#আলো-আঁধার🖤
#লেখিকা:সালসাবিল সারা
২৯.
হাতে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তূর্যয়।তার নজর আটকে আছে, মুখ খিঁচে সোফায় বসে থাকা রাণীর দিকে।তূর্যয়ের মেজাজ বারবার বিগড়ে যাচ্ছে রাণীর দিকে তাকাতেই।কিন্তু,রাণী আঘাত পেয়েছে বিধায় তূর্যয় রাণীকে কিছু বলছে না।চুপচাপ দাঁড়িয়ে রাণীর তামাশা দেখছে সে।রাণীর হাতে আর পায়ে তূর্যয় ওষুধ লাগাতে সক্ষম হলেও রাণীর পেটের দিকে কোনো মতেই রাণী তূর্যয়কে হাত লাগাতে দিচ্ছে না। যার কারণে তূর্যয় রাণীর উপর হালকা চিল্লিয়ে ছিলো একটু আগে, আর এতেই রাণী রেগে সোফায় হাতপা আঁকড়ে বসে আছে।রাণীর এমন অবস্থা দেখে তূর্যয়ের চোখ চড়কগাছ।রাণী লজ্জায় আর তূর্যয়ের সাথে রাগ দেখিয়ে মুখ ফুলিয়ে সোফায় বসে আছে।তূর্যয় অনেকক্ষণ চুপ থেকে এইবার নিজের পা বাড়ালো রাণীর দিকে।অমনি রাণী নিজের জামা খামচে ধরে তূর্যয়ের দিকে হাত দেখিয়ে বলতে লাগলো,
–“এই আপনি আমার কাছে আসবেন না।আপনি আমাকে বকা দিয়েছেন কেনো?”
তূর্যয়ের পা থেমে গেলো।সে রাণীর এমন কথা শুনে তাকে কি জবাব দিবে এটাই বুঝছে না।তাও তূর্যয় গম্ভীর কণ্ঠে রাণীকে বললো,
–“আজিব?এমন করছো কেনো?ওষুধ ই তো লাগাচ্ছি।এখনই তো খাচ্ছি না তোমায়!জাস্ট ওষুধ লাগাবো।প্রমিজ।”
রাণী দুইদিকে মাথা নাড়ালো।রাণী তার জামায় হাত রেখে তূর্যয়কে জবাব দিলো,
–“ইন্না।কখনো না।আমি আপনাকে আমার পেট দেখাবো না।”
তূর্যয় চোখ বাঁকা করে রাণীকে বললো,
–“সাদা পেটটা অনেক আগেই দেখে ফেলেছি আমি।পেটের মধ্যে হালকা একটা দাগ আছে তোমার।তাই না?”
রাণী নিজের মুখে হাত রাখলো জামা ছেড়ে।রাণীর চোখ জোড়া একেকবারে রসগোল্লার আকার ধারণ করেছে।রাণীর বিশ্বাস হচ্ছে না তূর্যয় কিভাবে তার পেট দেখেছে।শুধু তাই নয়,তূর্যয় তার পেটের সেই হালকা দাগটাও দেখেছে।রাণী সোফা থেকে উঠে মুখ থেকে হাত সরিয়ে বিস্মিত নজরে তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে তাকে প্রশ্ন করলো,
–“আপনি জানলেন কিভাবে?কিভাবে দেখেছেন আপনি?”
তূর্যয় বাঁকা হেসে রাণীকে উত্তর দিলো,
–“মনে আছে,একদিন ডাইনিং এ অতি খুশিতে তোমার জামা উল্টিয়ে ফেলেছো?সেদিনই দেখেছিলাম। আহ,কি সুন্দর ছিল সেই দৃশ্য!”
রাণী তূর্যয়ের বাঁকা হাসি দেখে গলতে গিয়েও গললো না।রাণী দ্রুত তূর্যয়ের সামনে এসে তূর্যয়ের মুখে হাত রেখে বললো,
–“আপনি সেদিন বলেছিলেন,কিছুই দেখেননি।”
তূর্যয় রাণীর হাতের তালুতে ঠোঁট লাগাতেই রাণী নিজের হাত সরিয়ে নিলো।আর তূর্যয় রাণীর দিকে হালকা ঝুঁকে বলে উঠলো,
–“মিথ্যা বলেছিলাম।”
রাণী এলোমেলো ভাবে তূর্যয়ের বুকে চড় দিতে লাগলো,
–“মিথ্যাবাদী, মিথ্যাবাদী। তাশরীফ তূর্যয় একটা মিথ্যাবাদী।”
তূর্যয় আবারও হেসে উঠলো।তার এই হাসিতে হালকা শব্দ হলো।রাণী চুপ করে গেলো তূর্যয়ের হাসির সেই মৃদু শব্দে।রাণীর বুকটা ধক ধক করছে।রাণী হারিয়ে গেলো তূর্যয়ের চোখের গভীরতায়।তূর্যয় এই সুযোগে আঁকড়ে ধরলো রাণীর পিঠ।রাণী এইবার বাস্তবে ফিরে এলো।রাণী সরতে চাইলে তূর্যয় আরেকটু শক্ত হাতে রাণীর পিঠ আঁকড়ে তাকে বললো,
–“যা হওয়ার হয়েছে।আগে পরে তোমার সবকিছুই তো আমার দেখা লাগবে,তাই না রৌদ্র?”
তূর্যয়ের এমন লাগামহীন কথা শুনে রাণীর সম্পূর্ণ শরীরে যেনো কাঁটা দিয়ে উঠেছে।রাণী তূর্যয়ের বুকের দিকের শার্ট চেপে ধরলো।তূর্যয় রাণীর হাত ধরে তাকে সোফায় বসিয়ে দিলো।লজ্জায় রাণী আর মাথা উঁচু করতে পারছে না।তূর্যয় রাণীর কামিজে হাত রাখতেই রাণী তূর্যয়ের দিকে তাকালো।তূর্যয় চোখের পলক ফেলে রাণীকে আশ্বাস দিলো।তূর্যয় যেই রাণীর কামিজ সরাবে অমনি রাণী তূর্যয়কে বললো,
–“সালেহা ম্যাডামের সাথে আপনার মায়ের কি সম্পর্ক ছিলো?”
তূর্যয়ের হাত থেমে গেলো।সাথে তূর্যয়ের চোখের রঙ বদলাতে লাগলো মুহূর্তেই।রাণী বুঝতে পারছে,তূর্যয়ের এমন চোখের রং বদলানোর কারণ। তূর্যয়ের অতীতকে সে প্রচন্ড ঘৃণা করে। আর তার এই অতীতের ব্যাপারে কেউ কথা বললে তূর্যয়ের তা মোটেও সহ্য হয় না।তূর্যয় রাণীর কামিজ থেকে হাত সরাতে নিলে রাণী তূর্যয়ের গালে দুই হাত রেখে তাকে নরম কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“যা প্রশ্ন করবো,তারই উত্তর দিবেন বলেছিলেন। তাহলে এখন কেন আপনার চোখের রং বদলাচ্ছে?আপনার রৌদ্রকে আপনি মনে খুলে সব বলতে পারেন।বিশ্বাস করেন তো আমায়?”
তূর্যয়ের মাথায় রাগ উঠেছে ঠিকই কিন্তু রাণীর কথায় আর রাণীর স্পর্শে তূর্যয়ের রাগটা সে প্রকাশ করতে পারছে না।তূর্যয় দাঁতে দাঁত চেপে রাণীকে জবাব দিলো,
–“অতীতের কথা অতীতই থাক। ঐসব কথা তুই জেনে কি করবি?আর যতটুক আসছে তোকে বিশ্বাস করার কথা, তুই একমাত্র মেয়ে যাকে আমি মোল্লা সাহেব আর হ্যারির মতোই বিশ্বাস করি।এখন চুপচাপ আমাকে আমার কাজ করতে দে।”
তূর্যয়ের রাগ মাখা কথায় রাণীর অস্থির লাগছে।কিন্তু, তাও রাণী দমে যায়নি।তূর্যয়কে আর কখন এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হবে, এটা রাণীর অজানা।তাই রাণী নিজেকে মোহরা বানিয়ে অসহায় ভাব নিয়ে তূর্যয়কে বলতে লাগলো,
–“সত্যি কথা বলতে আমার পেটে কিন্তু প্রচুর ব্যথা লাগছে। আপনি যদি আমাকে সত্যিই না বলেন, তাহলে আমি ওষুধ লাগাতে দিবো না।”
কথাটা বলে রাণী নিজের চোখে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুললো।রাণীর এমন অসহায় চাহনি তূর্যয়ের সহ্য হচ্ছে না।তূর্যয় রাণীর চুলের গভীর রাতে হাত বুলিয়ে তাকে উত্তর দিলো,
–“হুঁশ,রিল্যাক্স।বলছি।এতো চাপ নিতে হবে না।”
ওষুধ লাগানোর সময় রাণীকে কথায় ভুলিয়ে রাখা যাবে, এতে রাণীর কষ্টটাও কম হবে।এই ভেবে তূর্যয় রাণীকে সবটা বলবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো।রাণীর পেটের ডান দিকে কামিজ সরাতেই তূর্যয় দেখলো, অনেকখানি ছিলে গিয়েছে রাণীর পেটের ডান দিকে সাথে হালকা রক্ত বেরিয়ে আছে। তুলোয় স্যাভলন নিয়ে রাণীর ক্ষত স্থানে তুলো লাগাতেই রাণী “মাগো” বলে চিল্লিয়ে উঠলো তীব্র জ্বলে উঠার কারণে।সাথে সে তূর্যয়ের কাঁধ চেপে ধরেছে।রাণীর অস্থিরতা দেখে তূর্যয় বেশ ঝুঁকে রাণীর ক্ষত স্থানে ফুঁ দিয়ে হালকা করে তুলো দিয়ে চাপ দিচ্ছে।
রাণী নিজের দুই ঠোঁট চেপে ধরে আছে।রাণীকে ব্যথার দিক থেকে মন সরাতে তূর্যয় রাণীর ক্ষত স্থানে ফুঁ দিয়ে সাথে সেখানে ওষুধ লাগানো অবস্থায় রাণীকে বলতে লাগলো,
–“সালেহা ছিলো মায়ের একেবারে কাছের বান্ধুবি।আমি তাকে ‘সালেহা মা’ বলেই ডাকতাম।বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের বাড়ি এসে মাকে সে সান্ত্বনা দিতো।দুইজন নানা কথা বলতো।মাঝে মাঝে আমাকে দেখলে তাদের কথা থামিয়ে ফেলতো।ছোট ছিলাম,এতো কিছু বুঝিনি।কিন্তু,মা হাসানকে বিয়ে করার পর থেকে তাদের মধ্যে একটা ঝগড়া লাগে বিশাল। তাদের মাঝে কি হয়েছিল আমার জানা নেই। এরপর দুজনের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। মা সালেহাকে প্রচন্ড মিস করতো। প্রায় সময়ই মা সালেহার কথা মনে করে প্রচন্ড কান্না করতেন। আমি মাকে সান্ত্বনা দেয়ার মত ভাষা খুঁজে পেতাম না। মা, একমাত্র সন্তান হওয়ায়; নানা নানুর মৃত্যুর পরে মায়ের বাবার বাড়ি থেকে কেউ আমাদের পাশে ছিল না।সালেহা মাকে নিজের বোন ভাবতো। তবে সেই ঝগড়ার কারণে তাদের মধ্যে এত বড় দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিলো, আমার মায়ের মৃত্যুর দিনেও সালেহা দেখতে আসেনি আমার মাকে।আমাকে সে ছেলে বলতো নিজের,অথচ এই এতিম ছেলেটার মা মরার পর; তার কি অবস্থা হয়েছিল এটা উনি একবারও এসে দেখেননি। মায়ের মৃত্যুর দিনে আমি বুঝে গিয়েছিলাম এই দুনিয়াতে আমার কেউ নেই।হাসান আমার উপরে অনেক অত্যাচার করতো।মেরেও ফেলতে চেয়েছিল মাদ্রাসায় পড়াকালীন সময়ে। পরে আমাকে বাঁচান মোল্লা সাহেব। সেই সময় থেকে মোল্লা সাহেব আমার জীবনের একটা ভালো অধ্যায় হিসেবে আছে। মোল্লা সাহেব আমাকে বাঁচানোর জন্য হাসান থেকে একটা কাগজে সিগনেচার করে নিয়েছে, যাতে হাসান আমার কোনো ক্ষতি না করে।আর আমার কোনো ক্ষতি হলে সেটার দায় হাসানকেই নিতে হবে। বলতে গেলে আমার বেঁচে থাকার সুযোগ করে দিয়েছিলেন মোল্লা সাহেব। না হলে কত আগেই আমাকে মেরে ফেলতো হাসান। একদিন মোল্লা সাহেবের বাসায় আমাকে দাওয়াত করলে, আমি মোল্লা সাহেবের সাথে তার বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে আমি সালেহাকে দেখতে পাই। আমাকে দেখে সালেহার সে কি রাগ! আমার মায়ের নামে খারাপ কথা বলেছিল সেদিন উনি। সাথে আমার নামেও বলেছিল অনেক খারাপ কথা। ছোটবেলায় সে আমার মন থেকে উঠে গিয়েছিলো।কিন্তু সেদিনের পর আমি তার কথা কল্পনাও করতে চাই না। মোল্লা সাহেবের সাথে উনার কেন ছাড়াছাড়ি হয় আমি জানি না। তবে সালেহা বেঁচে আছে সেটা আমি তোমার এতিম খানায় গিয়ে জানতে পারলাম। প্রথমদিন যেদিন এতিম খানায় দেখেছিলাম তাকে, সেদিনই অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলাম অতীতের টানা পোড়ার কারণে। কিন্তু এখন এইসব সবার আমার উপর প্রভাব ফেলতে পারে না। আমার রৌদ্র যে এসেছে আমার জীবনে। কিন্তু সালেহার এমন ব্যবহার আমি কখনো ভুলতে পারবো না।এই তো কাহিনী।আর এইদিকে ব্যান্ডেজ করাও শেষ।”
তূর্যয় রাণীর পেটে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে কামিজ টেনে দিলো রাণীর।রাণী ছলছল চোখে দেখে আছে তূর্যয়ের দিকে।রাণীর পেটের ব্যথা সে অনুভব করতে না পারলেও, তূর্যয় এর মনের কষ্টটা বেশি অনুভব করতে পারছে সে।তূর্যয়ের অতীত জানতে বড্ড লাফায় রাণী।কিন্তু তূর্যয়ের অতীত জানার পর রাণী নিজের মনেই তূর্যয়ের জন্যে দুঃখ সৃষ্টি করে ফেলে।রাণীকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে থাকতে দেখে তূর্যয় ম্লান হাসলো।রাণী তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠলো,
–“হাসবেন না।”
তূর্যয় ডান দিকে মাথা নাড়িয়ে “আচ্ছা” বলে আবারও হাসলো সে।এই দেখে রাণী দ্রুত তূর্যয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো।তূর্যয় দুইহাতে আঁকড়ে ধরলো রাণীর পিঠ।
রাণী মনে মনে ভাবছে,
–“তূর্যয়ের প্রতি সালেহা ম্যাডামের এমন ব্যবহারের কারণ আমি বের করেই ছাড়বো।”
তূর্যয়ের অতীতের কথা ভাবতেই রাণীর ফুঁপিয়ে কান্না করে যাচ্ছে।রাণীর এমন অবস্থা দেখে তূর্যয় ভাবলো, তার পেটে কোনো সমস্যা হচ্ছে।এক হাত রাণীর পিঠে আর অন্য হাত রাণীর মাথায় রেখে তূর্যয় রাণীকে প্রশ্ন করলো,
–“ব্যথা লাগছে এখনো?রৌদ্র?কান্না করছো কেনো?”
রাণী তূর্যয়ের গলা ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। কিন্তু তূর্যয় এখনো রাণীর পিঠে হাত দিয়ে রেখেছে।রাণী হালকা করে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো তূর্যয়ের গালে।তূর্যয় নিজের ঠোঁট প্রশস্থ করলো রাণীর কান্ড দেখে।রাণী মাথা নাড়িয়ে তূর্যয়কে উত্তর দিলো,
–“ব্যাথা লাগছে না।আপনার জন্যে কষ্ট লাগছে।”
–“কষ্টের কিছু নেই।আচ্ছা এইসব বাদ দাও।আমি যে এতো চিকিৎসা করেছি,এটার ফি কে দিবে?আর তুই যে আমাকে যখন তখন চুমু দেস,আমি দিলে কিন্তু একেবারে আমার নিশান বসিয়ে দিবো।সেটা সহ্য করতে পারবি?”
রাণী নড়ে উঠলো তূর্যয়ের কথায়।রাণী নিজেকে সামলে চোখ ছোট করে তূর্যয়কে বললো,
–“উম,আচ্ছা আর দিবো না।আমার স্পর্শ আপনার ভালো লাগে না।তাই না?”
তূর্যয় ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই রাণী হেসে উঠলো।কান্না মাখা চেহারায় এমন খিলখিল হাসিতে রাণীর নেশাটা তূর্যয়ের মধ্যে নিমিষেই ছড়িয়ে গেলো।তূর্যয়ের বুকের উথাল পাথাল শব্দটা এখন বেশ জোরেই শোনা যাচ্ছে।রাণীর সেদিকে জ্ঞান নেই।কিন্তু তূর্যয়ের অস্থিরতা বাড়তে লাগলো।রাণী গাল চেপে ধরলো সে।আতংকে রাণী তূর্যয়ের ঘাড়ে হাত রাখলো।তূর্যয় বেশ শক্ত করে রাণীর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালে রাণী চোখ বন্ধ করলো নিজের।তূর্যয় রাণীর ঠোঁটের দিকে আগাতেই তখনই হ্যারি প্রবেশ করলো তূর্যয়ের রুমে।তাদের দুইজনের কাছাকাছি অবস্থা দেখতে পেয়ে হ্যারি নিজের চোখে হাত রেখে চিল্লিয়ে বললো,
–“ওহ গড!রোমান্স করলে ডোর অফ করে করতে হয়।এইভাবে ওপেনলি কে করে এইসব?”
হ্যারির কথায় রাণী চমকে উঠলো।কিন্তু তূর্যয়ের হেলদুল হলো না।সে ধীরে রাণীর গালে স্নিগ্ধ একটা চুমু দিলো।রাণী ইশারায় তাকে ছাড়তে বললে,তূর্যয় রাণীকে ছেড়ে দিলো।
–“হাত নামাও চোখ থেকে।”
কথাটা বলে তূর্যয় সোফায় সোজা হয়ে বসলো।হ্যারি রাণীর কাছে এসে তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
–“ভেবেছিলাম আমার সিসকে একা পেয়ে তুমি তাকে বেশ স্কল্ড করবে।বাট,কে জানতো তুমি সিসকে এতো লাভ করছিলে?তোমার সাথে কথা বলা শেষে,আমি সিসকে ফোন করে জানলাম, সে এইখানেই আসছিল। ব্যস, ঘুম বাদ দিয়ে আমি চলে এসেছি আমার সিসকে সেভ করতে।কিন্তু এইখানে তো স্টোরি আরেকটা প্লে হচ্ছে।”
হ্যারি হাল্কা হাত দিয়ে ধাক্কা দিলো রাণীকে।রাণী নড়তেই তূর্যয় রাগী গলায় হ্যারিকে বলে উঠলো,
–“রৌদ্রের গায়ে আঘাত আছে।ব্যাথা পাবে।”
হ্যারি তালি দিলো বেশ জোরে।এরপর বাতাসে সুগন্ধ নেওয়ার মতো নাক টেনে সে বলতে লাগলো,
–“আহ,স্মেল পাচ্ছি আমি।লাভের স্মেল।মনে হচ্ছে এই রুমে শুধু লাভ আর লাভ।”
–“শাট আপ, হ্যারি।নিজের বোনের সাথে গিয়ে নাস্তা বানাও।তোমার বোন অসুস্থ।রৌদ্র,নিজের খেয়াল রাখবে।”
রাণী নিজের নাম শুনে তূর্যয়ের দিকে তাকালেই তূর্যয় এক চোখ টিপে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলো।তূর্যয়ের এমন রূপ দেখে রাণী সেখানেই বরফ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।কিন্তু হ্যারি নানান কথা বলতে বলতে তাকে নিয়ে নিচে নেমে গেলো।হ্যারি রাণীর সাথে কাজ করার সময় রাণীকে প্রশ্ন করলো,
–“দোকানের বস এইখানে,তাহলে দোকানের ওয়ার্ক কিভাবে এগুবে?”
রাণী কফিতে অল্প চিনি মিশিয়ে হ্যারিকে উত্তর দিলো,
–“জিনিস তো আমি রাতে বানায় কিছু।সেগুলো দোকানে তোলা হবে।আর আমার বান্ধবিরা সবাই আমার ট্রেনিং প্রাপ্ত।কোনো কাস্টমার অর্ডার দিয়ে গেলে তারা দোকানেও বানিয়ে ফেলবে জিনিস।এইভাবেই চলবে আরকি, ভিনদেশী ভাই।”
–“ওয়াও,আমার সিস একটা জিনিয়াস।”
রাণী হাসলো হ্যারির কথায়।
‘
কিছুদিন পর….
তূর্যয়ের সাথে একটা মিশনে গিয়েছিলো রাণী। কিন্তু সব সময়ের মতো বাহিরেই দাঁড়িয়ে থাকে সে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে।মাঝে মাঝে মিশনে রাণী তার সাথে থাকা গার্ডদের সাথে মিলে আশে পাশের জায়গা ঘুরে বেড়ায় বা গাছের নানান ফলমূল পেড়ে খায়। আজও মিশনে এসে রাণী বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলো গার্ডদের সাথে। পাশে একটা তেতুঁল গাছ নজরে পড়তেই রাণী তাদের নিয়ে সেদিকে গেলো। একজন গার্ডকে গাছে উঠতে বলে রাণী নিজের মাথার উপর হাত দিয়ে ছায়ার ব্যবস্থা করে দেখছে গার্ড ঠিক করে তেতুঁল নিচ্ছে কিনা।বেশ কিছু তেতুঁল পেয়ে রাণী খুশিতে গদগদ হয়ে আছে।
ইতিমধ্যে রাণী গার্ড থেকে পানি নিয়ে তেতুঁল ধুয়ে সেগুলো খাওয়া আরম্ভ করলো। তেতুলে কামড় দিয়ে রাণী তেতুলের টক মিষ্টি স্বাদ উপভোগ করছে।একটু পরে তূর্যয় সেই ছোট ঘর থেকে বের হলো।এর আগেই তূর্যয় এক লোককে বাহিরে ফেললো।হ্যারির চেহারাও বেশ রাগান্বিত দেখাচ্ছে।রাণী বুঝতে পারছে এই লোকের জীবন এইখানেই শেষ।
রাণী আবারও নড়চড় হয়েছিল এই জায়গা থেকে এটা জানলে, তাকে তূর্যয় বেশ বকবে।তাই তূর্যয়ের ভয়ে রাণী সব তেতুঁল ফেলে দিলো হাত থেকে।তূর্যয় নিজের মাঝে নেই।সে লোকটার গলায় পা চেপে ধরে তাকে চিল্লিয়ে বললো,
–“তোর শেষ ইচ্ছা হিসেবে এই আকাশ দেখিয়ে দিলাম তোকে।এখন মর।তোর মতো নারী পাচার বেঁচে থাকার চেয়ে মরা ভালো।”
লোকটা হাত জোড় করলো।কিন্তু তূর্যয়ের মনে দয়া হলো না।হ্যারি ছুরি নিক্ষেপ করলে সেই ছুরি লোকটার গলা বরাবর আসতেই তূর্যয় নিজের পা সরিয়ে সেই ছুরির উপরই আবার পা বসালো।অতঃপর লোকটার গলায় সম্পূর্ণ ছুরি প্রবেশ করলো।এই দেখে রাণী নিজের মুখ চেপে ধরলো।অন্যদিকে ফিরে রাণী বুকে হাত দিয়ে বলে উঠলো,
–“ইস,কি হিংস্র!”
মিশনের কাজ শেষ করে রাণী তাদের সাথে অফিসে চলে এলো।অফিসের কিছু ফাইল তার জমা দেওয়া বাকি আছে তূর্যয়ের কাছে।রাণী সেই ফাইল বুকে জড়িয়ে তূর্যয়ের কেবিনের দিকে চললো।তূর্যয়ের কেবিনের দরজায় টোকা দিতেই তূর্যয় বলে উঠলো,
–“কাম ইন।”
রাণী দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলো,তূর্যয় ল্যাপটপে কিছু করছে।রাণী ফাইল টেবিলে রেখে তূর্যয়ের টেবিলের উপর রাখা তার মায়ের ছবি দেখে তাকে বললো,
–“আপনি অনেকটাই আপনার মায়ের মতো।বেশ আদুরে।”
তূর্যয় চোখ তুলে তাকালো রাণীর দিকে।রাণী হাসলো তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে।তূর্যয় রাণীর হাত টেনে তাকে তার কাছে নিয়ে আসলো।রাণী একহাত তূর্যয়ের বুকে ঠেকালো।তূর্যয় ভ্রু উঁচিয়ে রাণীকে প্রশ্ন করলো,
–“তাই?”
রাণী হাসলো আবারও।রাণীর হাসি দেখে রাণীর ঠোঁটে তূর্যয় নিজের আঙ্গুল দিয়ে হালকা ঘষে আবারও তাকে বললো,
–“এই হাসিতে কিসের এতো মাদকতা?মরে যাবো তো এমন হাসি দেখে।বুকে ব্যাথা লাগে বেশ।”
রাণী তূর্যয়ের মুখে হাত রেখে জবাব দিলো,
–“এইসব বলবেন না।আর এই হাসির মাদকতা আপনি বুঝবেন না।আপনি তো দানব সন্ত্রাসী।আপনি বুঝবেন কিভাবে হিংস্রভাবে মানুষকে মারতে হয়!”
তূর্যয় কিছু বলতে যাবে এর আগেই দরজায় টোকা পড়ে।রাণী সরে যায় তূর্যয় থেকে।তূর্যয়ের অনুমতি পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করে রিহানা।রিহানাকে দেখে তূর্যয়ের তাকে চেনা মনে হলো।কিন্তু কোথায় দেখেছে সেটা মনে করতে পারছে না সে।তূর্যয় গম্ভীর স্বরে তাকে প্রশ্ন করলো,
–“কে?”
রিহানা একটু ঢং করে হেঁটে রাণীর কাছে এসে তূর্যয়কে জবাব দিলো,
–“এতো জলদি ভুলে গেলে আমাকে?কমিশনারের মেয়ে, রিহানা আমি।সেদিনই তো নিজের মনের কথা জানিয়েছিলাম তোমায়।ভুলে গেলে সব?”
তূর্যয় টেবিলে বারি দিয়ে উঠে পড়লো চেয়ার থেকে।রাণী কেঁপে উঠলো।সাথে রিহানাও।রাণী ভেবে পাচ্ছে না,
“এই মেয়ে তূর্যয়কে কবে ভালোবাসার কথা বলেছে!তূর্যয় আমাকে এই ব্যাপারে কিছুই তো জানায়নি।”
রাণীর ধ্যান কাটলো তূর্যয়ের কথায়,
–“আমার হাতে মরতে না চাইলে,দূর হো এইখান থেকে! কার মেয়ে না কি,আমার কিছু যায় আসে না।জাস্ট লিভ!”
কথাটা বলে তূর্যয় গার্ডকে ফোন দিতে গেলে রাণী তূর্যয়কে বলে উঠলো,
–” আপনারা বসে কথা বলুন?”
রাণীর কথায় তূর্যয়ের মেজাজ আরো বেশি খারাপ হলো।তূর্যয় রাণীকে চিল্লিয়ে জবাব দিলো,
–“আমি কি করবো না করবো,সেটা তোমার কাছে থেকে শিখতে হবে আমার?”
তূর্যয়ের কথা শুনে রাণী চুপ করে গেল।রাণী তো জিদ করেই কথাটা বলেছিল।কিন্তু এতে তূর্যয় এতটা রেগে যাবে এটা রাণী ভাবতে পারেনি।
তূর্যয় গার্ডকে ফোন করলে গার্ড এসে মাথা নিচু করে তূর্যয়কে উত্তর দেয়,
–“উনি উনার বাবার হুমকি দিয়ে আসছিল সবাইকে,তাই আটকাতে পারিনি। ম্যাম,প্লিজ চলে আসুন।”
রিহানা গা ঝাড়া দিলো,
–“এইযে তাশরীফ তূর্যয়,এই রিহানা তোমায় নিজের করেই ছাড়বে।”
–“এর আগে তুই মরবি।”
তূর্যয়ের কড়া জবাব।
রিহানার কথা শুনে রাণীর গা জ্বলে উঠলো।রিহানাকে নিয়ে যাওয়ার আগে রাণী কেবিন বের হতে নিলে তূর্যয় রাণীকে ধমক দিল,
–“তোকে যেতে বলেছি?”
রাণী থেমে গেলো।রাণী মনে মনে ভাবছে,
–“লোকটা কি জীবনে স্বাভাবিক হয়ে কথা বলবে না?শুধু ভালোবাসা উতলিয়ে পড়লে তখন আমার সাথে নরম হয়ে কথা বলেন।আর সবসময় শুধু ধমক আর ধমক।দানব থেকে আর কিই বা আশা করা যায়?”
রিহানা বাহিরে যেতে যেতে তূর্যয়কে বললো,
–“আমার দিকে তাকানো যায় না,আবার রক্ষিতাকে ছাড়ছে না উনি।আমাকে শেখায় এইসব ভালো মানুষী? যাই কিছু করো, আমি তোমাকে আমার করেই ছাড়বো;
তাশরীফ তূর্যয়।”
–“মরণ কাছে এসেছে তোর!”
তূর্যয়ের কড়া জবাব।
রিহানাকে বাহিরে নিয়ে যেতেই গার্ড দরজা বন্ধ করে দিলো।রক্ষিতা শুনে রাণীর চোখে পানি চলে এলো।রাণী পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তূর্যয় রাণীর কাছে আসতেই রাণী তূর্যয়কে আহত কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“আমি কি শুধুই আপনার রক্ষিতা?”
তূর্যয় রাণীর গাল চেপে ধরলো।রাণী চোখ বুঁজে নিয়েছে নিজের।তবে রাণীর কানে প্রবেশ করলো তূর্যয়ের কথা,
–“আমার রৌদ্র,তুই।আমার জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষ।কিছুদিন পরেই টের পাবে,তুমি আমার কি!”
রাণী কিছু বললো না।তূর্যয় রাণীর গালে নিজের গাল ঘষে শক্ত করেই জড়িয়ে ধরলো রাণীকে।তূর্যয়ের উত্তর রাণীর জানা আছে।তাও,তূর্যয়ের মুখ থেকে ভালোবাসার কথাটা শুনতে রাণীর মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে।
–“আপনার মুখ থেকে ভালোবাসার কথা শোনার জন্যে আমি অপেক্ষা করবো,তূর্যয়।দানব সন্ত্রাসী কিভাবে তার প্রেম নিবেদন করবেন এটা ভাবতেই আমার অন্যরকম লাগছে।”
কথাগুলো ভেবে রাণী তূর্যয়ের পিঠে হাত রাখলো।
রিহানা নিজের গাড়িতে বসে নিজের চুল নিয়ে টানাটানি করছে।রাগে সে চিল্লিয়ে বলতে লাগলো,
–“তুমি আমার না হলে,তোমাকেও আমি অন্য কারো হতে দিবো না, তূর্যয়।মেরে দিবো আমি সবাইকে।আমি রিহানা।আমি যা চাই তা পায়।আর না পেলে জোর করে আমার করে নিই।”
রিহানা মোবাইল বের করে নিজের বাবাকে ফোন দিলো।
চলবে…