#আলো_আঁধার
পর্ব ঃ- ২২
~আঁখি দেব তৃপ্তি
শ্রাবণ বাসায় ফিরার পর দেখেছিল ওর বাসায় অনেক লোকজন। প্রথমে বিষয়টা বুঝতে পারে নি শ্রাবণ। পরে ওর মাকে জিজ্ঞেস করার পর বুঝতে পারলো। শ্রাবণের মামাতো ভাই এক মেয়েকে নিয়ে এসে শ্রাবণদের বাসায় উঠেছে। মেয়েটি বাসা থেকে পালিয়ে এসেছে। মেয়েটি বলছে যে ওর পরিবারের লোকজন ওকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছিলো আর সে শ্রাবণের মামাতো অয়নকে ভালবাসে তাই পালিয়ে এসেছে। কিন্তু মেয়ের অভিভাবকরা উল্টো কেস করেছে থানায় যে ছেলেটা ভুলিয়ে ভালিয়ে ওদের মেয়েকে নিয়ে গেছে। এ নিয়ে পুলিশ এসেছে শ্রাবণদের বাসায়। তারপর শ্রাবণের মা নিজের ভাইদের খবর দিয়ে নিজের বাসায় আসার জন্য বলেছেন। মেয়ের পরিবারের লোকজনও এসেছে। সবাই মিলে এখন বিচারে বসেছে। সবাই অপেক্ষায় আছে ফলাফলের।
মেয়ের বাড়ির লোকরা অনেক ভেজাল করলো কিন্তু মেয়েটি অনেক শক্ত। তার সেই এক কথাই। যেহেতু মেয়েটি সাবালিকা তাই আইনও মেয়ের কথামতো ছেলের পরিবারকে মেয়েটিকে মেনে নিতে বললো আর মেয়ের পরিবারকেও সবটা মেনে নিতে বললো। কিন্তু মেয়ের পরিবার সবকিছু মেনে নিল না। তারা আর এ মেয়ের মুখ দেখবে না বলে চলে গেল। রাত অনেকটা হয়ে যাওয়ায় শ্রাবণের মা আর নিজের ভাই, ভাই-পো আর মেয়েটিকে যেতে দিলেন না। তাদের বাড়ি শহর থেকে অনেকটা দূরে।
মেয়েটি অবিরাম কেঁদে যাচ্ছে আর অয়ন পাশে বসে বসে দেখছে। শ্রাবণ এসব দেখে অয়নের পাশে গিয়ে বসে ওর মাথায় একটি থাপ্পড় মেরে বললো –
“কীরে এ বয়সেই এতো বড় কাজ করে ফেললি?”
“আর লজ্জা দিও না দাদা আমার কিছু করার ছিল না এ ছাড়া। ”
“বুঝলাম, এখন যে মেয়েটি কাঁদছে চুপচাপ দেখছিস কেন?”
“কী করবো। সে তার বাবা মার জন্য কাঁদছে।”
“তুই সান্তনা দিবি। ”
“কী বলে দিব?”
“মেয়ে নিয়ে পালাতে জানিস আর কী বলে সান্ত্বনা দিবি জানিস না গাধা?”
অয়ন চুপ হয়ে ভাবতে লাগলো শ্রাবণের কথায়। শ্রাবণ মেয়েটিকে বললো-
“এই যে ম্যাডাম এতো কান্নার কিছু নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে। ”
“আমার নাম লিলি।”- কাঁদো কাঁদো গলায় উত্তর দিল মেয়েটি। বুঝা যাচ্ছে ম্যাডাম সম্মোধন তার ঠিক পছন্দ হয় নি। মনে মনে হাসলো শ্রাবণ। তারপর অয়নের কানে কানে বললো-
” ওকে বল। তাড়াতাড়ি সংসারে মন দিয়ে বাচ্চা-কাচ্চা ফুটিয়ে ফেলতে তাহলেই নাতি-নাতনির মুখ দেখে ওর বাবা আর রাগ করে থাকতে পারবে না। এখন কান্নার কোনো প্রয়োজন নেই। ”
“ইস, ভাইয়া কী যে বলো তুমি!”
“ভুল কী বললাম তুই সিনেমা দেখিস না? এইটুকু সান্ত্বনাও তোকে শিখিয়ে দিতে হবে কেন? ছোট ভাইয়ের বউ বলে তো অকে কিছু বলতে পারবো না তাই তোকে বললাম। কাজে লেগে পড়ো বৎস্য আমি গেলাম হা হা হা।”
অয়নকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে এলো শ্রাবণ। তারপর তার মাকে বললো-
“মা সব তো মিটে গেছে আমাকে এবার যেতে হবে।”
“এতো রাতে কোথায় যাবি?”
“হাসপাতালে তোমাকে বললাম না আলোর মা অসুস্থ। ”
আলোর নাম নিতেই প্রমির আলো সম্পর্কে বলা কথাটা শ্রাবণের মার মনে হলো। আর নিজের ছেলে পড়ে উল্টো পাল্টা কিছু করে বসে কিনা ভয়ও হলো। তিনি নরম গলায় বললেন –
“তুই তোর বাসার এই অবস্থা রেখে এতো রাতে কীভাবে বাইরে যাওয়ার কথা বলছিস? ওখানে তো কালও যেতে পারবি। তোর দুই মামা কতো আপসেট হয়ে আছে অয়নের এইকাজে দেখতে পারছিস না। একবারও তো ওদের সাথে কথা বললি না এখনো। বাসার কারো খাওয়া দাওয়াও হয় নি এখনো আর তুই বলছিস এ অবস্থায় বাইরে চলে যাবি!”
“কিন্তু মা ওখানে…”
“আমি কোনো কিন্তু শুনতে চাই না। তুই এখন কোথাও যাবি না। তোর বাবা তোকে ডাকছে যা মামাদের সাথে কথা বলে আয়।”- বলে শ্রাবণের মা রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।
শ্রাবণ কী করবে বুঝতে পারছে না। একটা খুঁজ নেওয়া প্রয়োজন ভেবে প্যাকেট থেকে ফোন বের করে দেখলো ফোনটাও চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
ঈশান খাবারের প্যাকেট আলোর পাশে রেখে বললো –
” অনেক রাত হয়েছে খেয়ে নিন অল্প।”
“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“আপনার মায়ের দেখাশুনা করার জন্য আপনার নিজের সুস্থ থাকাটা আবশ্যক তাই খেয়ে নিন একটু। ”
পেটে খিদে থাকা সত্ত্বেও খাওয়ার ঈচ্ছে ছিল না আলোর কিন্তু ঈশানের যুক্তিটা ফেলে দেওয়ার মতো না। তাই আস্তে আস্তে খাবারের প্যাকেট খুলে খেতে শুরু করলো আলো।
ডাক্তার এসে একবার আলোর মাকে দেখে গেলেন। বললেন উনাকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে তাই আজ আর রাতে জাগবেন না। আলো ও ঈশান যেন নিশ্চিতে বিশ্রাম করে।
ঈশান বুঝতে পারলো সে কেবিনে থাকলে হয়তো আলো সারারাত ঘুমাবে না। তাই আলোকে বললো-
“আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন আমি বাইরে গিয়ে বসছি। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে জানাবেন।”
“আপনি অনেক কষ্ট করেছেন। এবার বাসায় ফিরে যেতে পারেন। আমি একাই থাকতে পারবো এখানে। আপনি না ঘুমিয়ে সারারাত বসে থাকবেন এটা ঠিক হবে না।”
“আমার রাত জেগে অভ্যাস আছে কোনো সমস্যা হবে না। আপনি একটু বিশ্রাম নিন।”- বলে ঈশান বাইরে চলে গেল।
আলোর খুব ক্লান্ত লাগছিল তাই কেবিনের অন্য বেডে শুয়ে পড়লো কিন্তু ঘুম এলো না তার চোখে। কীকরে এতো টাকা পাবে সে? মাকে কী সুস্থ করতে পারবে? এসব চিন্তায় পার হতে লাগলো সময়।
রাত ২ টা,
চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে আলো। শ্রাবণ দুই বার ফোন দিল কিন্তু আলো ধরলো না। তারপর শ্রাবণ ঈশানের নাম্বার ডায়েল করলো।
” হ্যালো ”
“ঈশান কোথায় তুই?”
“কোথায় আবার হাসপাতালে। তোর কী হয়েছে? এলি না এখানে ফোনও ধরলি না।”
“সরি রে, আমি একটা সমস্যায় আটকে গেছিলাম। আলো কোথাও? ”
“যাই হোক জানানো তো উচিত ছিল তোর। আলো কেবিনের ভেতর হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। ”
“তুই কোথায় তাহলে?”
“বাইরে বসে আছি।”
“তোকে কষ্টে ফেলে দিলাম।”
“কষ্টের কিছু না। কিন্তু তোর একটা ফোন করা উচিত ছিল। আলো হয়তো কষ্ট পেয়েছে তোর জন্য। ”
“আমি কাল খুব সকালেই চলে আসবো। তুই আজ একটু কষ্ট কর দুস্ত।”
“আচ্ছা।”
“আন্টির অবস্থা কেমন?”
“বলা যাচ্ছে না। ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রেখেছে।”
“ও, আচ্ছা তাহলে তুই রেস্ট নে। ”
“হুম, রাখছি।”
“হুম।”
পরেরদিন আলোর বাবাসহ শুভাকাঙ্ক্ষী সবাই এক এক করে হাসপাতালে আসলেন। শ্রাবণ ও তার বাকি বন্ধুরাও এলো। ঈশানের চোখ লাল হয়ে আছে। বুঝা যাচ্ছে সারারাত ঘুমায় নি সে। আলোর মন ভালো নেই সে কারো সাথেই তেমন কথা বলছে না।
ডাক্তার এসে জানালো দুপুরের মধ্যে ১ লাখ টাকা জমা করতে হবে। আলো কী করবে বুঝতে পারলো না। প্রতিমাসে টিউশন করে কিছু টাকা জমিয়ে রাখতো আলো। সেখানে বড়জোর হাজার ত্রিশ হবে। বাকি টাকা কোথায় পাবে সে। আলোর মার কিছু গহনা আছে কিন্তু সেগুলা কোথায় রাখা তাও জানে না আলো। ব্যংকেও হয়তো আছে কিছু টাকা কিন্তু এসব সম্পর্কে কখনো মাকে কিছু জিজ্ঞেস করা হয় নি আলোর। আলার বাবা তখন এগিয়ে এলেন আলোর দিকে। তারপর বললেন-
“চিন্তা করিস না মা আমার কাছে লাখ দুয়েক টাকা আছে আমি এখনি গিয়ে নিয়ে আসছি। ”
“কিন্তু আপনি টাকা দিয়েছেন মা পড়ে জানতে পারলে রাগ করবে।”
“পরের কথা পরে দেখা যাবে। এখন তো ওকে সুস্থ করা প্রয়োজন। তাছাড়া ওর দায়িত্ব আমার ছিল যা আমি এতোবছর পালন করি নি। ছাড়াছাড়ির সময়ও সে কোনো টাকা নেয় নি আমার থেকে। আমি ওর অপরাধী আমাকে নিজের প্রায়শ্চিত্ত করার এই সুযোগটুকু দে মা।”
আলো আর মানা করলো না। আলোর বাবার টাকা দিয়ে আলোর মার প্রথম ধাপের চিকিৎসা সম্পন্ন হলো।
পরের দিন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেন আলোর মা। কিন্তু ডাক্তার জানালেন আলোর মার রক্তেও ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়ছে আর যাতে আলসার ক্যান্সারে রুপ না নেয় তাই উনার রক্ত বদলাতে হবে এবং একটা সার্জারি করতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আর সবকিছুর খরচ আরও ৩ লাখ পড়বে।
আলোর বাবার কাছে ১ লাখ ছিল। আরো ২ লাখ প্রয়োজন। আলো ব্যস্ত হয়ে গেল টাকা ম্যানেজ করার জন্য। মায়ের কাছ থেকে গহনা ও ব্যংকের টাকার তথ্য জেনে সেগুলো তোলার জন্য চেষ্টা করতে লাগলো।
আলোর জমানো টাকা আর বাকি সবকিছু মিলিয়ে ১ লাখ হলো কিন্তু বাকি আরও ১ লাখ।
ঈশান শ্রাবণকে বললো সে ১ লাখ টাকা দিতে পারবে শ্রাবণ যেন আলোকে টাকাটা নেবার জন্য রাজি করায়।
আলো খুব চিন্তিত ছিল। শ্রাবণ আলোর কাছাকাছি গিয়ে বললো –
“আলো চিন্তা করো না বাকি ১ লাখ টাকার ব্যবস্থা আমি করে দিব।”
” কীভাবে? ”
“ঈশান দিবে বলেছে।”
“না আমি উনার টাকা নিতে পারবো না।”
“কেন আলো? ”
“এটা কীরকম দেখায় আর পড়ে কোথা থেকে ফিরিয়ে দিব এতো টাকা।”
“পরেরটা পরে দেখা যাবে। ”
“না শ্রাবণ সবটা ভেবে করাই ভালো। আমি ভাবছি ঠিক একটা উপায় বেড়িয়ে যাবে।”
“কী উপায় বের হবে।”
“কালকে এক্সিবিশনের শেষ দিন শ্রাবণ। ভালো পেইন্টিং গুলো অনেকে কিনে নেয়। আমার পেইন্টিং থেকে কিছু টাকা আসতে পারে। আমার মাকে ফেলে ওখানে গিয়ে এসব দেখার সময় নেই। তুমি কী একটু কষ্ট করে ওইখানে গিয়ে কতৃপক্ষের সাথে আমার বিষয়ে কথা বলে আসবে?”
“কেন নয়। আমি এখনি যাচ্ছি।”
শ্রাবণ ঈশানকে এসে বললো এক্সিবিশনের কথা তারপর দুজনে মিলে চলে গেল একাডেমিতে। সবটা শুনার পর কতৃপক্ষ জানালো প্রতিবছরই পেইন্টিং বিক্রি হয় তবে মূল্য ক্রেতার উপর নির্ভর করে। ভালো মুল্য পায় না বলে অনেক শিল্পীই বিক্রি করেন না পেইন্টিং। তবে প্রথম স্থান অধিকার করা পেইন্টিং ভালো দামেই বিক্রি হয়। শ্রাবণ বললো আলোর টাকা প্রয়োজন। যতই হোক পেইন্টিংটা বিক্রি করে দিতে বলেছে সে। কতৃপক্ষ শ্রাবণ ও ঈশানকে পরের দিন বিকাল ৪ টায় আসার কথা বললো।
পরের দিন বিকাল ৪ টায় শ্রাবণ ও ঈশান বসে আছে একাডেমিতে। অপেক্ষা করছে রেজাল্ট ঘোষণার। আলোর পেইন্টিং কী পারবে প্রথম স্থান অর্জন করতে এটাই ভাবছে দুজনে।