#আলো_আঁধার
~আঁখি দেব তৃপ্তি
পর্ব ঃ- ০২
জ্ঞান ফিরার পর তনিমা দেখলো সে বিছানায় শুয়ে আছে। তার পাশে তার স্বামী বিজয় বসে আছে। এভাবে কতোদিন বিজয়কে পাশে বসতে দেখে নি তনিমা! আশেপাশে কোনো লোকজন নেই। তার মানে সবাই চলে গেছে। যাক বাঁচা গেলো। পাশেই ছোট্ট আলো খেলায় মেতে আছে।
“কেমন লাগছে এখন?”- বিজয়।
“ভালো। “- তনিমা।
” আচ্ছা তাহলে আমি যাই।”
“নিজের মেয়েকে একবার কোলে নিবে না বিজয়?”
এ কথা বলতেই বিজয় একবার আলোর দিকে তাকালো তারপর কিছু না বলে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। তনিমা অশ্রু ভেজা চোখে বিজয়ের যাবার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। এ কেমন বাবা? নিজের মেয়ের প্রতি এভাবে কেউ মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে?
পরের দিন থেকেই আশেপাশের বাসার লোকজনদের তনিমাদের বাসায় উঁকি-ঝুকি মারতে দেখা গেলো। সাথে নানান রকম কথা। এতে বিরক্ত হয়ে তনিমার শাশুড়ী তনিমার উপর মানসিক অত্যাচার করা শুরু করলেন। অনেক কষ্টে দিন যেতে লাগলো তনিমার।
কিছুদিন পর এক রাতে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলেন তনিমার শাশুড়ী। বিজয় ও তনিমা দৌড়ে উনার ঘরে গেল।
“কী হয়েছে মা? দুঃস্বপ্ন দেখেছেন?”- তনিমা।
“স্বপ্ন নয় সত্যি। আ…..মি আমি দেখলাম তোমার ওই অশুভ মেয়েটা সারা ঘরে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। অন্ধকারের সাথে একদম মিশে গেছে সে। তারপর আস্তে আস্তে আমার ঘরের ভিতর আসলো। আমি ওকে চলে যেতে বললাম কিন্তু গেলো না। তারপর অদ্ভুত ভাবে হাসতে হাসতে আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি পিছনে সরতে লাগলাম। তারপর হঠাৎ সে আমার গলা চেপে ধরলো। আমি চিৎকার দিতেই চলে গেল।”- তনিমার শাশুড়ী এই কথাগুলো কাঁপতে কাঁপতে বললেন।
” এটা কীভাবে সম্ভব মা। এতো ছোট বাচ্চা হাঁটবে কীভাবে। আর আলো তো ঘরে ঘুমাচ্ছে। এগুলো আপনার মনের না।”
“না না। আমি স্পষ্ট সব দেখেছি। ওই অপয়া মেয়ের দ্বারা সব সম্ভব। ও আমাকে মেরে ফেলতে চাইছে।”
“শান্ত হোন মা। এই নিন পানি খান।”- বলে তনিমা পানির গ্লাস এগিয়ে দিল।
পানি খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন তনিমার শাশুড়ী। তারপর ওরাও বেড়িয়ে এলো ঘর থেকে।
” এ মেয়ের জন্য না জানি আর কী কী সহ্য করতে হবে।”- বিরক্তি নিয়ে বললো বিজয়।
“তুমিও কী তোমার মায়ের মতো আমাদের আলোকে অশুভ মনে করো বিজয়?”- তনিমা।
” তা নয়তো আর কী? এর জন্মের পর থেকে ভালো কিছু ঘটেছে কী? শুধু অশান্তি আর অশান্তি। “- বলে অন্যপাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো বিজয়।
কাকে কী বলবে কী বুঝাবে কিছুই বুঝতে পারছে না তনিমা। বাকি রাত টুকু কেঁদে কেঁদেই কাটলো ওর।
যতদিন যেতে শুরু করলো অশান্তি ততই বাড়তে শুরু হলো। তনিমার শাশুড়ী কয়দিন পরপরই আলোকে নিয়ে ওসব কথা বলেন। আলো নাকি ওনাকে মেরে ফেলবে। তনিমার এসব বিশ্বাস হয় না। কিন্তু কেন তিনি নিজের নাতনিকে নিয়ে এসব বলেন বুঝে উঠতে পারছে না তনিমা। বিজয়ও আজকাল মায়ের কথাই বিশ্বাস করে। সেদিন তো তনিমাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললো-
” তুমি আমায় ঠকাচ্ছো না তো তনিমা?”
“এসব কী বলছো?”
“আচ্ছা, তুমি কী আলো পেটে থাকা অবস্থায় দুপুর কিংবা সন্ধ্যা বেলা বাড়ির বাইরে গিয়েছিলে? ”
“তুমিও মায়ের মতো ওসব বিশ্বাস করতে শুরু করেছো বিজয়! ”
“আচ্ছা, এ বাচ্চা নিয়ে যখন এতো সমস্যা হচ্ছে ওকে কোনো এতিম খানায় দিয়ে আসা যায় না? আমি প্রতিমাসে মোটা টাকা ওখানে পাঠিয়ে দিব।”
“ছিঃ বিজয়। এ কথা বলতে তোমার বিবেকে বাঁধলো না?”
“ভালো লাগছে না আর আমার এ অশান্তি। আমি নিতে পারছি না ওকে।”
পরের দিন রাতের বেলা আবার তনিমার শাশুড়ী চিৎকার দিয়ে জেগে উঠলেন। ওরা ছুটে গেলো উনার ঘরে।
“কী হয়েছে মা?”- বিজয়।
” কী আর হবে, যা হওয়ার তাই হয়েছে। আমি থাকবো না আর এ বাসায়। আর থাকবো না। ও আমাকে মেরে ফেলবে।”
“কী বলছেন এসব মা? আলো তো আপনার নাতনি ও কেন আপনাকে মারতে চাইবে?”-তনিমা।
” না না। কেউ না ও আমার কেউ না। হয় ও এ বাড়িতে থাকবে নয়তো আমি। বিজয় আমি কাল সকালেই চলে যাব। তোরা থাক তোদের মতো।”
“তুমি কোথায় যাবে না। তুমি চিন্তা করো না আমি সব ঠিক করে দিব।”
“না কিচ্ছু ঠিক হবে না। আমি চলে যাব।”
“আচ্ছা এখন ঘুমাও কাল সকালে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে কী করা যায়।”- বলে বিজয় ঘর থেকে বেড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট ধরালো। তনিমাও এলো পিছু পিছু। অবাক চোখে দেখতে লাগলো বিজয়কে। আগে বিজয় সিগারেট খেত না। আর মেয়েকে নিয়েই সারাক্ষণ কথা বলতো। আর আজ গায়ের রংয়ের জন্য মেয়েকে কোলে নিতেও চায় না এই বিজয়! উল্টো নিজের মেয়েকে এতিম খানায় দিতে বলে। এ সব কিছুর পেছনে আরো বড় অবদান রেখেছে পাড়া-প্রতিবেশীরা। তারা প্রতিনিয়ত আলোকে নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলে। সত্যি মানুষ বড় অদ্ভুত প্রাণী। তারা নিজের সুখ অন্যের কথার উপর ছেড়ে দেয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। সবকিছুর আগে ভাবে লোকে কী বলবে? এই একটি কথার জন্য নিজের আপনজনদের মনের অবস্থাও একবার ভেবে দেখার সময় হয়না।
” কী সিদ্ধান্ত নেবার কথা বললে তুমি মাকে?”
“আলো আর এ বাড়িতে থাকবে না।”
“মানে?”
“ওকে এতিম খানায় দিয়ে দিব।”
“কী?”
“তুমি কী চাও আমার মা আমার থেকে দূরে সরে যাক?”
“কিন্তু আমিও আলোর মা বিজয় আর তুমি বাবা। এটা কেন তুমি একবার ভেবে দেখছো না?”
বিজয় আস্তে আস্তে তনিমার কাছাকাছি আসলো। তারপর তনিমার গালে এক হাত রেখে বললো-
“আমি অনেক ভেবেছি তনিমা। এরকম করলেই আমরা আবার ভালো থাকতে পারবো। প্লিজ একটু বুঝো। আমি তোমাকে হারাতে চাই না তনিমা। বড্ড ভালবাসি তোমায়। ওর জন্যই তো এতো অশান্তি সব শেষ হয়ে যাবে দেখো। তুমি আবার মা হবে। ”
“আর বাচ্চা যদি আবার কালো হয়?”
“হবে না। আমি তোমায় সবসময় খেয়ালে রাখবো কথা দিচ্ছি।”
“বাহ বিজয়, এরকম তোমার ভালবাসার নমুনা আমি দেখে সত্যিই অবাক হচ্ছি। আমি কিছুতেই আমার মেয়েকে এতিমখানায় দিতে পারবো না।”- বলে বিজয়ের হাত সরিয়ে দিল তনিমা।
” তার মানে আমাকে তোমার চাই না তাইতো?”
“তোমাকে চাইবো না কেন? তুমি আমার স্বামী। ”
“তোমাকে যে কোনো একজনকে বেছে নিতে হবে তনিমা। হয় আমি নয়তো তোমার ওই বাচ্চা। ”
“কী!”
“যা বললাম তাই। ভালো করে ভেবে দেখো। তোমার কাকে বেশি প্রয়োজন। যদি আমাকে চাও বাচ্চাকে এতিমখানায় দিতে হবে নয়তো ওকে নিয়ে চলে যাও এখান থেকে।”
কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলো না তনিমা। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো বিজয়ের দিকে। এই কী তার সেই কাছের মানুষটা যে পাগলের মতো ভালবাসতো তাকে!
(চলবে)