#আলো_আঁধার
পর্ব ঃ- ১৯
~আঁখি দেব তৃপ্তি
“আরো তো সুন্দর সুন্দর ছবি আছে দেখলাম।”
“হুম, কিন্তু এটা বেস্ট হবে। এডিটিং করলে পুরাই অস্থির লাগবে।”
“হুম, তুই যা ভালো বুঝিস। তা কোথায় হলো এই মেয়েটার সাথে পরিচয়? ”
“ওই যে একাডেমিতে এক্সিবিশন দেখতে গিয়েছিলাম আর একটা পেইন্টিং আমার মনে ধরেছিল। এই সেই পেইন্টিং এর শিল্পী। ”
“ওই পেইন্টিং ইনি এঁকেছেন! দেখে তো বুঝাই যায় না।”
“হুম। আচ্ছা আমি আসি রে।”
“কফি খেয়ে যা।”
“না রে তুই খা। আমার অনেক কাজ আছে।”
“আচ্ছা যা তাহলে।”
কফিশপ থেকে বেড়িয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল ঈশান। মাঝরাস্তায় হঠাৎ লোকজনের ভীড় দেখে বাইক একপাশে দাঁড় করিয়ে এগিয়ে গেল ভীড়ের দিকে। লোকজদের সরিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলো একজন বয়স্ক ভদ্রলোক রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে আছে। একটি মেয়ে উনার চোখে মুখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে। প্রথমে মেয়েটির মুখ ঠিকমতো দেখতে পায় নি ঈশান। আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেল মেয়েটি আর কেউ নয় আলোই। অনেকক্ষণ চেষ্টার পরেও জ্ঞান ফেরানো গেলো না লোকটির। তারপর আলো তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য আশেপাশের লোকজনদের কাছে সাহায্য চাইলো কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না। অবশেষে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল ঈশান। একটি গাড়ি ডেকে আলো ও ঈশান ধরাধরি করে লোকটিকে একটি হাসপাতালে নিয়ে গেল। তারপর ঈশানই উনার চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করলো।
১ ঘন্টা পর মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলেন ভদ্রলোক। এতোক্ষণ আলো ও ঈশান লোকটির পাশেই বসে ছিল কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বলেনি। ছোটাছুটিতে অনেকটা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল আলোকে। ঈশান একবার চাইছিল আলোকে কিছু খাবার অফার করতে কিন্তু পরক্ষণেই আবার কী ভেবে বললো না কিছুই।
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে বললো যে উনাকে এখন বাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবে। ঈশান ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলো -” চাচা আপনার বাসার ঠিকানা বলতে পারবেন? ”
হ্যা সূচক মাথা নাড়ালেন ভদ্রলোক। তারপর আস্তে আস্তে ঈশানকে নিজের ঠিকানা বললেন। আলো ও ঈশান উনাকে উনার বাড়িতে পৌঁছে দিল। ওদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানালেন ভদ্রলোক। আলো খেয়াল করলো ভদ্রলোকের বাসায় কেউ নেই। উনি বেশ অসুস্থ বাসার কাউকে তো ডাক্তার যা বলেছে তা আর ওষুধপত্র সব বুঝিয়ে দিতে হবে তাই আলো জিজ্ঞেস করলো –
“আপনার বাসায় কাউকে দেখছি না যে?”
“কেউ নেই আমি একাই থাকি।”
“এই বয়সে একা কীভাবে থাকেন? ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী কোথায় আপনার।”
“সবাই যার যার মতো চলে গেছে।”- বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ভদ্রলোক।
” কোথায় চলে গেছেন?”
“স্ত্রী মারা গেছেন অনেকদিন আগেই। দুই ছেলে ছিল। বড়জন বউ নিয়ে বিদেশ চলে গেছে আমার কোনো খুঁজ-খবর নেয় না আর ছোট জন দিন দিন খারাপ পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছে হলে বাসায় আসে নয়তো না।”
“বলেন কী! তাহলে খাওয়া দাওয়া হয় কীভাবে আপনাদের?”
“মহিলা একজন এসে রান্না করে দিয়ে যায়।”
“আজকে এই অবস্থা কীভাবে হলো?”- ঈশান।
” সবই আমার কপাল বাবা। জীবনে অনেক পাপ করেছি তার ফল ভোগ করছি এখন। এই অবস্থা আমার ছেলেটাই করেছে। ওকে বুঝিয়ে বাসায় আনতে গেছিলাম কিন্তু আমাকে সবার সামনে রাস্তায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে চলে গেল। “- বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন ভদ্রলোক। ঈশান কী বলবে খুঁজে পেল না। এতোটা অমানুষ কেউ হয় কীভাবে!
” আপনি অসুস্থ। এখন আপনার দেখাশোনা কে করবে তাহলে? আগে এসব বললেন না কেন? তাহলে তো হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করা যেত।”
“আমার আর ভালো হওয়ার ইচ্ছে নেই মা। মরে গেলেই যেন শান্তি পাই।”
“এভাবে কেন বলছেন? আপনি বরং আমার সাথে চলুন। আমাদের বাসায় ২ দিন থেকে সুস্থ হবার পর না হয় এখানে আসবেন।”
“না মা, তোমাদের আবার আমার জন্য অসুবিধায় পড়তে হবে। ”
আলোর মানবিকতা দেখে খুব ভালো লাগলো ঈশানের। সত্যি মেয়েটা অনেক ভালো মনের। ছবিও দারুণ আঁকে তা জানা ছিল না। নিশু এ ব্যাপারে তো কিছু বললো না। যাই হোক আজ একবার এক্সিবিশনে গিয়ে ছবিটা ভালো করে দেখে আসবে এই ভাবলো ঈশান মনে মনে।
ভদ্রলোক প্রথমে আলোদের বাসায় যাবার জন্য রাজি না হলেও আলো উনাকে রাজি করিয়েই ছাড়লো।
“আমি কী আপনাদের পৌঁছে দিব?”- ঈশান।
” না আমি একাই পারবো।”- আলো।
“হুম, বুঝেছি। ”
“তোমার কতো টাকা খরচ হয়েছে বাবা হাসপাতালে? “- ভদ্রলোক।
” ও কিছু না। এসব ফেরত দিতে চেয়ে কষ্ট দিবেন না। আপনি আমার বাসার বয়সী। এইটুকু করতে পেরে আমার ভালোই লাগছে।”
“আমার ছেলেগুলো যদি তোমার মতো হতো বাবা।”
“চিন্তা করবেন না সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আলো ভদ্রলোককে নিয়ে বাসায় আসতে আসতে দুপুর পেরিয়ে গেল। ক্ষিদেও পেয়েছে খুব। আজ এক্সিবিশনের চুড়ান্ত ধাপে কোন কোন পেইন্টিং যাচ্ছে তার রেজাল্ট দিবে। তাই সকাল সকাল সেখানে যেতে চাইছিল আলো কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আজ আর যাওয়া হবে না। বাসায় কী রান্না হয়েছে কে জানে। ভদ্রলোককেও তো খাওয়াতে হবে।
কলিং বেল বাজানোর কিছুক্ষণ পর আলোর মা দরজা খুললেন।
“মা দেখো একজনকে নিয়ে এসেছি।”- আলো।
” কে?”- জিজ্ঞেস করে আলোর পিছনে তাকাতেই চমকে উঠলেন আলোর মা।
ঈশানের খুব ক্ষিদে পেয়েছে। তাই আগে একটি রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে বাইক যেখানে রেখে এসেছিল সেখানে গেল কিন্তু সেখানে তার বাইক খুঁজে পেল না।
সাথে সাথে শ্রাবণকে ফোন দিল ঈশান। শ্রাবণ ঘটনা স্থলে পৌছালো ২০ মিনিট পর।
“কীভাবে কী হলো?”-শ্রাবণ।
সবকিছু শ্রাবণকে বলার পর শ্রাবণ বললো-
” মেয়ে দেখে কী মাথা ঠিক ছিল না এমন বোকামি করলি?”
“মেয়ে দেখার কী? যাতা কথা বলিস না।”
“হা হা হা। যা গেছে তার আশা আর করে লাভ নেই। থানায় একটা জিডি কর। তারপর নতুন বাইক কিনার প্রস্তুতি নে। তোর তো আবার বাইক ছাড়া চলে না।”
“হুম, এখনি কিনবো চল।”
“এখনি!”
” হুম আয়।”
” আচ্ছা, যেমন তোর মর্জি।”
আলো দেখলো ওর মা এবং ভদ্রলোক দুজনেই একে অপরকে দেখে চমকে গেছেন। তার মানে কী ওরা পূর্বপরিচিত?
“মা তুমি উনাকে চিন নাকি?”- আলো।
আলোর মা কোনো উত্তর না দিয়ে দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে গেলেন।
” কী হলো মা এভাবে চলে গেলেন কেন? আপনি কী চিনেন মাকে।”- আলো।
কথাটা বলার পর ভদ্রলোকের চোখে জল দেখা গেল। উনি জিজ্ঞেস করলেন-
“তোমার নাম কী আলো?”
“হুম, আপনি কী করে জানলেন।”
লোকটা আবারো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। আলো উনাকে ভেতরে নিয়ে এসে বসালো তারপর দরজা লাগিয়ে দিয়ে আবার উনার কাছে গিয়ে বললো-
“আপনি এভাবে কান্না করছেন কেন? আর আমাকেই বা কীভাবে চিনেন? আমি কিছু বুঝতে পারছি না। প্লিজ সবটা খুলে বলুন।”
“আমি তোমার হতভাগ্য বাবা মা। আমাকে তুমি মাফ করে দাও।”- বলে লোকটি হাতজোড় করলো আলোর সামনে। হঠাৎ এমন কথা শুনে চমকে উঠলো আলো। দাড়ানো থেকে ধপ করে বসে পড়লো চেয়ারে। সবকিছু তার কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।