#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্বঃ ১৪
অভ্রর সকালটা শুরু হলো মকবুল ভাইয়ের ফোন পেয়ে। কল রিসিভ করার সাথে সাথেই তিনি প্রাণবন্ত স্বরে বললেন,
‘কিরে ব্যাটা? কোনো খোঁজ খবর নাই। বাড়িতে গিয়া ভাইরে ভুইলা গেলি?’
মকবুলের প্রশ্ন শুনে অভ্র বেশ লজ্জা অনুভব করলো। নিজেকে তার অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। সত্যিই তো! গ্রামে আসার পর মকবুল ভাইয়ের সাথে একবারো যোগাযোগ করা হয় নি। অবশ্য হবেই বা কিকরে? ফোনের ব্যালেন্স যে তার এখনো শূণ্যের কোটায়! অভ্র নিচু স্বরে উত্তর দিলো,
‘কি যে বলেন আপনি মকবুল ভাই! বড় ভাইকে কখনো ভোলা যায়?’
মকবুল হেসে জবাব দিলেন,
‘হইছে! না ভুললে একটাবার ফোন অন্তত করতে পারতি।’
অভ্র চুপ করে রইলো। মকবুল কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো। প্রত্যুত্তরে অভ্র কি বলে তা জানার জন্য। কিন্তু ফোনের অপর পাশের দীর্ঘশ্বাসটুকুই যেনো শোনা গেলো। এটাই উত্তর। মকবুল বললো,
‘তা সপ্তাহখানিক তো কাটিয়ে ফেললি বাড়িতে। হলে ফেরার পরিকল্পনা কি?’
অভ্র নিষ্ক্রিয় কন্ঠে বললো,
‘এখন ফিরেই বা কি হবে বাড়তি খরচ ছাড়া? রোজগারের যেটুকু পথ ছিলো নিজ হাতে বন্ধ করে এসেছি। বর্তমান সময়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ না করে চাকরির খোঁজা আর বীনা পারিশ্রমিকে গাধারখাটুনি খাটাও তো এক।’
মকবুল বললো,
‘চাকরি তোকে খুঁজতে বলেছে কে? হলে ফিরে আয়। একটা না একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। মায়ের কাঁধে চড়েও বা আর কতদিন খাবি? সামনের মাস থেকেই ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।’
অভ্র চুপ করে রইলো। তার পরিস্থিতি এখন অনেকটা এই প্রবাদের মতো,
জলে কুমির ডাঙায় বাঘ। দুদিকেই বিপদ। মহা বিপদ।
‘আমার কথা শোন।’
‘বলেন ভাই।’
‘একটা টিউশনের খোঁজ পাইছি। মাইনে কম। দেড় হাজার টাকা। কিন্তু নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। স্টুডেন্ট আমার এক পুরানো ছাত্রীর ভাই।’
‘দেড় হাজার টাকা!’
মকবুল হতাশ কন্ঠে উত্তর দিলো,
‘হুঁ।’
‘ছেলে কিসে পড়ে?’
‘ক্লাস এইট এ।’
‘বাসা কোথায়?’
‘সদরে।’
‘দেড় হাজার টাকা তো খুবই কম মকবুল ভাই! আমার পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা করতে হবে।বাড়িতে টাকা পাঠানোর পর নিজের কপালে কয় কানাকড়িই বা জুটবে?’
‘সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু তোরও তো টিউশন দরকার। একবারে খালি হাতে তো বসে থাকবি না। মাস শেষে কিছু টাকা হলেও পকেটে আসবে।’
অভ্র ক্ষণিককাল চুপ থেকে বললো,
‘মকবুল ভাই, আমি আপনাকে একটু চিন্তা করে জানাই?’
‘ঠিকাছে। চিন্তা ভাবনা কইরাই সিদ্ধান্ত নে। রাখি।’
অভ্র কান থেকে ফোন নামিয়ে ফেললো। টিউশনটা নিয়ে সে খুব একটা আগ্রহ খুঁজে পাচ্ছে না। এবিষয়ে ভাবতেও তার ভালো লাগছে না। তাহলে কি নিয়ে চিন্তা করা যায়? অভ্র কপালে ভাঁজ ফেললো। চিন্তার বিষয় মনে হয় পেয়ে গেছে। গতকাল রাতে সে একটা স্বপ্ন দেখেছে। এটা অবশ্যই অস্বাভাবিক কিছু নয়। ঘুমালে মানুষ স্বপ্ন দেখবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু স্বপ্নে সে যে মেয়েটাকে দেখেছে এটা তাকে ভীষণ চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। গতকাল রাতে তার স্বপ্নে ঘটেছে রায়ার আগমন।
মেয়েটা এসেছে লাল কাতানের শাড়ি পরে। গলায় হালকা গয়না। সে প্রচন্ড কাঁদছে। আকাশ তিমিরাচ্ছন্ন। ময়লা মেঘ জমে আছে। অভ্র দাঁড়িয়ে আছে সেই পরিচিত পোস্ট অফিসের সামনে। কাঁদতে কাঁদতে রায়ার হেঁচকি উঠে গেছে। সে দ্রুত পায়ে সোজা অভ্রর সামনে গিয়ে থামলো। বললো,
‘আজ আমার বিয়ে।’
অভ্র ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
‘হুঁ।’
‘আমি বিয়ে করবো না।’
‘কেনো?’
‘কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি। বিয়ে যদি কখনো করি শুধুমাত্র আপনাকেই করবো।’
‘ওঁ।’
‘ওঁ মানে? এটা কেমন উত্তর? আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছি। আমাকে আপনার সাথে নিয়ে চলুন স্যার।’
অভ্র বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
‘কোথায় নিয়ে যাবো?’
রায়া ঢোঁক গিলে বললো,
‘জানি না। আপনি আমাকে নিয়ে চলুন।’
অভ্র দেখলো রায়া ছলছলে চোখে অভ্রর দিকে তাঁকিয়ে আছে।
ব্যাস! এতটুকুই। এরপরে কি হয়েছে অভ্র জানে না। ফোনের রিংটোনে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছে তার। পরের ঘটনাটুকু এখন জানতে ইচ্ছা করছে। সে কি রায়ার হাত ধরেছিলো? নাকি রুদালির মতো তাকেও ফিরিয়ে দিয়েছিলো?
কোথা থেকে যেনো এক টুকরো মলিনতা ভর করে অভ্রর মুখে। সে চৌকিতে উঠে বসে। তখনি তার কানে ক্ষীণ হট্টোগোলের আওয়াজ আসে। কোনো একটা বিষয় নিয়ে তর্কাতর্কি হচ্ছে। তার মায়ের কন্ঠস্বরও শোনা যাচ্ছে। কৌতুহলী পায়ে অভ্র হট্টোগোলের উৎসের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখে উঠোনের গেটের কাছে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। একজনের মুখে পুরু গোফ। সে হাত নেড়ে নেড়ে তার মাকে যেনো কি বলছে। আরেকজন অল্প বয়স্ক। সে কোনো কথায় অংশগ্রহণ করছে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের গলায় গামছা ঝুলানো। অভ্র যেনো কোথায় এদের দেখেছে। এখন মনে পরছে না।
উঠোনে নামতেই তাদের কথা আংশিক শোনা গেলো। স্পষ্টভাবে শোনার জন্য অভ্র আরো সামনে এগিয়ে গেলো। পুরু গোফওয়ালা লোকটি বলছে,
‘আমি এত কিছু শুনবার চাই না। আফনে চাইর দিনের সময় নিছিলেন। আজকে এক সপ্তা হইতে চললো। হয় আফনে ট্যাহা দিবেন নইলে আংটি এইডা বেঁইচা দিমু।’
সালমা আঁকুতি করে বলছে,
‘ভাই আর দুইটা দিন সময় দেন? আমি টাকা দিয়ে দিবো।’
‘না আইজকাই দাওন লাগবো। হয় ট্যাহা দিবেন নইলে আংটি বেঁইচা দিমু।’
সালমা ভেজা চোখে নানাভাবে মিনতি করতে লাগলো। অভ্র চুপ করে থাকতে পারলো না। উদ্বিগ্ন মুখে এগিয়ে গেলো।
‘কি হয়েছে এখানে? এত হুল্লোড় কিসের?’
‘এই যে বাপু! আপনি মনে হয় এই আফার পোলা?’
‘জ্বি।’
‘শোনেন আপনারে কই কি হইছে। আপনি বুঝবেন হিসাবডা।’
সালমা লোকটাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
‘ভাই, আমি বললাম তো দুইদিন পরেই দিয়া দিবো। বাজানের সামনে আলাপ করার দরকার নাই।’
‘দাঁড়াও মা। আমি শুনবো। আপনি বলেন চাচা।’
সালমা আঁচলে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে রইলো। দুচোখ ভেঙ্গে তার অশ্রুকণা ঝরছে। গোফওয়ালা লোকটি বললো,
‘আপনি যেদিন আইছেন সেদিন আফায় বাজারে আইছিলো। বাড়িতে কিচ্ছু নাই, মুরগী কিনবো। হের কাছে ট্যাহা আছিলো না। আমি আবার বাকিতে সদাই দেই না। তাই তার আংটি বন্ধক রাইখা দুইডা মুরগী নিবার চাইলো। এহন, হাজার হইলেও আমি মানুষ। আমার পোলাও শহরে পড়ালেখা করে। বাড়িতে আইলে ভালোমন্দ কইরা খাওয়াই। তাই বিষয়ডা বিবেচনা কইরা, আফারে না করি নাই। কথা আছিলো চাইর দিনের মধ্যে ট্যাহা দিয়া দিবো। আইজকা সাত দিন চলে হের ছায়াও বাজারে পরে না! আংটিও নিবার আসে না। এইডা কোনো কথা আফনেই কন?’
সবশুনে অভ্র পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখ ক্রমশ ঝাঁপসা হয়ে আসছে। সালমা এখনো মুখ লুকিয়ে কাঁদছে। অভ্র আঁড়চোখে সালমার আঙুলের দিকে তাঁকালো। যা ভেবেছে তাই। বিয়ের আংটিটাই বন্ধক রেখেছে। অভ্র বললো,
‘এখন আপনি কি চাইছেন?’
‘আজকের মধ্যে ট্যাহা দিলে আংটি ফেরোত। নইলে বিক্রি কইরা দিমু।’
সালমা ভাঙ্গা গলায় বললেন,
‘ভাই আমার খদ্দের দুইদিনের মধ্যেই জামার টাকা দিয়া দিবো। দয়া কইরা দুইটা দিন সময় দেন।’
‘আর একদিনও দাওন যাইবো না আফা।’
অভ্র বললো,
‘ঠিকাছে। আপনি আজকের মধ্যেই পেয়ে যাবেন। আমি সন্ধ্যায় গিয়ে টাকা দিয়ে আংটি নিয়ে আসবো।’
‘আইচ্ছা।’
লোকটি তার সাথের অল্প বয়স্ক ছেলেটিকে নিয়ে ফিরে গেলো। সালমা এখনো কেঁদে চলেছে।
অভ্র ঢোঁক গিললো। তারও গলা ভেঙ্গে কান্না আসছে। সালমা এখনো কাঁদছে। অভ্র দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মা ছেলের বুকে মাথা গুঁজে কাঁদছে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। প্রকৃতিও যেনো মায়ের আহাজারিতে থমকে গিয়েছে। কাকগুলোও শান্ত ভাবে বসে আছে গাছের ডালে। অভ্র প্রাণপণে চেষ্টা করছে নিজেকে সামলানোর। আজ বুঝি তাদের স্থান নিম্ন মধ্যবিত্তদের চেয়েও এক ধাপ নিম্নে!
অভ্র ব্যাগ খুলে টাকা পয়সা খুঁজতে লাগলো। যদি কয়েক পয়সা পাওয়া যায়! বইয়ের ভাঁজে সত্যিই চকচকে একটি বিশ টাকার নোট পাওয়া গেলো। নোটে রুদালির নাম লিখা। হঠাৎ করে অভ্রর মনে হলো এই নোটটি রুদালি তাকে কোনো এক ইদে দিয়েছিলো। সালামি হিসেবে। সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো এই নোটটি কখনো খরচ করবে না। কিন্তু আজ সেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের সময় এসেছে। তাছাড়া যে মানুষটির অস্তিত্ব তার জীবনে এখন আর নেই, সেই মানুষটির নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকার কোনো মানে হয় না। টাকাটা নিয়ে অভ্র বাজারে গেলো। ফোনে ব্যালেন্স ভরতে হবে। মকবুল ভাইকে ফোন করতে হবে। কিছু টাকা ধার চাইতে হবে। টিউশনটা সে করবে। এবিষয়েও তার সাথে কথা বলা প্রয়োজন।
রাতে ঝিলের পাড়ে ঠান্ডা বাতাসের ছড়াছড়ি। অভ্র একা বসে আছে। তার হাতে বিড়ি। দুপুরে সে খায়নি। সবকিছু জানার পর খাবার গলা দিয়ে নামার কথা না। খালি পেটে বিড়ি টানায় পেটের ভেতোর দলা পাঁকিয়ে যাচ্ছে। আরো নানান উপসর্গের দেখা মিলেছে। বমিভাব, মাথাব্যথা, বুক ব্যাথা। তবুও অভ্র অন্যমনস্ক হয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে। তার অন্যমনস্ক ভাব কেটে গেলো ফোনের শব্দে। পরিচিত নাম্বার। গত কয়েকদিন ধরে প্রায়ই এই নাম্বার থেকে কল আসে। অভ্র ফোন রিসিভ করলো।
‘বলুন।’
‘আজ এত শান্ত কন্ঠে কথা বলছেন যে! আমিতো আপনার ঝাড়ি খাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম।’
অভ্র উত্তর দিলো,
‘এমনি।’
তনিমা উদ্বিগ্নচিত্তে বললো,
‘আপনার কি মন খারাপ?’
‘হুঁ।’
‘এজন্যই বুঝি আমি ফোন দেওয়ার পরেও ঝাড়ছেন না?’
অভ্র কোনো উত্তর দিলো না।
‘আপনি এখন কোথায়?’
‘ঝিলের পাড়ে।’
‘একা?’
‘হুঁ।’
‘ভয় করে না?’
‘ভয় কেনো করবে?’
তনিমা ঢোঁক গিয়ে বললো,
‘এত রাতে ঝিলের পাড়ে বসে আছেন। যদি অন্যকিছু পা টেনে ধরে?’
অভ্র অবাক হয়ে বললো,
‘কি পা টেনে ধরবে?’
‘ভূত!’
অভ্র একটু শব্দ করে হেসে উঠলো। বললো,
‘ভূত বলে কিছু নেই।’
‘আপনাকে কে বলেছে কিছু নেই? একটা ঘটনা শুনাবো, শুনবেন?’
‘শোনান।’
তনিমা বলতে শুরু করলো,
‘একটা লোক ঝিলে মাছ ধরতে যেতো। সে সবসময় রাতে যেতো…..’
অভ্র মনযোগ দিয়ে তনিমার গল্প শুনছে। তার ভালো লাগছে। এত ঝুই ঝামেলার পর কারো কথা শুনতে যদি ভালো লাগে তবে তার জন্য ফোনে একটুখানি সময় ব্যায় করলে ক্ষতি কি?
(চলবে…)
#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্ব: ১৫
নুরুল আলমের বাড়িতে আজ সকাল থেকেই হুলস্থুল কান্ড। বাবুর্চি ভাড়া করে আনা হয়েছে। নানারকম মুখরোচক খাবারের আয়োজন চলছে। আজ একটি বিশেষ দিন। তার একমাত্র মেয়ে রায়ার জন্মদিন। সেই সুবাদে ছোট খাটো পার্টি রেখেছেন নুরুল আলম। ছোট খাটো পার্টি হলেও গুণে গুণে চল্লিশ জনকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই পার্টিতে অংশগ্রহণ করার মতো রায়ার কোনো বন্ধু-বান্ধব নেই আবার নুরুল আলমের বন্ধুদের অভাবও নেই। সম্প্রতি তার খুব কাছের এক বন্ধুর ছেলের বিয়ে হয়েছে। মেয়ে দেখতে গিয়েই চটজলদি শুভকাজ সম্পন্ন করে ফেলা হয়েছে। এখনো অনুষ্ঠান করা হয় নি। সেই বন্ধুও সপরিবারে আসছেন।
রায়া নিজের ঘরে চুপচাপ বসে আছে। জন্মদিন উপলক্ষে এই আয়োজন তার পচ্ছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু বাবার অপ্রকৃতস্থ ভাব দেখতেও তার ভালো লাগছে। মানুষটা কত উৎসাহ নিয়ে সকল আয়োজন করছেন। অবশ্য প্রতিবছরই করেন। পুরো বাড়ি ম ম করছে বৈদেশিক খাবারের ঘ্রাণে।
নুরুল আলম রায়ার ঘরে ঢুকলেন। রায়া একমনে জানালা দিয়ে বাইরে তাঁকিয়ে ছিলো। মাথায় কারো আলতো হাতের স্পর্শে তার অন্যমনস্কভাব কেটে গেলো।
‘বাবা, তুমি এখানে! কিছু বলবে?’
নুরুল আলম মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
‘একা একা কি করছিস, মা?’
রায়া মিষ্টি করে হেসে বললো,
‘কিছু না। বসে আছি।’
‘বেলা গড়িয়ে এলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই চলে আসবে। গোসল করবি না? নতুন জামাকাপড় পরবি না?’
রায়া আবারো মিষ্টি করে হেসে বললো,
‘পরবো।’
‘যা তাহলে। গোসল করে তৈরি হয়ে নে।’
‘তোমার বন্ধুরা কখন আসবে?’
‘এইতো সন্ধ্যার পর।’
রায়া কিছু বললো না।
আচমকা নুরুল আলমের বুকটা হুঁ হুঁ করে উঠলো। চোখ দুটো নিমিষেই এলো ঝাপসা হয়ে। অস্ফুটবাকে বলে উঠলেন,
‘কত বড় হয়ে গেছিস। আজ তোর মা বেঁচে থাকলে একসাথে কত আনন্দ করা যেতো। হাসি ঠাট্টায় মেতে থাকতো পুরো বাসা।’
‘হুঁ।’
‘মায়ের জন্য তোর মন খারাপ করছে তাই না রে?’
রায়া সহজ কন্ঠে বললো,
‘না তো। মনে খারাপ করছে না।’
নুরুল বিস্মিত কন্ঠে বললেন,
‘মায়ের কথা তোর মনে পরছে না?’
‘না। যে মানুষটার অস্তিত্ব নেই সেই মানুষের কথা মনে করে লাভ আছে?’
নুরুল আলম বড় বড় চোখ করে মেয়ের দিকে তাঁকিয়ে আছেন। রায়ার সেদিকে মনোনিয়োগের প্রয়োজন বোধ করলো না। বাবার সামনে থেকে উঠে আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বড় করে শ্বাস নিয়ে আলমারি খুললো। নতুন জামা বের করলো। এরপর বাবার দিকে তাঁকিয়ে বললো,
‘আমি তাহলে গোসলে যাচ্ছি।’
নুরুল মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন,
‘ঠিকাছে।’
রায়া বাথরুমে ঢুকে গেলো। কাপড় গুলো ঝুলিয়ে রেখে ঝরনা ছেড়ে ফ্লোরে বসে পড়লো। হাটু দুটো ভাঁজ করে দুই হাত তার ওপর রেখে মাথা গুঁজে দিলো। রায়া কাঁদছে। ঝরনার ঠান্ডা পানির মাঝেও তার উষ্ণ চোখের পানি বিছিন্ন করা সম্ভব।
রুদালি উইন্ড চাইম হাতে বসে আছে। তার চোখে মুখে বিরক্তি। উইন্ড চাইমটা কোথায় লাগাবে সে বুঝতে পারছে না। দরজার সামনে নাকি জানালার সামনে। উইন্ড চাইমটা ঝিনুকের তৈরি। সাগরপাড়ে একটি বাচ্চা ফেরি করে বেড়াচ্ছিল। শেষ বিকেলের আলোয় ঝিনুকগুলো কেমন চিকচিক করছিলো। রুদালি বিমোহিত হয়ে যায়। তার অনুরোধেই অর্ণব উইন্ড চাইমটা কিনে ফেলে। কিন্তু এখন এটা রুদালির পচ্ছন্দ হচ্ছে না। একবার ভাবলো ঘরে ঢোকার দরজার কাছে লাগাবে। পরক্ষণেই মনে হলো, জানালার কাছে লাগালে বেশ হবে! সূর্যের আলোয় সেই আগের চাকচিক্য ভাব ফিরে আসতে পারে। রুদালি যখন দ্বন্দ্বের টানা হেঁচড়ায় ক্লান্ত তখন ঘরে প্রবেশ করলো অর্ণব। মাত্র বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ফিরলো। কাঁধের একপাশে টাওয়েল ঝুলছে।
‘কি ব্যাপার এভাবে বসে আছো কেনো?’
রুদালি করুণ কন্ঠে বললো,
‘উইন্ড চাইমটা দরজার সামনে লাগাবো নাকি জানালার সামনে লাগাবো বুঝতে পারছি না।’
অর্ণব বললো,
‘উইন্ড চাইম ছাড়ো। দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। আধা ঘন্টার মধ্যে আমরা বের হচ্ছি।’
‘বের হচ্ছি মানে? কোথায় যাচ্ছি?’
‘বললাম না? বাবার খুব ঘনিষ্ট বন্ধু নুরুল আংকেলের মেয়ের জন্মদিন।’
রুদালি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
‘আমার হট্টোগোল পচ্ছন্দ না।’
‘বাহ। তুমি তো একদম রায়ার মতো!’
রুদালি অবাক হয়ে বললো,
‘রায়া টা কে?’
অর্ণব হেসে বললো,
‘কে আবার? নুরুল আংকেলের মেয়ে। তোমার চেয়ে বছর দুয়েক ছোট হবে হয়তো। কিন্তু মেয়েটা অনেক ভালো।’
‘ওঁ।’
‘আমার অনেক আদরের ছোট বোনও বলতে পারো।’
রুদালি হাসলো।
অর্ণব বললো,
‘হট্টোগোল ভালো না লাগলে রায়ার সাথে গিয়ে বসে থাকবে। প্রতিবছর ও তাই করে। জন্মদিন ওর অথচ ওকেই খুঁজে পাওয়া যায় না। যাইহোক, তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নাও।’
রুদালি বিরস মুখে উইন্ড চাইমটা অর্ণবের দিকে এগিয়ে বললো,
‘দয়া করে এটার একটা ব্যবস্থা করে ফেলুন।’
অর্ণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
‘যথা আজ্ঞা, মহারাণী। এবার তৈরি হতে যান?’
রুদালি হেসে বললো,
‘ঠিকাছে।’
রুদালি ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই অর্ণব মাথা চুলকাতে লাগলো। সেও দেখা যায় রুদালির মতো দোটানায় পরে গেলো। উইন্ড চাইমটা কোথায় লাগালে বেশি সুন্দর লাগবে? দরজার সামনে নাকি জানালার এপারে?
সিড়ি দিয়ে রমজান খান তিন তলায় উঠছেন। নুরুল আলম তাকে দেখা মাত্র তিনি হই হই করে উঠলেন। কোলাকোলি করে বললেন,
‘কিরে ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলি। কয়েকদিন পর দাদা হয়ে যাবি। হা হা হা।’
রমজান খান হাসিমুখে বললেন,
‘ওরে দাদা কি আমি একা হবো রে? তুই হবি না?’
‘তা তো অবশ্যই। অর্ণব কি তোর একার ছেলে নাকি? আমারো ছেলে। তা কই সে কই?’
এপর্যায়ে রুদালি এবং অর্ণবের পাশাপাশি দেখা মিললো। অর্ণব সালাম দিলো। হাসিমুখে বললো,
‘কেমন আছেন আংকেল?’
‘আলহামদুলিল্লাহ বাবা। ভালো আছি।’
অর্ণব রুদালিকে ইশারা করলো। রুদালি উবু হয়ে দোয়া নিলো। নুরুল প্রাণভরে দোয়া করে দিলেন।
‘কি যেনো নাম তোমার মা?’
‘রুদালি।’
‘বাহ খুব মিষ্টি নাম।’
অর্ণব বললো,
‘আংকেল রায়া কই?’
নুরুল পানসে কন্ঠে বললেন,
‘কই আবার? গিয়ে দেখো, ঘরবন্দী হয়ে আছে।’
‘আচ্ছা আমি তাহলে রুদালিকে নিয়ে যাই। রায়ার সাথে তো ওর পরিচয় নেই।’
‘হ্যাঁ বাবা অবশ্যই। ওকে নিয়ে যাও।’
অর্ণব রুদালিকে নিয়ে ভেতোরে চলে গেলো।
রমজান খান জিজ্ঞেস করলো,
‘ছেলের বউ পচ্ছন্দ হয়েছে?’
‘মাশা আল্লাহ। ভারী মিষ্টি চেহারা।’
‘মেয়েটা অনেক লক্ষ্মী।’
‘পড়াশোনা কোন পর্যন্ত করেছে?’
‘অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছে।’
‘বাহ। খুব ভালো। অনুষ্ঠান করবি না? যেভাবে ছেলের বিয়ে দিলি।’
‘আসলে দেখতে গিয়ে পচ্ছন্দ হয়ে গেলো। মেয়ের বাবার জোরাজুরিতে আর না করতে পারি নি। ইচ্ছা আছে এই বছরের শেষের দিকে অনুষ্ঠান করার। বাকিটা উনার ইচ্ছা।’
রমজান খান আকাশে এক আঙুল দিয়ে ইশারা করে দেখালো। মানে সবই আল্লাহর ইচ্ছা। নুরুল আলম হাসলেন। পরক্ষণেই উদ্বিগ্ন মুখে বললেন,
‘ভাবি কই?’
‘পার্টির নাম শুনেই বাতের ব্যাথার বাহানা জুটিয়েছে!’
‘ভাবি এজীবনে আর শুধরাবে না।’
রমজান খান হেসে বললেন,
‘চল ভেতোরে যাই।’
‘চল।’
রায়া ডায়রিতে কিছু একটা লিখছিলো। অর্ণবের গলার স্বর শুনে চমকে উঠে।
‘কি খবর ভেটকি?’
রায়া পেছোনে ঘুরে হেসে ফেলে।
‘আরে অর্ণব ভাইয়া!’
“শুভ জন্মদিন।’
‘ধন্যবাদ।’
রায়া দেখলো অর্ণবের পাশে তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা কিছুটা অপ্রস্তুত। রায়া মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে থেকে অর্ণবের দিকে তাঁকালো। চোখাচোখি হতেই অর্ণব হেসে ফেললো।
‘তোর ভাবী। তোর মতোই। হুল্লোড় পচ্ছন্দ না। তাই ভাবলাম তোর কাছে রেখে যাই। দুজনে মিলে গল্প গুজব কর।’
রায়া হাসিমুখে বললো,
‘কোনো সমস্যা নেই। ভাবী এখানে থাকুক। তুমি যাও পার্টি ইনজয় করো।’
অর্ণব মাথা ঝাঁকিয়ে রুদালির দিকে তাঁকালো। ইশারায় আশ্বস্ত করে বললো,
‘থাকো তাহলে?’
‘আচ্ছা।’
অর্ণব রুম থেকে বের হয়ে গেলে রায়া এগিয়ে আসলো। রুদালির হাত ধরে টেনে বিছানায় নিয়ে আসলো। বললো,
‘আমার নাম জানেন?’
‘জানি। তোমার নাম রায়া।’
রায়া ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,
‘আমার নাম বলে দিয়েছে?’
রুদালি হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘হ্যাঁ।’
‘কেমনটা লাগে!’
‘কি হয়েছে?’
‘আমার নাম বলেছে অথচ আমাকে আপনার নাম বলে গেলো না।’
রুদালি হেসে ফেললো,
‘এই কথা? আমি বলছি। আমার নাম রুদালি।’
‘অর্ণব রুদালি। বাহ! আপনার নামটা কিন্তু ভাইয়ার নামের পাশে মানিয়েছে।’
রুদালি হাসলো। মুখে কিছু বললো না।
‘আপনি কিসে পড়াশোনা করছেন?’
‘অনার্সে।’
‘কোন বিশ্ববিদ্যালয়?’
‘ভাসানীতে।’
রায়া কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। হঠাৎ করে তার অভ্রর কথা মনে হলো। অভ্র আর রুদালি একই ভার্সিটিতে পড়ছে। রায়া কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। হঠাৎ করে রুদালি কাশতে শুরু করলো। রায়া অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। রুদালিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে দ্রুত পানি আনতে গেলো।
রায়া যাওয়ার পর পরই রুদালি নিজেকে কিছুটা সামলে নিলো। গলার খুশখুশ কমে এসেছে। হঠাৎ জানালার ফাঁক দিয়ে সাই সাই করে দক্ষিণা বাতাস এসে ঘরময় ছোটাছুটি করতে লাগলো। বাতাসের তোড়ে রায়ার ডায়রির পাতা একাই উল্টাতে লাগলো। ডায়রিতে চোখ পড়তেই রুদালি চমকে উঠলো। একটি পৃষ্ঠায় রঙিন মার্কার দিয়ে বড় করে লিখা,
‘ভালোবাসি অভ্র স্যার।’
(চলবে…)
লিখা: আতিয়া আদিবা