বৃষ্টি নামবে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অভ্রের পা ব্যাথা করছে। রাস্তার এখানে সেখানে কিছুক্ষণ আগেও মানুষজনের জটলা ছিলো। বৃষ্টির আগমনী বার্তা পেয়ে তারা চলে গেছে। পুরো রাস্তা ফাঁকা। অভ্রর গান শুনতে ইচ্ছা করছে। দুঃখের বিষয় হলো তার ফোনে গান বাজানো যায় না। যদি বাজানো যেতো তাহলে সে কোন গানটা শুনতো? এমন পরিবেশে রবীন্দ্রসংগীতের চেয়ে সুমধুর গান আর কিই বা হতে পারে? অভ্র এই গানটা শুনতো_
“মেঘের পরে মেঘ জমেছে, আঁধার করে আসে।
আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে।
কাজের দিনে নানা কাজে থাকি নানা লোকের মাঝে,
আজ আমি যে বসে আছি তোমারি আশ্বাসে
তুমি যদি না দেখা দাও, কর আমায় হেলা,
কেমন করে কাটে আমার এমন বাদল-বেলা।
দূরের পানে মেলে আঁখি কেবল আমি চেয়ে থাকি,
পরান আমার কেঁদে বেড়ায় দুরন্ত বাতাসে।”

বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। অভ্র আগের অবস্থায় দাঁড়িয়েই বৃষ্টিতে ভিজছে। পীচ ঢালা রাস্তায় বৃষ্টিফোটার আঘাতে অন্যরকম টিপ টিপ শব্দ হচ্ছে। অভ্র মনযোগ দিয়ে সেই শব্দ শুনছে। ফাঁকা রাস্তার মাঝ দিয়ে ধেয়ে একটি রিক্সা আসছে। অভ্র মাথা উঁচু করে তাঁকালো। রিক্সা থেমেছে। ভাড়া মিটিয়ে রুদালি এদিকেই আসছে। অভ্র মুদ্ধ হয়ে তাঁকিয়ে দেখছে। রুদালির পড়নে দামী কাতান শাড়ি। কপালে টিপ। চোখের কাজল বৃষ্টির পানিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে। ঠোঁটে রঙিন লিপস্টিক। রুদালি কাছে এসে অভ্রকে জড়িয়ে ধরলো। প্রচন্ড বাতাস। বৃষ্টির পানিও ঠান্ডা। দুজনই শীতে কাঁপছে। রুদালি কাঁপতে কাঁপতে বললো,
‘আমি বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি।’
‘কি বলছো এসব?’
রুদালি অভ্রকে জড়িয়ে ধরে রেখেই বললো,
‘আমি বাড়ি থাকলে আজকেই ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিবে। অন্য কোনো উপায় ছিলো না। তাই আমি তোমার কাছে চলে এসেছি।’
অভ্র রুদালির কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। সরু চোখে তার দিকে তাঁকিয়ে বললো,
‘কাজটা তুমি ঠিক করো নি।’
রুদালি অবাক হয়ে বললো,
‘বিয়ে করে ফেললে ঠিক করতাম?’
অভ্র চুপ করে রইলো।
‘এরকম সংকটপূর্ণ অবস্থায় মুখে টেপ লাগিয়ে রাখবে না। কথা বলো।’
অভ্র দেখলো রুদালির কন্ঠ ভারী শোনালেও তার চোখে পানি। বৃষ্টির পানির মধ্যেও রুদালির চোখের পানি আলাদা করতে পারে সে।
‘রুদালি। আমি বেকার। হলে থাকি। টিউশনি করে যা পাই তাতে নিজেরই চলে না। তারপরেও কিছু টাকা গ্রামে পাঠাতে হয়। তোমাকে আমি কই নিয়ে রাখবো? কি খাওয়াবো?’
‘আমি আপাতত কোনো বান্ধুবীর বাসায় গিয়ে উঠবো। তুমি তোমার কোনো বন্ধু বা বড়ভাইকে বলে সাবলেটের ব্যবস্থা করো। আমার কাছে কিছু টাকা আছে। তা দিয়ে মাস দুয়েক কাটিয়ে দেওয়া যাবে। আমিও টিউশন খুঁজবো। দেখবে দুজনের টাকায় আমাদের সংসার বেশ চলবে।’
অভ্র মাথা নাড়লো।
‘এভাবে হয় না। এভাবে একটা অনিশ্চিত জীবনের দিকে আমি তোমাকে ঠেলে দিতে পারি না।’
‘চাইলে সব হয়। কিন্তু তুমি হওয়াতে চাচ্ছো না।’
‘তুমি ফিরে যাও রুদালি।’
রুদালি গলার স্বর যতটুকু সম্ভব উঁচিয়ে বললো,
‘তুমি কি ভাবছো আমি মজা করছি? বাসায় ফিরে গেলে আজকেই আমার বিয়ে হয়ে যাবে অভ্র!’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে অভ্র বললো, ‘হোক।’
রুদালি যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না। সে বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো,
‘কি বলছো এসব?’
অভ্র লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বললো,
‘নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করছি। তোমাকে আমার কাছে রাখার মতো যোগ্যতা এখনো হয় নি রুদালি। এ অবস্থায় তোমাকে বিয়ে করে নিজের কাছে রাখা সম্ভব নয়।’
‘কিন্তু…’
‘বাস্তবতা কোনো ভালোবাসার উপন্যাস নয় রুদালি যে তোমার হাত ধরে আমি অনিশ্চিত পথের পথিক হবো। তুমি ফিরে যাও। বিয়ে করে ফেলো। সুখী হবে।’
‘এতদিনের সম্পর্ক, ভালোবাসার মুহুর্ত, প্রতিজ্ঞা সব কি মিথ্যে ছিলো অভ্র?’
‘না। সব সত্যি ছিলো। শুধু ভালোবাসার বয়সটাই ছিলো মিথ্যে।’
রুদালি শেষ বারের মতো জিজ্ঞেস করলো,
‘আমাকে তুমি আটকাবে না তাই না?’
‘না।’
‘এই সম্পর্ক থেকে মুক্ত করে দিবে?’
‘দিয়েছি।’
বৃষ্টি এখনো থামে নি। রুদালি আর অভ্র দুজনেই ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। রুদালি এগিয়ে এসে অভ্রের কপালে ছোট্ট করে চুমু এঁকে দিলো। গাল ধরে হাসলো। তারপর অভ্রকে ফেলে তার বিপরীতে কদম ফেলতে শুরু করলো। তার মন বলছে, অভ্র এখুনি তাকে ডাক দিবে। দৌঁড়ে এসে তাকে আটকাবে। জড়িয়ে ধরে বলবে,
‘আমাদের ভালোবাসাটা নাহয় কোনো উপন্যাসের কাহিনীই হোক। চলো দুজন অনিশ্চিত পথের পথিক হই।’
মানুষের মন যা বলে তা সবসময় হয় না। অভ্র রুদালিকে আটকায় নি। তাকে যেতে দিয়েছে নিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।

লিখাঃ আতিয়া আদিবা

#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্বঃ ৩
আকাশ এখন পরিষ্কার। বৃষ্টি থেমেছে তাও ঘন্টাখানিক হলো। অভ্র ভেজা কাপড় গায়ে দিয়েই এলোমেলো ঘুরে বেরাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে সে জেলা রোডে গেলো। বড় বড় হেলিপ্যাড গুলোর পাশে নানারকম স্ট্রিটফুডের আস্তানা। অভ্র এক প্লেট চটপটি অর্ডার করলো। বিকালে এই দিকটায় কপোত কপোতীদের মেলা বসে। হাতের মুঠোয় হাত পুরে তারা জোড়ায় জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়। অভ্র আর রুদালির অনেক স্মৃতি মিশে আছে এই জায়গায়। ক্যাম্পাসে তারা খুব একটা দেখা করতো না। প্রয়োজনে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে কথা বলতো। কিন্তু এই দূরত্ব রুদালির পচ্ছন্দ হতো না। সুযোগ পেলেই তারা জেলা রোডে চলে আসতো। হেলিপ্যাডের এর কোণায় দূর্বাঘাসের ওপর হাত ধরে বসে থাকতো। রুদালি তার মাথা এলিয়ে দিতো অভ্রের কাঁধে। সেখানে বসে তারা আংশিক সূর্যাস্ত উপভোগ করতো। জব্বার মামা তার ছোট নাতনিকে দিয়ে এক প্লেট চটপটি আর এক প্লেট ফুসকা পাঠিয়ে দিতো। বেশিরভাগ সময়ই অভ্র ভুল করে মরিচে কামড় দিয়ে ফেলতো। ছেলের কান লাল হয়ে যেতো। নাক টানতে শুরু করতো। রুদালি পরম যত্নে তার ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে রুমাল বের করে অভ্রর দিকে এগিয়ে দিতো। পলিথিনে মোড়ানো ছোট্ট ঠান্ডা পানির বোতল পাশে রেখে দিতো। মাঝে মধ্যে তার প্লেটের এক দুইটি ফুসকাও অভ্রকে খাইয়ে দিতো। অবশ্য এর পরিবর্তে তাকেও এক দুই চামচ চটপটি খাইয়ে দিতে হতো! এই ছোট ছোট বিষয়গুলোর মধ্যে তারা অফুরন্ত ভালোবাসা খুঁজে পেতো।নিজেদেরকে পৃথিবীর সবচে সুখী মানুষ বলে মনে করতো। মধ্যবিত্তদের প্রেমগুলো হয় পবিত্র। স্বার্থহীন। এদের প্রেমের শুরুটা কোনো দামী চাইনিজ রেস্টুরেন্টে হয় না। শুরুটা হয় কোনো পার্কের কোণায় বসে পাঁচ টাকার বাদাম ছিলিয়ে খেতে খেতে। বিল দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রেমিকদের পিছে ফেলে প্রেমিকারাই বেশি এগিয়ে থাকে। দুজনের মাঝে বোঝাপড়া থাকে। দুজনের প্রতি সম্মান এবং শ্রদ্ধা থাকে। সত্যিকারের ভালোবাসার উদাহরণ হিসেবে এদের ভালোবাসাই হয় শ্রেষ্ঠ। এদের ভালোবাসাময় জীবনে অনেক ঝড় আসে। অনেকে সেই ঝড়গুলো উপেক্ষা করে এগিয়ে যায়, অনেকে শক্ত স্তম্ভের অভাবে উপড়ে পরে।
অভ্র চেয়ারে বসে আছে। জব্বার মামা নিজেই চটপটির প্লেট নিয়ে আসলেন। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কি ব্যাপার মামা? একা আইছেন দেখি! মামি কনে?’
‘আজকে আসে নি, মামা।’
‘বাড়িতে সমস্যা?’
অভ্র হেসে জবাব দিলো,
‘হ্যাঁ।’
‘ওঁ। বুঝবার পারছি। আইচ্ছা খান আপনে।’
জব্বার চলে গেলো। অভ্রর একবার বলতে ইচ্ছা করছিলো রুদালি আর আসবে না। আজ থেকে সে একাই চটপটি খেতে আসবে। একটু বাদেই আবার ভাবলো, থাক! কি দরকার আছে? সে অন্যমনস্ক হয়ে চটপটি খাচ্ছে। হঠাৎ মরিচে কামড় দিয়ে ফেললো। মুখ ফসকে বলে উঠলো,
‘রুদালি! পানি বের করো পানি। মরিচে কামড় দিয়ে ফেলেছি। ওরে বাপরে! কি সাংঘাতিক ঝাল!
কি হলো তাড়াতাড়ি বের করো। ঝালে মরে গেলাম তো!’
কোনো উত্তর এলো না। পরক্ষণেই অভ্রর মনে হলো রুদালি তো তার পাশে নেই। সে হয়তো কনে সাজায় ব্যস্ত। অভ্র জানে মেয়েটা অনেক কাঁদছে। কিন্তু তার কেনো কান্না পাচ্ছে না? তার চোখে কেনো পানি নেই? কোথায় যেনো একবার পড়েছিলো, ‘অধিক শোকে পাথর’। তার অবস্থা মনে হয় এখন তাই। অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে। তাই কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। একটা বাচ্চা ছেলে বেশ দূরে বসে আছে। কিন্তু সে তাঁকিয়ে আছে অভ্রর হাতের দিকে। বিষয়টা অভ্রর দৃষ্টিগোচর হলে বাচ্চাটিকে সে ডাক দেয়। ছেলেটি ভয়ার্ত চোখে এগিয়ে আসে। অভ্র জিজ্ঞেস করে,
‘নাম কি তোর?’
‘মফিজ।’
‘থাকিস কই?’
ছেলেটা হাত দিয়ে ফুটপাতের দিকে ইশারা করলো। ‘ওইহানে থাকি।’
‘চটপটি খাবি?’
ছেলেটা চুপ করে রইলো। অভ্র ছেলেটার হাতে চটপটির প্লেট দিয়ে বললো,
‘নে খা। সাবধানে খাস। মরিচগুলো অনেক ঝাল।’
অভ্র একথা বলে উঠে দাঁড়ালো। জব্বার মামাকে বিল পরিশোধ করে হাঁটতে লাগলো। পেছোন থেকে মফিজ নামক ছেলেটি বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে অভ্রর চলে যাওয়া দেখছে।
মাঝে মাঝে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে ভালো লাগে। অভ্র আজকে গন্তব্যস্থান ঠিক না করেই হাঁটছে। অবশ্য তার মনে একটি জায়গায় যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে কাজ করছে। কিন্তু সেখানে যাওয়াটা যুক্তিহীন। রুদালিদের বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝে কোনো যুক্তি নেই। আবার তার যে এখন রুদালিকে কনের সাজে দেখতে ইচ্ছে করছে, এটাও যুক্তিসঙ্গত নয়। তবুও অভ্র কি রুদালিদের বাসার সামনে যাবে একবার?

চারিদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। রুদালিদের বাসায় পায়ে হেঁটে যেতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট লাগবে। এমন সময় অভ্রর গ্রামের বাড়ি থেকে ফোন এলো। বৃষ্টির কারণে মোবাইল ছোট্ট প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে রেখেছিলো। আয়োজন করে ফোন বের করে রিসিভ করলো সে।
‘আসসালামু আলাইকুম, আম্মা।’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। ক্যামন আছো বাজান?’
‘আলাহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনারা কেমন আছেন?’
‘আমি ভালো আছি। কিন্তু তোমার বাপজানের বুকের ব্যাথা বাড়ছে।’
‘বাবাকে শহরে এনে ডাক্তার দেখাবো নাকি ভাবছি।’
‘দেখাবার পারলে অনেক ভালো হইতো। ইয়ে মানে বাজান? একটা কথা ছিলো।’
‘জ্বি আম্মা বলেন।’
‘কইতেছিলাম যে কয়েকদিন ধইরা তো অর্ডার পাই না। জামা সেলাই করতে পারতেছি না। টাকা যা ছিলো তা দিয়া বাজার সদাই কিনা আনছি।’
‘হুঁ।’
‘তোমার বাপের ওষুধ কিনবার পারি নাই। টাকায় হয় নাই।’
‘কত টাকা লাগবে?’
‘দুইশ।’
‘আমি আগামীকাল সকালেই পাঠিয়ে দিচ্ছি।’
‘মাস শেষ হইতে তো এহনো দশ দিন বাকি। তুমি চলবার পারবা তো?’
‘হ্যাঁ মা। পারবো। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।’
‘রাতে খাইছো?’
‘না আম্মা। হলে গিয়ে খাবো।’
‘আইচ্ছা বাজান। ভালো থাইকো। দোয়া রইলো।’
‘জ্বি আম্মা।’
অভ্র ফোন রেখে দিলো। কথা বলতে বলতে সে রুদালিদের দুতলা বাসার সামনে এসে পরেছে। প্রতিটি ঘরের লাইট জ্বলছে। অভ্র কিছুক্ষণ বাসার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর পুনরায় হাঁটতে লাগলো। এখন সে হাঁটতে হাঁটতে বেবিস্ট্যান্ড যাবে। রিক্সায় যেতে পারলে ভালো হতো। একটানা হাঁটার ফলে প্রচন্ড পা ব্যাথা করছে। কিন্তু পকেটে মাত্র পনেরো টাকা আছে। অটো ভাড়াতেই দশ টাকা চলে যাবে। বাকি পাঁচ টাকা দিয়ে রাতে কিছু একটা খেয়ে নিতে হবে। সারাদিন পেটে সেভাবে কিছু পরে নি। অভ্র ক্যাম্পাসের সামনের দোকান থেকে এক কাপ চা আর এক পিস রুটি খেয়ে নিলো। তার খিদে কমে নি বরং পেটে অল্প কিছু পরায় আরো বেড়ে গেছে। হলের খাবার খেলে অভ্রর পেটে অসুবিধা হয়। একটা সিগারেট টানতে পারলে মনে হয় ক্ষুধার জ্বালা কিছুটা কমতো। কিন্তু টাকা পয়সার যে টানাটানি, এ অবস্থায় সিগারেট কেনাটাও বিলাসিতার পর্যায়ে পরে। অভ্র ঘরে ঢুকলো। তার রুমমেট ঘরে নেই। হয়তো অন্য কারো রুমে গিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। অভ্র দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা প্যান্টে হাত ঢুকিয়ে দেখলো মোটে দুইশো পঞ্চাশ টাকা আছে। সে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। দুইশো টাকা আগামীকাল বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে হবে। বাবার হার্টের সমস্যা আছে। ওষুধ কোনোভাবেই বাদ দেওয়া যাবে না। আর বাকি পঞ্চাশ টাকা দিয়ে মাসের বাকি দিনগুলো যেভাবেই হোক কাটাতে হবে।

(চলবে…)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে