আলো-আঁধার পর্ব-৩০

0
921

#আলো-আঁধার🖤
#লেখিকা:সালসাবিল সারা

৩০.
রিহানার ব্যাপারটায় তূর্যয়ের মনকে বিষিয়ে তুলেছে।অনেক মেয়েই তূর্যয়ের কাছাকাছি আসতে চেয়েছিল সব সময়।কিন্তু তূর্যয়ের বাজে ব্যাবহার আর ঘাড় ত্যাড়ামোর কারণে কেউ তার কাছে ঘেষতেই পারতো না।কমিশনারের মেয়ে হওয়াতে তূর্যয় রিহানার কোনো বেহাল দশা করেনি।সাথে সে রাণীর ব্যাপার নিয়েও বেশ ভাবছে।তূর্যয়ের ধারণা,রিহানা বেশ সাহসী একজন মেয়ে।তূর্যয়ের প্রতি রিহানার ভালোবাসা বেশ কঠিন পর্যায়ে চলে গিয়েছে,নাহলে রিহানা কোনো ভাবেই সাহস পেতো না তূর্যয়ের সামনে এসে এতো কথা বলার। কমিশনারকে অনেক শ্রদ্ধা করে তূর্যয়। যার কারণে রিহানার ক্ষতি করেনি সে।তূর্যয় আজ নিজের অফিসে কমিশনারকে ডাকিয়েছে।এই নিয়ে কমিশনারের চিন্তার শেষ নেই।কারণ,তূর্যয় সাধারণত কমিশনারকে তার অফিসে ডাকে না।তূর্যয় নিজের কেবিনে বসে তার কিছু অফিসিয়াল হিসাবের কাজ করছে।রাণী একটু আগেই তূর্যয়কে সেই ফাইলগুলো দিয়ে গিয়েছিল।তূর্যয়ের মুখে বিরক্তিভাব দেখে রাণী কিছুই জিজ্ঞেস করেনি তূর্যয়কে। এইসবের সাথে তূর্যয় দিন রাত ভাবছে,কিভাবে তার রৌদ্রকে দ্রুত নিজের করে নিবে। ফাইল এর হিসাব মিলিয়ে তূর্যয় চোখ বন্ধ করে কিছু একটা পরিকল্পনা করছে।তূর্যয় সিদ্ধান্ত নিলো, আজ সে কমিশনারকে বুঝাবে; রিহানাকে যেনো উনি দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়। কারণ রিহানাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে এত সহজে সে তূর্যয়ের পিছু ছাড়বে না।রিহানা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করলে তূর্যয় রিহানাকে কঠিন শাস্তি দিবে,এমনটাই ভেবে রেখেছে সে।তাই রিহানাকে সে একটা সুযোগ দেওয়ার জন্যেই আজ তূর্যয় কমিশনারকে ডাকিয়েছে। তূর্যয় ফাইল বন্ধ করে নিজের কপালে আঙ্গুল ঘষছে।এরমধ্যেই কেউ দরজায় টোকা দিলে তূর্যয় ভেতরে আসার পারমিশন দিলো। কমিশনার তূর্যয়ের কেবিনে ঢুকে হাত দেখালো তূর্যয়কে।তূর্যয় চোখের ইশারা করলো কমিশনারের দিকে তাকিয়ে। ইশারায় তূর্যয় কমিশনারকে বসতে বললো।কমিশনার বসে পড়লো তূর্যয়ের টেবিলের সামনে থাকা চেয়ারে।কমিশনারের পেছনে উনার দুইজন গার্ড দাঁড়িয়ে আছে।তূর্যয় চেয়ার সোজা করে টেবিলে হাত রেখে কমিশনারকে বললো,
–“একান্তই কথা বলতে চাচ্ছি।”
কমিশনার তূর্যয়ের কথাটি বুঝতে পেরে গার্ডদের
নির্দেশ দিলো,
–“বাহিরে গিয়ে দাঁড়াও তোমরা।”
কমিশনারের কথায় সেই দুইজন গার্ড তূর্যয়ের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।
কমিশনার তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো।এরপর উনি তূর্যয়কে বলে উঠলেন,
–“হঠাৎ ডাকিয়েছো?উম,জরুরী কিছু না হলে তো ডাকাতে না।তো বলো কি হয়েছে?”
–“অবশ্যই জরুরী। তবে আমার জন্য না, আপনার মেয়ের জন্য।”
তূর্যয়ের কড়া জবাব।
কমিশনার নিজের চশমায় হাত রেখে বললো,
–“রিহানার জন্যে জরুরী?কি করেছে সে?”

তূর্যয় এইবার চেয়ারে হেলান দিলো। দুই পাশে চেয়ার দুলানো অবস্থায় সে কমিশনারকে জিজ্ঞেস করলো,
–“নিজেই আমার অফিসের ঠিকানা দিয়েছেন আর আপনিই জানেন না? কার সাথে গেইম খেলতে বসে আছেন?”
কমিশনার এইবার একটু ঘাবড়ে গেলো তূর্যয়ের প্রশ্নে।উনি আমতা আমতা করে তূর্যয়কে বলতে লাগলো,
–“ইয়ে মানে,আমি শুধু তাকে ঠিকানা দিয়েছিলাম তোমার অফিসের।কিন্তু সে কেনো খুঁজেছে আমি জানিনা।কি করেছে রিহানা?”
–“আমার অফিসে এসে ঝামেলা করতে চেয়েছে।ভাগ্য ভালো আপনার কথা ভেবে আমি কিছু করিনি তাকে।কিন্তু,ব্যাপারটা আমার বাড়াবাড়ি বলে মনে হলো।নিজের মেয়েকে বাইরের কোনো দেশে পাঠিয়ে দিন।এরপরের বার আমার সামনে এলে এই মেয়েকে আমি খুন করে দিবো।কারণ,তূর্যয়ের জীবনে ঝামেলা সৃষ্টি করা কাউকেই তূর্যয় জীবিত রাখে না।”
তূর্যয়ের সোজা উত্তর।
কমিশনার ভয়ের সাথে একটু রেগে উঠলো।উনি বেশ রাগী কণ্ঠে তূর্যয়কে বললো,
–“তূর্যয়!আমার সামনে, আমার মেয়েকেই খুন করবে বলছো তুমি?”
তূর্যয় হাত দেখালো কমিশনারকে।তূর্যয়ের চোখে ভয়ংকর রাগের দেখা মিলছে।কমিশনার চুপ হয়ে গেলেন।তূর্যয় এইবার বলে উঠলো,
–“আমার অফিসে আমি ছাড়া কারো গলা উঁচু হয় না। শুধু অফিসে কেনো আমার সামনে কেউই গলা উঁচু করে কথা বলতে পারেনা। আমি এই পারমিশন কাউকে দিইনি। এই যে আপনি এখন বলেছেন জোরে কথা, এতে আমি আপনাকে ছাড় দিলাম। কারণ নিজের মেয়ের ব্যাপারে কেউ খুন করার কথা বললে, যে কারোই খারাপ লাগা স্বাভাবিক।কিন্তু আপনি তো আমাকে চিনেন।আমি যায় বলি তাই করি।আপনার মেয়ে আমার ব্যাক্তিগত জীবনে আসার চেষ্টা করছে।যেটা আমার মোটেও পছন্দ না।আপনার মেয়ে বিধায় সে এখনো বেঁচে আছে।এখন আপনার চয়েস,কি করবেন আপনার মেয়েকে?”
কমিশনার নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।কমিশনার নিজের মেয়েকে মেরে ফেলার কথা শুনে চিল্লিয়ে উঠলো ঠিকই, কিন্তু পরক্ষণে তূর্যয়ের জবাব শুনে কমিশনার একদম মিইয়ে গেল।কমিশনার বেশ জানে,তূর্যয় ঠিক কতটা হিংস্র!কমিশনার নিজের মেয়েকে নিয়েও চিন্তিত।তাই নিজের মেয়ের স্বার্থে তূর্যয়কে কমিশনার হাত জোড় করে বলে উঠলো,
–“একজন মেয়ের বাবা হয়ে বলছি,আমার মেয়েকে বিয়ে করে নাও।আমার মেয়ে সত্যি ভালোবাসা তোমাকে।”
তূর্যয় নিজের হাতটা দুইবার নাড়িয়ে বিরক্তি নিয়ে কমিশনারকে বললো,
–“আহহ,থামুন।আমার এইসব শুনতে মোটেও ভালো লাগছে না।আমার শেষ কথা হলো,আপনার মেয়েকে বাহিরের দেশে পাঠিয়ে একটা ভালো জীবন দিন।নাহলে আমার হাতেই মরবে সে।এখন আপনার উপর সব।আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকবো।আপনি আমাকে বেশ ভালোই চিনেন।”
কমিশনার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।চেয়ার থেকে উঠে উনি তূর্যয়কে আশ্বাস দিলো,
–“ঠিক আছে।আমি রিহানাকে বাহিরের দেশে পাঠিয়ে দিবো।”
তূর্যয় মাথা নেড়ে বললো,
–“গুড।”
মন খারাপ করে কমিশনার তূর্যয়ের কেবিন থেকে চলে গেলো।টেবিলের উপর গ্লাসে রাখা পানি এক চুমুকেই খেয়ে নিলো সে।রিহানার ব্যাপারটা শেষ হবে,এটা ভাবতেই রাণীর জন্যে নিশ্চিন্ত হলো তূর্যয়।নিজের খারাপ সে মেনে নিতে পারলেও,রাণীর প্রতি কোনো ভুল কিছুতেই সে মেনে নিতে পারে না।তাই,সব সময় রাণীর জন্যে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করে তূর্যয়।মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে তূর্যয় ল্যাপটপ চালু করে তার কাজে মন দিলো।
;
আজ অফিসের কাজ জলদি শেষ হওয়াতে রাণী তার দোকানে একটু দ্রুত যেতে পারলো।প্রত্যেকদিন একটুর জন্যে হলেও সে দোকানে আসে।রাণী সন্ধ্যার দিকে দোকান বন্ধ করে দেয়।দোকান থেকে এতিম খানায় যাওয়ার আগ পর্যন্ত রাণীর জন্যে ঠিক করা গার্ড,ফরহাদ তাকে ফলো করে।রাণী এতিম খানার ভেতরে গেলে সেই খবর সে তূর্যয়কে দেয়।এরপরই তূর্যয় নিশ্চিন্তে থাকে।তাছাড়া তূর্যয় রাণীকে নির্দেশ দিয়েছে,রাতের বেলা যেনো রাণী এতিম খানা থেকে বের না হয়।তূর্যয়ের ভয়ে রাণী তূর্যয়ের এই কথা পালন করবে বলে ওয়াদা করলো তূর্যয়কে।রাণী যেনো কিছু সময় তার দোকানে কাটাতে পারে,তাই তূর্যয় এখন অনেক সময় রাণীকে মিশনে নিয়ে যায় না।তাছাড়া যেসব মিশন অনেক ভয়ংকর এইসব মিশনে রাণীর যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না।হ্যারি নিজেই রাণীকে তার দোকানে দিয়ে আসে।হ্যারি রাণীকে বোন ভাবে বিধায় এই ব্যাপারে কেউ তেমন একটা মাথা ঘামায় না।কিন্তু,হ্যারির এমন কাজের পেছনেও রয়েছে তূর্যয়ের অবদান।রাণী আজ দোকানে জলদি ফেরার কারণে অনেক কাস্টমারকে সে নিজেই সামলিয়েছে।এর জন্যে রাণী বেজায় খুশি।দোকানের কাজ শেষ করে রাণী তার বান্ধবীদের সাথে এতিম খানায় চলে এলো।হালকা নাস্তা করে রাণী ছাদে উঠলো,মাটির তৈরী কিছু জিনিস বানাতে।রাণী মনে মনে ভেবে নিয়েছে,আর যায় কিছু হোক তূর্যয়কে সে নিজের মনের কথা জানিয়ে দিবে অতি শীঘ্রই।রাণীর কেনো যেনো আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করছে না।একটু পরেই ছাদে এলো সালেহা।সালেহাকে দেখে রাণী মুচকি হাসলেও তূর্যয়ের বলা কথাগুলো রাণীর মাথায় ঘুরছে।রাণী সালেহার সাথে কথা বলার জন্য এতদিন একটা ভালো সুযোগের অপেক্ষা করছিলো। আর আজই রাণীর কাছে এই সুযোগটা বেশ ভালোই মনে হলো।সালেহা রাণীর পাশে বসে নানা আলোচনা করতে লাগলো। এইসব কথার মাঝেই হঠাৎ করে রাণী সালেহাকে বলে উঠলো,
–“তূর্যয়ের মা, আপনার অনেক ভালো বান্ধুবি ছিলো। তাহলে কেনো উনার মৃত্যুর দিনেও আপনি তাকে দেখতে যাননি? কি হয়েছিল আপনাদের মাঝে?”
সালেহার মাথায় যেনো বাজ পড়লো।সালেহা অবাক হয়ে রাণীকে বললো,
–“তূর্যয় বাবাজি বলেছে এইসব?”
রাণী মাথা নাড়ালো সালেহার প্রশ্নে।সালেহা কান্নায় ভেঙে পড়লো। রাণী হাত মুছে সালেহার কাঁধে হাত দিয়ে বললো,
–“ম্যাডাম প্লিজ কান্না করবেন না।আমাকে সব বলুন প্লিজ।”
সালেহা শাড়ীর আঁচলে চোখের পানি মুছে রাণীকে জবাব দিলো,
–“অর্ধেক সত্য যখন জেনেছিস তাহলে পুরোটাই শুনে নে আমার থেকে।নাহলে আমি কখনোই আমার বুকের এই কষ্টের কথা কাউকে জানাতাম না।তূর্যয়ের মা আমার বেশ ভালো বান্ধবী ছিল।আমরা দুইজন দুইজনকে বোন ভাবতাম।তূর্যয়ের বাবা বেশ ভালো মানুষ ছিল।তূর্যয়ের বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় আমার সাথে হাসানের সম্পর্ক ছিল।হাসানের চরিত্র খারাপ এটা আমার জানা ছিলো আগেই।কিন্তু হাসানের টাকার লোভে আমি সিদ্ধান্ত নিই,আর যায় হোক হাসানকে আমি ছাড়বো না।গরীব ছিলাম,টাকা কি জিনিস হারে হারে চিনতাম।যৌবনে আমি আর তূর্যয়ের মা ছিলাম বেশ সুন্দরী।তবে তূর্যয়ের মা একটু বেশি সুন্দর ছিলেন।হাসান আমাকে ইনিয়ে বিনিয়ে কয়েকবার বলেছিল তূর্যয়ের মায়ের কথা।তখন আমার বেশ রাগ হতো।তূর্যয়ের মা আমাকে মানা করতো হাসানের সাথে আর সম্পর্ক না রাখতে।হঠাৎ একদিন তূর্যয়ের বাবা মারা যায়।তূর্যয়ের মায়ের দুনিয়াটাই যেনো আঁধারে চেয়ে গিয়েছিল।অনেকমাস তূর্যয়ের মা নিজের আয়ত্বে ছিল না।আমি তূর্যয়কে নিজের ছেলের মতো পালন করেছিলাম।তখন আমি বুঝতে পেরেছি,
টাকাওয়ালা জামাই থেকে একটা সচ্চরিত্রবান জামাই অনেক বেশি কল্যাণকর।তাই আমি ঠিক করি,হাসানের সাথে আমি আর সম্পর্ক রাখবো না।তূর্যয়ের মা সেদিন বেশ খুশি হয়েছিল।কিন্তু একদিন!”
সালেহা থেমে গেলো।রাণী সালেহাকে অবাক চোখে প্রশ্ন করলো,
–“একদিন কি?”
–“সেদিন ছিল শুক্রবার।বাহিরে সবার মুখে মুখে একটাই কথা শোনা যাচ্ছিল,হাসান এক বিধবাকে বিয়ে করেছে।এই কথা শুনে আমার প্রথমে অবাক লাগলো না।কিন্তু যখন জানতে পারি তূর্যয়ের মাকেই হাসান বিয়ে করেছে, তখন আমার গায়ে আগুন জ্বলে উঠলো।রাগে আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।এতো বড় বিশ্বাস ঘাতকতা করবে তূর্যয়ের মা,আমি এটা কখনোই ভাবিনি।সুযোগ বুঝে একদিন তূর্যয়ের মাকে হাটে পেয়েছিলাম।ভরা বাজারে আমার সইকে আমি কতো অপমান করেছি!অথচ আমার সই আমাকে কিছু বলেনি।শুধু যাওয়ার সময় আমাকে ভালো থাকতে বলে গিয়েছিল।তার কণ্ঠের অসহায়ত্ব আমি টের পায়নি সেদিন।এরপর বছরের পর বছর যেতে লাগলো।তূর্যয়ের মা বলে কেউ ছিলো আমার জীবনে এটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। ঘরটাও পরিবর্তন করেছিলাম অনেক আগে।তাই ঐপাশের কোনো খবর আমার কাছে আসতো না।তূর্যয়ের মা মারা গিয়েছিল সেটাও আমি জানতাম না।এতো রাগ জমেছিল আমার,তার ব্যাপারে কোনো খবর রাখিনি সেদিনের পর।মনে মনে আমার বেশ কষ্ট লাগতো, তূর্যয়ের মাকে বেশ মনে পড়তো।কিন্তু জিদের কারণে কখনো খতিয়ে দেখিনি আমি।এরমধ্যে মাঝে মাঝে তূর্যয়কে রাস্তা ঘাটে দেখতাম।প্রচুর ঘৃণা লাগতো আমার তূর্যয়কে দেখে।কখনো দেখা দিইনি আমি ওকে।একদিন মোল্লা সাহেব,আমার জামাই; আমাদের বাড়িতে তূর্যয়কে নিয়ে আসলে বেশ অপমান করি তাকে।আমার এমন জঘন্য ব্যবহার দেখে আমি আর মোল্লা সাহেব দুইজনই অবাক হয়েছিলাম প্রচুর।কিন্তু ক্রোধ মানুষকে অন্ধ করে দেয়।অতঃপর আমার এমন হৃদয়হীন আচরণে মোল্লা সাহেব আমাকে ছেড়ে চলে যান।কিন্তু,
আমাদের খরচ সবটাই উনি পাঠাতেন।এর বছর তিনেক পরে হাসপাতালে গিয়েছিলাম,সেখানে দেখা হয় হাসানের এক পুরাতন লোকের সাথে।উনি আমাকে দেখে আমার সামনে এসে হাউমাউ করে কান্না করে বলেছিলেন,
–‘ অনেক পাপ করছি আমি ঐ হাসানের সাথে মিল্লা।আমারে মাফ কইরা দিও।’
অনেক অবাক হয়েছিলাম তার কথায়। পরে তার কাছে জানলাম হাসান তূর্যয়ের মাকে আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে বিয়ে করে নেয়।তূর্যয়ের মা আমাকে বাঁচাতেই এমন জঘন্য মানুষকে বিয়ে করে।বিয়ের কিছু বছর পরেই নাকি তূর্যয়ের মা মারা যায়।তবে হাসান প্রচন্ড মারতো তূর্যয়ের মাকে।আমার সই কাউকে এই ব্যাপারে কিছুই বলেনি।চুপ করে সহ্য করে নিতো সব।সেদিনই জানলাম আমার সই পৃথিবীতে নেই।বিশ্বাস কর রাণী,এই বুকটা সেদিন খালি হয়ে গিয়েছিল।আল্লাহ্ আমাকে মাফ করবেন কিনা জানিনা কখনো।এমনকি তূর্যয়ের সাথে হওয়া অত্যাচারের কথা আমি সেদিনই জেনেছিলাম। হাসানের এমন কঠিনতম কাজ দেখে ঐ লোকটা চাকরি ছেড়ে দেয়।কিন্তু সে আমাকে জানায়,
তূর্যয়ের মায়ের মৃত্যুর পেছনে হাসানের হাত আছে।যদিও এটা একেবারে শিউর না সে।সেদিনের পর আমার দুনিয়া এলোমেলো হয়ে গেলো।আমার মনটা একেবারে ভেঙে গিয়েছে।তূর্যয় এখন এমন একজনে পরিণত হয়েছে যার সামনে আমি কেউ না।কিন্তু এই ছেলেকে আমার ভুল বোঝাবুঝির কথাটা আমার জানাতে হবে।মোল্লা সাহেবের সাথে রেগে আছি এখনো।উনি কেনো আমাকে তূর্যয়ের কষ্টের কথা জানাননি।মোল্লা সাহেব চান এখন আমাদের সম্পর্ক যেনো ঠিক হয়ে যায়।কিন্তু,
আমি চাই আগে তূর্যয়কে আমি যেনো সবটা জানায়।এরপর আমি মোল্লা সাহেবের কাছে যাবো।তবে,তূর্যয়ের সামনে যাওয়ার শক্তি আমার নেই।”
সালেহা কান্না করে উঠলো।

রাণী সালেহাকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছে।রাণী মনে মনে ভাবছে,
–“এই দানব আপনাকে দেখলে কোনো মতেই আপনার কথা শুনবে না।চিকনা হাসানের এইসব ব্যাপারটা জানাতে হবে আমার তূর্যয়কে।আমার মাকে মারতো ঐ হারামজাদা।এইবার তুই মজা বুঝবি।কি জঘন্য এই হাসান নামক লোকটা!”
রাণী মনে মনে কথাগুলো ভেবে,সালেহাকে বলে উঠলো,
–“আমি উনাকে এই ব্যাপারে বুঝিয়ে বলবো।আপনি চিন্তা করবেন না,ম্যাডাম।”
–“আল্লাহ্ তোর ভালো করুক,রাণী।এই ছেলের মধ্যে থাকা আমি নামক বিষকে তুই কাটিয়ে দে।আমি আবারও তূর্যয়ের ‘সালেহা মা ‘ হিসেবে বাঁচতে চায়।”

রাণী সালেহাকে আশ্বাস দিলো,
–“ইন শাহ্ আল্লাহ্।”
সালেহা চলে গেলো।রাণী মাটিতে হাত দিয়ে এক গভীর ভাবনায় চলে গিয়েছে।বেশ কিছুক্ষণ পরে রাণীর মোবাইল বেজে উঠলে রাণীর হুঁশ ফিরে এলো।রাণী পাশে তাকিয়ে দেখে তূর্যয়ের নাম মোবাইলের স্ক্রিনে ভাসছে।রাণী আবারও হাত মুছে কল রিসিভ করলে অপর পাশ থেকে তূর্যয়ের কণ্ঠ শুনতে পেলো,
–“তোমার অফিস ছুটি কাল।মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী কালকে।বাড়িতে চলে এসো।”
–“বাহ্,অফিসের বস আমাকে নিজেই ফোন করে আসতে নিষেধ করছে?আমি কি অনেক বেশি ভাগ্যবতী?নাকি আমি আপনার কাছে বেশি স্পেশাল।”
রাণীর প্রশ্ন শুনে তূর্যয় নিজের গলায় হাত দিয়ে তাকে বেশ নরম কণ্ঠে জবাব দিলো,
–“দুটোই।”
–“বাহ্,আমার তো জীবন ধন্য হয়ে গেল।”
রাণী হেসে জবাব দিলো।
–“এই হাসিতে কি তোমার বুকের উপর তোমার হাতটা রাখা আছে?”
তূর্যয়ের প্রশ্ন শুনে রাণীর হাসি বন্ধ হয়ে গেলো।রাণী নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে দেখে ঠিকই তার বুকের উপর অন্য হাত রাখা আছে।রাণী প্রায় সময় জোরে হাসলে তার বুকে হাত রাখে।রাণী হালকা ঢেঁকুর গিলে তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“আপনি কিভাবে জানলেন?”
–“তূর্যয়ের রৌদ্রের ব্যাপারে তূর্যয় সব জানে।”
তূর্যয় বিনীত সুরে বললো।
–“ছি,একটা মেয়ের বুকের দিকে তাকাতে কি আপনার লজ্জা করে না?কি খারাপ আপনি!”
কথাটা বলে রাণী নিজেই বোকা বনে গেলো।মুখ ফসকে কখন কি বলে ফেলে রাণী,এটা সে নিজেই বুঝে না। রাণীর কথায় তূর্যয় বাঁকা হেসে জবাব দিলো,
–“আমারই তো তুই।তোর সব দেখার আমার অধিকার আছে।বুক, পেট সবই দেখ..”
তূর্যয়ের কথার মাঝেই রাণী চিল্লিয়ে বললো,
–“ছি,দানব সন্ত্রাসী কোথাকার!একদম চুপ করুন।”
তূর্যয়ের হাসির শব্দে রাণীর বুকটা কাঁপছে।রাণীর মুখে রাগের সাথে সাথে বেশ লজ্জাও দেখা যাচ্ছে।রাণী নিজের বুকের উপর রাখা হাতটা আরেকটু জোরে চেপে তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–“নির্লজ্জ,দানব একটা।কিভাবে হাসছে!তাশরীফ তূর্যয় একটা নির্লজ্জ,নির্লজ্জ!”
তূর্যয় তার হাসির পরিমাণ বাড়িয়ে জবাব দিলো,
–“হ্যাঁ,শুধুমাত্র তোর জন্যে।”
রাণী “ধেত” বলে ফোন রেখে দিলো।গাল জোড়া জ্বলছে তার।রাণীর গলা শুকিয়ে আছে।তূর্যয়ের এইসব কথাবার্তা রাণীর বুকের স্পন্দন বাড়িয়ে দেয় প্রচুর।রাণী বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
–“যতটা হিংস্র উনি,ততটাই নির্লজ্জ।কিভাবে বলেন উনি এইসব কথা?”
রাণী কথাগুলো ভেবে আবারও নিজের কাজে মন দিলো। তবে একটু পর পর তূর্যয়ের কথা মনে আসতেই তার বুকে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
;
সকালে ঘুম থেকে উঠে রাণী তৈরি হয়ে নিলো।তখনই সিমি রাণীকে বললো,
–“তোর সাথে আমাকেও নিয়ে যাবি আজ?হ্যারির সাথে আবারও ঝগড়া লেগেছে।তাই ভাবলাম আমি আজ যাবো তোর সাথে।আজ তো তোদের কাজ নেই কোনো,
হ্যারি থেকে শুনলাম।চল,আজকে আমরা দুইজনই শাড়ী পড়ে যায়।”
রাণী মাথা নেড়ে সিমিকে বললো,
–“আমি এইসব শাড়ীতে নেই।তুই পড়লে পড়তে পারিস।আমার ভাই তোকে দেখে একেবারেই গলে যাবে।”
–“নাহ নাহ,আমি পড়লে তুইও পড়বি।”
সিমি জিদ করলো।
অগত্য রাণীকে শাড়ী পরার জন্যে রাজি করিয়ে নিলো সিমি।দুইজন শাড়ি পড়ে বেরিয়ে পড়লো।তূর্যয়ের বাড়িতে পৌঁছাতেই রাণী দেখলো বেশ কিছু হুজুর।হ্যারি তাদের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে।সিমিকে দেখে হ্যারি বেশ বিরক্ত হলো।তাও সে সিমি আর রাণীকে বাসার ভেতরে যেতে বললো। কেনো যেনো হ্যারির এখন সিমিকে কম ভালো লাগছে।সিমির ব্যাপারে হ্যারি কিছু একটা আন্দাজ করতে পারে।কিন্তু বুঝে উঠতে পারে না। কাল সিমি হ্যারিকে দেখা করতে বলেছিল।হ্যারি তূর্যয়ের মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীকে কাজে লাগিয়ে সিমিকে মানা করে দেয়।কিন্তু সিমি এইখানে আসবে এটা হ্যারির কল্পনার বাইরে ছিলো।
সিমি অবাক হয়ে তূর্যয়ের বাড়ি দেখছে।তারা একটা ভেতরকার রুমে বসেছে।একটু পরে হ্যারি এসে রাণীকে বাহিরে ডেকে নিয়ে গেলো।সিমিকে বসতে বলে রাণী রুমের বাহিরে চলে গেলো হ্যারির সাথে।

–“সিস,এই মেয়েকে কেনো এনেছো?”
হ্যারির প্রশ্নে রাণী হ্যারিকে বললো,
–“ভুল বোঝাবুঝি ছেড়ে দিন।নিজেদের সব মিটমাট করে নিন।”
রাণীর কথায় হ্যারি বলে উঠলো,
–“সেসব লেটারে করা যাবে।ফার্স্ট অফ অল, তুমি বামদিকের রুমে যাও। ব্রোকে নিয়ে আসো এইখানে।সে ডোর খুলছে না রুমের।আমি বাহিরে যাচ্ছি একটু।”
রাণী মাথা নাড়িয়ে হাঁটতে লাগলো।রাণী বুঝে না হ্যারি আর সিমির মধ্যে কিসের এতো ঝামেলার সম্পর্ক। রাণী সেই রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় কড়া নেড়ে ডেকে উঠলো,
–“দরজা খুলুন।আপনার জন্যে সব হুজুর অপেক্ষা করছে।”
রাণীর কণ্ঠ শুনে তূর্যয় খট করে দরজা খুলে দিলো।রাণীকে দেখে তূর্যয়ের চোখের পলক থমকে গেলো।রাণীর শাড়ি পড়া রূপটা যেনো তূর্যয়ের গায়ে জ্বালা সৃষ্টি করেছে।রাণী তূর্যয়কে দেখে ভ্রু নাচালে তূর্যয় রাণীর হাত ধরে তাকে ভেতরে নিয়ে নিলো রুমের।কিছু না বলেই তূর্যয় রাণীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।রাণী হাসলো তূর্যয়ের কান্ডে।তূর্যয় রাণীর মাথায় চুমু দিয়ে বলে উঠলো,
–“সুন্দর লাগছে তো।শাড়ীতে এতো ভালো লাগবে তোমায়, এটা আমি আশা করিনি।”
রাণী তূর্যয়ের মুখে নিজের তারিফ শুনে লজ্জায় লাল।নিজের কোমর থেকে তূর্যয়ের হাত ছুটিয়ে রাণী তূর্যয়কে বললো,
–“এইসব কথা বাদ,বাহিরে আসুন।আপনি হুজুরদের পাশে বসে আপনার মায়ের জন্যে দোয়া করলে এটা বেশ ভালো হবে।”
তূর্যয় রাণীর দিকে তাকিয়ে আছে।তূর্যয় কখনো এইসব করেনি।তূর্যয়কে চুপ থাকতে দেখে রাণী আবারও বলে উঠলো,
–“কি জবাব?চলুন।”
–“বিয়ের পর সবসময় শাড়ি পড়বে কিন্তু।”
রাণী তূর্যয়কে আর কিছু বলতে দিলো না।তূর্যয়ের মুখে “বিয়ে” কথাটা শুনতেই এক অজানা অনুভূতিতে রাণী শেষ হয়ে যাচ্ছে।তূর্যয়ের মুখে হাত রেখে বলে উঠলো,
–“এইসব কথা পরে হবে।এখন চলুন।”
রাণীকে থামিয়ে তূর্যয় রাণীর মাথায় কাপড় দিয়ে তাকে বলে উঠলো,
–“এখন পারফেক্ট।কেনো এতো সুন্দর তুই?”
রাণী চোখ ঘুরিয়ে তূর্যয়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।মুখে কিছু না বললেও,রাণীর মনটা খুশিতে গদগদ হয়ে আছে।।

তাদের এতক্ষণের কথা কেউ কান পেতে শুনছিল।রাণী এবং তূর্যয় রুমের বাহিরে আসার ইঙ্গিত পেয়ে দ্রুত পায়ে সরে গেলো ব্যক্তিটি।রাণী আর তূর্যয়ের সম্পর্কের গভীরতা তার ভেতরটা নাড়িয়ে তুলেছে। সে সাথে সাথে ফোন দিলো সাবিনাকে,
–“আজ যা জেনেছি,সেটা শুনলে খুশিতে মরে যাবেন।”
–“বকবক করিস না।এখন বল।”
সাবিনার বিরক্তমাখা কথা।
–“তূর্যয় আর রাণীর মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে।আগেই সন্দেহ করেছি।কিন্তু আজকে এমন টোপ কাজে লাগালাম,সত্যিটা নেচে নেচে আমার সামনে চলে এলো।”
সাবিনা লাফ দিয়ে উঠলো ব্যক্তিটির কথায়।
–“আরে বাহ!তূর্যয়ের আপন মানুষ পাওয়া গিয়েছে।আহা,এখন মজা হবে খেলা।রাণী মরলে, তূর্যয় না মরেও মরবে এখন।তুই বেঁচে থাক অনেক বছর।আমি আজই ফিরছি দেশে।একসাথে মাঠে নামবো আমরা।”
–“হ্যাঁ।”
ফোনের ব্যক্তিটি নিজের মোবাইল রেখে দিলো।রুমে থাকা আয়নার সামনে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে গেলো ব্যক্তিটি।আয়নায় নিজের অবয়ব দেখে ব্যক্তিটি বলে উঠলো,
–“দাঁড়ালে আমাকে বেশ সুন্দর লাগে।কিন্তু,এই রাণীকে বিনাশ করতে আমাকে এখনো হুইল চেয়ারে বসে থাকতে হয়।বাহ্,সিমি তোর মুখের মিষ্টটায় তোর ভেতরকার খারাপ কেউ দেখেই না।অতি চালাক রাণী পর্যন্ত আমার এই রূপ দেখলো না।আর না কখনো দেখবে ।এইবার রাণী তুই মরবিই।”
সিমি মুখ চেপে হাসতে লাগলো কথাগুলো বলে।

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে