আলো অন্ধকারে পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0
551

#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ১২)

১.
জাফর জানালার কাছে বালিশ নিয়ে উবু হয়ে বই পড়ছেন। বসন্তের এই সকাল বেলাটা বড্ড সুন্দর। সামনের মেহগনি গাছের পাতাগুলো সব কেমন করে ঝরে পড়ছে। বাতাস এলেই বৃষ্টির ফোঁটার মতো হলুদ বাদামি পাতাগুলো ঝরে পড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে একটা স্বর্গীয় দৃশ্য। চেয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। এর আগে কখনও এমন করে এইসব দেখা হয়নি। নিজেকে সত্যিই সুখী মনে হয়।

সকালের নাস্তা সেরেছেন কিছুক্ষণ হলো। কাজের মেয়েটা এসে কাটাকুটি শুরু করেছে। দিলশাদ সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে নরমাল হবার জন্য রেখে দিয়েছেন। শুক্রবার ছুটির দিন হলেই এখন পোলাও মাংস রান্না হয়। মনের অজান্তে এই একটা দিনের জন্য এখন অপেক্ষা করেন। খেতে খুব ভালো লাগে। অথচ আগে এমন হতো প্রতিদিনই মাংস থাকত, অথবা রিচ ফুড। অরুচি হয়ে গিয়েছিল। এখন খাওয়াটাও একটা ছকে বাঁধা পড়েছে। দিলশাদ হিসেব করে সুনিপুণ গৃহিণীর মতো সংসার চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ওর হাতে সব ছেড়ে দিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত একটা জীবন এখন। আগে নানা দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম হতো না। এখন জীবনের চাহিদা কমেছে সাথে দুশ্চিন্তাগুলো। চাহিদাগুলো আবর্জনার মতো ছিল। অপ্রয়োজনীয় সব ব্যাপার জীবন থেকে ছেঁটে ফেললে জীবনটা যে এত স্বস্তির হয় তা আগে বোঝ যায়নি।

ভাবনার এই পর্যায়ে চায়ের কাপ হাতে দিলশাদ রুমে ঢোকেন। একবার গলা বাড়িয়ে দেখেন, তারপর হেসে বলেন, ‘তোমার দেখি বেশ ভালোই গল্প পড়ার নেশা হয়েছে। জহির ছেলেটা তোমার সর্বনাশ করে দিল।’

জাফর উঠে বসে চায়ে চুমুক দিয়ে বলেন, ‘জানো দিলশাদ, যখন ইউনিভার্সিটি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি তখন শীর্ষেন্দুর এই ‘পার্থিব’ বইটা সবে বেরিয়েছে। দাম অনেক ছিল। আমি টিউশনের টাকা বাঁচিয়ে এই বইটা কিনেছিলাম। পুরো একটা সপ্তাহ বুঁদ হয়ে শুধু পড়েছিলাম। জীবনবোধের এক অসাধারণ গল্প। আমরা ভাবি জীবনের সবকিছু বোধহয় আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কিন্তু সব যে আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। আর সব কাজ শেষ করবারও দরকার নেই। প্রতিটি মানুষের জীবন একটা অসমাপ্ত কাহিনী। তাই জীবনপাত করে জীবনের সব অংক মেলানোর কোনো দরকার নেই। জানো, আমাদের যে সবকিছু এক রাতের আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে গেল তাতে আমার এখন আর কোনো আফসোস নেই। আমি প্রথম দিকে খুব ভাবতাম, কেন এমন হলো। কিছুতেই মানতে পারতাম না। মনে হতো সৃষ্টিকর্তা বুঝি আমার সব কেড়ে নিলেন। আমি প্যারালাইজড হয়ে কতটা দিন বিছানায় পড়ে রইলাম। মেয়েটা জীবনের শুরুতে এমন করে ঠকে গেল। খুব হতাশ লাগত।
তোমার উপর দিয়ে সব ঝড়ঝাপটা গেল। তারপর একটা সময় যখন সব থিতু হলো তখন আমি দেখলাম আমি অনেক কিছুই ফিরে পেয়েছি। মেয়েটা কেমন লক্ষ্মী হয়েছে, নিজে টিউশন করে করে আজ অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে পড়ছে এখন। এখনই ভালো ভালো চাকরির অফার পাচ্ছে। আরুশকে নিয়ম করে পড়াত। ছেলেটাও দেখো কী সুন্দর ইউনিভার্সিটিতে ভালো একটা সাবজেক্ট নিয়ে পড়ছে। তুমি আমাদের সবাইকে কেমন করে আগলে রেখেছ। পরিবারের একটা মায়ার বাঁধন আমি টের পাই। আগের দিন থাকলে এই যে একজন আরেকজনকে পরম মমতায় দেখে রাখা সেটা এমন করে হয়তো হতো না।

দেখো, আমি এখন ছুটির দিনগুলোতে একটু আয়েশ করে গল্পের বই পড়ছি। আগের দিনগুলো থাকলে আমি হয়তো এখন কোনো জাগতিক বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থাকতাম। মানুষের এই জাগতিক ব্যস্ততা যে তার মনের ভালো থাকার উপাদানগুলো কেড়ে নেয় সেটা বুঝতেই পারে না। তাই বলি, আমি সত্যিই পেয়েছি অনেকই, হারিয়েছি কম।’

দিলশাদ তন্ময় হয়ে শুনছিলেন। একটা ঘোরের মাঝে চলে গিয়েছিলেন যেন। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলেন, ‘তুমি একদম আমার মনের কথাটাই বলেছ। ক’টা মাস ধরে আমারও এমন মনে হয়। মেয়েটা একটা ধাক্কা খেয়েছে বটে, কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছে দারুণ করে। এই ধাক্কাটা ওকে সামনের জীবনে চলতে খুব সাহায্য করবে। আমার শখের গহনাগুলো বিক্রি করতে হয়েছে কিন্তু এখন মনে হয় তার বিনিময়ে আমি তোমাদের অনেক কাছে পেয়েছি। এই যে তুমি চাকরির পয়সা বাঁচিয়ে আমার জন্য মাঝে মাঝে শাড়ি নিয়ে আসো এটাতে একটা মায়া আছে, ভালোবাসা আছে। যেটা আমি লাখ তিনেক টাকার হীরের আঙটি কিনে পাইনি। আমাদের জীবন যুদ্ধে তুমি যে অমন চাকরি করতে গিয়েছ সেটা আমাদের সম্মানিত করেছে। নিজের সব ইগোকে গলা চাপা দিয়ে শুধুমাত্র পরিবারের জন্য তুমি যে ভূমিকা রেখেছ, আমরা সবাই সত্যিই আপ্লুত। মনের টান আরও বেড়েছে।’

জাফর মাথা নাড়ে। আজ সকালটা দারুণ একটা আত্ম-উপলব্ধির সকাল হলো।

দিলশাদ আবদারের গলায় বলে, ‘আচ্ছা, শোন না, অনেক দিন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয় না। এবার চলো, সবাই মিলে কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসি। ট্রেনে যাব, ট্রেনে করে ফিরে আসব। খুব একটা খরচ হবে না। আমি আর আরুশ মিলে হিসেব করেছি। আর নওরিনের মনটা ফ্রেশ হবে। মেয়েটা ইদানিং কথা কম বলে। কী যেন ভাবে সারাক্ষণ। একটু ঘুরে এলে ওর মন ভালো হবে।’

জাফর মাথা নাড়েন। একটা সময় বছরে নিয়ম করে বিদেশ যেতেন ঘুরতে। কক্সবাজারও যাওয়া হয়েছে, তবে প্লেনে করে। ট্রেনে করে যাওয়াটা নতুন অভিজ্ঞতা হবে।

আগ্রহের সাথে বলেন, ‘চলো ঘুরে আসি। অনেক দিন এক জায়গায় থাকতে থাকতে হাত পায়ে শিকড় গজিয়ে গেছে। আচ্ছা একটা কাজ করা যায়, ওই জহির ছেলেটাকে আমাদের সাথে নিয়ে যাই? বেচারার এই পৃথিবীতে কেউ নেই। কতটা বছর আরুশকে টানা পড়াল। আরুশও ওকে ভীষণ পছন্দ করে।’

দিলশাদ একটু বিরক্ত গলায় বলেন, ‘আমরা ফ্যামিলি নিয়ে ঘুরতে যাচ্ছি সেখানে বাইরের একটা ছেলে থাকা ঠিক হবে? না মানে বলছিলাম মেয়ে তো এখন বড় হয়েছে, বিয়ে দিতে হবে। এমন সম্পর্কহীন একটা ছেলেকে সাথে করে নিয়ে গেলে নানান জনে নানান কথা বলবে।’

জাফর মুচকি হেসে বলে, ‘সম্পর্ক করে নিলেই হয়। শুনলাম ছেলেটা নাকি ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্ট হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় চাকরি হয়ে যাবে। না হলেও একটা ভালো কিছু নিশ্চয়ই করবে। এমন ভালো একটা ছেলে হাতছাড়া করা কি ঠিক হবে?’

দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এমন এতিম একটা ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিবে? নওরিনের সাথে এমন চালচুলোহীন একটা ছেলের বিয়ে কী করে হয়?’

জাফর দার্শনিক গলায় বলেন, ‘আমার কিন্তু একটা সময় সব কিছু ছিল। গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক ব্যালেন্স, আত্মীয়স্বজন – কোনো কিছুর কমতি ছিল ন। কিন্তু ভাগ্যের ফের দেখো, এই আমার আজ কিছুই নেই। কাছের মানুষেরাও আজ দূরে। এক রাতের আগুনে সব শেষ হয়ে যায়। তাই বলে কি তুমি আমাকে ছেড়ে গিয়েছ? ছেলেটা ভালো, ওর জাগতিক ঐশ্বর্য না থাকতে পারে, কিন্তু মনের ঐশ্বর্য আছে। ভেবে দেখতে পারো, অবশ্য নওরিন কী ভাবছে সেটাও জানা দরকার।’

দিলশাদ একটু থমকান। এভাবে তো ভেবে দেখা হয়নি। বিপদে কাছের মানুষকে কাছে পাননি। নিজেরাই নিজেদের যুদ্ধটা করে গেছেন। জহির ছেলেটা সেই প্রথম থেকেই ওদের সাথে। কোনোদিন একটা উল্টোপাল্টা কিছু করেনি। নওরিনও হয়তো ওকে পছন্দ করে। মানুষের আসলে কী চাই? একটা ভালো মানুষ।

ভাবনার এই পর্যায়ে আরুশ রুমে ঢোকে। অভিযোগের গলায় বলে, ‘আম্মু, আপু বলছে কক্সবাজার যাবে না।’

দিলশাদ ঘুরে তাকান। ছেলেটা কত লম্বা হয়ে গেছে। এখনই পাঁচ ফুট আট। কী সুন্দর গায়ের রঙ, চোখ দুটো ভাসা ভাসা। মুগ্ধ চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তাই? দাঁড়া, আমি রাজি করাব তোর আপুকে।’

আরুশ এবার বাবার পাশে গিয়ে বসে।

দিলশাদ উঠে গিয়ে নওরিনের রুমে যান। দরজার কাছে এসে থমকে তাকান। জানালার পাশে একটা চেয়ারে বসে আছে নওরিন। হাতে একটা বই। মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছে। কী বিষণ্ণ মুখ! দিলশাদের বুক ধক করে ওঠে। মেয়েটা আবার কষ্ট পেলো না তো?

পায়ে পায়ে এগিয়ে যান। কাছে যেতেই ও মুখ তোলে। দিলশাদ নরম গলায় বলে, ‘কী পড়ছিস?’

নওরিন হাসার চেষ্টা করে, তারপর নিচু গলায় বলে, ‘জীবনানন্দের কবিতা।’

দিলশাদ আগ্রহের গলায় বলে, ‘আমাকে শোনাবি একটু?’

নওরিন ঘাড় কাৎ করে বলে, ‘আচ্ছা। এটা জীবনানন্দের ‘মৃত্যুর আগে’ কবিতাটা।’

দিলশাদ একটু চমকায়। কিন্তু ওকে বুঝতে দেয় না।

নওরিন বিষাদ গলায় পড়তে শুরু করে –

“আমরা হেঁটেছি যারা নির্জন খড়ের মাঠে পউষ সন্ধ্যায়,
দেখেছি মাঠের পারে নরম নদীর নারী ছড়াতেছে ফুল
কুয়াশার; কবেকার পাড়াগাঁর মেয়েদের মতো যেন হায়
তারা সব; আমরা দেখেছি যারা অন্ধকারে আকন্দ ধুন্দুল
জোনাকিতে ভ’রে গেছে; যে-মাঠে ফসল নাই তাহার শিয়রে
চুপে দাঁড়ায়েছে চাঁদ–কোনো সাধ নাই তার ফসলের তরে;

আমরা বেসেছি যারা অন্ধকারে দীর্ঘ শীত রাত্রিটিরে ভালো,
খড়ের চালের পরে শুনিয়াছি মুগ্ধরাতে ডানার সঞ্চার:
পুরোনো পেঁচার ঘ্রাণ; অন্ধকারে আবার সে কোথায় হারালো!
বুঝেছি শীতের রাত অপরূপ, মাঠে-মাঠে ডানা ভাসাবার
গভীর আহ্লাদে ভরা; অশথের ডালে-ডালে ডাকিয়াছে বক;
আমরা বুঝেছি যারা জীবনের এই সব নিভৃত কুহক”

পড়তে পড়তে নওরিনের চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে৷ দিলশাদ মেয়েকে জড়িয়ে ধরতেই ও হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা শুন্যতা দিনে দিনে গ্রাস করে নিয়েছে। যে মানুষটাকে এত করে চায় সেই মানুষটার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস নেই। অতীতের অন্ধকার বার বার পিছু টানে, কিছুতেই যে সেই মানুষটার কাছে পৌঁছুতে দেয় না।

২.
আজ দুপুরের আগেই ক্লাশ শেষ হয়ে গেল। অথচ আজ সারাদিন ক্লাশ হবার কথা। ডিপার্টমেন্টের একজন সিনিয়র শিক্ষক মারা যাওয়াতে হঠাৎ করেই সব ছুটি হয়ে গেল। নওরিন ক্লাশ ছেড়ে রাস্তায় নামে। বসন্তের একটা মাতাল বাতাস এসে ওর কপালের চুলগুলো এলোমেলো করে দেয়। মনটা কেমন হু হু করে ওঠে। আজ কতটা দিন জহিরের সংগে কথা হয় না৷ নিজের মনের সংগোপন এই বেদনা যে কাউকে বলবার না। নিজের সেই বিষাক্ত ইতিহাস নিয়ে ও কী করে জহিরের সামনে ভালোবাসার দাবি নিয়ে দাঁড়ায়? সেদিন বাসায় একগাদা মিষ্টি নিয়ে এসেছিল। মাস্টার্সের নাকি রেজাল্ট হয়েছে। অনার্সের মতো এবারও ফার্স্ট হয়েছে। নওরিন সেদিন শুকনো মুখে অভিনন্দন জানিয়েছিল শুধু। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল অনেকগুলো সাদা চন্দ্রমল্লিকা নিয়ে সামনে দাঁড়াতে। কিন্তু সাহস হয়নি। জহিরও কোনোদিন ওর সামনে এসে জোর করে জানতে চাইল না কেন ও দূরে সরে গেল। উলটো জহির নিজেও দূরে দূরেই থাকে। এড়িয়ে চলে।

ভাবতে ভাবতে আনমনে রাস্তার মাঝখানে চলে আসতেই হঠাৎ পেছন থেকে সাইকেলের ট্রিং ট্রিং শব্দে মনের অজান্তেই লাফ দিয়ে সরে যায়। আর তখনই টের পায় স্যান্ডেলের ফিতে ছিড়েছে। বিরক্তি নিয়ে কিছু বলতে যেতেই অবাক হয়ে দেখে জহির সাইকেল থামিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।

জহির তাড়াহুড়ো করে নীলক্ষেতে যাচ্ছিল। কিছু কাগজপত্র ফটোকপি করতে হবে। আর হঠাৎ করেই এই বিপত্তি। কিন্তু এমন করে নওরিনের সাথেই আবার একই ঘটনা ঘটবে ও স্বপ্নেও ভাবেনি।

ও সাইকেল নিয়ে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়, তারপর ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আজকেও স্যান্ডেলের ফিতে ছিড়ে গেছে? সাইকেলে উঠে বসুন।’

নওরিন আজ আর দ্বিরুক্ত করে না। সাইকেলের পেছনে উঠে বসতেই জহির প্যাডেলে চাপ দেয়। কোথা থেকে একটা বাতাস এসে জহিরের চুল এলোমেলো করে দিচ্ছিল। জহির টের পায়, বহুদিন পর বুকের কোথাও পুড়তে থাকা জায়গাটায় ঠান্ডা জল পড়ল।

নিমাই দাদাকে ইউনিভার্সিটির গেটেই পাওয়া যায়। ওদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হেসে বলে, ‘আজকেও বুঝি ফিতে ছিড়ে গেল?’

জহির হাসে, তারপর বলে ভালো করে সেলাই করে দাও নিমাই দাদা, আর যেন কখনো না ছোটে। তুমি বাঁধনগুলো এত আলগা করে দাও কেন, শক্ত করে বাঁধতে পারো না?’

নিমাই ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, ‘এবার এমন বাঁধন বাধব আর কোনদিন ছুটবে না।’

নওরিন মাথা নিচু করে। একটা ভালো লাগা ওকে ঘিরে যাচ্ছিল। একটা মানুষকে এত ভালো লাগে সেটা সেই মানুষকে বলতে না পারার কষ্ট যে কত বড় শুধু ওই জানে।

জুতো মেরামতি শেষে নওরিন টাকা বের করতেই জহির বাধা দিয়ে বলে, ‘আজকে না হয় আমিই দিলাম।’

নওরিন কিছু বলে না। দাম মিটিয়ে ওরা একটু এগোতেই, নওরিন বলে, ‘আমি তাহলে যাই আজ?’

জহির মন খারাপ গলায় বলে, ‘চলে যাবেন? আচ্ছা ঠিক আছে যান। আমার কাছে আপনার একটা জিনিস রয়ে, গিয়েছিল।’

নওরিন জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলে, ‘কী জিনিস?’

জহির ব্যাগ থেকে জীবনানন্দ দাশের একটা কবিতা সমগ্র বের করে বলে, ‘এটা আপনার জন্য কিনেছিলাম কয়েক বছর আগে। কিন্তু দেওয়া হয়নি। আমি প্রতিদিন এটা ব্যাগে নিয়ে ঘুরি। যদি কোনদিন আপনাকে দেবার সুযোগ হয়। কেন যেন আপনাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অথচ আপনি এই পৃথিবীতেই থাকেন। যে পৃথিবীতে আপনি থাকেন সেই পৃথিবীতে আমি আপনাকে খুঁজে পাই না, একটু কাছে পাইনা। নওরিন আমি আপনাকে ভালোবাসি। আপনি যেদিন আমার হলে গেলেন আমার সেই জ্বর দেখতে আমার মনে হয়েছিল এই পৃথিবীতে একজন মানুষ হলেও আমার আপন আছে। জানেন তো, এই পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। আপনাকে পেয়ে আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। একজন কেউ তো আমায় মায়া করে। কিন্তু সেদিন আপনাদের বাসায় আমি যখন বললাম আমি এতিমখানায় বড় হয়েছি আপনি খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলেন। আপনি হয়তো আশা করেননি এমনটা। কী করব বলুন তো? আমাকে ছেড়ে যে সবাই চলে যায়। প্রিয় বাবা মা চলে গিয়েছেন। এখন আপনিও যদি চলে যান আমি বাঁচি কী করে বলুন তো?’

নওরিন কান্না সামলাতে পারে না। ফাল্গুনের এক বুক কেমন করা দুপুরবেলা পরীর মত সুন্দর একটা মেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। আটকানো গলায় বলে, ‘সেদিন আমার ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। আপনি যখন বললেন বললেন এই পৃথিবীতে আপনার কেউ নেই আমি কান্না আটকাতে পারিনি। ইচ্ছে হয়েছিল আপনাকে ঝাপটে বুকের ভেতর রেখে দেই। কিন্তু আমার যে একটা অন্ধকার অতীত আছে। আমি সেই অতীত নিয়ে আপনার সামনে দাঁড়াতে চাইনি, আপনাকে ঠকাতে চাইনি কোনদিন। একটা ছেলের সাথে আমার প্রেম ছিল, সে আমাকে ঠকিয়েছে। ভীষণভাবে আমার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছিল। শরীরের ক্ষুধা মিটিয়ে আমাকে ঠকিয়ে সে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। আপনি বলুন, এই অতীত নিয়ে কি করে আপনার সামনে গিয়ে দাঁড়াই? ভালোবাসার মানুষের সাথে ছলচাতুরি করা যায়?আমি যে আপনাকে ভালোবাসি।’

জহির এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে আকুল গলায় বলে, ‘ বোকা মেয়ে একটা, এমন করে এতটা বছর কষ্ট চেপে রাখতে আছে? কাউকে ভালোবাসলে শুধু তার ভালোটা ভালবাসতে নেই, তার খামতিগুলো নিয়েও ভালোবাসতে হয়। এই যে তুমি আমার এতিমখানায় বড় হওয়া নিয়ে উল্টো কষ্ট পাচ্ছ, আমার জন্য মায়া হয়েছে এটাই তো ভালোবাসা। তুমি যে এমন কষ্ট পেয়েছ এখন সেটা জেনে আমার ইচ্ছে হচ্ছে তোমাকে বুকে লুকিয়ে রাখি।’

জহির যে মনের অজান্তে ওকে তুমি করে বলছে সেটা বুঝি ও খেয়াল করেনি। কোথাও একটা কোকিল ডেকে ওঠে। তাতে করে পুরো পৃথিবীর সব ফুলের বাগানে ফুল ফোটে, বসন্তের আগমনের ঘোষণা দেয়।

ঢাকা শহরের রাজপথে একটা মেয়ে একটা ছেলের সাইকেলের পেছনে বসে ঘুরতে থাকে। আর একটা হাত দিয়ে পরম মমতায় ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে রাখে।

পথচলতি যারাই ওদের দেখে তারাই কেমন থমকে যায়, বুকের ভেতর কেমন একটা নরম মায়া টের পায়। আমি বাজি ধরে বলতে পারি এই দৃশ্য দেখলে আপনাদেরও চোখে জল আসবে।

সমাপ্ত

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে