আলো আঁধার পর্ব-২৪

0
2429

#আলো_আঁধার

পর্ব ঃ- ২৪
~আঁখি দেব তৃপ্তি

“এগুলো কী শ্রাবণ? ”

“ব্যবহার করলেই বুঝতে পারবে।”

“মানে কী? কীসের জন্য ব্যবহার করবো?”

“এগুলো অনেক ভালো মানের ক্রিম, লোশন। এগুলো ব্যবহার করলে তুমি আস্তে আস্তে ফর্সা হয়ে উঠবে। ”

“কী?”- চোখ মুখ কুচকে বললো আলো।

” এরকম রিয়েক্ট করছো কেন? আমি তো তোমার কথা ভেবেই..”

“তোমাকে আর ভাবতে হবে না আমার কথা শ্রাবণ। আমি তো ভাবতেই পারছি না যে তুমি আমাকে এরকম করে বলতে পারো।”

“এভাবে বলছো কেন?”

“তোমার কী আমাকে এভাবে গ্রহণ করতে সমস্যা হচ্ছে? আমি কেমন তা কী তুমি আগে দেখো নি? তোমার যখন আমার গায়ের রং নিয়ে সমস্যা তাহলে কেনো জড়িয়েছিলে আমার সাথে?”

“সমস্যা ঠিক আমার না আলো। একটু শুনো আমার কথা, বুঝার চেষ্টা করো।”

“আর কী শুনার আর বুঝার আছে। আমার সব আশা, স্বপ্ন এলোমেলো করে দিয়েছো তুমি শ্রাবণ। ”

“শোন আলো আমার মা অনেক অসুস্থ জানোই তো। উনি আগামী সপ্তাহেই আমার বিয়ে দিবেন বলে ঠিক করেছেন আমি তোমার কথা বলার পর উনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। উনি কিছুতেই তোমাকে বউ করতে রাজি নন। উনার কথা আমাদের আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কেউ এতো কালো নয়। তোমাকে বউ করে নিলে লোকে কী বলবে। আমি এখন কী করবো বলো।”

“তোমারও কী আমাকে ফর্সা রঙে দেখলে ভালো লাগবে।”

“বউ সুন্দর হোক এটা তো সব ছেলেরাই চায় আলো। আমি তোমায় খুব বেশি সুন্দর হতে হবে এমন চাইছি না। একটু মানানসই হলেই হলো।”

“তার মানে আমি তোমার সাথে মানানসই নই?”

“আমি ঠিক এভাবে বলি নি আলো। অনেক সময় দেখো না আমরা কোথাও বসলে কিংবা রাস্তা দিয়ে হাটার সময় মানুষজন কীরকম একটা চোখে তাকিয়ে থাকে। পিছনে কথাও বলে। এগুলো দেখতে কী ভালো লাগে আমার বলো?”

“ধন্যবাদ শ্রাবণ। এ বিষয়গুলো আমাকে ক্লিয়ার করে বুঝিয়ে দেবার জন্য নয়তো আমি ভুল ভাবনা নিয়েই তোমায় ভালবেসে যেতাম। আর সমস্যাটা শুধু তোমার মায়ের নয় শ্রাবণ তোমারও কিছু আছে নয়তো তোমার মা এখানে ফ্যাক্ট হতেন না। তুমি ঠিক উনাকে বুঝাতে পারতে। আসছি আমি। ভালো থাকো।”

“আলো প্লিজ এরকম যেও না। তুমি ভুল বুঝছো আমায়। আমি তোমায় ভাল না বাসলে কী এতোটা ভাবতাম বলো। আমি তো মনে মনে ঠিক করেছিলাম যে আমি যে ট্যুর প্যাকেজ জিতেছি যেখানে তুমি আমি দুজনেই যাব।”

“এমন ভালবাসার আমার কোনো প্রয়োজন নেই শ্রাবণ যা আমার অস্তিত্বকে বদলে দিতে চায়। ট্যুরে গেলেও অন্যান্যদের মাঝে তোমার আমাকে নিয়ে অস্বস্তি বোধ হবে। তুমি বরং তোমার মায়ের পছন্দ করা সুন্দরী মেয়েকেই বিয়ে করে নাও।”- বলে আলো শ্রাবণের দেয়া প্যাকেট টেবিলের উপর রেখে দ্রুত কফিশপ থেকে বেড়িয়ে গেল।

বাসায় ফিরার পথে ঈশানের সাথে দেখা হয়ে যায় আলোর। ঈশান ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করবার জন্য আলোর দিকে এগিয়ে আসে কিন্তু আলো তাকে দেখেও না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে। আলোকে কীরকম একটা লাগছিল। কিন্তু এভাবে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ায় খুব খারাপ লাগলো ঈশানের।

বাসায় ফিরে দ্রুত নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল আলো। তারপর হ্যান্ড ব্যাগ বিছানার উপর ছুড়ে ফেললো। চুলের বাঁধন খুলে এলোমেলো করে দিল সব চুল। গায়ের ওড়নাটাও ছুড়ে ফেললো ফ্লোরে। তারপর আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। আয়নায় যে অবয়ব দেখা যাচ্ছে তা প্রায় পাগলপ্রায় অবস্থার এক কালো মেয়ে। তার চোখের কাজল অশ্রুতে গলে আরও কালো করে তোলেছে চোখের নিচের অংশ। হালকা গোলাপি লিপস্টিক পড়া ঠোঁট দুটি কেঁপে কেঁপে উঠছে কান্নার তালে।

বিকেল বেলা শ্রাবণের ইনভাইটেশন অনুযায়ী ঈশান,নিলয়, প্রমি, দিয়া সবাই উপস্থিত হলো রেস্টুরেন্টে। সবাই অভিনন্দন জানালো শ্রাবণকে। তারপর যার যার ইচ্ছে মতো খাবার অর্ডার করলো আর আড্ডায় মেয়ে উঠলো। একপর্যায়ে ঈশান শ্রাবণকে জিজ্ঞেস করলো –

“কী রে শ্রাবণ আলোকে আসতে বলিস নি? ”

ঈশানের প্রশ্নে খানিকটা ঘাবড়ে গেল শ্রাবণ। আচমকা কী উত্তর দিবে বুঝতে পারলো না।

“কী রে কী ভাবছিস?”- ঈশান।

” না কিছু না। আলোকে বলেছিলাম আমি। ও বললো ওর শরীর বেশি ভালো না আজ বেড়োতে পারবে না।”

“ও।”- ঈশান বুঝতে পারলো কিছু একটা সমস্যা হয়েছে কিন্তু শ্রাবণ তা বলতে চাইছে না।

সবাই খেয়ে দেয়ে মজা করে চলে যাবার পর ঈশান শ্রাবণকে নিয়ে ওদের পুরনো আড্ডার জায়গায় গেল। তারপর জিজ্ঞেস করলো –

” শ্রাবণ কী হয়েছে আমাকে বল।”

“কী আবার হবে?”

“কিছু তো একটা হয়েছে। তুই মিথ্যা কথা বললি কেন?”

“মিথ্যা বললাম কী?”

“বলেছিলি আলো বাসা থেকে বের হবে না বলেছে কিন্তু আমি আলোকে বাইরে থেকে বাসায় ফিরতে দেখেছি। ওকে কীরকম একটা ডিস্টার্বড লাগছিল।”

শ্রাবণ চুপ করে রইলো।

“কী হলো চুপ করে গেলি কেন? বল আমাকে কী হয়েছে। ”

শ্রাবণ সবটা খুলে বললো ঈশানকে। সবকিছু শুনে ঈশান খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর বললোঃ-

“কাজটা তুই ঠিক করিস নি শ্রাবণ। তোর বা তোর পরিবারের কেমন লাগবে, মানবে কিনা না এইসব তোর আগে ভাবা উচিত ছিল। আর একটা মেয়েকে এরকম জিনিস এভাবে গিফট দেওয়ার কথা ভাবলি কীভাবে তুই? আগে তো তোর বুঝার চেষ্টা করা উচিত ছিল যে আলো নিজেকে বদলাতে চায় নাকি না। ও তো চাইলে নিজেই এসব কিনে ব্যবহার করতে পারতো।”

“আমি এখন কী করবো দুস্ত বুঝতে পারছি না। একদিকে মা একদিকে আলো। ”

“তোর মন কী বলে ভেবে দেখ তবে আমার মতে মেয়েটার সাথে এমন করা তোর একদম উচিত হয়নি। আর তুই নিজের জায়গায় ঠিক থাকলে আন্টিকে বুঝানো খুব কঠিন হবে বলে মনে হচ্ছে না। ”

“তুই বুঝতে পারছিস না ঈশান।”

“আমি সবই বুঝতে পারছি। তুই আগে আলোর কাছে ক্ষমা চেয়ে নে। তারপর ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ তুই কী চাস? আলোকে মানতে দ্বিধা থাকলে সরাসরি কথা বলে ক্লিয়ার কর। অযথা মেয়েটার কষ্ট বাড়াস না।”

“হুম, আচ্ছা।”

রাতে বাসায় ফিরার পর শ্রাবণের মা তাকে নিজের ঘরে ডাকলেন।

“হ্যা মা বলো।”

“বিয়ের ব্যাপারে কী ভাবলি?”

“আমি তো বললাম মা আমি আলোকে পছন্দ করি।”

“আমি তোকে সেদিন এতো করে বুঝালাম তাও তুই একি কথা বলছিস। আমি আজ আছি কাল নেই। আমার এই শেষ ইচ্ছেটা তুই রাখবি না?”

“মা আজ এসব বিষয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আজ আমি বেতন পেয়েছি মা। তোমার জন্য একটা শাড়ি কিনেছি। দাড়াও নিয়ে আসি।”- বলে শ্রাবণ নিজের ঘরে গিয়ে শাড়ির ব্যাগ নিয়ে এলো। তারপর তা ওর মায়ের হাতে দিল।

শ্রাবণের মা শাড়ি দেখে খুব খুশি হয়ে বললেন-
” শাড়িটা খুব সুন্দর হয়েছে বাবা। আমি এটা তোর বিয়েতে পড়বো।”

“আচ্ছা মা আমি যাই কাজ আছে।”- বলে শ্রাবণ তার ঘরে চলে গেল।

বাবা -মাকে রাতের খাবার দিয়ে আলো নিজের ঘরের জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। ঘন অন্ধকার রাত, আকাশে নেই কোনো চাঁদ,শুধু হাতে গোনা কয়েকটি তারা মিটিমিটি করে জ্বলছে। আলো নিজের অন্ধকারের সাথে প্রকৃতির অন্ধকার মিলিয়ে নিজেকে একটু হালকা করার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই তা পারছে না। বার বার ভিজে যাচ্ছে তার চোখের পাতা।
হঠাৎ বিছানায় রাখা মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। আলোর ইচ্ছে হচ্ছে না এখন কারো সাথে কথা বলতে।
তাই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো সে। একবার বেজে থামার পর আবারও বাজতে শুরু করলো ফোন। এবার বাধ্য হয়েই আলো ফোন রিসিভ করতে এগুলো। কাছাকাছি এসে শ্রাবণের নাম্বার দেখে আবারো মুখে কালো ছায়া পড়ে গেল আলোর। তবুও ফোন রিসিভ করলো আলো।

” হ্যালো।”

“কী করছো আলো?”

“কিছু না।”

“আজকের ব্যবহারের জন্য সরি আলো। আমি আসলে বুঝতে পারি নি তুমি এতোটা কষ্ট পাবে।”

“সরি বলার কিছু নেই। আমারই ভুল আমি নিজের মতো করে ভেবে নিয়েছিলাম।”

“এভাবে বলো না আলো। তুমি কী চাও বলো?”

“আমার চাওয়া তুমি যদি জানতে বুঝতে পারতে তাহলে আজ এমন করতে না।”

“আমি একটা জিনিস ভেবেছি।”

“কী?”

“আমরা রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে ফেলি চল। তারপর মা আর কিছু বলতে পারবে না।”

“আমি লুকিয়ে বিয়ে করতে চাই না শ্রাবণ আর এমন কাউকে তো নয়ই যে আমার অস্তিত্ব বদলে দিতে চায়।”

“বিয়ে তো পরে হবে সবার সামনে এখন জাস্ট রেজিস্ট্রির কথা বলছি। প্লিজ রাগ করে থেকো না। কাল একবার দেখা করো সামনাসামনি কথা বলবো।”

কী বলবে ভেবে পেল না আলো।

“ভেবে দেখবো। ”

“এসো প্লিজ। ”

“দেখি।”

“আচ্ছা আজ অনেক ক্লান্ত লাগছে রাখি?”

“ওকে।”

সারারাত বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবলো আলো সে কী চায়? কী করা ঠিক হবে। তার মন শ্রাবণকে ছাড়তেও চাইছে না আবার ওর সাথে জড়াতেও পুরোপুরি সায় দিচ্ছে না। অনেক জটিল হয়ে উঠেছে মুহুর্তটা। যাই হোক কাল সামনাসামনি কথা বলার পর ঠিক করা যাবে এই ভেবে ঘুমানোর চেষ্টা করতে শুরু করলো আলো।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে