#আলো_আঁধার
পর্ব ঃ- ২০
~আঁখি দেব তৃপ্তি
আলোর বাবা নিজের করা কর্মের জন্য আলো ও ওর মায়ের কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং তাদের নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন কিন্তু এ প্রস্তাবে আলোর মা রাজি হলেন না। তিনি বললেন তাদের ছাড়াছাড়ি অনেক আগেই হয়ে গেছিল। বর্তমানে আর কোনো সম্পর্ক নেই তাদের মধ্যে আর এই শেষ বয়সে এসে নতুন করে কিছু উনার চাওয়ারও নেই। তবে আলো যদি চায় ওর বাবার সাথে থাকতেই পারে।
যে মা এতোদিন কষ্ট করে আলোকে বড় করেছেন তাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা আলো ভাবতেই পারে না। তবে বয়স্ক লোকটার অসুস্থ অবস্থা তার উপর হাজার হোক নিজের বাবা বলে আলো উনাকেও নিরাশ করতে পারলো না। মাঝে মাঝে উনার কাছে যাবে বলে কথা দিল।
ঈশান নতুন বাইক কিনার পর শ্রাবণকে বললো “কোথাও ঘুরতে যাবি?”
“না রে। কাজ আছে আজকে অনেক।”
“আচ্ছা তাহলে তোকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসবো?”
“না আমি অন্য একটা কাজে যাব। তুই বাসায় চলে যা।”
“আচ্ছা।”
বিকেলবেলা শ্রাবণ আলোকে এক্সিবিশনে আসার জন্য ফোন দিল কিন্তু আলো জানালো সে আজ আসতে পারবে না বাসায় কিছু সমস্যা আছে। শ্রাবণ যেন চূড়ান্ত পর্যায়ে কোন কোন পেইন্টিং গিয়েছে তা আলোকে জানায়। শ্রাবণ আচ্ছা বলে ফোন রেখে দিল আর রেজাল্টের অপেক্ষা করতে শুরু করলো।
চূড়ান্ত পর্যায়ের জন্য ৫ টি পেইন্টিং সিলেক্ট করা হলো এর মধ্যে আলোর পেইন্টিংটিও স্থান পেয়েছে। সাথে সাথে শ্রাবণ আলোকে জানালো। আলো ভেবেছিল আর বোধয় এগুতে পারবে না এতো ভালো ভালো পেইন্টিং ছিল সব। তাই খবরটা পেয়ে খুব খুশি হয়ে ওর মাকে জানালো। এসব শুনে আলোর বাবা এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে ওর বাবাকেও বললো তার এ গুনের কথা। আলোর বাবা খুব খুশি হলেন এবং নিজের ভুলের জন্য বার বার অনুশোচনা করতে লাগলেন।
শ্রাবণ খুব সুন্দরভাবে এডিট করলো আলোর সেই ছবিটি তারপর তা পোস্ট করলো কম্পিটিশনের গ্রুপে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ ভালো সারা পেল ছবিটি। আর শ্রাবণ বিজয়ী হওয়ার ভীব্র আশা ধারণ করতে শুরু করলো তার মনে। কম্পিটিশন ১ মাস চলবে তার পর রেজাল্ট আসবে। এই সময়টা কী সহজে পার হবে এই নিয়ে ভাবছে শ্রাবণ কারণ অপেক্ষার সময় বরাবরই দীর্ঘ হয়।
২ দিন পর আলোর বাবা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলেন। তারপর তিনি চলে গেলেন নিজের বাসায়। বাবার আদর ছোটবেলা থেকে পায়নি আলো। বাবা নিয়ে অনেক কৌতূহল, আগ্রহ ছিল তার মনে। কিন্তু একসময় মনে হয়েছিল হয়তো বাবার সাথে এ জীবনে তার দেখা হবে না। অবশেষে দেখা হয়েই গেলো তাও এইরকম অবস্থায়। উনাকে এতো কষ্টে দেখে নিজের ভিতরে জমিয়ে রাখা অভিযোগ, অভিমান আর আলো প্রকাশ করতে পারে নি। কিন্তু মন থেকে মিশতেও পারে নি উনার সাথে কীরকম একটা যেন লাগছিল। যাবার সময় অনেক কেঁদেছেন আলোর বাবা। আলো কথা দিয়েছে সে মাঝে মাঝে যাবে। বাবা হিসেবে উনি কোনো দায়িত্ব পালন করেন নি বলে সন্তানের দায়িত্বও ভুলে যাবে এরকম অমানবিক কখনো হতে পারে না আলো।
আলোর বাবা চলে যাওয়ার পর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন আলোর মা। নিয়তি কোথায় এনে তার সাথে তার স্বামীর দেখা করালো এই ভেবে অবাক হলেন। লোকটার চোখের জল কখনো দেখেন নি তিনি সেই লোকটা এভাবে কাঁদছে দেখে ভেতর ফেটে যাচ্ছিল উনার। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। এই দুই দিন নিজেকে যতটা সম্ভব দূরে দূরেই সরিয়ে রেখেছিলেন তিনি।
৭ দিন পর,
আলোর সাথে দেখা করতে এসেছে শ্রাবণ একটি কফিশপে। এটা এক্সিবিশন এর বাইরে ফটোসুট ছাড়া তাদের প্রথম আসা। এসব জায়গায় এসে অভ্যস্ত নয় আলো তাও আবার কোনো ছেলের সাথে। এতোদিনে আলো আর শ্রাবণের সম্পর্ক অনেকটাই অন্যদিকে এগিয়ে গেছে। আলো ভাবতে শুরু করেছে শ্রাবণ তাকে ভালবাসে। কিন্তু শ্রাবণের মনে কখন কী চলে সে নিজেও বুঝতে পারে না। বন্ধুরা সবাই আলোর কথা জানতে পেরেছে। পাগল করে দিচ্ছে আলোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। ছবিটা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। অসাধারণ, অসাধারণ কথায় ভরে যাচ্ছে মন্তব্য। তবুও বন্ধুদের সামনে আলোকে নিয়ে যেতে কীরকম একটা লাগছে শ্রাবণের কিন্তু কেন তার সঠিক উত্তর তার নিজের কাছেই অস্পষ্ট।
“কফিটা ভালো লেগেছে আলো?”- শ্রাবণ।
” হুম।”- আলো।
“এখান থেকে কোথায় যাবে?”
“এক্সিবিশনে যাব একটু তারপর বাবার বাসায় গিয়ে উনাকে দেখে আসবো।”
“তোমরা তো তোমাদের নিজেদের বাসায় গিয়ে থাকতে পারো।”
“জানোই তো সব শ্রাবণ। মা ওই বাসায় যাবে না। আর আমি মাকে একা রেখে কীভাবে যাব।”
“বুঝেছি। তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।”
“বলো।”
“আমার বন্ধুরা তোমার সাথে দেখা করতে চাচ্ছে।”
“ও, কিন্তু। ”
“কিন্তু কী?”
“আমার হয়তো আনইজি লাগবে সবার সামনে। কে কী বলবে কে জানে।”
“কেউ কিচ্ছু বলবে না। কাল কাল বিকেলে ফ্রি আছো?”
“হুম, ওই একটু এক্সিবিশনে যেতাম আর কী।”
“ও, ফাইনাল রেজাল্ট কবে দিবে?”
” ৩ দিন পর।”
“ও, তাহলে কাল না গেলে হয় না?”
“আচ্ছা, রাতে জানাবো।”
“আচ্ছা।”
“তুমি কোথায় যাবে এখান থেকে? ”
“এক্সিবিশনে যাব তোমার সাথে তারপর টিউশন। ”
“হুম।”
কফিশপ থেকে বেড়িয়ে রাস্তা দিয়ে হাটছে শ্রাবণ ও আলো। আশেপাশের মানুষজন কীরকম একটা আড়চোখে তাকাচ্ছে তাদের দিকে। দুইটা মেয়ে তো পেছনে গিয়ে বলেই দিল। দেখেছিস এতো হ্যান্ডসাম ছেলের প্রেমিকা কেমন কালো! কথাটা আলো শুনতে পায় নি কিন্তু শ্রাবণ শুনেছে। শুনার পর কিরকম একটা আনইজি লাগতে শুরু হলো তার।
পরেরদিন বিকেলবেলা শহর থেকে কিছুটা বাইরে একটা রিসোর্টে আলোকে নিয়ে গেল শ্রাবণ। রিসোর্টটা ঈশানের এক পরিচিত আঙ্কেলের তাই কোনো প্রকার টাকা পয়সা ছাড়াই তারা এখানে ঘুরতে পারে। মাঝে মাঝেই এখানে সবাইকে নিয়ে আসে ঈশান। আজ আলো আসবে বলে ওরা একটা সারপ্রাইজ ওয়েলকামের ব্যবস্থা করলো।
শ্রাবণ আলোকে নিয়ে ভেতরে ঢুকার পর পরই নিলয় ও প্রমি ফ্লাওয়ার স্প্রে করলো তাদের উপর। তারপর একটা ফুলের বুকে দিয়ে ওয়েলকাম জানালো আলোকে। তারপর শ্রাবণ সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল আলোর। ঈশানকে দেখে অবাক হলো আলো। শ্রাবণ ওকে তার বন্ধু সবার কথাই বলেছে কম বেশি। কিন্তু এই ঈশান যে শ্রাবণের বন্ধু তা ভাবতে পারে নি আলো। ঈসান অন্যসবার মতোই আলোর সাথে পরিচিত হলো যেমন এটা ওদের প্রথম দেখা।
সারাদিন অনেক ভালো কাটলো আলোর। শ্রাবণের বন্ধু সবাই খুবই মিশুক। আলোকে গুরুত্বও দিয়েছে তারা। বিশেষ করে নিলয় ছেলেটা। ঈশানের উপস্থিতির জন্য আলোর প্রথমে অনেকটা আনইজি লাগছিল। কিন্তু পরে আর লাগে নি। সে বুঝতে পারছিল ঈশানকে সে যেমন ভেবেছিল আসলে তেমন নয়। শ্রাবণও ঈশান সম্পর্কে ভালোই বলতো সবসময়। দিয়াকে একটু কেমন লাগছিল। শ্রাবণ বলেছিল দিয়ার সাথে ওর বুঝাপড়া খুবই ভালো তাই নতুন একজন দেখে হয়তো ওর একটু খারাপ লাগছে। প্রমি অনেক ছবি উঠলো। আলো ও দিয়া তেমন ছবি তোলার জন্য উৎসাহী ছিল না।
সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরলো আলো। আজ ওর খুব ভালো লাগছে। সবাই এভাবে ওকে গুরুত্ব দিবে ভাবতে পারে নি আলো। আসলেই ওরা সবাই খুব ভালো।
“মা, একটু শরবত বানিয়ে দিবে?”- আলো।
” আমার শরীর খারাপ লাগছে তুই বানিয়ে খা।”- আলোর মা।
মায়ের কন্ঠটা স্বাভাবিক লাগলো না আলোর কাছেম দ্রুত পায়ে মায়ের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল আলো। ঘরে ঢুকার পর যা দেখলো তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না আলো। ঘরের মেঝেতে রক্তে ভেসে যাচ্ছে। রক্ত বমি হচ্ছে ওর মা। আলো কী করবে ভেবে পেল না। পাশের বাসার এক মামার সাহায্য দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেল মাকে।
বাসায় ফিরার পথে প্রমি দিয়াকে জিজ্ঞেস করলো-
“আলোকে কেমন লাগলো দিয়া তোর?”
“ভালোই। ”
“একটু বেশিই কালো মেয়েটা।”
“তো কী হয়েছে?”
“ওকে কী আমাদের শ্রাবণের সাথে যাবে?”
“শ্রাবণের সাথে যাবে মানে?”
“তুই কী কিছুই বুঝতে পারিস নি?”
“না তো।”
” মেয়েটা শ্রাবণকে পছন্দ করে। আর শ্রাবণ ও মনে হচ্ছে… ”
“কীসব বলছিস শ্রাবণ তো বললো ওরা শুধুই বন্ধু।”
“এখন তো এটাই বলবে। ”
“এ কথা শুনে মুখ কালো হয়ে গেল দিয়ার।”
হঠাৎ প্রমির হাতে থাকা দিয়ার ফোনটা বেজে উঠলো। শ্রাবণের মা ফোন দিয়েছেন। এখন উনি কেন ফোন দিচ্ছেন!