আলো-আঁধার পর্ব-০৩

0
1028

আলো-আঁধার🖤
লেখিকা:সালসাবিল সারা

৩.
সাবিনা স্থব্দ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।তার এই পরিকল্পনাটি ব্যর্থ যাবে,এটা বুঝতে তার একটুও কষ্ট হচ্ছে না।কারণ, তূর্যয় চাবুক নিচে ফেলে রাণী এবং সাবিনার দিকে হিংস্র নজরে তাকিয়ে আবারও চেয়ারে বসে পড়লো।এতেই;
সাবিনার বোঝা হয়ে গেলো তার পরিকল্পনা আজও সফল হবে না।রাগে সাবিনা নিজের হাত নিজেই খামচে ধরলো।তার চোখে যেনো হিংসার আগুন ঝরে পড়ছে।অন্যদিকে রাণী যেনো নিজের প্রাণ ফিরে পেলো, তূর্যয়কে চেয়ারে বসতে দেখে।রাণী তার চুলের উপর হাত চালিয়ে নিজেকে শান্ত করছে।এই কড়া রোদে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে রাণীর চুলগুলো কপালের ঘামের সাথে লেপ্টে রইলো।এতে রাণী আরো বেশি বিরক্ত হচ্ছে।নিজের চুলগুলোকে আগলিয়ে নিয়ে রাণী রোদ থেকে বাঁচার জন্যে আবারও নিজের মাথার উপর হাত দিল।তূর্যয় বর্তমানে ফোনে কথা বলছে।কিন্তু,কি কথা বলছে,সেটা রাণীর কানে প্রবেশ করছে না।তূর্যয় এক প্রকার ফিসফিস করে কথা বলছে ফোনে।রাণী তূর্যয় থেকে চোখ ফিরিয়ে সাবিনার দিকে তাকালো।সাবিনা বেশ হিংসাত্মক নজরে তাকিয়ে আছে তূর্যয়ের দিকে।নিজের ছেলের প্রতি সাবিনার এমন নজরের কাহিনী মাথায় এলো না রাণীর। সে সেদিক থেকে ধ্যান ফিরিয়ে তাকালো তূর্যয়ের দিকে।তূর্যয় এক হাতে মোবাইল একটু দূরে সরিয়ে রেখে এখন সে ঘাড় বাঁকিয়ে তার পাশের ছেলেটার কানে কিছু একটা বলছে।ছেলেটা তূর্যয়ের কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে চলে গেলে,তূর্যয় আবারও কানে ফোন লাগালো।এইবার সে বেশ জোরে বললো….
–“আসছি বললাম না?এতো চেচাঁচ্ছিস কেনো?বেশি কথা বললে,তোর এই মুখ একেবারের জন্যে বন্ধ করে দিবো। হ্যারিকে আপাতত সব সামলাতে বল।”
তূর্যয়ের চিল্লানো শুনে কলি রাণীর হাত চেপে ধরলো।রাণী নিজেও তূর্যয়ের এমন গর্জনে একটু অবাক হলো।কিন্তু এইভাবে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে রাণীর দুনিয়া ঘুরছে।তূর্যয় সোজা হয়ে বসতেই রাণী তার মাথা থেকে হাত নামালো।রাণী তার গলা খাকারি দিয়ে নিলো তূর্যয়ের সকল প্রশ্নের জবাব দিতে।কারণ রাণী জানে,তূর্যয় এখন তাদের নানান প্রশ্ন করবে।
–“কাহিনী কি এইবার বল।”
তূর্যয়ের কথা শুনে কলি চিমটি দিলো রাণীর পিঠে।আর ফিসফিস করে তাকে বললো…
–“তুই বল ভাই।আমি পারবো না কিছুই বলতে।”
রাণী কলিকে কিছু বলার আগেই তূর্যয় আবারও ভারী গলায় বললো…
–“তোদের জন্যে আমি সারাদিন এইখানে বসে থাকবো?জলদি জবাব চাই।”
এইবার রাণী এক নিঃশ্বাসে বলা শুরু করলো…
–“গতকাল আপনাদের বাসায় দুইটি জিনিস পাঠিয়েছিলাম।আমরা নিজ হাতে বেশ শক্ত পাকাপোক্ত করে জিনিস বানায়।আপনাদের জিনিসটাও বেশ ভালো করে বানিয়েছিলাম।কিন্তু আপনার মা বলছে জিনিসগুলোতে ফাটল ধরেছে।এটা কোনো কালেই সম্ভব না।”
রাণী তার বক্তব্য দিয়ে, চুপ হলো।রাণী তার নির্ভুল জবাব দেওয়ার কারণে বেশ খুশি।তূর্যয় যে রাণীর বক্তব্য শুনেছে এটা রাণীর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।বুকটা এক প্রকার ঢিপ ঢিপ করছে তার।তূর্যয় কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কিছু একটা চিন্তা করে সাবিনার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো…
–“আপনার কি কিছু বলার আছে?”
–“সব এদের দোষ।এরা সব মিথ্যে বলছে,বাবা।তুই আমার কথা বিশ্বাস কর।”
সাবিনার কথায় তূর্যয় তার কপালে হাত ঘষে বললো…
–“আমি জিনিসগুলো দেখতে চাই।”
কথাটা বলে তূর্যয় রাণীর দিকে তাকালো।তূর্যয়ের সাথে চোখাচোখি হতেই রাণীর বেশ অন্যরকম লাগলো,এক প্রকার অস্বস্তি।রাণী চোখ নিচে নামিয়ে নিলো।তূর্যয়ের কথায় সাবিনা গলার স্বর বড় করে বলে উঠলো…
–“আমি তোর মা।তোর কি আমার কথা বিশ্বাস হয় না?”
–“যখন আমি বিচার করতে বসি,তখন আমি কাউকে বিশ্বাস করি না।আমার হাতে সময় নেই।জলদি করলে ভালো হবে।”
তূর্যয় ভারী কণ্ঠে বললো।
–“ঠিক আছে।আমি আনিয়ে দিচ্ছি জিনিসগুলো।”
–“মালকিন, আপনি দাঁড়ান।আমি নিয়ে আসছি।”
একজন কাজের লোক বললো।কিন্তু সেই কাজের লোকের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে,সাবিনা নিজেই হন হন করে ভেতরের দিকে চললো।সাবিনার সম্পূর্ন শরীর যেনো রাগে রি রি করছে।সাবিনা পারছে না তার নিজের মাথার চুল ছিড়ে নিতে।সে রাণীদের তৈরি করা জিনিসগুলো নিয়ে আবারও বাহিরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
–“কিন্তু যায় হয়ে যাক,এই এতিম খানার মেয়েদের তো আজ তূর্যয়ের হাতে অত্যাচার করিয়ে ছাড়বো আমি।তাছাড়া তূর্যয়কে এই বাড়িতে আমি আর এক মুহূর্তেও সহ্য করতে পারছি না।নিজের এতো টাকা,অন্য কোথাও গিয়ে মরতে পারে না এই ছেলে।”
সাবিনা আপন মনে বলল কথাগুলো।
মাটির তৈরী জিনিসগুলো সাবিনা ধরিয়ে দিলো তূর্যয়ের পাশে দাঁড়ানো ছেলেটির হাতে।এরপর ছেলেটি জিনিসগুলো ভালো করে দেখাচ্ছে তূর্যয়কে।একটু পরে তূর্যয় নিজ হাতে জিনিসগুলো নিয়ে দেখতে লাগলো।আর তূর্যয় তীক্ষ্ণ নজরে সাবিনার দিকে তাকিয়ে বললো…
–“এইসব কিন্তু একদম ভালো কাজ না।মাটির জিনিসে ফাটল ধরলে এইভাবে ধরে না।এই জিনিসের উপর কেউ আঘাত করে ফাটল ধরিয়েছে এটি বেশ ভালই বোঝা যাচ্ছে। এতে এই মেয়েগুলোর দোষ আমি দেখছি না।কারণ এই জিনিসগুলো যেহুতু কাল পাঠিয়েছিল,তাই আপনি এই ভাঙ্গা জিনিস নিয়ে কাল থেকে তো আর চুপ করে থাকতেন না!আর এমনটাও না যে,আপনি কোনো জিনিস কিনে সেগুলো নেওয়ার সময় দেখে নেন না!শুধু শুধু আমার সময় নষ্ট করিয়েছেন আপনি।আপনার চোখ কতটা প্রখর আমি বেশ জানি।”
তূর্যয় কথাটা বেশ ঘৃণার সুরে বলে একবার হাসানের দিকে তাকালো।হাসান এর সাথে তূর্যয়ের নজর মিলতেই হাসান অন্যদিকে ফিরে গেলো।তূর্যয় চেয়ার থেকে উঠে আবারও বললো…
–“বিচার শেষ।এইখানে মেয়েগুলোর দোষ নেই। যা দোষ,সব আপনার।হুদাই,আমার আর মেয়েগুলোর সময় নষ্ট করেছেন।”
–“ভদ্র ভাবে কথা বল তূর্যয়।”
হাসান সাহেব বেশ জোরে বললেন।হাসান সাহেবের কথায় তূর্যয়ের রাগ যেনো হঠাৎ বেড়ে গেলো।সে হাসান সাহেবকে কড়া ভাষায় জবাব দিল…
–“অন্তত আপনি আমাকে ব্যবহার শেখাতে আসবেন না!আপনার নিজের ব্যাবহার ঠিক করা উচিত এখন,হাসান সাহেব।বয়স তো কম হচ্ছে না আপনার! সৎ ভাবে বাঁচার চেষ্টা করুন।”
কথাগুলো বলে তূর্যয় নিজের শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।তার পেছনের জন তার মাথার উপর এখনো ছাতা ধরে তূর্যয়ের পিছু যাচ্ছে।তূর্যয় যতক্ষণ গাড়িতে উঠছিল না, ততক্ষণ রাণী তূর্যয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।গাড়িতে উঠার আগেই রাণী দেখতে পেলো তূর্যয় নিজের পকেট থেকে একটা কালো রঙের চশমা বের করে চোখে লাগিয়ে নিল।গাড়ি চলে গেলো গেটের বাহিরে।তবে রাণী এখনো সেদিক চেয়ে আছে।মনে মনে তূর্যয়কে অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছে রাণী, সুষ্ঠ বিচার করার জন্যে।কিন্তু হাসান সাহেব আর সাবিনার প্রতি তূর্যয়ের ব্যবহার দেখে রাণীর মনে আবারও তূর্যয়ের জন্যে ঘৃণার জন্ম দিল। রাণী আর কলি তাদের পা এগোতেই সাবিনার কথায় তারা থেমে গেলো…
–“আমার ক্ষতিপূরণ না দিয়ে কোথায় যাচ্ছিস,এতিমের বাচ্চা!”
রাণী আর কলি অবাক হলো না সাবিনার আচরণে।এই সব বড় লোকের ঘরের মহিলারা এমন জঘন্য হয়,
সেগুলো তারা বেশ ভালো করেই জানে।কলির মুখ দিয়ে কোনো কথায় বেরুচ্ছে না।সে এক প্রকার ঘোরের মধ্যে আছে।তাছাড়া মেয়েটা একটু ভয় পায় বেশি।তাই অগত্য রাণীকেই মুখ খুলতে হলো…
–“আমাদের বাবা,মা এতিম ছিলো কিনা আমাদের জানা নেই।তাই গালি দিলে আমাদেরকেই দিন।তাছাড়া আমাদের বাবা,মাকে কখনো দেখিনি;তাই তাদের শুধু শুধু গালি দিয়েও লাভ নেই।আর যতটুক আসছে ক্ষতিপূরণের কথা! বড় স্যার তো বিচার করেই দিলেন।আর কি ক্ষতিপূরণ দিবো?আপনি আমাদের বিনা দোষে এইখানে আনিয়েছেন। এতে আমাদের গাড়ি ভাড়া উল্টো লস হলো।আচ্ছা যান,আপনার জন্যে দুইদিন পর একটি ফুলদানি পাঠিয়ে দিবো।একদম ফ্রি!”
কথাগুলো বলে রাণী হেসে উঠলো।এই মহিলাকে একটা উচিত জবাব দিতে পেরে বেশ খুশি লাগছে তার।রাণীর এমন কথা শুনে সাবিনার মাথার রাগ আরো বেড়ে গেলো।সে রাণীকে থাপ্পড় দেওয়ার জন্যে হাত এগিয়ে দিতেই হাসান সাহেব এসে সাবিনার হাত ধরে ফেললো।হাসান সাহেব নোংরা দৃষ্টিতে রাণী আর কলির দিকে তাকিয়ে বললো…
–“আহ মালকিন! ছাড়ো এইসব।যেতে দাও এদের।এই সুন্দর ফুলদের উপর হাত উঠানো ভালো হবে না।”
রাণীর গা ঘিন ঘিন করে উঠলো হাসানের কথা। সে কলির হাত ধরে দ্রুত পায়ে হেঁটে চললো।আর রাণী বিড়বিড় করে বলছে…”বুড়ো বয়সে বেডার লুচ্চামি করার শখ হলো। শালা,লুচ্চা বুড়া।” রাণীর বিড়বিড় করা শুনতেই কলি রাণীকে বলে উঠলো..
–“কি বলছিস রে?”
–“আরে ঐ লোককে দেখলি না!কিভাবে তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে?পাশে তার বউ দাঁড়িয়ে ছিল।কিন্তু তার কোনো লজ্জা নেই।একেবারেই নির্লজ্জ।এই পুরো পরিবারটাই কেমন যেনো।একেবারে নোংরা।”
–” হ্যাঁ,একদম ঠিক বলেছিস।তবে তূর্যয় সাহেব বেশ ভালই বিচার করলো।নিজের মায়ের দোষটা উনি ঢাকলেন না।উল্টো সবার সামনে নিজের মাকে ভুল প্রমাণ করলেন।”
রাণী মুখ বাকালো কলির কথায়।পরক্ষণে রাণী বলে উঠলো…
–“কি আর বলবো! ঐ তূর্যয় নামের লোকটা বিচার ভালো করলেও, ঐখানের সবার মুখের ভাষা,ব্যবহার সব একই।কিভাবে হিংস্র ভাবে কথা বলে নিজেরাই!তাছাড়া নিজের বাবাকে সেই লোকটা নাম ধরে ডাকে।কি অদ্ভুত এই বড় লোকেরা!টাকার অভাব নেই কিন্তু ভালোবাসা আর মার্জনার অভাব ঠিকই আছে।বাদ দে।আমাদের কি!”
কলি মাথা নাড়ালো রাণীর কথায়।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারা তাদের এতিম খানায় যাওয়ার জন্যে টেম্পুতে উঠে পড়লো।
সাবিনা দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতর যেতে যেতেই কানে ফোন ধরলো। অপর পাশ থেকে কেউ ফোন তুললে সাবিনা চেঁচিয়ে বলে উঠলো…
–“ঐ মেয়ে! দুই মেয়ের মধ্যে, কি এক মেয়ে পাঠিয়েছিস? লম্বা পাতলা মেয়েটা আমাকে ভয় পায়নি একটুও।উল্টো কি সুন্দর করে তূর্যয়ের মাইর থেকে বেঁচে গেলো।আর অন্য কোনো মেয়ে পাসনি?তুই তো আমাকে বলিসনি এই মেয়ে এত চতুর।”
অপর পাশ থেকে এক মেয়েলি কণ্ঠ সাবিনার কথার বিপরীতে বললো…
–“কি বলছেন এইসব?আমার প্ল্যান কাজ করেনি?এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না!”
–” হবে কিভাবে?তূর্যয়কে মেয়েটা নিজের কথার জালে পেঁচিয়ে নিয়েছিল।সাথে তূর্যয়ের বিচারকার্য এতো সুক্ষ্ম হবে এটা আমি কখনোই ভাবিনি।ভেবেছিলাম তূর্যয়ের মেজাজ গরম হবে আর সে ঐ মেয়েদের গায়ে হাত তুলবে।তবে প্ল্যান যখন হয়নি,তাই বাকি টাকা পাবি না তুই।পরেরবার ভালো কোনো প্ল্যান আসলে মাথায় এরপরই আমাকে ফোন করবি।”
সাবিনা কল কেটে দিলো।অপর পাশের মেয়েটি আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না।

তূর্যয়ের গাড়ি উত্তর দিকের রোড দিয়ে যাচ্ছে।যতোই গাড়ি এগুচ্ছে, ততই তূর্যয়ের মনে তার ছোট বেলার স্মৃতি উঁকি দিচ্ছে।দিবে নাই বা কেনো?তার ছোটকাল এই এলাকায় যে কেটেছে।তূর্যয়ের যখন আট বছর বয়স তখন তার মা হাসান সাহেবের কাছে বিয়ে বসেন।তূর্যয় কোনো কালেই তাদের সেই বিয়ে মেনে নেয়নি।কারণ,
তূর্যয়ের মনে এখনো তার বাবার স্থানে আছে মিলন হক;তূর্যয়ের প্রথম বাবা।তূর্যয়ের মা কেনো ঐ হাসান সাহেবকে বিয়ে করেছে এই কথাটি এখনো তূর্যয়ের অজানা।তার মা থেকে এই কথাটি কখনো সে জানতেই পারেনি।তার মা,বাবার প্রেমের বিয়ে থাকায় তার নানা বাড়ীর পরিবারের সাথে তার কখনোই দেখা হয়নি।আর বাবার বাড়ির আত্মীয়রা তো সেদিনই তাদের হাত ছেড়ে দিয়েছিল যেদিন তার বাবা মারা যায়।বয়সটা কম হলেও,তূর্যয়ের স্মৃতি শক্তি প্রখর।তাই সেই অনেক বছর আগের কথা একে একে তার মাথায় উঁকি দিচ্ছে।আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতেই তূর্যয় ব্রেক কষলো।ফলাফল গাড়ি থেমে গেলো। ঘাড় বাঁকিয়ে ডান দিক ফেরাতেই তূর্যয় দেখতে পেলো তাদের বাড়িকে।চোখ জোড়া কেমন যেনো জ্বলে উঠলো তার।সবসময় এমনটা হয় তার সাথে।যতবারই এই জায়গা আর এই বাড়ি দেখে ততবারই তূর্যয়ের চোখজোড়া বড্ড জ্বালাতন করে।তবে এখন অবশ্য এই বাড়িটি শুধু বাড়ি নয়,বরং এটি বাচ্চাদের এতিম খানা।তূর্যয় তার এক শিক্ষকের সাথে হাত মিলিয়ে তাদের সেই পড়ে থাকা ঘরকে বাচ্চাদের জন্যে এতিম খানায় পরিণত করেছিল।বর্তমানে এই এতিম খানায় বিভিন্ন শহরের নানা ধরনের বাচ্চা আছে।আর এই এতিম খানা শহরের সবচেয়ে দামী এতিম খানার মধ্যে অন্যতম।তূর্যয় এইখানের সকল খরচ একাই বহন করে।ধীর পায়ে তূর্যয় এতিম খানার গেইটের সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।তূর্যয় গেইটের সামনে যায় ঠিক কিন্তু কখনোই ভেতরে ঢুকে না।তার ভয় হয়,অন্য রকম ভয়।এইখানের যাবতীয় কাজ সে গেটের বাহির থেকেই করে।আজও সে দাঁড়িয়ে রইলো গেইটের সামনে।অনেক ধরনের বাচ্চারা খেলাধুলা করছে।কেয়ার টেকার মেয়েগুলো বাচ্চাগুলোকে সামলাচ্ছে।তূর্যয়ের স্মৃতির পাতাটা যেনো আরো ভারী হচ্ছে।তার এখনো মনে আছে
এই উঠানে সে, তার মা-বাবা সবাই মিলে কতো আনন্দ করেছে!বাবা-মায়ের হাস্যোজ্বল হাসি আর হাসির শব্দ এখনো যেনো কানে বাজে তার।চোখে জ্বলজ্বল করা পানিগুলো দুই তিনটা পলক ফেলে আবারও সামলিয়ে নিলো সে।চোখের পানি গাল গড়িয়ে পড়তে দেয়নি।চোখ বুলিয়ে চারদিক দেখছে সে।
–“তূর্যয় তুই?ভেতরে ঢুক।আয় আমার সাথে।”
এমন কথা শুনে তূর্যয় পেছনে ফিরলো।মোল্লা সাহেবকে দেখা যাচ্ছে,যে তূর্যয়ের হুজুর,শিক্ষক সবই।এই মোল্লা সাহেব তার জীবনে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছেন।মোল্লা সাহেব এখন আগের মতো নেই।দাড়ি সাদা হয়েছে উনার, চামড়াটাও কুচকে গেলো।কিন্তু উনার মুখের সেই হাসি এখনো বিদ্যমান।যে হাসি দেখে তূর্যয় অনেক বছর আগেই নিজের বেঁচে থাকার মূল্য বুঝেছে।তূর্যয় মোল্লা সাহেবকে বলে উঠলো…
–“এখন না হুজুর।অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে আমার।এই বাড়ি দেখে গাড়ি থেকে না নেমে পারলাম না।আপনি ঠিক আছেন তো?”
মোল্লা সাহেবের মুখের হাসি আরো চওড়া হলো।উনি হেসে তূর্যয়কে জবাব দিলেন…
–“প্রত্যেকদিন একবার হলেও ফোন করে আমার খবর নিস।তাই তোর তো জানার কথা আমি কেমন আছি?তারপরও বলছি আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি।তুই কি কখনোই ভেতরে ঢুকবি না?”
–“ভয় করে আমার।কেমন যেনো লাগে।নিজেও বুঝতে পারি না।”
–“ভয় করে?তোর?হাহা!যে ছেলেকে সবাই ভয় পায়, সে নাকি নিজের ঘরে ঢুকতেই ভয় পায়?কিছু হবে না আয় তুই আমার সাথে।”
মোল্লা সাহেব তূর্যয়ের হাত ধরে হেসে কথাগুলো বললেন।কিন্তু তূর্যয় অনড়।সে তার পা শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলো।
–” শেষ বার এই বাড়িতে ঢুকেছিলাম মা মারা যাওয়ার আগের দিন।মা ঐ লোকের সাথে বিয়ে করলেও, মা একটা বারও এই বাড়ি,আমার বাবার কথা ভুলেনি।আমি আজও বুঝি না মা কেনো ঐ লোককে বিয়ে করলো?তাছাড়া মা বেশিদিন থাকতেও পারেনি সে বাড়িতে।বিয়ের দুই বছর পরই হঠাৎ মা মারা যায়।অথচ মারা যাওয়ার আগের রাতেও মা আমাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়ে বলেছিল,মা মরে গেলেও সে বাড়ি কখনো না ছাড়তে।আর সকালে উঠে শুনি আমার মা আর নেই!মায়ের চলে যাওয়া আর আমার জীবনের পরিবর্তন হওয়া,সবটাই এক সূত্রে গাঁথা।মা মারা না গেলে হাসান সাহেবের ষড়যন্ত্র,আমার উপরে করা জুলুম কিছুই আমি বুঝতে পারতাম না।আর না কখনো এতো বড় মাপের একজন ব্যক্তি হতে পারতাম!আর বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা জোগাতে,আমাকে সাহসী হতে আপনিই শিখিয়েছেন হুজুর।আমি বড় কৃতজ্ঞ।”
কথাগুলো বলতে বলতেই তূর্যয়ের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।সাথে তার বাম হাত মুট করে নিল সে।মোল্লা সাহেব আবারও মুচকি হাসলো তূর্যয়ের চেহারা দেখে।মোল্লা সাহেবের এখনো মনে আছে তূর্যয়ের কিশোর বয়সের সেই রাগী চেহারা।তূর্যয়ের জীবনে রাগটা খুব দরকার ছিল।আর তার এই রাগের প্রথম যোগসূত্র হয়েছিল তূর্যয় যখন সপ্তম শ্রেণীতে ছিলো।আগের কথা ভাবতেই মোল্লা সাহেব নিজেকে সামলিয়ে নিলেন।এরপর তূর্যয়ের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে নিলে,তূর্যয়ের একজন লোক এসে বললো…
–“স্যার, হ্যারি ড্যানের এসিস্ট্যান্ট বারবার ফোন করছে।আপনাকে দ্রুত যেতে বললো।”
তূর্যয়ের টনক নড়লো কথাটা শুনে।সে বেশ দ্রুত বলে উঠলো…
–“আসি হুজুর।কোনো দরকার হলে আমাকে ফোন দিবেন।আসসালামুয়ালাইকুম।”
তূর্যয় আর এক সেকেন্ড দাঁড়ালো না সে দ্রুত গাড়িতে উঠে পড়ল।মোল্লা সাহেব তূর্যয়ের যাওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে হাতের ইশারায় বলতে লাগলো…
–‘”ফি আমানিল্লাহ।আজ ছেলেটা আবার কোন যুদ্ধে নেমেছে আল্লাহ্ জানেন।আল্লাহ্,আপনি ছেলেটাকে দেখে রাখবেন।ছেলেটাকে হিংস্র হতে বলেছিলাম।তবে এতো হিংস্র গিয়ে যাবে কে জানতো?তার এই আঁধার মাখা দুনিয়ায় আলোর আগমন কি কখনোই হবে না?”
মোল্লা সাহেব নিজে নিজে কথা বলতে বলতে ঢুকে পড়লো। গাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় তূর্যয়ের চোখ পড়লো “মায়া এতিম খানা” এর পাশে থাকা পাহাড় আর জঙ্গলের দিকে।দুইদিন পরে তার একটা অপারেশন আছে এইখানে।এই কাজটি অবশ্য পুলিশ কমিশনার নিজেই তাকে দিয়েছিল। তূর্যয়ের কাছে এই মিশনটি আলো আঁধারের খেলা লাগছে। এতে তূর্যয়ের মনে এক চাঞ্চল্যকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে।এইসব আলো আঁধারের খেলা তূর্যয়ের বেশ পছন্দ।নিজের ঠোঁট হালকা বাঁকা করে,তূর্যয় নিজের ফোন বের করে কাউকে ফোন লাগালো।

নিজেদের এতিম খানায় পৌঁছে রাণী দৌড় লাগলো ছাদের দিকে। তার কাজ যে ফেলে গিয়েছিল সে !কলিও আসছে রাণীর পিছু পিছু।ছাদে গিয়ে দেখে ফুলদানি দুইটি বেশ সুন্দর করে তৈরি হয়ে গেল।রাণীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে দৌড়ে গিয়ে রিয়াকে জড়িয়ে ধরে বললো…
–“কাজ সামলানোর জন্যে এতগুলো ধন্যবাদ।এগুলো রাত আটটা অব্দি শুকাতে থাকুক।এরপর নাজিম ভাই গিয়ে দিয়ে আসবে জিনিসগুলোর মালিকের কাছে। ইস,আমরা আজ আবারও টাকা পাবো।”
রিয়া নিজেকে ছাড়িয়ে নিল রাণীর কাছ থেকে।আর বেশ কড়া ভাষায় বললো…
–“তোর সাহস খুব বেশি তাই না?নাজিম ভাইটাও একদম বেশি করে।কি এক খবর দিলো আর তুই কারো সাথে দেখা না করে সেই বাড়িতে চলে গেলি কলিকে সাথে নিয়ে?ম্যাডাম এসেছিল একটু আগে, তোর খোঁজে।ম্যাডাম সেই রেগে আছে।নাজিম ভাইয়ের কথায় অমনিই দৌড় দিয়েছিস।ম্যাডামের সাথে এই ব্যাপারে একবার কথা বলার কি প্রয়োজন মনে করলি না?তোর যদি কিছু হয়ে যেতো? আমি নিজেও প্রথমে ভাবতে পারলাম না, সে শান্তি মহল আসলে একটা অশান্তির ভবন।”
রিয়ার কথায় বেশ অবাক হয়ে রাণী বলে উঠলো…
–“আরে,নাজিম ভাই তো বললো ম্যাডামের কাছে ফোন এসেছে।তাই ম্যাডাম তো এই বিষয়ে জানার কথা!”
–“আমি কি বলেছিলাম তুই নিজে কারবারি দেখিয়ে সেই বাড়িতে দৌড় দিতে?সাবিনা বেগম কেমন মহিলা আমার বেশ জানা আছে।তোর উচিত ছিল একবার আমার সাথে দেখা করা।সাথে ফোনটাও নিলি না তুই।আমি তো ভেবেছিলাম আজ তোর অবস্থা করুণ হবে।সাবিনা বেগম মোটেও ভালো মহিলা না।আমি নাজিমকে পাঠিয়েছি একটু আগে তোদের নিয়ে আসতে।আর দেখি তোরাই চলে এসেছিস।তো,অক্ষত ভাবে এসেছিস কিভাবে?”
সালেহার এমন কথায় চমকে উঠলো রাণী।তার মুখ আপাতত বন্ধ।সালেহা বেশ রেগে আছে এটা বুঝতে একটুও দেরী হলো না তার।আসলেই সাবিনা বেগম কেমন মহিলা তা আজ বেশ জানা হলো তার।ভাগ্যিস তাদের সাথে খারাপ কিছুই হয়নি।রাণী মুখ খুলতে নিলে কলি বলে উঠলো…
–“ঐযে তূর্যয়,বড় সাহেব আছেন না?উনি আমাদের বিচার করেছিলেন।আর বেশ ভালই বিচার হলো।উনার জন্যে আমি আর রাণী বেঁচে ফিরলাম।লোকটা হিংস্র হলেও বিচার কাজ ভালো করে।”
–“তূর্যয় ছিলো তোদের বিচার কার্যে?”
সালেহা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।
–“হ্যাঁ, ঐ সন্ত্রাসী আমাদের বিচার করলো।আর সাবিনা মালকিন তার নিজের জালে আটকে গিয়েছিল।তবে লোকটা বিচার করলেও,তার ব্যাবহার খুবই খারাপ।কেমন তুই তুই করে কথা বলে,নিজের বাবাকে নাম ধরে ডাকে।ইস জঘন্য!”
কথাগুলো বলে নাক ছিটকালো রাণী।আর এতেই সালেহা রাগী কণ্ঠে বলল…
–“যেমন হোক ব্যবহার,তার জন্যেই তো বেঁচে ফিরলি তোরা। শোকর আদায় করা শিখ রাণী।মানুষের খারাপ কাজের মধ্যে ভালো কাজের কদরও করতে হয়।আর কখনো আমাকে না বলে এই জায়গা থেকে বের হবি না।”
সালেহা চলে গেলো নিজের বক্তব্য দিয়ে।কলি,রিয়া,রাণী সবাই নিচে নেমে এসেছে।তাদের রুমে সিমি আর ফারিয়া বসে রইলো।সিমিকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক কান্না করেছে।সিমির এমন ফোলা মুখ দেখে রাণী বলে উঠলো…
–“কি হয়েছে তোর?”
সিমি জড়িয়ে ধরলো রাণীকে।আর কান্না মাখা কণ্ঠে বলে উঠলো..
–“তুই আমাকে না বলে শান্তি মহলে কেনো গিয়েছিস?তোদের কিছু হয়ে গেলে আমরা কিভাবে বাঁচতাম?”
সিমির এমন কথায় হেসে উঠলো রাণী।সিমির পিঠে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে রাণী।এমন বান্ধুবী কি আজকাল পাওয়া যায়?রাণীর চোখে পানি জমে।সেই পানি আবারও হাত দিয়ে মুছে নিল সে। তাদের সাথে যোগ দিলো কলি আর রিয়া। খাটে বসা অবস্থায় অবাক চোখে ফারিয়া রানীদের বন্ধুত্ব দেখছে।সবাইকে জড়ায় ধরা অবস্থায় রাণী সবার উদ্দেশ্যে বললো…
–“আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো তোরা।আমি তোদের অনেক ভালোবাসি।”
রাণীর সাথে তাল মিলিয়ে বাকিরাও বলে উঠলো…..
“আমরাও ভালোবাসি।”কথাটা শুনে রাণী আবারও হাসলো।বেশ শক্ত করে সবাইকে জড়িয়ে ধরলে রাণী।

তীব্র আর্তনাদে মুখরিত হয়ে আছে খাতুন পাড়া।একজনের আর্তনাদেই এইখানের পরিবেশ ভারী হয়ে আছে।তূর্যয় চেয়ারে বসে,তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা লোকটির আঙ্গুল কাটতে ব্যস্ত।ইতোমধ্যে লোকটির এক হাতের তিন নাম্বার আঙ্গুলে কাটার বসিয়েছে সে।আর লোকটি আর্তনাদ মাখা কন্ঠে বলল…
–“আর কখনো এমন কাজ করবো না।মাফ করে দিন,তূর্যয় স্যার।”
–“সেদিন যখন তূর্যয় তোকে এলার্ট করেছিল, তখন তোর বুদ্ধি হওয়াটা খুবই ইম্পর্ট্যান্ট ছিল।বাট, ইউ রাসকাল! ইউ ডিড এ ভেরি আনগ্রেটফুল ওয়ার্ক।তূর্যয় তোকে বাঁচিয়ে রাখবে, ভেবেছিস কিভাবে? হাউ?”
হ্যারি বিরক্ত নিয়ে বললো।তূর্যয়ের মুখে হিংস্রতা স্পষ্ট।সে লোকটির তিন নাম্বার আঙ্গুলে কাটার চালিয়ে চিল্লিয়ে বললো..
–“এই হাত দিয়েই তো সেই ফাইলটি চালান করেছিস, তাই না?না এখন এই হাত থাকবে,আর না এখন তুই বেঁচে থাকবি।তূর্যয়ের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করার অপর নাম ‘ ডেথ, মানে মৃত্যু ‘।
–“সে বুঝতে পেরেছে হয়তো।হ্যাভ সাম মার্সি তূর্যয়।”
হ্যারি একটু নরম কণ্ঠে বললো।তূর্যয় ঠোঁট বাকালো হ্যারির কথায়।তার বাম পায়ের পরিহিত বুট থেকে ধারালো ছুরি বের করে খট করে কেটে দিলো সামনে থাকা লোকটার গলা।আর লোকটা এক বিকট শব্দ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।এমন দৃশ্য দেখে হ্যারি নিজের চোখ চেপে বললো..”ওহ, গড!তুমি আসলেই একটা পাষাণ। হার্টলেস পার্সন একটা।” তূর্যয় নিজের হাতে থাকা ছুরি পাশের অন্য ছেলের দিকে এগিয়ে দিল।আর ছেলেটি সেই ছুরি পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।হ্যারির কথায় তূর্যয় জবাব দিলো..
–“পাপ যেমন বাপকে ছাড়ে না,তেমনি তূর্যয়ও কোনো অপরাধীকে ছাড়ে না।যে বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে জানে না,তার বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না।বাবলু,তার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ঘেটে তার পরিবারের কিছু ব্যবস্থা করে দাও।আমি চাই না,কোনো অপরাধীর জন্যে নিরপরাধ মানুষরা কষ্ট পাক।”
তূর্যয়ের লাল চোখগুলো একটু একটু পরিষ্কার হচ্ছে। তূর্যয় আরেকজনকে ইশারা করতেই সে তূর্যয়ের দিকে সিগারেট এগিয়ে দিল।তূর্যয় মুখে সিগারেট দিতেই হ্যারি তার লাইটার দিয়ে সিগারেট জ্বালিয়ে দিলো।
–“আই মিসড ইউর দিস এটিটিউড।এখন থেকে নো চিন্তা।আমি এসে গিয়েছি এখন।তোমার সব কাজে তোমার সাথে আছি আমি।আফটার অল, আই এম ইউর ক্রাইম অ্যান্ড বিজনেস পার্টনার।”
হ্যারি হাসি মুখে বললো।তূর্যয়ও বাঁকা হাসলো হ্যারির কথায়।হ্যারির বাড়ি ফ্রান্সে।অনেক আগে থেকেই হ্যারির সাথে তার সম্পর্ক।হ্যারির মতে, ফ্রান্স থেকে সে বাংলাদেশে তূর্যয়ের সাথে কাজ করে আরো বেশি লাভবান হয়।তাই সে বাংলাদেশেই থাকে।এতো বছর বাংলাদেশে থেকে বেশ ভালোই বাংলা জানে হ্যারি। মাঝে মাঝে হ্যারি ফ্রান্সে যায় নিজের পরিবারের কাছে।তূর্যয়ের একটা নরম দিক হলো, এই হ্যারি।যাকে সে নিজের ভাইয়ের মতোই দেখতে পারে।তূর্যয়ের সাথে আরো কিছু কথা বলে, হ্যারি সেই স্থানের লাশকে ঠিকানা করার ব্যাবস্থা করছে।তূর্যয় চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে,
সবার কাজ তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করছে।

–দুইদিন পর,
রাণী তার অন্য অর্ডারের কাজে ডুবে আছে সকাল থেকেই।আজকের অর্ডার বেশি হওয়াতে এক পর্যায়ে রাণী দেখলো মাটির পরিমাণ শেষের দিকে।তার আরো চারটা জিনিস বানানো বাকি আছে।তাছাড়া শান্তি মহলেও একটা ফুলদানি দেওয়ার কথা আজ।কিন্তু এইদিকে মাটির পরিমাণ একেবারে কম।কলি আর রিয়া সমানতালে চিন্তিত। নাজিম,সালেহার কাজে বেরিয়েছে।তাই রাণী কলি আর রিয়াকে বাকি কাজ করতে বলে নিচে নামলো।এরপর সিমি থেকে ফোন নিয়ে সে ফোন লাগালো নাজিমকে..
–“নাজিম ভাই,তোমার আসতে কতক্ষণ লাগবে?”
–“রাত হবে।কেনো?”
নাজিম উত্তর দিলো।
–“জরুরি মাটি লাগবে। তুমি কোথা থেকে মাটি এনেছো গতবার?মাটিগুলো বেশ ভালো।আমাকে একটু ঠিকানা বলো তুমি।আমি গিয়ে নিয়ে আসি।”
–“মাটি এনেছিলাম,মায়া এতিম খানার পাশের পাহাড় থেকে।তবে তুই একা যাস না।গেলেও কাউকে নিয়ে যা।”
নাজিম বলে উঠলো রাণীর কথায়।
–“ঠিক আছে।”
রাণী সম্পূর্ন ঘটনা বুঝিয়ে বললো সিমিকে।আর সিমি বুঝতে পারছে,এখন মাটি আনাটা কতো জরুরি।রাণী সিমির উদ্দেশ্য বললো..
–“কোনো লোকাল মহিলাকে নিয়ে আমি সেখান থেকে মাটি নিয়ে চলে আসবো।বেশিক্ষণ লাগবে না। তুই কাউকে কিছু বলবি না কেমন?ম্যাডামও নাকি কাজে আছে বাহিরে।আমি পেছনের দেওয়াল টপকিয়ে যাচ্ছি।নাহলে দারোয়ান দেখলেই বিরক্ত করবে।রিয়া আর কলি আমার খোঁজ করলে, তাদেরকে বাকি কাজ সাবধানে চালিয়ে যেতে বলবি।”
–“সাবধানে থাকবি।আমার না খুব চিন্তা হচ্ছে।তবে শুনেছি,সেখানের মানুষ খুবই সাহায্য করে সবাইকে।তুই নিজের খেয়াল রাখিস।”
–“হ্যাঁ।আসছি।”
একটা হাত ব্যাগে কিছু টাকা,আর মোবাইল নিয়ে রাণী বেরিয়ে পড়লো।সিমি মোনাজাতের ভঙ্গিতে বিড়বিড় করে কিছু বলছে।

খুব দ্রুত গতিতে গাড়ি এসে পৌঁছিয়েছে “মায়া এতিম খানা” এর পাশের পাহাড়ের দিকে।তূর্যয় তার যাবতীয় সকল অস্ত্র নিজের সাথে নিয়ে নিয়েছে।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে চারপাশ ভালো করে দেখছে। হ্যারিও প্রস্তুত আছে তার অস্ত্র নিয়ে।নিজের ঘাড়কে দুইদিক দুলিয়ে নিজের হাতে গুলি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তূর্যয়।আজ বেশ ভয়ংকর কিছু হতে যাচ্ছে এই জঙ্গলে।তূর্যয়ের মুখটাও হিংস্রতায় ছেয়ে আছে।যতোই ধীরে ধীরে সে ভেতরের দিকে যাচ্ছে,ততই তূর্যয়ের কপালের রগ ফুলে উঠছে।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে