আলো-আঁধার পর্ব-২৭

0
895

#আলো-আঁধার🖤
#লেখিকা:সালসাবিল সারা

২৭.
অফিসের কিছু মাসের টাকা আর মাটির বেশ কিছু জিনিস বিক্রি করার টাকা একসাথে করে রাণীর বেশ ভালোই টাকা জমলো।রাণী আজ সকালেই মাটির দোকান দেওয়ার জন্যে, দোকানের খোঁজে তূর্যয়ের বাড়ির এরিয়ায় কাছাকাছি দোকান খুঁজতে বেরিয়ে পড়লো।যদিও তাদের দুইজনের মধ্যে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠার আগ পর্যন্ত রাণীর ইচ্ছা ছিল সে তূর্যয়ের সাথেই কাজ করবে আর তার দোকান সামলাবে তার প্রিয় বান্ধুবীরা।কিন্তু পরক্ষণে সে চিন্তা করে ফেললো,
আর যায় হোক;তূর্যয়ের সাথ সে ছাড়তে পারবে না।তাই রাণী মনে মনে ঠিক করে নিলো সব সময় সে তূর্যয়ের অফিসেই কাজ করবে এবং তার দোকান এর সবকিছু তার বান্ধুবীরা সামলাবে।রাণী অনেক্ষণ যাবত দোকান খুঁজতে লাগলো রাস্তার দুই ধারে।এইখানে সমুদ্র দেখতে অনেক মানুষ আসে,সাথে অনেক পর্যটকের দেখা মিলে এইখানে।তাই রাণীর ধারণা,দোকান এই দিকে দিলে তার অনেক বিক্রি হবে।রাণীর যেই ভাবনা,সেই কাজ।রাণী বেশ কিছুক্ষণ ধরে রাস্তার এই পাড় ঐ পাড় ঘুরছে।কিন্তু, কোথাও দোকান খালি নেই।অনেক দেরি হয়ে যাওয়ায় রাণী আর দূরে গেলো না।গরমে এমনিও রাণীর অবস্থা খারাপ হয়ে আছে।তার মুখটাই লাল বর্ণ ধারণ করলো রোদের তাপে।রাণী মাথার উপর হাতের ছায়া দেওয়ার চেষ্টা করে তূর্যয়ের ঘরের দিকে হাঁটতে লাগলো।
.
তূর্যয় আজ জগিং এ যায়নি।রাতের মিশন শেষ করে সে তার ডার্ক হাউজে চলে এসেছিল।আকবরকে তূর্যয় অনেকদিন ধরে খুঁজছিল।কিন্তু, আকবর তার রূপ বদলিয়ে বেশ কায়দা করে নিজের গা ঢাকা দিয়েছিল। তবে,ইকরাম ডিটেক্টিভের সাথে মিলে আজ তাকে খুঁজে পেলো।সাথে সাথেই আকবরকে নিয়ে আসা হলো এইখানে।গতকাল তূর্যয়ের মিশন শেষ করতে অনেক দেরী হয়েছিল,প্রায় ভোর বেলায় ফিরেছে সে তার বাড়িতে।জগিং করার জন্যে বের হতেই ইকরাম তাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, তারা আকবরকে নিয়ে আসছে।যার কারণে,তূর্যয় আজ আর যায়নি জগিং এ।একটু পরেই আকবরকে নিয়ে আসা হলো তূর্যয়ের বাড়িতে অবস্থিত তার গোপন আস্তানায়। আকবরের মুখ থেকে কালো মুখোশ খুলতেই তূর্যয় ভ্রু কুঁচকে নিলো।আকবর তার রূপ বদলানোর জন্যে মুখে কালো কালি ব্যবহার করেছে।তূর্যয় নিজের গলার ডান পাশে চুলকিয়ে আকবরের চুল টেনে তাকে বলে উঠলো,
–“কি লাভ হলো এতো গা ঢাকা দিয়ে?যেই সেই তূর্যয়ের কাছেই তো আসতে হলো।তাই না, আকবর?”
আকবর রাগে বেশ নড়াচড়া করছে।কিন্তু তার শরীর চেয়ারের সাথে আটকে থাকায় সে কিছুই করতে পারছে না।আকবর বেশ রাগ নিয়ে তাকালো তূর্যয়ের দিকে।সে রাগী কণ্ঠে তূর্যয়কে বলতে লাগলো,
–“আমার ভাইপোকে মেরেছিস কেনো?সে কি করেছিল?”
–“তুই আর তোর ভাইয়ের মতোই বাটপার ছিলো তোর ভাইপো।আমি প্রশ্ন করেছিলাম তাকে। কিন্তু সে,এর ভুল উত্তর দিয়েছিল বারবার।অনেক সুযোগ দিয়েছিলাম, কিন্তু কাজে লাগায়নি সে।আর তুই তো জানিস,তূর্যয় মিথ্যাবাদীদের ঘৃণা করে।এখন বল,কিভাবে মরতে চাস?তোর শেষ ইচ্ছাটা তো পূরণ করি?”
তূর্যয় বেশ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো আকবরকে।
–“আমাকে কেনো মারা হচ্ছে?”
আকবরের সোজা প্রশ্ন।
–“তুই আমাকে হুমকি দিয়েছিলি তাই।তুই তো জানিস,
তূর্যয় এইসব হুমকি একদম সহ্য করতে পারেনা।”
তূর্যয় কপালে নিজের পিস্তল ঘষে বললো।
–“তা,তোমার আপন মানুষ কে?”
আকবরের প্রশ্নে তূর্যয় চোখ তুলে তাকালো আকবরের দিকে।আকবর কিছু একটা জানে,এমনটাই মনে হচ্ছে তূর্যয়ের। তূর্যয় চোখ গরম করে আকবরকে বলে উঠলো,
–“নিজের চিন্তা কর।শেষ বারের মতো আল্লাহ্কে স্মরণ কর।”
আকবর চোখ বন্ধ করলো।এরপর ধুম করে চোখ খুলে সে হেসে উঠে বললো,
–“রাণী।মমতা এতিম খানায় থাকে।শক্তিশালী মাফিয়া তূর্যয়ের একমাত্র ভালোবাসা।মেয়েটা কিন্তু সেই।তোর থেকে মেয়েটা কম পক্ষে দশ বছরের ছোট হবেই!তো,
মেয়েটাকে খেয়েছিস নাকি পরে খাবি?মেয়েটাকে দেখতেই না, আমার বেশ জ্বলে।বুঝিস তো!”
তূর্যয় তাকালো ইকরামের দিকে।ইকরাম একটু নড়ে উঠলো।আকবর বুঝতে পারেনি,সে কার সামনে কি বলে ফেললো। ইকরামকে কিছু বলার আগেই সে তূর্যয়ের দিকে ফিঙ্গার কাটার এগিয়ে দিলো।তূর্যয় সেটা নিয়ে এগিয়ে গেলো আকবরের সামনে।আকবর আবারও হেসে বললো,
–“আহহ,তূর্যয় দেখি হেব্বি রাগ করেছে।জানিস,এই খবরটা না আমি এখনো কাউকে দিতে পারিনি।তোর রাণীকে দেখে আমি নিজেই তার দেওয়ানা হয়েছি।ভেবেছি তোকে মেরে তোর রাণীকে বিয়ে করে নিবো আমি।কিন্তু কপাল খারাপ,আমি ধরা পড়ে গেলাম।”
তূর্যয় ঠোঁট বাঁকা করলো আকবরের কথায়।আকবর কিছু বুঝে উঠার আগেই ফিঙ্গার কাটারের উল্টো দিকের ধারালো অংশ দিয়ে তূর্যয় আকবরের চোখের পাতার উপর ঢুকিয়ে দিল। যার কারণে আকবরের এক চোখ অর্ধেক বেরিয়ে এসেছে চোখের কোটর থেকে।তীব্র আর্তনাদে আকবর চিল্লিয়ে উঠলো।তূর্যয় আকবরের চুল টেনে ধরে তাকে শাসিয়ে উঠলো,
–“আমার রৌদ্রের দিকে চোখ তুলে তাকালে,চোখ উপড়ে ফেলবো;এটা আমার মুখের কথা না।এটা আমার বাস্তব কথা।আমার আপন মানুষের খোঁজ যখন পেয়েছিস,তাহলে এইবার মর।”
আকবরের এইবার ভয় লাগতে শুরু করলো।তূর্যয় ভয়ংকর এটা সে জানতো।তবে, এতো ভয়ংকর! এটা সে কখনোই কল্পনা করেনি।আর রাণীর ব্যাপারে আকবর আঁধারে ঢিল ছুড়ে মেরেছিল।কিন্তু,এটা সঠিক নিশানায় লেগে যাওয়াতে আকবরের অবাকের শেষ নেই।যদিও বাহিরে অনেকবার রাণীকে তূর্যয়ের দলের সাথে, তার সাথে দেখেছিল সে।তখন আকবর ভেবেছিল,রাণী এমনিতেই এতিম খানার কোনো দাসী হবে তূর্যয়ের।আর রাণীর কথাটা শুনে তূর্যয় এমনিতেই কোনো রিয়েক্ট করবে না। কিন্তু,তূর্যয় রাণীকে এতটা ভালোবাসে,এটা আকবর কখনোই বুঝে উঠতে পারেনি।তবে, এটাও ঠিক;
আকবর রাণীর মোহে আটকা পড়েছিল।আকবরের এক চোখ দিয়ে রক্তে ভেসে যাচ্ছে।আকবর আকুতির সুরে তূর্যয়কে বলতে লাগলো,
–“মাফ করে দাও,তূর্যয়।আমি অনেক দূরে চলে যাবো।আর কখনোই ফিরে আসবো না তোমার কাছে।আমি কাউকেই তোমার ভালোবাসার কথা জানাবো না।আমি সত্যি আঁধারে ঢিল মেরেছি।আমি রাণী আর তোমার ব্যাপারটায় শিউর ছিলাম না।”
তূর্যয় গুলি তাক করলো আকবরের দিকে।তূর্যয়ের শরীরে এখন হিংস্রতায় ছেয়ে গিয়েছে।তূর্যয় দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে তাকে বলতে লাগলো,
–“ভুল করার পর,তূর্যয় কাউকে মাফ করে না।”
কথাটা বলে দেরী,কিন্তু তূর্যয়ের পিস্তল চালাতে দেরী হয়নি।আকবরের কপাল ভেদ করলো তূর্যয়ের পিস্তলের বুলেট।নিমিষেই আকবরের প্রাণ চলে গেলো।তূর্যয় নিজের কোমরের পিছে গুঁজে দিলো পিস্তল।নিজের গায়ের দিকে তাকিয়ে নাক সিটকালো সে।কারণ,
আকবরের চোখ উপড়ে ফেলার সময় তূর্যয়ের গায়ে রক্তের ছিটা লেগেছে।তূর্যয় ইকরাম থেকে তাওয়াল নিয়ে সেই রক্ত মুছতে লাগলো।কিন্তু পরিষ্কার ভাবে রক্ত এখনো তার শরীর থেকে মুছে যায়নি।তূর্যয় ইকরামকে তাওয়াল ছুড়ে মারলে ইকরাম তা ধরে ফেললো।
–“লাশ গাড়িতে বসিয়ে এক্সিডেন্ট সাজাও।গাড়ি যেনো ব্লাস্ট হয়,সাথে তার দেহ যেনো পুড়ে ছাই হয়ে যায়।কোনো ক্লু রাখবে না।”
ইকরাম মাথা নাড়ালো তূর্যয়ের কথায়।

আকবরের মৃত দেহ একটা সাদা রঙের ব্যাগে নিয়ে নেওয়া হলো।তূর্যয় সামনে হাঁটছে আর বাকি সবাই পিছে।তূর্যয়ের এক পুরাতন গাড়িতে তুলবে আকবরের লাশকে।সেই গাড়িটা গ্যারেজে।তূর্যয় গ্যারেজের সামনে আসার আগেই তার সামনে এসে দাঁড়ালো রাণী।
.
রাণী মাত্রই তূর্যয়ের বাড়িতে ঢুকেছে।অমনি সে দেখলো, তূর্যয়ের গায়ে ছাই রঙের গেঞ্জি পড়নে,তার গায়ে রক্তের ছিটা। পেছনে তাকাতেই সে দেখলো, সাদা রঙের লম্বা একটা ব্যাগ চারজন মানুষ কাঁধে তুলে রেখেছে।রাণীর বুঝতে দেরী হলো না এইখানে কি হয়েছে।তূর্যয় ইশারা করতেই চারজন মানুষ সাথে ইকরাম চলে গেলো গ্যারেজের দিকে।তূর্যয়ের মেজাজ বেজায় খারাপ হলো রাণীকে এইখানে দেখে।তূর্যয় ভেবেছে রাণী অনেক আগেই বাড়িতে চলে এসেছিল।তূর্যয়ের এইখানে গোপন আস্তানা আছে, এটা রাণীকে জানাতে চায়নি তূর্যয়।

আর রাণী রেগে আছে তূর্যয়ের বাড়িতে আস্তানা আছে,
এই কথাটি বুঝতে পেরে।রাণী কিছু বলার আগেই তূর্যয় রাণীর বাহু চেপে ধরলো শক্ত করে।রাণী মুখ কুচঁকে ফেললো ব্যাথায়।তূর্যয় রাণীর বাহু চেপে তাকে চিল্লিয়ে উঠলো,
–“এতো দেরীতে এসেছিস কেনো?”
রাণী তূর্যয়ের চোখে চোখ রেখে ভারী গলায় বললো,
–“দেরীতে না আসলে,এইখানের কাজ কারবার দেখতে পেতাম না। এতো জায়গায় আস্তানা গেড়ে আপনার শান্তি নেই?বাড়ির ভেতরে এইসব নিয়ে এসেছেন?এইসব আস্তানা থাকা চলবে না এই বাড়িতে।”
–“রৌদ্র!কি প্রশ্ন করেছি আমি?”
তূর্যয় চোখ রাঙালো রাণীকে।
–“রৌদ্র!কি প্রশ্ন করেছি আমি?…ইস,আমি কেনো আপনাকে উত্তর দিতে যাবি?আপনি গিয়ে মানুষ মারুন।যান যান।”
রাণী মুখ ভেঙিয়ে বললো তূর্যয়কে।রাণীর এমন মুখ ভেংচি দেওয়া দেখে তূর্যয় ঠোঁট প্রশস্থ করলো। তা দেখে রাণী আবারও তূর্যয়কে বললো,
–“একদম হাসবেন না।হাসি দেখে মন গলবে না আমার। ছাড়ুন তো।আপনার বাড়ি,আপনার যা মন চায় করুন।প্লিজ ছাড়ুন,অন্যর রক্ত আপনার গায়ে লেগে আছে।আমার বমি আসছে।”
রাণীর এমন কথা শুনে তূর্যয় ছেড়ে দিলো রাণীকে।আর তূর্যয়ের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে রাণী দিলো এক দৌড়। তা দেখে তূর্যয় চিল্লিয়ে উঠলো রাণীকে,
–“এতো চঞ্চল কেনো তুই?আমার কথার জবাব না দেওয়ার সাহস আসে কিভাবে তোর?”
রাণী ততক্ষণে বাড়ির ভেতরে চলে এলো।তূর্যয়ের চিৎকারে সারা ঘর যেনো নড়ে উঠলো।রাণীর মনে ভয়ের পাশাপাশি বড্ড হাসি আসছে।তূর্যয়কে জ্বালাতে রাণীর বরাবরই ভালো লাগে প্রচুর।রাণী রান্নাঘরে ঢুকে বুকে হাত রেখে বলতে লাগলো,
–“চিল্লাতে থাকুন,জলহস্তী।এই রাণী আপনার কথা শুনবে না।”
রাণী নিজের কাজে মন দিল।তূর্যয় উপরে উঠার আগে চিল্লিয়ে রাণীকে বলে উঠলো,
–“নাস্তা নিয়ে উপরে আসবি,আমার রুমে।”
তূর্যয়ের কথা শুনে রাণী নাস্তা বানানো মাঝে নিজে নিজে ভাবলো,
–“আজ আমার ভাই কই?”
রাণী ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে ফোন দিলো হ্যারিকে,
–“ভিনদেশী ভাই,আপনি কোথায়?”
হ্যারি ঘুম ঘুম চোখে উত্তর দিলো,
–“আম স্লিপিং, সিস।আইল কাম টু পিক ইউ।”
–“নাস্তা কই করবেন?”
হ্যারির উত্তরে রাণী প্রশ্ন করলো।কিন্তু,রাণী কোনো উত্তর পেলো না।রাণী ফোন কেটে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,
–“রাতভর খুন খারাবি করে এখন চোখ খুলতে পারছে না।এরা কি এইসব কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ পায়নি করতে?”
রাণী একরাশ বিরক্ত নিয়ে নাস্তা বানানো শেষ করলো।নাস্তা উপরে নিয়ে এক হাতে ট্রে ধরে অন্য হাতে দরজায় কড়া নাড়তেই,দরজা নিজে নিজে খুলে গেলো।ভেতরে যেতেই রাণী দেখলো, কোমরে তাওয়াল পেঁচিয়ে তূর্যয় প্যান্ট পড়ছে।রাণী একহাতে নিজের চোখ ধরে পেছনে ফিরে বললো,
–“আস্তাগফিরুল্লাহ্।”
–“সামনে ফির।”
তূর্যয়ের ভারী কণ্ঠ।
–“আপনার মতো বেশরম না আমি।”
রাণী পেছনদিকে ফেরা অবস্থায় জবাব দিলো।
–“যেটা পরে দেখবি,সেটা আগে দেখলে কি সমস্যা?”
তূর্যয়ের এমন কথা শুনে রাণী কান গরম হয়ে এলো।রাণী কিছু না বলে চুপ করে আছে।তূর্যয় নিজের গায়ে শার্ট জড়িয়ে রাণীকে নির্দেশ দিলো,
–“ব্যালকনিতে আয়।”
রাণী পেছনে ফিরে তাকে প্রশ্ন করলো,
–“কাপড় পড়েছেন তো?”
–“তুই কিছু দেখতে চাইলে,এখনই আমি কাপড় খুলে ফেলছি।”
তূর্যয়ের কথায় রাণী সোজা হয়ে দাঁড়ালো।তূর্যয়কে দেখে রাণী শান্ত হলো।বেশ ভদ্র কাপড় পড়ে আছে সে।রাণী তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো ব্যালকনিতে।তূর্যয় রাণীর পেছন পেছন গেলো।দুইজন বসে পড়েছে ব্যালকনিতে থাকা চেয়ারের উপর।তূর্যয় নাস্তা খাওয়া আরম্ভ করলো।রাণী পাউরুটির টুকরো মুখে দিয়ে অবাক চোখে সমুদ্র দেখছে।রাণীর বেশ শান্তি লাগছে সমুদ্র দেখতে।নাস্তা খাওয়ার মাঝে তূর্যয় রাণীকে বলে উঠলো,
–“দোকান দিয়ে কি করবি?”
–“দোকান খুঁজতে গিয়ে এইখানে আসতে দেরী করেছি,
এটা জানলেন আর কেনো দোকান খুঁজেছি,সেইটা জানলেন না?আমি কি এতোই বোকা?”
রাণীর সোজা জবাব।
–“বাহ্,আমার সাথে থেকে অনেক চালাক হয়েছিস তুই। ইকরামকে বলেছি,দোকানের ব্যবস্থা করে দিবে।কিন্তু,
তুই আমার সাথেই কাজ করবি।”
রাণী খুশি হয়ে তূর্যয়ের দিকে তাকালো।হাসিমুখে তূর্যয়কে বললো,
–“ধন্যবাদ,দানব সন্ত্রাসী।”
–“শুধু ধন্যবাদ?”
–“তো, কি বলবো আর?”
রাণী অবাক হয়ে বললো তূর্যয়কে।
তূর্যয় চেয়ার থেকে উঠে রাণীর দিকে এগিয়ে যেতেই রাণীর হাত থেকে পাউরুটির টুকরো পড়ে গেলো।তূর্যয় রাণীর গালে হাত রাখতেই, তূর্যয়ের মোবাইল বেজে উঠলো।রাণী চমকে উঠে চেয়ার নিয়ে একটু সরে বসলো।তূর্যয় মোবাইলে কথা বলতেই,তার কপালের রগ ফুলে উঠলো।তূর্যয় ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো,
–“আবারও ধোঁকা?পায়ের তালুতে একশো বেত মার। বেতের সাথে ধারালো ব্লেড পেঁচিয়ে নে।আমি আসছি।সত্যিটা যেনো একবারেই বলে।”

রাণী তূর্যয়ের কথা শুনে বুকে হাত রেখে ভাবছে,
–“কি ভয়ানক শাস্তি,বাবা!”
রাণী আবারও সমুদ্রের দিকে নজর দিল।তূর্যয় গায়ে কোট জড়িয়ে ব্যালকনিতে এলো।তূর্যয়ের উপস্থিতি টের পেয়ে রাণী তার দিকে ফিরলো।রাণী কিছু বুঝে উঠার আগে তূর্যয় রাণীর গাল চেপে জোরে চুমু দিলো রাণীর কপালে।রাণী হাত রাখলো তূর্যয়ের গলায়।আকস্মিক এইসব হবে রাণী ভাবেনি।তূর্যয় রাণীর কপালে আরো দুটো চুমু দিয়ে সরে এলো।রাণীর দিকে ঘোর মাখা চোখে তাকিয়ে তূর্যয় বললো,
–“হ্যারি আসবে নিতে।ওর সাথে চলে আসবে অফিসে।আমি কাজে যাচ্ছি।আর হ্যাঁ,আগ বাড়িয়ে কিছু করতে যাবে না।অতিরিক্ত মানব দরদী দেখালে পা ভেঙে দিবো।আসছি।”
তূর্যয় চলে গেলো।রাণী হাত রাখলো নিজের কপালে।নিজের কপালে তূর্যয়ের চুমু দেওয়া স্থানে হাত ঘষে রাণী বিড়বিড় করে বলছে,
–“ভালবাসা দেখায় আবার হুমকি দেয়।এই দানব সন্ত্রাসীর মতিগতি কিছুই বুঝা যায় না। তবে,এই রাগী সন্ত্রাসীকে আমার লাগবে।উনাকেই আমি ভালোবাসি আর সারাজীবন ভালোবেসেই যাবো।”
রাণীর মনে সালেহার সাথে তূর্যয়ের সম্পর্ক,তাদের মধ্যে ঝামেলার কারণ, এইসব কথা ঘুরছে।এই ব্যাপারে সালেহাকে অনেক জিজ্ঞেস করেও লাভ হয়নি রাণীর।রাণী ভেবে পাচ্ছে না এই দানবকে সে কিভাবে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে!তূর্যয়ের সাথে এসব ব্যাপারে কথা বলতে, রাণীর বরাবরই ভয় লাগে।রাণী এক ঘোরের মধ্যে চলে গেলো এইসব কথা ভাবতে গিয়ে।
.
সাবিনাকে এতিম খানার মানুষটা ফোন দিয়ে প্রত্যেকদিন এর আপডেট দেয়।রাণীকে শায়েস্তা করতে তারা নেমে পড়লো এক বড় পরিকল্পনায়।রাণীকে যেনো তারা এইবার শায়েস্তা করেই ছাড়বে।
.
কিছুদিন পর,মিশন থেকে ফিরতে আবারও তূর্যয় আজ গাড়ি থামালো,মায়া এতিম খানার সামনে।তূর্যয় চেয়েও এই জায়গাটা উপেক্ষা করতে পারে না।তূর্যয়, হ্যারি,রাণী সবাই নেমে পড়লো গাড়ি থেকে।রাণী দৌড় দিয়ে ভেতরে চলে গেলো।তূর্যয় থামালো না রাণীকে। ওয়ানিয়া সাথে অন্য বাচ্চারা রাণীকে পেয়ে বেজায় খুশি।হ্যারিও যোগ দিলো রাণীর সাথে।তূর্যয় গেইটে দাঁড়িয়ে সব দেখছে।রাণী আর হ্যারি পরিকল্পনা করে তূর্যয়ের এক হাত ধরে তাকে টেনে ভেতরে নিয়ে এলো।তূর্যয় মোবাইলে কথা বলছিল বেখেয়ালি ভাবে।ভেতরে ঢুকতেই তূর্যয়ের মাথায় একে একে তূর্যয়ের সব অতীত ভেসে আসছে।তার বাবার মারা যাওয়া, তার মায়ের কান্না,তাদের সংসার ভেঙে যাওয়া,সবটাই চোখে ভাসছে তার।তূর্যয়ের অস্থির লাগা শুরু হলো।রাণী তূর্যয়ের হাত চেপে ধরলো।তূর্যয়ের অস্থির লাগার সাথেই রাণীর উপর তীব্র রাগ জমছে তার।তূর্যয় ধপ করে বসে পড়লো।তার অস্থির অবস্থার মাঝেও সে রাণীকে চিল্লিয়ে উঠলো,
–“আমাকে বাহিরে নিয়ে যা।আমার সহ্য হচ্ছে না মায়ের কান্না।”
রাণী জড়িয়ে ধরলো তূর্যয়কে শক্ত করে।রাণীর দেখাদেখি সব বাচ্চারা রাণীকে জড়িয়ে ধরলো।সব বাচ্চাদের উপর হ্যারিও জড়িয়ে ধরলো তাদের।রাণী তূর্যয়কে বলতে আরম্ভ করলো,
–“সবার অতীত আছে।আমারও আছে।আপনার বাড়ি এটা।এইখানে যেমন খারাপ স্মৃতি আছে আপনার।তেমন ভালো স্মৃতিও আছে।সেই ভালো স্মৃতি চিন্তা করুন,
তূর্যয়।আমার তো মা বাবাও নেই।কিন্তু,আপনার তো ছিলো। আপনি তাদের সাথে কাটানো ভালো সময় চিন্তা করুন।খারাপ অতীতের কথা একেবারে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।আমাদের সবকিছুর সাথে যুদ্ধ করেই বেঁচে থাকতে হয়। আপনি তো আমার দানব সন্ত্রাসী।আপনার জন্যে কিছুই কঠিন না।আপনি আপনার এই খারাপ অতীত ভুলতে পারবেন।এইযে দেখুন,আমরা সবাই আপনার সাথে আছি। আপনার পাশে আছি।তূর্যয় আপনি পারবেন।”
রাণীর কথা তূর্যয়ের মাথায় তীব্রভাবে প্রবেশ করলো।ধীরে ধীরে তার সেই ভয়ংকর অতীতের কথা বাদ দিয়ে, তার মাথায় উদিত হচ্ছে তার সেই ভালো দিনগুলোর কথা।যে ভালো দিনগুলো সে কাটিয়েছে তার বাবা মায়ের সাথে। তার বাবার সাথে তার মায়ের খুনসুটি,
তাদের ভালোবাসা,একসাথে ঈদ কাটানো,বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া,বাবা – মায়ের সাথে তার শান্তির ঘুম দেওয়া সবটাই তূর্যয়ের চোখে ভেসে আসছে।তূর্যয়ের অস্থিরতা কমতে লাগলো।তার চোখে অতীতের সুখময় দিনের কথাগুলো মনে আসতেই তূর্যয়ের চোখে পানি জমেছে।তূর্যয় ধীরে ধীরে অতীতের দুঃখের দিনগুলো ভুলে তার সুখের দিনগুলো ভাবতে লাগলো।তূর্যয়ের বুকের ধড়ফড় ভাব কমছে।তূর্যয় ধপ করে চোখ খুললো।আগের মতো তার চোখে এখন আর তার মা বাবার অতীতের খারাপ চিন্তা আসছে না।যেদিকে তাকাচ্ছে সে,সেদিকেই তার বাবা মায়ের হাসি মুখ দেখতে পাচ্ছে সে।তূর্যয় বুঝতে পারছে তার বুকটা আজ হালকা লাগছে।তূর্যয় রাণীর কোমরে হাত পেঁচিয়ে জড়িয়ে ধরলো।তূর্যয় ভাঙ্গা কণ্ঠে বললো,
–“আমি ঠিক আছি।”
রাণী তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে তার গালে একটা চুমু দিলো। তা দেখে মোল্লা সাহেব কিটকিট করে হেসে উঠলো।সাথে সব বাচ্চারা রাণীকে চুমু দেওয়া শুরু করলো।হ্যারি এইসব দেখে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তূর্যয় রাণীর এমন কান্ড দেখে নিজেই অবাক। রাণী তূর্যয়কে ছাড়তে চাইলে তূর্যয় রাণীর কোমর আরো শক্ত করে চেপে ধরলো।অন্যসব বাচ্চারা তূর্যয়ের হাত ছুটিয়ে দিতে চাইলো রাণীর কোমর থেকে।কিন্তু,তূর্যয় নিজের হাত শক্ত রেখেই বাচ্চাদের বললো,
–“কি সমস্যা?”
ওয়ানিয়া বলে উঠলো,
–“আঙ্কেল, আন্টিকে দিন।আমরা খেলবো এখন।”
অস্থিরতার কারণে তূর্যয় ঘেমে একাকার।তূর্যয় রাণীর ওড়না দিয়ে নিজের কপালের ঘাম মুছে বাচ্চাদের বললো,
–“নাহ,দেওয়া যাবে না।”
বাচ্চারা সবাই তূর্যয়কে চিল্লিয়ে উঠলো।রাণী ইশারা করতেই তূর্যয় রাণীকে ছেড়ে দিলো।রাণী আর বাচ্চারা খেলা শুরু করার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে।হ্যারি হাত উঠিয়ে তাদের বলে উঠলো,
–“আমিও খেলবো।সিস, আই ওয়ান্ট টু জয়েন ইউর গ্রুপ।”
–“ঠিক আছে,ভিনদেশী ভাই।”
রাণীর শান্ত জবাব।সবাই মিলেই খেলতে বসলো।
তূর্যয় মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে।হালকা মাথা ব্যাথা করছে তার।কষ্টদায়ক অতীতের কথা মনে আসতেই তূর্যয় অসুস্থ হয়ে পড়তো।সেখানে আজ সে এই বাড়িতে বসে আছে,এটা ভাবতেই অবাক হচ্ছে সে।তূর্যয় এখনো তার বাবা মায়ের সাথে কাটানো ভালো দিনগুলোর কথা মনে করছে।তূর্যয় দুইহাতে নিজের মাথা চেপে ধরলো।মোল্লা সাহেব এসে বসলো তূর্যয়ের পাশে।তূর্যয়ের মাথায় হাত রেখে মোল্লা সাহেব বলে উঠলেন,
–“অনেক দোয়া করেছিলাম আল্লাহ্ এর কাছে,এই মেয়েটা যেনো তোর জীবনের আঁধার কাটাতে তোকে সাহায্য করে।দেখ,আল্লাহ্ আমার দোয়া কবুল করেছে। মেয়েটা তোর জীবনের জন্যে এক রাশ আলো।সামলিয়ে রাখিস তাকে।”
মোল্লা সাহেবের কথায় তূর্যয় ঘাড় বাঁকিয়ে পেছনে ফিরলো।রাণী,হ্যারি আর বাচ্চারা,সবাই মিলে খেলছে।তূর্যয় মোল্লা সাহেবকে প্রশ্ন করলো,
–“মেয়েটা এমন কেনো?আমার সব সমস্যার সবাধান কেনো, এই মেয়েটা?”
–“তোর হিংস্রতার মাঝে ভালো মানুষটাকে মেয়েটা উপলব্ধি করতে পেরেছে তাই।তোকে বুঝে উঠার ক্ষমতা আল্লাহ্ এই মেয়েকে দিয়েছে,তাই।সারাজীবন একসাথে থাক তোরা,এই দোয়া করছি আমি।”
কথাটা বলে মোল্লা সাহেব উঠে পড়লেন।তূর্যয় রাণীর দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে,
–“ভালোবাসি তোকে,অনেক বেশি।ধন্যবাদ তোকে,
আমার অতীতের এই বিষাক্ততা কাটাতে আমাকে সাহায্য করার জন্যে।চিন্তা করবেন না,মোল্লা সাহেব।আমি আমার রৌদ্রকে আগলিয়ে রাখবো সব খারাপ জিনিস থেকে।আমার রৌদ্র শুধু আমার,একান্তই আমার।”
তূর্যয় কথাগুলো ভেবে রাণীর খিলখিল হাসি শুনছে। নেশাযুক্ত চোখে তূর্যয় রাণীর চঞ্চলতা,রাণীর হাসি,
রাণীর অঙ্গভঙ্গি সবটাই মন ভরে দেখছে।তূর্যয়ের বুক বারবার কেঁপে উঠছে রাণীকে দেখে।রাণীকে নিজের করে নিতে, তূর্যয়ের একটুও অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করছে না।তূর্যয় অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার রৌদ্রের দিকে।

খেলার ছলে রাণী তূর্যয়ের দিকে বারবার তাকাচ্ছে।তূর্যয়কে এইখানে বসে থাকতে দেখে রাণীর মনে শান্তির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে।রাণী তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে মনে মনে বলছে,
–“ধীরে ধীরে আপনার জীবনের সব আঁধার দূর করে দিবো আমি। আপনার জীবনে এই রাণীই আলো ছড়িয়ে দিবে সারাজীবন।চিন্তা করবেন না দানব সন্ত্রাসী, আপনার রৌদ্র সারাজীবন আপনার সাথেই থাকবে।কিছুদিন যাক,সুযোগ বুঝেই সালেহা ম্যাডামের সাথে আপনার জীবনের রহস্যটা সমাধান করে দিবো আমি।ইস আল্লাহ্,এই রহস্য যেনো ঠিকই উদঘাটন করতে পারি।এই দানব সন্ত্রাসী যেনো ক্ষেপে না যায় আমার উপর।এই সন্ত্রাসীর বিশ্বাস নেই।আল্লাহ্ আমাকে রক্ষা করবেন!”
রাণী আপনমনে তার দানব সন্ত্রাসীর জীবনের এই রহস্য ভেদ করার নানান চিন্তা করছে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে