#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্বঃ ১২
রায়া পড়ার টেবিলে মুখ গোঁজ করে বসে আছে। তার সামনে অংকের নতুন মাস্টার। উদাস মনে বসে বসে পান চিবোচ্ছেন। তার পান চিবানোর ধরনটা খুবই বিশ্রি। অনেকটা জাবর কাটার মতো। ঠোঁটের ওপর পুরু মোচ। কুচকুচে কালো। রায়া মোটামোটি নিশ্চিত স্যার মোচে কলপ লাগিয়েছেন। সবাই চুল দাঁড়িতে লাগায়। তিনি মোচে লাগিয়েছেন। স্যারের আরেকটা জিনিস রায়ার পচ্ছন্দ হচ্ছে না। কথা বলার সময় তার মুখ থেকে পানের পিচকি ছিটে আসছে। খাতার এজায়গায় ওজায়গায় ক্ষুদ্রাকার লাল রঙ ফুটে উঠছে। পান চিবানো শেষ করে বিমল বাবু রায়াকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘অংক করতে ভালোলাগে না?’
রায়া সহজ গলায় উত্তর দিলো,
‘না।’
বিমল বাবু বললেন,
‘লাগার কথাও না। অংক কি মাইয়া মানুষের পড়ার বিষয় নাকি? অংক হইলো বুদ্ধিমানদের পড়ার বিষয়। মাইয়াগো মাথায় তো গোবর চাষ হয়। বুদ্ধির কারবার নাই।’
রায়া শান্ত গলায় বললো,
‘স্যার, গোবরে সার আছে।’
বিমল বাবু ইতস্তত করে বললেন,
‘তা আছে। কিন্তু সেই গোবর দিয়া তো মস্তিষ্ক চাষ করা যাবো না তাই না? মস্তিষ্ক চাষ করা লাগে বুদ্ধি দিয়া।’
রায়া কোনো উত্তর দিলো না। খুব সাবধানে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পড়াতে আসার পর থেকে বিমল বাবু নানাভাবে মেয়েদের অপমান করে যাচ্ছেন। মেয়েদের বুদ্ধি নেই, উপস্থিত জ্ঞান নেই, পড়াশোনা করে বিশেষ কোনো লাভ নেই ইত্যাদি।
অংক বই হাতে নিয়েই তার প্রথম কথা ছিলো,
‘মেয়ে মানুষের পড়াশোনা কইরা লাভ কি? দিনশেষে শশুড়বাড়ি গিয়া হেঁসেলই ঠেলা লাগে। জজ ব্যারিস্টার কয়জন হয়?’
রায়া চাইলে তার প্রশ্নের জবাব দিতে পারতো। কিন্তু দেয় নি। কিছু কিছু মানুষের সাথে বাক্যালাপ মানে সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই না। বিমল স্যার সেই কিছু কিছু মানুষদের মধ্যে পরেন।
পড়ানো শুরু করা হলো। ত্রিকোণমিতি। বিমল বাবু মুখস্ত বিদ্যা আওড়াচ্ছেন। রায়া বিরস মুখে ঘড়ির দিকে তাঁকালো।
স্যার চলে যাওয়ার পর প্রচন্ড মাথা ব্যাথা নিয়ে রায়া দাদীর ঘরে প্রবেশ করলো। এঘরটা অন্যদিন খালি পরে থাকে। কারণ রায়ার দাদী বেশিরভাগ সময় কাটান তার ছোট ছেলের বাড়িতে। ঢাকার মোহাম্মদপুরে। আজ সকালে তিনি বড় ছেলের বাড়িতে এসেছেন। অজানা কোনো এক কারণে রায়ার মা কে তিনি সহ্য করতে পারতেন না। তবে রায়ার প্রতি তার ভালোবাসার কোনো কমতি ছিলো না। মেয়েটা যখন মাত্র ক্লাস ফাইভে পড়ে, রায়ার মা চিত্রা মারা যান। নাহ! মানুষটার কোনো শারীরিক অসুস্থ্যতা ছিলো না। হয়তো তার কাছে খুব বেশি সময়ও ছিলো না। সৃষ্টিকর্তা খুবই স্বল্প আয়ু দিয়ে তাকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। তাই, হঠাৎ একদিন চিত্রার হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে যায়। রায়ার দাদী সেদিন কাঁদেন নি। তবে কষ্ট খানিকটা পেয়েছেন তা বেশ বোঝা গেছে।
রমলা বিছানার এক কোণে বসে তসবি জপছিলো। এই ঘরটার মাঝে এক প্রকার শুভ্রতা বিরাজমান। দেয়ালের রঙ, জানালার পর্দা, বিছানার চাদর সবকিছু ধবধবে সাদা। আর সাদা মানেই একরাশ পবিত্রতা। রমলা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সাথে খুঁতখুঁতে স্বভাবের। চাইলেই তার আশেপাশে ঘেঁষা অসম্ভব। কেউ তার সাদা চাদরের বিছানায় বসতে গেলেই খেঁকিয়ে ওঠেন।দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হলেও তিনি অবয়ব দেখেই মানুষ চিনে ফেলেন। অবশ্য, রায়ার বিষয়টা আলাদা।
নাতনিকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে তিনি বললেন,
‘দিদিভাই নাকি? আসো ভেতোরে আসো।’
রায়া ভেতোরে প্রবেশ করলো।
‘কি হইছে দিদিভাই? চেহারা ময়লা কইরা রাখছো কেন?’
রায়া চোখ কপালে তুলে বললো,
‘চেহারা ময়লা করে করে রাখছি মানে?’
‘এই যে মুখ কালা বানাইয়া রাখছো। কিছু হইছে?’
রায়া বুঝলো, বিমল স্যারকে নিয়ে যে সে বিরক্ত সেই ছাপ তার চোখে মুখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।মুখচিত্র দেখাচ্ছে বাংলার পাঁচের মতো। একেই দাদী -চেহারা ময়লা বলে সম্বোধন করছেন। রায়া শান্ত গলায় বললো,
‘কিছু হয় নাই। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে।’
রমলা তসবি জপতে জপতে বললেন,
‘চুলে একটু তেল দিয়া দিমু? তাইলে মাথাব্যথা কইমা যাবো।’
রায়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললো ‘দাও। মাথায় তেল দিয়ে দাও।’
বিছানার পাশে বেশ বড়সড় একটি ট্রাঙ্ক। এই ট্রাঙ্কটির গায়েও সাদা রঙ লেপ্টে দেওয়া হয়েছে। তার ওপরে একটি তেলের বোতল। ছোট্ট একটি পিরিচ নেওয়া হলো। তারপর আয়োজন করে রমলা তার নাতনির চুলে তেল মালিশ করে দিতে লাগলেন। আরামে রায়ার চোখ বারবার বুজে আসছে। ঝাঁপসা দৃষ্টিতে ভেসে উঠলো পুরোনো কিছু স্মৃতি। ছোটবেলায় রায়ার মা কম চেষ্টা করেছে মেয়ের মাথায় তেল লাগিয়ে দিতে? রায়া সারাবাড়ি জুড়ে সেকি ছোটাছুটি! কিছুতেই মাথায় তেল লাগাবে না। পরিশেষে তাকে ধরে বেঁধে বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হতো। আবছা আলো আবছা আঁধারের অংশটুকুতে বসতো তারা। চিত্রা উঁচু টুলে বসতেন আর রায়াকে বসিয়ে দিতেন ঝকঝকে ফ্লোরে। রায়ার মুখে ভর করতো এক ঝাঁক মলিনতা। চিত্রা মেয়ের কান্ড দেখে মুচকি মুচকি হাসতেন। চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলতেন,
‘গল্প শুনবি?’
একথা শোনার পর রায়ার গম্ভীর ভাব মুহূর্তের মধ্যেই উবে যেতো। অধিক আগ্রহ নিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করতো,
‘কিসের গল্প?’
মা উত্তর দিতেন,
‘সুয়োরানী আর দুয়োরাণীর গল্প।’
‘না। আমি রাজকুমারীর গল্প শুনবো।’
‘আচ্ছা। রাজকুমারীর গল্পই শোনাবো।’
রায়া শব্দ করে হেসে উঠতো। চিত্রা মেয়ের তেলযুক্ত মাথার একপাশে সযত্নে চুমু খেয়ে গল্প বলা শুরু করতেন,
‘একদেশে ছিলো এক রাজকুমারী। রাজকুমারীর নাম কি ছিলো জানিস?’
‘কি ছিলো?’
‘রায়ামণি।’
রায়া পুনরায় খিল খিল করে হেসে উঠতো।
‘কিন্তু রায়ামণির মনে অনেক কষ্ট ছিলো।’
‘কেনো কষ্ট ছিলো মা?’
‘কারণ মেয়েটা যখন খুব ছোট তখন তার মা মারা যান। বাবা তো রাজ্য সামলাতে ব্যস্ত। মেয়ের খেয়াল রাখবে কে? তখন রায়ামণির বাবা মেয়ের জন্য নতুন একটা মা নিয়ে আসলো।’
‘তারপর?’
‘রায়ামণি তাতেও খুশি হলো না। সবসময় একা একা থাকতো। কারো সাথে ঠিকমতো কথা বলতো না। এভাবেই একাকিত্বের মাঝে রাজকুমারী রায়া ধীরে ধীরে বড় হয়ে গেলো। তারপর হঠাৎ একদিন কি হলো জানিস?’
‘কি হলো?’
‘রাজকুমারী কাউকে কিছু না বলে গহীন জঙ্গলে চলে গেলো। চারিদিকে এত গাছপালা। স্থানে স্থানে অন্ধকার! কোথা থেকে আচমকা একটা বাঘ রাজকুমারীকে আক্রমন করে বসলো!’
গল্পের এপর্যায়ে রায়ার চোখদুটো বড়বড় হয়ে যেতো। সে ভয়মিশ্রিত কন্ঠে বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করতো,
‘তারপর? রাজকুমারীকে বাঘ খেয়ে ফেলে?’
‘না। সেসময় শিকারে বের হয়েছিলো অন্য দেশের এক রাজকুমার। সে শিকারের সন্ধান করতে করতে রায়ামণিদের দেশে চলে আসে আর জঙ্গলের বাঘের হাত থেকে তাকে বাঁচায়।’
‘এরপর কি হয় মা?’
তেলের বাটি সরিয়ে রেখে রায়ার চুলে বিনুনি গেঁথে দিতে দিতে চিত্রা বলে,
‘রাজকুমারী রাজকুমারের সাথে দেশ ছেড়ে চলে যায়।’
‘বাবাকে না জানিয়ে?’
‘হুঁ।’
‘রাজকুমারের নাম কি ছিলো?’
‘রাজকুমারের নাম ছিলো মেঘ।’
রায়া অনুনয়ের স্বরে বলতো,
‘আমারো একটা মেঘ লাগবে, মা। এনে দিবে?’
চিত্রা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাসিমুখে বলতো,
‘সব এনে দিবো।’
আনন্দে রায়া মাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরতো।
রমলার ডাকে কল্পনার জগৎ থেকে রায়া বাস্তবে ফিরে আসে।
‘দিদিভাই।’
‘বলো।’
‘বিনুনি গাঁইথা দেই?’
‘দাও।’
রমলা বিনুনি গাঁথতে লাগলো। রায়ার বোধগম্য হলো পুরোনো স্মৃতিপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে তার চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে। আচ্ছা, মা কি তাহলে বুঝতে পেরেছিলো, সে খুব ক্ষুদ্র সময়ের জন্য এই পৃথিবীতে এসেছে? গল্পের সেই রায়ামণির মায়ের মতো সেও কেনো চলে গেলো দূরে? বহুদূরে! ধরা ছোঁয়ার বাইরের ওই আকাশের শূন্যে?
দাদীর ঘর থেকে বের হয়ে রায়া রান্নাঘরে গেলো। মাথার যন্ত্রণা এখনো পুরোপুরি সাড়ে নি। একটু চা খেয়ে দেখা যেতে পারে। রায়া দুকাপ চায়ের সমপরিমাণ পানি নিয়ে চুলায় কেতলি বসালো। রঙ চা বানাবে। সুন্দর করে আদা ছেঁচে কেতলিতে ছেঁড়ে দিলো। পানি ফুটছে। কিছুক্ষণ বাদে কেতলিতে চা পাতা ছেড়ে দিলো। মিনিট এক জাল করে কেতলি নামিয়ে ফেললো। দুকাপ চা নিয়ে সে নিচতলায় গেলো। বাবার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে আসা যাক। কিন্তু রায়ার ইচ্ছেটা অপূর্ণই থেকে গেলো। স্বভাবমতো নুরুল আলম তার বন্ধুদের সাথে আড্ডায় ব্যস্ত। রায়া বিরক্তের পাত্র হতে চায় নি। সে দরজার সামনে থেকেই তিনতলায় ফিরে এলো। তার ঘরের দক্ষিণ দিকের জানালা খুলে দিতেই ঠান্ডা বাতাস দেয়ালের প্রতিটি কোণায় যেনো আছড়ে পড়লো। পাঠ্যবইয়ের নিচ থেকে ডায়রিটা বের করলো রায়া। বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে সে ডায়রির পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলো। কলমের কালিতে অর্ধেক ডায়রি পূর্ণ। সব লিখা তার মা চিত্রাকে উদ্দেশ্য করে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সে আজ আবার লিখতে বসলো।
চা টা কেমন হয়েছে বল তো মা? মজা হয়েছে না? বাবার জন্য করেছিলাম। কিন্তু তার চেখে দেখার সময় হলো কই? আজও বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। তুমিই আমার চা বৈঠকের সংঙ্গী হও?
জানো মা? আমার মাঝে মাঝে ভীষণ একা লাগে। তুমি তো কবেই আমায় ফাঁকি দিয়ে চলে গেলে। বাবাও সবসময় ব্যস্ত থাকে। ম্যাট্রিকে পাশ করতে পারি না বলে আমার এখন কোনো বন্ধুও নেই। বড্ড একা লাগে মা। তোমার কথা খুব মনে পরে!
কতদিন তোমার মুখে রাজকুমারীর গল্প শুনি না। জানো মা? তোমার ওই গল্পের রায়ামণির মতো আমার জীবনেও একজন মেঘ এসেছে। অবশ্য তার নাম মেঘ নয়। অভ্র। কিন্তু মজার বিষয় দেখো! অভ্র কিন্তু মেঘেরই প্রতিশব্দ।
তবে আমার মেঘটা কিন্তু গল্পের মেঘের মতো নয়। অনেক আলাদা। খাটাশ প্রকৃতির। আমার অনুভূতিগুলোর দামই দিলো না। নিষ্ঠুরভাবে ফেলে চলে গেলো। সামনে যে আমার পরীক্ষা সে চিন্তেটাও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। সে শুধু খাটাশ না। দায়িত্বজ্ঞানহীনও বটে!
আচ্ছা তোমায় একটা প্রশ্ন করি।
সবার মা আছে। আমার মা কেনো নেই? আমায় ফেলে হারিয়ে যাওয়ার এত তাড়া কেনো ছিলো তোমার? আজ তুমি বেঁচে থাকলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যেতো?
এটুকু লিখে রায়ার হাত থমকে গেলো। ডায়রির ওপর টপটপ করে চোখের পানি পরছে। আর লিখা যাবে না। সবসময়ই ডায়রির লিখা অপূর্ণ থেকে যায়। ভেজা ডায়রির পাতায় কি কলম ছোঁয়ানো যায়! ছিঁড়ে যাবে না?
(চলবে…)
#আষাঢ়ের_তৃতীয়_দিবস
পর্ব: ১৩
জানালার পর্দা সরিয়ে দিলো অর্ণব। আবছা অন্ধকারে আচ্ছন্ন রুম হঠাৎ করেই দ্বিগুণ আলোকিত হয়ে গেলো। ঝলমলে সকাল। রোদের তীব্রতা রুদালির চোখজোড়া স্পর্শ করতেই ঘুমের মাঝে সে কপালে আংশিক ভাঁজ ফেললো। অর্ণব তাড়াহুড়ো করে রুদালির মাথার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রুদালির কপালের ভাঁজ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। অর্ণব সামান্য হাসলো। মেয়েটার সামনে থেকে সরে গেলেই কপালের ভাঁজ আবার স্পষ্ট হয়ে উঠবে। অর্ণব রুদালির দিকে তাঁকিয়েই পা টিপে টিপে পেছোতে লাগলো। জানালার পর্দাটা অল্প একটু টেনে দিলো। রুদালির মুখ এবার রোদের স্পর্শের বাইরে। অর্ণব নিচে তাঁকিয়ে দেখলো সুইমিং পুলের পাশে বসে এক দম্পতী কাপে করে চা অথবা কফি কিছু একটা খাচ্ছে। অর্ণবেরও কফি খেতে ইচ্ছে করছে। সে ঠিক করলো হোটেল বয়কে ফোন দিয়ে এক কাপ চা আর এক মগ কফি দিয়ে যেতে বলবে। ওরা এখন আছে হোটেল কক্স টুডে তে। গতকাল রাতে সীতাকুন্ড থেকে কক্সবাজার এসেছে।
কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরে হোটেল বয় ফোন রিসিভ করলো,
‘গুড মর্নিং স্যার। আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি?’
‘আমি কি এক কাপ চা এবং এক মগ কফি পেতে পারি?’
‘অবশ্যই স্যার। রুম নাম্বার?’
অর্ণব রুম নাম্বার বলে হোটেল বয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখে দিলো। ক্ষণিককাল বাদে কলিং বেল বাজলো। শব্দ এতোটাই প্রকট ছিলো যে রুদালির ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সে ধীরে ধীরে কাথা সরিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসলো।অর্ণব এদিটায় নেই। সম্ভবত কে এসেছে দেখতে গিয়েছে। রুদালির প্রচন্ড মাথাব্যথা করছে। এক কাপ চা খেতে পারলে বেশ হতো। মনে মনে কথাটি ভাবা শেষ না হতেই অর্ণব ট্রে হাতে রুমে ঢুকলো।
‘ঘুম ভাঙ্গলো তোমার? ভালোই হয়েছে। এই দেখো এসে গেছে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা! যদিও দুধ চিনি মিশিয়ে নিতে হবে।’
রুদালি বললো,
‘আপনিই মিশিয়ে দিন।’
অর্ণব উৎসাহিত কন্ঠে বললো,
‘ঠিকাছে দিচ্ছি। ছোট খাটো একটা রান্নার শো করে ফেলি কি বলো?’
‘করুন।’
‘ওকে। ওয়ান, টু, থ্রি একশন। প্রথমে কাপে দুচামচ গুড়া দুধ মেশাতে হবে। তারপর দিয়ে দিচ্ছি পরিমাণ মতো চিনি। এবার চামচ দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে নিন। ব্যাস! তৈরি হয়ে গেলো মজাদার এক কাপ দুধ চা। নিন ম্যাডাম। টেস্ট করে দেখুন।’
রুদালি হেসে চায়ের কাপ হাতে নিলো। আলগোছে কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
‘চা ভালো হয়েছে।’
অর্ণব কফির অন্যান্য মিশ্রণ গুলো মগে চামচ দিয়ে মেশাতে মেশাতে বললো,
‘ধন্যবাদ। আচ্ছা, বিচে কখন যাবে? এখন নাকি বিকালে?’
‘এখনি যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু পা ব্যাথার সাথে সাথে নতুন করে মাথা ব্যাথার উপসর্গ দেখা দিয়েছে।’
‘তাহলে এবেলা থাক। তবে তোমার এই পা ব্যাথা কমতে দেরী আছে। পাহাড় বেয়ে উঠা নামা করেছো। পায়ে অত্যাধিক চাপ পরেছে। সেড়ে উঠতে সময় লাগবে।’
‘তাই মনে হচ্ছে।’
‘কোনো সমস্যা নেই। সমুদ্র দেখলে অর্ধেক পা ব্যাথা এমনেই ভালো হয়ে যাবে।’
‘কেনো? সমুদ্র বুঝি এসব ব্যাথার থেরাপি?’
রুদালির প্রশ্ন শুনে অর্ণব হেসে ফেললো। বললো,
‘তা জানি না। তবে যখন সমুদ্রের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে তখন দেখবে তার বিশালতার কাছে নিজের সমস্ত দুঃখ, বেদনা, ব্যাথা সব বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে অনেক হালকা বলে মনে হচ্ছে।’
রুদালি নিচু স্বরে বললো,
‘আপনি অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলেন।’
অর্ণব আবারো হেসে বললো,
‘ধন্যবাদ।
আচ্ছা এক কাজ করো। তুমি চা খাও আমি বরং নিচে যাই। খাবারের ব্যবস্থা করে আসি। কেমন?’
রুদালি মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
‘ঠিকাছে।’
অর্ণব রুম থেকে বের হয়ে গেলো। রুদালি লক্ষ্য করলো অর্ণবের মগে এক ফোটা কফিও নেই! এত দ্রুত একটা মানুষ গরম কফি কিভাবে শেষ করে ফেললো। নাহ! এই ছেলেটা সত্যিই বড় অদ্ভুত প্রকৃতির!
বর্ষার উত্তাল সমুদ্র। দক্ষিণের বাতাসের দুয়ার যেনো কেউ খুলে দিয়েছে। বাতাসের তোড়ে সৈকতে শুরু হয়েছে বালুঝড়। হন্যে হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে সুনীলের এপাড়ে। খানিকটা মরুভূমির আমেজ। রুদালি আর অর্ণব পাশাপাশি হাঁটছে সাগরপাড়ে। চতুর্দিকে পর্যটকদের আনাগোনা। এদের মাঝে বৈদেশিক নাগরিকও আছে। বেশিরভাগ মানুষই ছবি তোলায় ব্যস্ত। অনেকে আবার সমুদ্রের নীল জলরাশিতে পা ভিজিয়ে বসে আছে। কেউ কেউ আবার সৈকতে পেতে রাখা রঙিন চেয়ার গুলোতে অর্ধশোয়া অবস্থায় আছে। অপেক্ষা। কখন সূর্য পশ্চিমে হেলে পরবে। কখন দেখা যাবে নীল আর রক্তিম আকাশের মিলনপর্ব। উপভোগ করা যাবে সাগর তীরে সূর্যাস্তের অপরূপ সৌন্দর্য! অর্ণব রুদালিকে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
‘পা ব্যাথা কমেছে?’
রুদালি উত্তর দিলো,
‘না।’
‘সমুদ্রের পানিতে পা ভিজিয়ে দেখবে?’
‘তাতে কি লাভ হবে?’
‘কে জানে? পা ব্যাথা সেড়েও যেতে পারে!’
রুদালি হেসে জবাব দিলো,
‘না।’
‘নামতে যখন চাইছো না, তখন জোর করবো না। কিন্তু এই সমুদ্র বিমুখীতার কারণ জানতে পারি?’
‘সমুদ্র বিমুখীতা নয়। আসলে আমি পানির সংস্পর্শে আসতে ভয় পাই।’
অর্ণব অবাক হয়ে বললো
‘ভয় পাও? তাহলে তো জোর করে নামাতেই হয়! চলো যাই।’
একথা বলে অর্ণব রুদালির হাত ধরলো। রুদালি একটু জোর গলায় বললো ‘না’। শুধুমাত্র না বলেই ক্ষান্ত হলো না। অর্ণবের কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ঝামটা মারলো। অর্ণবও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। সে খানিকটা ইতস্তত করে বললো,
‘সর্যি। আসলে…’
কথা শেষ না করে অর্ণব এদিক সেদিক তাঁকিতুকি করতে লাগলো। বললো,
‘এই তুমি ঝালমুড়ি খাবে?’
রুদালি কোনো উত্তর দিলো না। অর্ণব অবশ্য রুদালির উত্তরের অপেক্ষায় নেই।
‘ওদিকটায় ঝালমুড়ি বিক্রি করছে দেখা যায়। তুমি একটু দাঁড়াও। আমি ঝালমুড়ি কিনে আনি।’
একথা বলেই অর্ণব ঝালমুড়ি কিনতে চলে গেলো। এভাবে মেয়েটার হাত ধরা মোটেও উচিত হয়নি। তাকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য একটু সময় দেওয়া প্রয়োজন।
রুদালি সৈকতে একা দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনেই বেশ কয়েকটি বাচ্চা ইচ্ছেমতো লোনা পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করছে। শেষ বিকালের আলোয় উর্মিমালা গুলো চিকচিক করছে। দূর সমুদ্র থেকে উঁচু হয়ে এসে আছড়ে পড়ছে তীরে। বাচ্চাগুলো ঢেউয়ে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে। লাইফ গার্ডরাও তাদের কিছু বলছে না। মাথার ওপর দিয়ে এক ঝাঁক পাখি উড়তে উড়তে পাহাড়ের দিকটায় চলে গেলো। রুদালি মনোযোগ দিয়ে সেই পাখিদের ডাক শুনছে। এমন সময় তার পাশে বয়স্ক একজন মহিলা এসে দাঁড়ালো। উনার স্বামীও আছেন সাথে। কিন্তু তিনি বসে আছেন হুইল চেয়ারে। রুদালি শুনলো মহিলাটি তার স্বামীকে বলছেন,
‘দেখছো কত সুন্দর? একটু পরেই সূর্য ডুইবা যাবে।’
কিন্তু তার স্বামী প্রত্যুত্তরে কিছুই বললেন না। মহিলাটি অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে। সমুদ্রের এদিক ওদিক আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন। কিন্তু তার স্বামী একটি কথার উত্তরও দিচ্ছেন না। তার দৃষ্টি স্থির। রুদালি বেশ অবাক হয়। সে কৌতূহলী চোখে তাদের দিকে তাঁকিয়ে থাকে। রুদালির এই কৌতূহল বৃদ্ধার দৃষ্টি এড়ালো না। তিনি নিজের থেকেই রুদালির সাথে কথা বললেন,
‘আমার মিস্টার। স্ট্রোক করার পর থেকে কথা বলতে পারে না। হাঁটতেও পারে না।’
রুদালির কাছে এবার পুরো বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেলো। সে হাসার চেষ্টা করে বললো,
‘ওঁ।’
বৃদ্ধাও হাসিমুখে বললেন,
‘সম্প্রতি ক্যান্সার ধরা পরছে। লাস্ট স্টেজ। চিকিৎসা করাইয়াও লাভ নাই।’
রুদালি বিস্মিত চোখে বৃদ্ধাকে দেখছে। কত স্বাভাবিক ভাবেই না তিনি কথাগুলো বলছেন! কোনো রকম জড়তা ছাড়া। রুদালি জিজ্ঞেস করলো,
‘এই অবস্থায় উনাকে নিয়ে কক্সবাজার আসলেন, ডাক্তার কিছু বলে নি?’
বৃদ্ধা বিস্মিত কন্ঠে উত্তর দিলো,
‘না। ডাক্তার কি বলবে? এমনিতেও দয়াল তারে যেকোনো সময় ডাক দিবে। বিয়ার রাতে উনি আমার হাত ধরে বলছিলেন। মৃত্যুর আগে আমার সাথে একবার সমুদ্র দেখার খুব ইচ্ছা তার। সেই ইচ্ছাই পূরণ করতে কক্সবাজার নিয়া আসলাম।’
‘আপনার ছেলে মেয়ে কেউ নেই?’
‘আছে।’
‘তারা কোথায়?’
‘ঢাকা।’
‘এই বয়সে আপনাদের দুজনকে একা এতদূর আসতে দিলো?!’
বৃদ্ধা বললেন,
‘আসতে দিতে চায় নাই। জোর কইরাই আসছি। বিয়ার রাতে হাত ধইরা তাকে কথা দিছি না? সেই কথা কি অমান্য করা যায়?’
উত্তর শুনে রুদালি চুপ করে রইলো। বৃদ্ধা হাসিমুখে বললেন,
‘আপনি কার সাথে আসছেন?’
‘হাজবেন্ডের সাথে।’
‘ভালো। বেশ ভালো। আমি যাই। তারে আরেকটু ঘুরাইয়া আনি।’
রুদালি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। বৃদ্ধা তার স্বামীর হুইল চেয়ারে ধাক্কা দিয়ে ধীরগতিতে সমুদ্রতীরে হাঁটতে লাগলো। এরকম সুন্দর একটি দৃশ্য দেখে রুদালির চোখ কেনো জানি ঝাঁপসা হয়ে এলো। আঁচল দিয়ে চোখের কোণা মুছে সে বৃদ্ধা এবং তার স্বামীর চলে যাওয়া দেখতে লাগলো।
এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে অর্ণবের আগমন। ঝালমুড়ির একটি ঠোঙ্গা রুদালির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
‘আর বলো না। এত ভীড়! বিচের অর্ধেক মানুষ মনে হয় ঝালমুড়ি কিনতেই এসেছে।’
অর্ণবের কথায় রুদালি মুচকি হাসলো।
‘বেশি দেরী করে ফেললাম কি?’
‘না। ঠিক আছে।’
অর্ণব চুপ করে ঝালমুড়ি খেতে লাগলো। মুখ দিয়ে ‘উমমম’ জাতীয় শব্দ করে বললো,
‘অনেক মজা। খেয়ে দেখো।’
রুদালি ঝালমুড়ি খেলো না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,
‘আমি সমুদ্রে নামতে চাই।’
অর্ণব খাওয়া বাদ দিয়ে ভ্রুঁ কুচকে বললো,
‘তোমার না ফোবিয়া আছে? পানিতে ভয় পাও?’
‘ভয় পেলে আমাকে শান্ত করার জন্য আপনি আছেন তো।’
অর্ণব নিচে বালুর দিকে তাঁকিয়ে হাসলো। তারপর স্নিগ্ধ চোখজোড়া তুলে রুদালির দিকে তাঁকিয়ে বললো,
‘ঠিকাছে। চলো।’
রুদালি নিচু স্বরে বললো,
‘আরেকটা কথা।’
‘কি?’
‘আমার হাত ধরতে হবে কিন্তু!’
‘হাত ধরবো?’
‘হুঁ। একা সমুদ্রে নামার সাহস আমার নেই। তাছাড়া বন্ধুর হাত ধরা যেতে পারে। এটা অন্যায় নয়।’
অর্ণবের ঠোঁটের কোণে হাসি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রুদালির গালেও কিছুটা লজ্জমিশ্রিত হাসির রেখা।
দুজন মানুষের ছায়া সৈকতের বালুতে লম্বালম্বি ভাবে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ছায়া দুটো হাত ধরাধরি করে সুনীল জলরাশিতে পা ভেজাতে এগিয়ে যাচ্ছে। সূর্য অর্ধেক হারিয়ে গেছে সমুদ্রের মাঝে। রুদালির পায়ে শীতল পানি এসে স্পর্শ করলো। সে খানিকটা কেঁপে উঠলো। মনের অজান্তেই অর্ণবের হাতে বেশ শক্ত করে ধরলো। তার নিশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে অস্ফুটবাকে অর্ণবও বলে উঠলো,
‘মৃত্যুর আগেও যেনো একবার তোমার হাত ধরে ঠিক এভাবেই সমুদ্র দেখতে পারি।’
অর্ণবের কথায় রুদালি খানিকটা চমকে উঠলো। অজানা এক অনুভূতি গ্রাস করে ফেললো তাকে। এই অনুভূতি তার কাছে একদম নতুন।
(চলবে…)
লিখা: আতিয়া আদিবা