#আলো_আঁধার
পর্ব ঃ- ০৩
~আঁখি দেব তৃপ্তি
রান্না-বান্না শেষ করে কাপড়-চোপড় গোছাতে গোছাতে দুপুর ১২ টা বেজে গেল। এদিকে জল অনবরত পড়েই যাচ্ছে তনিমার চোখ থেকে। এটাই হয়তো এ বাড়িতে তার শেষ রান্না। আচ্ছা বিজয় কী সত্যি সত্যি ওদের ছাড়া থাকতে পারবে। হয়তো দুইদিন পর ঠিকই আবার ফেরত আনতে চাইবে। কিন্তু যদি এমন না চায় তাহলে? এসব কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে তনিমার মাথায়। যাই হোক নিজের মেয়েকে একা ছাড়তে পারবে না কখনো সে।
১২ঃ৩০ মিনিটে গাড়ি চলে আসলো। সকালে তনিমা যখন তার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল তারপর থেকে বিজয় আর কোনো কথা বলে নি তনিমার সাথে। সোজা বলে দিয়েছিল” আমার কথা যখন মানতে পারবে না চলে যাও বাবার বাড়ি। আমার কাছে আমার মা ইম্পর্ট্যান্ট। ”
সকাল থেকে শাশুড়ীর মনও বেশ ভালো বুঝা যাচ্ছে। যাক অবশেষে উনার ইচ্ছে পূর্ণ হয়েছে। আর কেউ উনাকে জ্বালাবে না। কিন্তু উনি এতোদিন আলো সম্পর্কে যা যা বলে এসেছেন তা কী সত্যি ছিল নাকি আমাদের তাড়ানোর একটি ফন্দি মাত্র?
ঘর থেকে বাইরে পা রাখতে গিয়ে শরীর কেঁপে উঠল তনিমার। চোখ বুলাতে লাগলো চারপাশটায়। এতোদিন ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা তার সাজানো সংসার নিমিষেই পর হয়ে গেল! যতপা সামনে এগুচ্ছিলো ততই শরীর অবশ হয়ে আসছিল। বাসার সামনের একপাশে ফুলের বাগান আর অন্যপাশে সবজির। সব ফুলগাছই তনিমার নিজের হাতে লাগানো। বাগানের মাঝখানে একটি বসার জায়গাও আছে। জায়গাটা বেশ পছন্দের বিজয়ের। প্রায় দিন সকালেই পত্রিকা হাতে এখানে এসে বসতো আর তনিমাকে এখানে এনেই চা দিতে হতো বিজয়কে। চা দিয়ে আসার সময় বিজয় হেসে হেসে বলতো ” অসংখ্য ধন্যবাদ তোমায় হে প্রিয়তমা। আমাকে এতো সুন্দর একটি পরিবেশ উপহার দেবার জন্য। ” সেই দিনগুলো আজ শুধুমাত্র স্মৃতির এক ঝরা পাতা!
নিজের মনকে শক্ত করে গাড়িতে উঠে বসলো তনিমা। বিজয়কে এবার ঘর থেকে বাইরে আসতে দেখা গেলো। ড্রাইভারকে ভাড়া দিল এসে বিজয় আর বললো সাবধানে যেতে। তারপর তনিমার সাথে কথা না বলেই ফিরে যেতে শুরু করলে তনিমা বলে উঠলো –
“নিজের খেয়াল রেখ। ”
কোনো উত্তর দিল না বিজয়। সোজা হেটে ভেতরে চলে গেলো।
শহর থেকে ২০ কি.মি. দূরের একটি গ্রামে তনিমার বাবার বাড়ি। তনিমার বড় ভাই, ভাইয়ের বউ, ছেলে, মেয়ে আর বাবা মাকে নিয়ে ওদের সংসার। একসময় তনিমার বাবার বেশ ভালো অবস্থা ছিল। ছেলেমেয়েকে শহরে রেখে লেখাপড়া করিয়েছেন। তনিমার একটি বেসরকারি অফিসে চাকরিও ছিল বিয়ের আগে কিন্তু বিজয় চায়নি তনিমা চাকরি করুক তাই সে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু তনিমার ভাই তেমন কিছুও জোটাতে পারে নি। তারপর বিদেশে যাবে বলে বাবার কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা এনে দালালের হাতে ধরা খেয়ে সব হারালো। সেই ক্ষতিপূরণটা ভালোভাবে কাটিয়ে উঠতে পারে নি তনিমার পরিবার। তাও তাদের পুরোনো ব্যবসা দিয়ে মোটামুটি চলে যায় ভালোই। তনিমার হঠাৎ এভাবে মেয়েকে নিয়ে ওদের পরিবারে উপস্থিতির পর কি হবে? ওরা তনিমাকে কীভাবে গ্রহণ করবে তা বুঝতে পারছে না তনিমা। এ নিয়ে ভীষণ চিন্তা হচ্ছে তার। কিন্তু মনে এই বিশ্বাসও জাগছে যে বিজয় ঠিক দুদিন পর ওদের ফিরিয়ে নিতে আসবে।
২ ঘন্টা জার্নির পর গন্তব্যে পৌঁছল তনিমা ও তার মেয়ে। তনিমার এমন হঠাৎ উপস্থিতিতে বেশ অবাক হলেন বাড়ির সবাই। তনিমাদের বড় বাড়ি। সবাই গাড়ির কাছে এসে ভীড় জমালো। সবাই বাচ্চা দেখতে চাইছে কিন্তু তনিমা চাইছে না এখনি সবাই আলোকে দেখুক। দেখেই তো নানান কথা শুরু করে দিবে। তনিমা অস্বস্তিতে পড়েছে সেটা ওর বাবা বুঝতে পেরে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন-
“কী শুরু করলে তোমরা সবাই। মেয়েটা এতোদূর থেকে এসেছে আগে ঘরে যেতে দাও। আমার নাতনির মুখ কী রাস্তায় দেখবে নাকি। আগে মিষ্টিমুখ করাবো তারপর দেখাবো। দেখি সরতো সবাই।”
একথা বলতেই সবাই সরে গেলো। তনিমা আলোকে শাড়ির আঁচল দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে গাড়ি থেকে নেমে ঘরে গিয়ে ঢুকলো। ঘরে ঢুকতেই তনিমার মা আলোকে টেনে নিজের কাছে নিতে নিতে বললেন-
“দেখিতো আমার সোনাটা কেমন দেখতে হয়েছে। যেতেও পারি নি ওকে হাসপাতালে দেখতে। আর তুইও যে কী হাসপাতালে যেতে না করলি এখন আবার হুট করে কাউকে কিছু না জানিয়ে এখানে চলে এলি?”
“মা আস্তে আস্তে সব বলবো। আলোকে দাও পড়ে দেখবে।”
তনিমার মা ওর কথা না শুনে আলোর মুখ থেকে টায়েল সরাতেই চমকে উঠে বললেন।
“এ কী রে তনিমা? এ কার বাচ্চা? ”
“আমার মা।”
“কী বলছিস এসব তুই এতো কালো মেয়ে তোর কী করে হতে পারে? এর দিকে তো তাকানোই যাচ্ছে না।”
“ইচ্ছে না হলে তাকিও না।”
“এ কী সর্বনাশ হয়ে গেলো গো।”- বলে তনিমার মা কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। সাথে সাথে সবাই ছুটে এলো ঘরে। বাচ্চাকে দেখে নানান ধরনের কথা বলতে শুরু করলো।
তনিমার বাবা ভীর ঠেলে ভেতরে গিয়ে বাচ্চাকে দেখে উনিও চমকে গেলেন। তারপর এ অবস্থা সামাল দেবার জন্য সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে দরজা আটকে দিয়ে তনিমাকে জিজ্ঞেস করলেন-
” এসব কী মা?”
তনিমা সবকিছু কাঁদতে কাঁদতে তার বাবাকে খুলে বললো।
সবকিছু শুনে তনিমার বাবা মেয়েকে শান্তনা দিয়ে বললেন -” চিন্তা করিস না মা। সবই উপরওয়ালার ইচ্ছা। উনি যা করেন ভালোর জন্যই করেন। ধৈর্য রাখ সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমি নিজে গিয়ে জামাই ও বেয়ানের সাথে কথা কথা বলবো এ বিষয়ে।”
“না বাবা তার কোনো প্রয়োজন নেই। দেখি ও আমাকে ছাড়া কীভাবে কতোদিন থাকতে পারে। আমার বিশ্বাস ও ঠিকই দুদিন পর আমায় নিজে নিতে আসবে।”
” এরকম হলে তো ভালোই। আচ্ছা চিন্তা করিস না তোর এই বাপ যতদিন আছে তোর কোনো সমস্যা হতে দিবে না। তোর মেয়েকেও কেউ কিছু বলার সাহস করবে না। স্রষ্টার সকল সৃষ্টিই সুন্দর। ”
তারপর বাবার বাড়িতে ভালোই সময় কাটাতে লাগলো তনিমার। বাবার ভয়ে তনিমার সামনে বাচ্চা সম্পর্কে কেউ কিছু না বললেও পিছনে ঠিকই নানান রকম কথা হতো। অনেক সময় তনিমা এসব শুনেও না শুনার ভান করে চলে যেত। তনিমা দিন গুনতো বিজয়ের অপেক্ষায় কিন্তু বিজয় আসা তো দূরের কথা একটা বার ফোনও করলো না তনিমাকে। একপর্যায়ে তনিমা আর রাগ করে থাকতে না পেরে নিজেই ফোন দিল বিজয়কে। কিন্তু অপর পাশ থেকে কেউ কল রিসিভ করলো না। তনিমার আজ নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। সে আবারও ডায়েল করলো বিজয়ের নাম্বার।
#আলো_আঁধার
পর্ব ঃ- ০৪
~আঁখি দেব তৃপ্তি
৪ বার ডায়েল করার পরও কেউ ফোন রিসিভ করলো না। রাতের বেলা আবারও ফোন দিল তনিমা। ২ বার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ করলো বিজয়।
“হ্যালো ”
“কেমন আছো?”
“ভালো।”
“দিনে এতোবার কল দিলাম ব্যাক করার প্রয়োজন মনে করলে না।”
“ব্যস্ত ছিলাম।”
“ও, আমাদের কী একবারও মনে পড়ে না তোমার।”
” এসব এখন জিজ্ঞেস করার মানে কী? যাবার সময় মনে ছিল না?”
“আলো আমাদের মেয়ে বিজয়। ওর জন্য খারাপ লাগে না তোমার?”
“না। তোমাকে আমি একটা শেষ সুযোগ দিতে চাই।”
“কী?”
“ফিরে এসো।”
“সত্যি! “- খুশিতে আপ্লূত হয়ে বললো তনিমা।
” হুম। তবে তোমার ওই মেয়েকে ছাড়া। ”
“মেয়েকে ছাড়া মানে?”
“মেয়েকে তোমার বাবার বাড়িতে রেখে আসতে পারো।”
“বিজয় তুমি আবারও? ”
“হুম। আমার এই একটাই কথা। যদি আমার সাথে সংসার করতে চাও ওই মেয়েকে তোমার ছাড়তেই হবে। আমি তোমাকে ১ মাসের সময় দিলাম। সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিও।”
“আমি যদি না যাই তো?”
“আমি পরবর্তী স্টেপ নিতে বাধ্য হবো।”
“কী স্টেপ?”
“ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিব।”
“কী!”
“এতো কথা বলার সময় নেই রাখি।” – বলে কল কেটে দিল বিজয়।
তনিমা দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। বিজয়ের কথা শুনে দপ করে বসে পড়লো বিছানায়। সারা শরীর কাঁপছে তার। মাথা ঘুরছে। হঠাৎ ঠাস করে পড়ে গেল বিছানায়।
কিছু একটা পড়ার শব্দ শুনে সবাই ছুটে এলো তনিমার রুমে। এসে দেখলো তনিমা পড়ে আছে। তনিমার মা পানি ছিটিয়ে দিলেন মেয়ের চোখে মুখে। আস্তে আস্তে চোখ খুললো তনিমা। তারপর সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়েই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
“কী হয়েছে মা? এরকম করছিস কেন? বল আমাকে। “- তনিমার বাবা।
” সব শেষ হতে বসেছে বাবা। এখন আমি কী করবো? ”
“কী হয়েছে বল আগে।”
“বিজয় বলেছে ১ মাসের মধ্যে আমি যদি আলোকে ছেড়ে ওর কাছে না যাই তাহলে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে।”
“কী? এতো বড় কথা। ওরা ভেবেছে কী নিজেকে? যা ইচ্ছে করে যাবে আর আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবো? তুই একদম চিন্তা করিস না আমি কালই যাবো তোর শ্বশুর বাড়িতে। ”
” জোর করে কিছু করে কী লাভ বাবা। আমি তো ওর মন থেকেই উঠতে বসেছি। জোর করে কী মন ফেরানো যায়।”
“যাই হোক এসব কাজের হিসাব ওদের দিতেই হবে।”
পরের দিন সকালবেলাই তনিমার বাবা ওর শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে দিলেন। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়ে গেল।
ড্রয়িংরুমে বসে আছেন তনিমার বাবা। বিজয়ের মা ভেতর থেকে চা নিয়ে আসলেন।
“কী খবর বেয়াই? কিছু না জানিয়ে হঠাৎ এখানে। ”
“আপনারাই আসতে বাধ্য করলেন।”
“আমরা কী করলাম?”
“আপনারা আমার মেয়ের সাথে কী শুরু করেছেন?”
“দেখুন আমরা যা বলার সোজাসাপ্টা বলেছি। আমরা তো বলেছি তনিমাকে এখানে চলে আসতে। ওই বাচ্চা নিয়েই তো যত সমস্যা। ওকে তো আপনারা রেখে দিতে পারেন। এতে আপনার মেয়ের ঘরও বেঁচে যাবে।”
“নিজের বংশের সন্তানকে আপনি এভাবে কীভাবে অস্বীকার করতে পারেন?”
“ও আমাদের কেউ না। ওর মধ্যে অশুভ ছায়া আছে। ও আমাকে মেরে ফেলবে এখানে আসলে।”
“এসব আপনার বানানো মনগড়া কথা। জামাই কোথায় ওকে ডাকুন। আমি ওর সাথে কথা বলবো।”
“আচ্ছা ডাকছি তবে ও একই কথা বলবে।”
“এর পরিণাম কী হতে পারে আপনারা কী ভুলে যাচ্ছেন? দেশে কী আইন আদালত নেই?”
“ওসব ভয় আমাদের দেখিয়ে লাভ নেই বেয়াই। আমার ছেলে খাসা আইনজীবী ও সব সামলে নিবে।”
মহিলার কথার ধরণ দেখে অবাক হলেন তনিমার বাবা। মনে হচ্ছে যেন এটাই উনি চান সংসারটা ভেঙে যাক। তারপর বিজয় এলো কিন্তু সেও তার মায়ের মতো একই কথা বললো। বিজয়ের কথা শুনে রাগে মাথা গরম হয়ে গেল তনিমার বাবার। বেড়িয়ে এলেন ওদের বাড়ি থেকে। এখন কী করবেন কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না উনার।
বাড়িতে ফিরে তনিমার মায়ের সাথে সবকিছু আলোচনা করার পর তনিমার মা বললেন-
“মেয়ের সংসার বাঁচানোটা আগে প্রয়োজন। আলোকে না হয় আমরাই রেখে দিলাম। এভাবে তো আর মেউএর সংসার নষ্ট হয়ে যেতে দেখতে পারি না।”
“তনিমা কী এতে রাজি হবে?”
“ওর সাথে আমি কথা বলবো।”
“আচ্ছা বলে দেখো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না কী করা উচিত। তনিমা যা চায় তাই হবে।”
তনিমার মা মেয়ের ঘরে গিয়ে আস্তে আস্তে মেয়ের পাশে বসলেন। তনিমা আলোকে ঘুম পাড়াচ্ছিল।
“তোর সাথে কিছু কথা ছিল।”
“বলো।”
“তুই বরং এখন তোর শ্বশুর বাড়িতে চলে যা।”
“আর আলো? ”
“আমরা তো আছি ওকে দেখে রাখবো।”
“এ সম্ভব নয় মা।”
“কেন সম্ভব নয়? তুই কী চাস তোর ঘর ভেঙে যাক।”
“তা চাই না কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের মেয়েকে স্বীকার করে না কালো বলে। যে স্ত্রীকে পাগলের মতো ভালবাসতো তাকে মেয়ে কালো হওয়ার জন্য সন্দেহ করে। এরকম নীচ মানসিকতার কারো সাথে আমি থাকতে পারবো না।”
“ঠান্ডা মাথায় একটু ভেবে দেখ মা। তুই গিয়ে আস্তে আস্তে নাহয় বিজয়কে সবটা বুঝাবি তারপর সে হয়তো আলোকেও নিতে রাজি হবে।”
“সে হবে না মা। আমার ওকে চিনা হয়ে গেছে।”
“তাও তুই আবার ভালোকরে ভেবে দেখ। তোর ভবিষ্যৎ কী হবে? কীভাবে কাটাবি তুই সারাজীবন। ”
“কিন্তু মা..”
“এখন ঘুমা। কাল কথা হবে আর এ বিষয়ে। আর যা বললাম ভেবে দেখিস।”