#আলো-আঁধার🖤
#লেখিকা: সালসাবিল সারা
২.
মাঝারি সাইজের নীল রঙের একটা বাক্স নিয়ে চুপি চুপি বারান্দায় গেলো রাণী।মুখে তার রাজ্য জয়ের হাসি। কাল রাতে যখন সে এই বক্সে তার পরিশ্রমের টাকা রাখছিল,তখন সে দেখতে পেলো এই নীল রঙের বাক্সটি প্রায় পরিপূর্ণ।তাই আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই সে তার জমানো টাকা হিসেব করার চিন্তা করলো।তার চিন্তা স্বরূপ রাণী তাদের শোয়ার ঘরের বারান্দায় চলে গেলো।এখন মাত্রই সকাল হচ্ছে,তাই শোয়ার ঘরের সবাই আপাতত ঘুম।এই ছোট শোয়ার রুমে রাণী,কলি,রিয়া আর ফারিয়া থাকে।আগে শুধু রাণী,কলি,রিয়া থাকতো এই ঘরে।কিন্তু কাল থেকে ফারিয়াও তাদের সাথে এই ঘরে থাকার জন্য চুক্তিবদ্ধ হলো।মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাণী তার বাক্সটা খুললো “বিসমিল্লাহ” বলে।এরপর বাক্সের সব টাকা নিজের কোলের মধ্যে ফেললো।মুহূর্তেই রাণীর কোল ভরে গেলো নানান টাকার নোটে।রাণী তার কোল থেকে পঞ্চাশ টাকা,একশো টাকা,পাঁচশো আর এক হাজার টাকার নোটগুলো সব আলাদা করে নিলো।এরপর সে মনের সুখে টাকা গুনতে লাগলো।সব টাকা গোনা শেষ করে সে এইবার হাজার টাকার নোটগুলো নিয়ে নিল।মনের সুখে রাণী নোটগুলো নিয়ে শেষ কয়েকটি নোট গুনতে গুনতে সে বলতে লাগলো…
–“সতেরো হাজার,আঠারো হাজার,উনিশ হাজার,বিশ হাজার!ওরে রাণী,তুই এখন বিশ হাজার টাকার মালিক।আর কয়েকমাস এইভাবে টাকা জমাতে পারলে তুই একটা ছোট্ট মৃৎশিল্পের দোকান দিতে পারবি।আহা,
তখন তোর দোকান থেকে মানুষ জিনিস কিনবে।ধীরে ধীরে তোর আরো টাকা আসবে।আর তুই তোর বান্ধবীদের নিয়ে একটা ভালো জায়গায় থাকতে পারবি।তবে, তখনও কিন্তু আমার মনে এই জায়গার জন্যে ভালোবাসা থাকবে। মাসে মাসে আমি এই জায়গার জন্যে টাকা পাঠাবো।”
রাণী বেশ খুশি হলো নিজের পরিকল্পনায়।কিন্তু মুহূর্তেই সে তার হাতের টাকাগুলো বটে হাতের মুঠোয় নিল।এখন তার চোখে অল্প অল্প পানি জমছে।সে আপনমনে ভেবে চলছে…
–“অনেক কিছু তো পরিকল্পনা করেছি,কিন্তু এইসব কি আদৌ বাস্তবায়ন হবে?দোকান দেওয়া, টাকা কামানো সব কিছুর কথা চিন্তা করা যতো সহজ;তার চেয়ে বেশি কঠিন এইসব সত্যিকার অর্থে পাওয়া।কে দিবে আমাকে দোকান?কিন্তু যত কঠিন হয়ে যাক,এই রাণী সবকিছুর ব্যবস্থা ঠিক করে নিবে।তাছাড়া আল্লাহ্ তো আছেই আমার সাথে।যার কেউ নেই তার আল্লাহ্ আছে।”
রাণী নিজের চোখের জমানো পানিগুলো মুছে নিলো। মানুষের ফিসফিস শব্দ শুনে রাণী দ্রুত উঠে দাঁড়ালো।নিজের হাতের মুঠে থাকা টাকাগুলো বাক্সে রেখে সে তার জায়গামতো বাক্সটি রেখে দিল।এরপর সে রুম থেকে বের হলো।বারান্দায় মানুষের শব্দ কম শোনা গেলেও এখন মানুষের শব্দ এখন বেশ ভালো শোনা যাচ্ছে।রাণী দোকানের কথা ভাবতে ভাবতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেও কারো কথা শুনে থেমে গেলো।একজন মহিলার কথার শব্দে রাণী মাথা এগিয়ে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করলো।সামান্য উঁকি দিতেই সে রাহেলা খাতুনকে দেখতে পেলো।যে এখন দাঁড়িয়ে আছে আরো দুইটি মেয়ের সাথে।সেই দুইজন মেয়ের মধ্যে একজন পেটে হাত দিয়ে মাটিতে বসে আছে।আরেকজন মেয়ে কোমরে হাত দিয়ে মুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে। সেই মেয়ে দুজনকে রাণী বেশ ভালো করেই চিনি। তবে,এই রাহেলা নামের মহিলাকে রাণী একেবারেই দেখতে পারে না।এতিম খানার যুবতী, ভারম্ভর্তি মেয়েদের টাকার লোভ দেখিয়ে এই মহিলা রাত বিরাতে নানান ছেলে লোকের কাছে সাপ্লাই দেই। এইসবে ঐ মহিলার একা দোষ দিয়েও লাভ নেই।টাকার জন্যে এতিম খানার কিছু মেয়ে এই মহিলার কথায় এইসব কাজ করে।তবে,একটা কথা হলো,এই কাজের জন্যে এই মহিলা কাউকে জোর করে না।টাকার লোভেই মেয়েরা আগ বাড়িয়ে এই মহিলার হাত ধরে রাতে বেরিয়ে যায় নানা লোকদের কাছে।এই কাজটা রাণীর ভীষন অপছন্দ।আর এই মহিলাকেও রাণী এক প্রকার ভয় পায়।সালেহা ম্যাডামও কিছু বলেন না তাদের।কিন্তু কেনো?জানা নেই রাণীর।রাণী আরেকটু কান পেতে সেই দিকে নজর দিলো, যেখানে রাহেলা নিচে বসা মেয়েটাকে বকে যাচ্ছে।বর্তমানে এই মহিলা মুখে পান ঢুকিয়ে নিচে বসে থাকা ফারিনকে ধমকে বলে উঠলো…
–“আগেই বলে দিছিলাম ছোট সাহেব একটু বেশি হিংস্র।তুই তো নাচ দিয়ে বলছিলি তুই পারবি তার সাথে রাত কাটাইতে।ব্যাথার ওষুধ নেস নাই।এখন পেট ধইরা কান্দিয়া কি লাভ?ওষুধ খা,ভালো হয়ে যাবি।এইযে চেরিকে দেখ। সে ওষুধ খাইছে বইলা কতো সুন্দর দাঁড়ায় আছে।”
রাহেলার কথায় চেরি বলে উঠলো…
–“ঐ বড় সাহেব তো আমাকে কিছুই করলেন না।সারারাত তার রুমের বাহিরে আমাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন।লোকটা হিংস্র হলেও মেয়েদের সাথে হয়তো খারাপ করে না।”
রাহেলা নিজের মাথায় চড় দিয়ে বললেন…
–“হায়রে,এই তূর্যয় বড় সাহেবের জন্যে আমাকে সাবিনা ম্যাডাম কখনোই গোটা টাকা দেন না।এতো বেডি দিলাম সেই ছেলেরে।এই ছেলে কোনো বেডির লগে থাকে নাই। এতো রঙিন বেডি দেইখা উনি কিভাবে যে নিজেরে আটকায়া রাখেন, আল্লাহ্ জানে?”
–“এতো কথা জানিনা।আমার টাকা আমাকে দিয়ে দিন।”
চেরি বললো।
রাণী তাদের কথা শুনে দ্রুত সরে গেলো সেখান থেকে।অজানা এক ঘৃনা তার ভেতরে চেপে বসলো।কিন্তু তূর্যয়ের এমন ব্যবহারের কথা শুনে বেশ অবাক হলো সে।
–“রাত কাটানোর মেয়েরা নিশ্চয় ভালো পোশাক বা ভালো ইঙ্গিত করে না।সেখানে তূর্যয় ছেলেটা কিভাবে নিজেকে সংযত রাখেন?তার উপর উনি নাকি চেরি আপুকে বাহিরে কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন।বড্ড অবাক লাগছে আমার ব্যাপারটা।আমি যতটুক জানতাম,এমন সন্ত্রাসী লোকদের মেয়ের রোগ থাকেই।যেখানে আমি জানতাম উনার মত লোকেরা রাত, দিন মেয়েদের সাথেই উঠাবসা করেন; সেখানে উনি এমন কেনো?ধুর,আল্লাহ্ জানে।এই সন্ত্রাস লোকের কথা আর ভাবতে ইচ্ছা করছে না আমার।”
রাণী নিজের মাথায় নিজে হাত বুলিয়ে চললো তাদের রুমের দিকে।হাত মুখ ধুয়ে সে ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।তার বন্ধুবিদের উঠতে এখনো অনেক দেরী।সে এত দেরী করে উঠলে, তার কাজের বারোটা বেজে যাবে।আজও রাণীর দুটো অর্ডার আছে “মাটির তৈরী ফুলদানির।”তাই এখন রাণীর পরিকল্পনা হলো নাস্তা খেয়ে কাজে লেগে যাওয়ার।মাঝপথে তার দেখা হলো সালেহার সাথে।রাণীকে দেখতে পেয়ে সালেহা থেমে রাণীর দিকে এগিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল..
–“এতো সকাল সকাল কি কাজ তোর? কোথায় নাক ডেকে ঘুম যাবি,আর তুই কিনা এতো সকালে উঠে গিয়েছিস?”
রাণী হাসলো সালেহার কথায়।সে তার ঠোঁট আরো প্রসারিত করে সালেহাকে বললো…
–“আমার অনেক কাজ ম্যাডাম।মাটির সাথে কাজ করব,তারপরই তো টাকা পাবো।আর টাকা পেলে আমার স্বপ্ন পূরণ হবে নিজে কিছু করার,একটা ভালো জায়গায় থাকার।”
–“আমি জানি, রাণী।আমার বিশ্বাস তুই ঠিক একদিন সব পারবি। তোর জন্যে আমার দোয়া সর্বদায় আছে।তুই শুধু মন দিয়ে কাজ কর।”
সালেহা রাণীকে কথাগুলো বললো বেশ আদরের সুরে।রাণী সালেহার কথার বিপরীতে মাথা দুলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো।ক্যান্টিনে যেতেই রাণী তার প্লেট নিয়ে খাবার আনার জন্যে সামনে পা ফেললো।এখন ক্যান্টিনে বেশি মানুষ নেই।তিন চারজন মেয়ে দেখা যাচ্ছে।রাণী তার প্লেটে পরোটা, ভাজি,আর প্লেটের এক পাশে চায়ের কাপ নিয়ে নিল।এরপর সে ধীর পায়ে এগিয়ে একটা টেবিলে বসে পড়লো।এই এতিম খানায় শুধু মেয়েরা থাকে। একটু পরে তার পাশে বসে পড়লো আরেকটি মেয়ে।মেয়েটি রাণীকে নানা প্রশ্ন করছে। হয়তো মেয়েটিও নতুন এসেছে।তাই রাণী মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো..
–“কতদিন হলো এইখানে এসেছো?”
–“এই তো এক সপ্তাহ হবে আজ।এই এতিম খানার অবস্থা অন্য এতিম খানা থেকে অনেক ভালো।আমি আগে অন্য একটাতে থাকতাম।সেখানে সব কিছুতে উচ্চ বিলাসিতা থাকলেও সবাই বেশ খারাপ ব্যাবহার করতো।তাই আমার ফুফু আমাকে এইখানে রেখে গেলো।এইখানের খাবার দাবার এমন ভালো হবে এটা আমি কখনোই ভাবিনি।”
মেয়েটি অবাক হয়ে বললো।
–“সাহেলা ম্যাডাম এইখানকার মেয়েদের যতটুক পারে ভালো খাবার এবং কাপড়ের ব্যাবস্থা করে দেয়।তাছাড়া ম্যাডাম এইখানে মেয়েদের সাবলম্বী হওয়ার জন্যেও নানা ব্যাবস্থা করে দেয়।যে মেয়ের যেমন ইচ্ছে তারা তেমন কাজে জড়িয়ে পড়ে। তা তোমার নামটা বেশ সুন্দর ‘পরী’।
রাণী তার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো।
–“তুমি অনেক ভালো।মাঝে মাঝে দেখা হবে আপু তোমার সাথে।”
রাণী মাথা নাড়িয়ে তার প্লেট জমা দিয়ে দ্রুত চললো ছাদের দিকে।তার অনেক কাজ বাকি আছে আজ। রাণী ছাদে উঠতেই ছাদে কিছু সংখ্যক মেয়েকে দেখতে পেলো।তার মধ্যে ছিলো চেরি। চেরির সাথে রাণীর চোখাচোখি হলে চেরি রাণীর কাছে এসে তাকে বললো..
–“কেমন আছিস রাণী?”
–“এইতো ভালো আপু।তুমি কেমন আছো?”
রাণী স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলেও তার মাথায় ঘুরছে, চেরি গতকাল রাতে তূর্যয়ের সাথে রাত কাটাতে গিয়েছিল সে কথাটি।পরক্ষণে চেরির কথায় রাণীর হুঁশ ফিরে এলো।চেরি নির্দ্বিধায় বলতে লাগলো..
–“আমি বেশ আছি।কাজ না করেই কাজের টাকা পেয়ে গেলাম।এর চেয়ে আর খুশির কি আছে!”
কথাটা বলে চেরি নাচতে নাচতে চলে গেলো।আর রাণী ভাবছে…
–“সত্যিই তাহলে কাল রাতে তূর্যয় নামের ছেলেটির সাথে চেরি আপুর কোনো দৈহিক সম্পর্ক হয়নি!কিভাবে সম্ভব এটা?উফ,বাবা।এইসব কথা বাদ। মরুক ঐ তূর্যয়। খুনী লোক একটা!এতো লোকের অভিশাপ নিয়ে সে লোকটি কিভাবে যে বেঁচে আছে?সন্ত্রাসী একটা!”
রাণী তূর্যয়কে বকতে বকতে ছাদের এক কোনায় এসে লেগে পড়লো তার কাজে।মাটির কাজ করার জন্যে নাজিম পাহাড় থেকে মাটি এনে দেয়।সেই মাটির বেশ কিছুটা এখন রাণী কাজে লাগাচ্ছে।চাকে মাটি লাগিয়ে সেটিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাটিগুলোকে রাণী ফুলদানির আকার দেওয়ার চেষ্টা করছে।একটা ফুলদানির আকার দেওয়া শেষ হতেই ছাদে তার সঙ্গীরা হাজির হলো।কলি,
রিয়া মিলে ফুলদানিকে আগুনের দিকে ঠেলে দিল।রাণীর বানানো দুইটি ফুলদানিকে আগুনে পুড়িয়ে নিচ্ছে রিয়া আর কলি।সেগুলো পোড়ানো হলে,রাণী একটা ফুলদানি সুন্দর করে রং করলো।সেটার দেখাদেখি কলি আর রিয়া অন্য ফুলদানি রং করছে।আর রাণী ফারিয়াকে মাটির জিনিস কিভাবে বানাতে হয় সেটা শিখিয়ে দিচ্ছে।সিমি আজ নিচেই আছে।বেশ কিছুক্ষণ পরে নাজিম দৌড় দিয়ে এলো ছাদে।এরপর একপ্রকার হাঁপানো অবস্থায় রাণীর উদ্দেশ্যে বললো…
–“শান্তি মহলে যে জিনিসগুলো পাঠিয়েছিস কাল,
সেগুলো কি ভালো করে তৈরি করিসনি তুই,রাণী?বাকিরা তো শুধু আগুনে পোড়ায় জিনিসগুলো আর রং করে।সাথে তুইও সেগুলো রং করিস।কিন্তু মেইন যে মাটি দিয়ে জিনিসটা তৈরি করিস, সেটি তো তুই করিস। তাই না?”
রাণী বেশ অবাক হলো নাজিমের এমন কথায়।সে অবাক হয়ে নাজিমকে বললো,
–“হ্যাঁ,আমিই তো করি।কেনো কি হয়েছে? তাছাড়া শান্তি মহল মানে ঐ সন্ত্রাসীর বাসা?হয়েছে টা কি সেখানে? সবকিছু ভেঙে বলো আমাকে।”
রাণীর সাথে বাকিদের মুখের অবস্থা বেশ নুইয়ে যাচ্ছে।নাজিম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো..
–“ম্যাডামের কাছে ফোন এসেছে শান্তি মহল থেকে।মাটির জিনিস যারা বানিয়েছে তাদের যেতে বললো সেই বাড়িতে।তাদের জিনিসগুলো নাকি ইতিমধ্যে ফাটল ধরেছে।”
–“অসম্ভব!আমি এটা বিশ্বাস করি না।আমার বানানো জিনিস এত ঠুনকো হবেই বা কিভাবে?”
রাণী চিল্লিয়ে বললো।
–“অতো কিছু জানিনা।জলদি আয়।ম্যাডাম বললো সাবিনা মালকিন ডাকিয়েছে তোদের।”
রাণী তার কোমর আর বুকে পেঁচানো ওড়নাটা অন্যদিকে ঘুরে ঠিক ভাবে গায়ে জড়িয়ে নিলো।এরপর পায়ে স্যান্ডেল লাগিয়ে কলি আর রিয়ার উদ্দেশ্যে বললো…
–“কলি, তুই চল আমার সাথে।আর রিয়া তোর কাজ করে ভালো করে শুকাতে দিস এইগুলোকে।আমি আসছি।”
রিয়া মাথা নাড়ালো রাণীর কথায়।ধপ ধপ পা ফেলে রাণী নিচে নামছে।রাণীর পিছে পিছে কলি আর নাজিম আসছে।নিচে নেমে রাণী তার পায়ের গতি আরো বাড়িয়ে দিল।যাওয়ার সময় সে দেখলো সিমি উল্টো দিকে ঘুরে বসে আছে।সিমির দিকে তোয়াক্কা না করে নাজিম থেকে চল্লিশ টাকা নিয়ে দ্রুত এতিম খানা থেকে বেরিয়ে পড়লো রাণী।এরপর রাণী, কলির হাত ধরে রাস্তা পার হয়ে টেম্পুতে উঠে পড়লো।তাদের এতিম খানা থেকে শান্তি মহল বেশি দূরে নয়।
‘
সবে মাত্র ঘুম ভাঙলো তূর্যয়ের। শোয়া থেকে উঠে বসতেই তার মাথায় ভারী ভাবটা অনুভব করলো সে।এটা তার নিত্যদিনের ব্যথা। কাল রাতে মদ খাওয়ার পরিমাণটা একটু বেশিই ছিলো তার। তাই আজ সে অসহনীয় ব্যাথা অনুভব করছে মাথায়।গায়ের উপর থেকে চাদরটা এক হাতে সরিয়ে নিয়ে অন্য হাতে মাথা চেপে ধরে রেখেছে সে।ব্যথায় তার চোখজোড়া বারবার বুজে আসছে।চারদিকে পর্দা দেওয়ার কারণে রুমটাতে আলো আসতে পারছে না।ফলস্বরূপ রুমের মধ্যে আবছা আলো হয়ে আছে।কোনোভাবে সে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে তার রুমে থাকা ছোট্ট ফ্রিজটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো।এক হাত মাটিতে রেখে অন্যহাতে সে ফ্রিজ খুলে বাটিতে রাখা কাটা লেবু থেকে দুইটা লেবু নিয়ে নিল।আর সাথে সাথে সেগুলো মুখে পুরে ফেললো সে।লেবুর টক স্বাদে মুখ খিঁচে রেখেছে তূর্যয়।কিন্তু তাও সে লেবু চিবিয়ে যাচ্ছে।মদের নেশাটা যে তার কাটাতে হবে!মুখে লেবু নিয়ে সে মেঝতেই শুয়ে পড়লো।দ্রুত নিঃশ্বাসের কারণে তার চওড়া বুকটা বেশ জোরে উঠা নামা করছে। কাল রাতে সে একটু অতিরিক্ত খেয়ে ফেলেছে মদ।তার কারণ একটাই,সাবিনা।মাঝে মাঝে এই মহিলা খুবই বাজে কাজ করে বসেন। কাল রাতেও ঠিক একই ঘটনা হলো।তূর্যয় ঘুমোতে যাবে, এই সময়ে সাবিনা তার দরজায় টোকা দেয়। মণি ভেবে সে দরজা খুললে সাবিনা আর তার সাথে আরেকটি মেয়েকে দেখতে পেয়েছিল। মেয়েটির পড়নে ছিল বেশ অশালীন কাপড়।সাবিনা কিছু কথা বলে মেয়েটিকে তূর্যয়ের কাছে রেখে চলে গিয়েছিল।তূর্যয় যতোই হিংস্র হোক,মেয়েদের নিয়ে এমন বেহায়াপনা সে কখনোই করেনি।এইসবের কথা তার মাথায় আসলেও,তার মায়ের মুখের ছবি তার সামনে ভেসে এলে সেসব বাজে কথা দূরে গিয়ে পালায়।মেয়েদের নিয়ে তূর্যয় কোনো পাপ করতে চাই না।ফলস্বরূপ আগের বারের মতো ঐ মেয়েটাকে বাহিরে কান ধরিয়ে দাঁড় করে রেখেছিল সে।সাবিনা এইসব কেনো করে সবই তূর্যয়ের জানা আছে।তার ছেলের মতো মেয়ের নেশায় ডুবিয়ে সাবিনা তূর্যয়ের মন জয় করতে চাই।আর এই মন জয়ের সুযোগে সাবিনা এই বাড়িতে থাকা তূর্যয়ের অংশ নিজের নামে করার প্রচেষ্টায় আছে।
–“যতোই চেষ্টা করো, সৎ মা!আমার মায়ের শেষ ওয়াদা আমি কখনোই ভুলব না।আমি এই বাড়ি থেকে চলে যাবো না, যতদিন বাবার মৃত্যু না হয়।বাবা না আসলে সে আমার। সে আমার বাবা হলে আমাকে কখনোই এমন একটা জায়গায় পাঠাতো না, আমার মায়ের মৃত্যুর পর।যে জায়গায় আমি বেঁচে থাকতে মৃত্যুর মত যন্ত্রণা পেয়েছিলাম।না আমি এই বাড়ি ছাড়বো,না আমি এই বাড়িতে নিজের অংশ ছাড়বো! এই বাড়িতে আমার মায়ের হক আছে।আর আমার মায়ের হক রক্ষা করা আমার দায়িত্ব।সাবিনা!তূর্যয়ের ভয়ংকর রুপটার কথা শুধু শুনেছো তুমি।যেদিন তার এমন রূপটা দেখবে,
সেদিন নিজে এইসব সম্পত্তি আমার পায়ের কাছে এনে রাখবে।”
বিভিন্ন কথা ভাবতে ভাবতে তূর্যয়ের নেশা কাটতে লাগলো।তার জরুরী ফোন আসায় দ্রুত সে গোসল সেরে তৈরি হয়ে নিলো।ফোন পেয়ে তূর্যয়ের চোখ ভয়ংকর লাল রং ধারণ করেছে।কারণ,তারই দলের একজন অনেক বড় বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে তার সাথে।রেডি হয়ে নিচে নামতেই সে সাবিনার শিকার হলো।সাবিনা তূর্যয়ের হাত ধরে বলতে লাগলো…
–” তুই সবার বিচার করিস।আজ তোর মায়ের সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার কর।কিছু চোরকে আনিয়েছি আমি।তারা বাহিরে অপেক্ষা করছে তোর জন্যে।তুই সবার অন্যায়ের বিচার করিস,আর তোর মায়ের সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার করবিনা?”
তূর্যয় মুখ খুলতে চাইলো না। বরং নিজের কাজে যাওয়ার পরিকল্পনা করলো সে।কিন্তু সাবিনার পেছনে তার বাবাকে দেখতে পেলো। এখন যদি সে সাবিনার সাহায্য না করে,তাহলে এই দুইজন তার সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হবে।ঝগড়ায় তূর্যয়ের মাথা ঠিক থাকবে না আর সে উল্টো পাল্টা কিছু করে বসবে।আর শেষ মেশ কথা গিয়ে দাঁড়াবে তূর্যয়ের বাড়ি ছাড়া নিয়ে।কিন্তু,তাদের এই কাহিনী তূর্যয় কখনোই সফল হতে দিবে না।তাই তূর্যয় দাঁতে দাঁত চেপে বললো…
–” আমার হাতে পাঁচ মিনিট সময় আছে।এর মধ্যেই সব বিচার শেষ করতে হবে।”
সাবিনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তূর্যয় দ্রুত বাহিরের দিকে যেতে লাগলো।আর অন্যদিকে হাসান সাবিনার উদ্দেশ্যে বললো…
–“এই ছেলে তার মায়ের মতো এত হাবাগোবা না।এই ছেলেকে এই বাড়ি থেকে বের করতে হলে অন্য উপায়ে বের করতে হবে।এখন যাও।বাহিরে যে কান্ড বাঁধিয়েছো,
সেটা গিয়ে ঐ নষ্ট মহিলার ছেলেকে বুঝিয়ে আসো।”
সাবিনা শয়তানি হাসি দিলো হাসানের কথায়।হাসান নিজেও জানে না,সাবিনার পরিকল্পনা কি!তাই সে দাঁত কেলিয়ে হাসানকে বললো…
–“কাল রাতের পরিকল্পনা ঠিক হয়নি তো কি হয়েছে?আজ একটা সুযোগ এসেছে আমার হাতে।এই সুযোগ এক শুভাকাঙ্ক্ষী এনে দিয়েছে আমাকে।তূর্যয়ের বিচার মানে অন্যর গায়ে হাত তোলা।এমনি তো সে বাড়ির কারো সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে না, কথাও বলে না।কিন্তু আজ আমার ফাঁদে পড়লো সে। আমার প্ল্যানিং মতে এই এতিম খানার মেয়েগুলোকে সে মারলে, তুমি তার সাথে ঝগড়া করবে।আর এতেই তূর্যয়ের মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হবে।আর সে তোমার সাথে রাগ করে এই বাড়ি ছেড়ে পালাবে।একটু সাহস রাখবে তুমি সেই ছেলের সামনে।এমনি এমনি তো সে তোমার সাথে কখনোই ঝগড়া করবে না।তাই এই প্ল্যানটা কাজে লাগাতে হবে।”
হাসান হাত মেলালো সাবিনার সাথে।
–“উফ,তোমার জবাব নেই। চলো।জলদি চলো।”
হাসান আর সাবিনা উঠোনের দিকে যাচ্ছে।
বাড়ির বড় দরজা থেকে বের হতেই তূর্যয়ের চোখ স্তব্দ হয়ে গেলো উঠোনের মাঝে রোদে দাঁড়ানো এক মেয়েকে দেখে।উঠোনে দুইজন মেয়ে থাকলেও তূর্যয়ের দৃষ্টি, লম্বা গঠনের মেয়েটির দিকে।যে তার মাথার উপর হাত দিয়ে রেখেছে রোদ না লাগার জন্যে।এই মেয়ের এমন চেহারা,
ভাব ভঙ্গি তূর্যয়ের চেনা একজনের সাথে মিলে যায়।তার অতীতের কোনো এক অংশের সাথে এই মেয়ের একটা সংযোগ সে দেখতে পাচ্ছে।
–“ঠিক সেই গায়ের সাদা রং! যার গায়ে রোদ লাগলে একেবারেই কড়া লাল হয়ে যেতো। রোদের কারণে মুখটাও সে একেবারে কুঁচকে রাখতো!”
নিজের মনে এই কথাগুলো ভাবতেই আবারও তূর্যয়ের মেজাজ সাত আসমানে উঠে গেলো।কারণ অতীতের কোনো কথায় সে মনে আনতে চাই না।বাম হাত দিয়ে নিজের দুই চোখ কচলে সে বসে পড়লো রাণী আর কলির সামনে রাখা একটি চেয়ারে।আরেকজন লোক তূর্যয়ের মাথার উপর ছাতা ধরলো।
তীব্র রোদের জন্যে রাণী তার মাথার উপর হাত দিয়ে রেখেছিল।রাণী, কলি থেকে বেশ লম্বা হওয়ার কারণে কলি এতক্ষণ রাণীর ছায়াতে দাঁড়িয়ে ছিল।তাদের সামনে তূর্যয়কে বসতে দেখে বুকটা ধক করে উঠলো রাণীর।এতো কাছ থেকে তূর্যয়কে কখনোই দেখেনি সে। শ্যামলা রঙের মধ্যে গম্ভীর চেহারা,রাগী দুটো চোখ,
কপালের ডান দিকে একটা কাটা দাগ সব কিছু মিলিয়ে তূর্যয়কে বড্ড রহস্যজনক মনে হচ্ছে রাণীর কাছে।তূর্যয়ের গায়ের গঠন,উচ্চতা এতো বিশাল হবে, এটা রাণী কখনোই ভাবেনি।কারণ দূর থেকে দেখে একটা মানুষকে সে বুঝবেই বা কিভাবে? রাণী এখনো হাঁ করে তূর্যয়কে দেখছে।তূর্যয়ের শার্টের বোতাম প্রায় অনেকখানি খোলা,শার্টের হাতা অর্ধেক বটে রাখার কারণে তূর্যয়ের হাতের মোটা মোটা রগ দেখা যাচ্ছে।
তূর্যয়ের বুকের উপর ঝুলানো সোনালী রঙের লকেটটাও চোখ এড়ালো না রাণীর।তূর্যয় ঘাড় বাঁকিয়ে অন্য দিকে ফিরে আছে।রাণী চুপি চুপি কলিকে বললো…
–“এই লোক এইখানে কেনো?উনি কি আমাদের বিচার করবেন?”
–“জানিনা ভাই!আমার ইতিমধ্যে ভয়ে বাথরুম পাচ্ছে।উনি আমাদের বিচার করলে আমরা তো শেষ!”
কলির কথায় রাণীর চোখ তূর্যয় থেকে সরলো না।সে এখনো দেখে যাচ্ছে তূর্যয়কে।তার মাঝে রাণী এক বিরাট রহস্য দেখতে পাচ্ছে।রাণী একান্তই ভেবে চলছে,”এই লোকের এমন সন্ত্রাসী হওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে!” রাণীর চিন্তার ইতি ঘটল যখন সে দেখতে পেলো,একটা মহিলা এসে তূর্যয়ের হাতে চাবুক ধরিয়ে বলল…
–“আমি সাবিনাকে, এরা ভুল জিনিস দিয়ে ঠকিয়েছে।বাবা,তুই এদের একটা শাস্তি দে।এমন শাস্তি দে,যেনো এরা আর জীবনে মানুষকে ভুল জিনিস দিয়ে ঠকাতে না পারে।”
এমন কথা শুনে কলি, রাণীর হাত চেপে ধরে কান্না শুরু করলো।রাণী এখনো তূর্যয়ের দিকে চেয়ে আছে।তূর্যয় নিজের হাতে চাবুকটা নিয়ে নিল।তূর্যয় যেনো মুহূর্তেই তার চোখের রং পাল্টে ফেললো।ভয়ংকর লাল দেখাচ্ছে তূর্যয়ের চোখ।তূর্যয় নিজের হাতে চাবুকটা প্যাঁচানো শুরু করলে রাণী তার গলা খাকিয়ে তূর্যয়ের উদ্দেশ্যে বললো…
–“আপনি আমাদের গায়ে হাত তোলার আগে,আমি এই ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বলতে চাই সব।আমাকে আগে বলুন,কি হয়েছে আমার বানানো জিনিসগুলোর?”
–“এই মেয়ে চুপ!এক থাপ্পর দিয়ে মুখ ভেঙে দিবো।তূর্যয় বাবা,এই মেয়ের মুখ বেশি চলছে।এই মেয়েকেই আগে দে এক ঘা।”
সাবিনার এমন কথায় রাণী চোখ বড় করে তাকালো তূর্যয়ের দিকে।তূর্যয় চেয়ার থেকে উঠে সজোরে নিজের হাত ঘুরালো চাবুক দিয়ে।আর এই দৃশ্য দেখে তখনই রাণী চিল্লিয়ে উঠলো…” মা গো!”
রাণী তার গায়ে কোনো আঘাতের আভাস না পেয়ে চোখ খুললো। সে দেখতে পেলো,চাবুক পড়ে আছে নিচে।আর তূর্যয় রাগী চোখে একবার তাকাচ্ছে রাণীর দিকে আরেকবার তাকাচ্ছে সাবিনার দিকে।রাণী বুকের উপর এক হাত রেখে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে, আর মনে মনে ভাবছে…
–“এই সন্ত্রাসী মানুষটা আসলে কিই বা করতে চাচ্ছে?”
চলবে….