#আলো অন্ধকারে (পর্ব ৭)
১.
আরুশ মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দিচ্ছিল, ক্লাশ এইটের ভর্তি পরীক্ষা। যদি পরীক্ষা ভালো হয় তাহলে নতুন এই স্কুলে পড়তে পারবে। আর আম্মু খুব করে চাচ্ছে এই স্কুলটায় ও যেন ভর্তি হতে পারে। আরুশ ভেবে পায় না আম্মু এমন পচা একটা স্কুলে কেন ওকে ভর্তি করতে নিয়ে এল। বেঞ্চগুলো কাঠের, পুরনো। কেমন উঁচুনিচু ঢেউ খেলানো। খাতা রাখলে অসমান হয়ে যাচ্ছে। ফ্লোরে ছেঁড়া কাগজ, ধুলোবালি। জানালার কাচ ভাঙা, দেয়ালের রঙ উঠে গেছে। এমন ছিরিছাঁদহীন একটা স্কুলে ওকে নাকি ভর্তি পরীক্ষায় টিকতেই হবে।
এই যখন ভাবছে ঠিক তখন পেছন থেকে একটা ছেলে নিচু গলায় ডাক দেয়, ‘ওই পটলা, তোর খাতাটা বাম দিকে সরা। আর তোর হাত সরা খাতার উপর থেকে।’
আরুশ অবাক হয়ে পেছন ফিরে তাকায়। এই ছেলেটা ওকে পটলা বলছে কেন?
ঠিক এই সময় ক্লাস রুমে গার্ড দিতে আসা মাঝবয়সি একজন শিক্ষিকা কড়া গলায় ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই ছেলে, পেছন ফিরে কথা বলছ কেন?’
আরুশ ভয়ে কেঁপে ওঠে। দ্রুত সামনে তাকায়, তারপর মাথা নিচু করে লিখতে থাকে। কিছুক্ষণ পর পরীক্ষা শেষ হবার ঘন্টা বাজে। আরুশ খাতাটা গুছিয়ে বেঞ্চের উপর রাখে। সেই ম্যাডাম একে একে সবার খাতা নিয়ে বলেন, ‘আগামী মাসের এক তারিখে রেজাল্ট দেওয়া হবে। যারা টিকবে তারা ভর্তির জন্য টাকা নিয়ে আসবে।’
ম্যাডাম ক্লাশ থেকে বের হতেই সেই পেছনে বসা ছেলেটা ওর পেটে খোঁচা মারে, ‘ওই পটলা, তোরে যে বললাম খাতা দেখাইতে, দেখাইলি না কেন?’
আরুশ একটু ভয় পায়, ও থতমত গলায় বলে, ‘ম্যাডাম না করলেন তো। আর তুমি আমাকে পটলা ডাকছ কেন, আমার নাম আরুশ।’
ছেলেটা হো হো করে হেসে ওঠে, তারপর মুখ ভেঙচে বলে, ‘আমাকে পটলা ডাকছ কেন? তুই এত শুদ্ধ করে কথা বলিস ক্যান? আমার নাম নিলয়। এই স্কুলে টিকলে তোর সাথে আবার দেখা হবে।’
আরুশ এবার একটু সহজ হয়, ‘ওকে, থ্যাংকিউ নিলয়। তোমার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল।’
নিলয় এবার হেসে গড়িয়ে পড়ে, ‘এই, তুই কী রে! আমাকে থ্যাংকিউ দিচ্ছিস কেন। আর আমাকে তুমি তুমি করে বলছিস কেন। তুই করে বলবি।’
আরুশ মাথা নাড়ে, তারপর ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই মাকে দেখতে পায়।
কাছে যেতেই দিলশাদ উদবিগ্ন গলায় বলে, ‘কী রে, পরীক্ষা কেমন হলো? এখানে টিকবি তো?’
আরুশ মুখ গোল করে বলে, ‘হ্যাঁ আম্মু, আমি কোয়ালিফাই করব। ইংরেজিগুলো তো খুব ইজি ছিল। আর ম্যাথ একটু টাফ ছিল, কিন্তু আমি পেরেছি।’
দিলশাদ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। এই স্কুলটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদম কাছেই। আর এটাতে ইংরেজি ভার্সন আছে। তাতে করে আরুশের খাপ খাইয়ে নিতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। ইতোমধ্যে নওরিনের ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে। দু’জনের পড়ার জায়গাটা কাছাকাছি না হলে যে খুব মুশকিল হয়ে যাবে। আরুশ এই স্কুলে টিকে গেলেই এখানে একটা বাসা দেখতে হবে। ব্যাংক থেকে ওদের এই ক’টা মাস সময় দিয়েছে। এর মধ্যেই সব গুছিয়ে নিতে হবে। দিলশাদ হিসেব করে দেখেছে ব্যাংকের লোন শোধ করে হাতে যা থাকবে তা দিয়ে মাসে এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকার মতো পাওয়া যাবে। এত অল্প টাকা দিয়ে ঠিক কী করে চালাবেন বুঝে উঠতে পারেন না। আরুশের আগের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলটা ইতোমধ্যে ছাড়িয়ে নিয়েছেন। তাতে বড়ো একটা খরচ বাঁচে। নওরিনের পেছনেও খুব একটা খরচ হবে না। জাফরের ফিজিওথেরাপিতে খরচটা বেশি। অবশ্য ওর অনেক উন্নতি হয়েছে এই ক’টা মাসে। এখন অনেকখানি হাঁটতে পারে। ইশ, নিজেদের বাসাটা অন্তত যদি থাকত! ইদানিং মাঝে মাঝেই ভীষণ ভয় লাগে। মনে হয় সব হারিয়ে ফেলবেন। এমন আর্থিক নিরাপত্তার ভয় জীবনে কোনোদিনই ছিল না।
আরুশ এবার তাড়া দেয়, ‘আম্মু, ক্ষুধা পেয়েছে।’
দিলশাদ সম্বিৎ ফিরে পান, মাথা নেড়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, চল। বাসায় যেয়ে ভাত খাবি।’
আরুশের ভীষণ অভিমান হয়। আম্মু যেন কেমন হয়ে গেছে। এত কষ্ট করে পরীক্ষা দিয়ে আসলো আর ওকে বার্গার খেতে বলল না। কতদিন বাইরে খেতে যায় না। এখন সেই বাসায় যেয়ে ভাত খাও। আরুশ মন খারাপ করে গাড়িতে উঠে পড়ে।
সেদিন বাসায় ফিরে রাতের বেলা দিলশাদ হিসেব করতে বসেন। পাশে নওরিন। জাফরকে ইচ্ছে করেই ডাকেন না। মানুষটা এমনিতেই দুশ্চিন্তায় থাকে। নওরিনকে ইদানিং সব কথা শেয়ার করেন যাতে করে মেয়েটা সংসারের বাস্তব চিত্রটা বুঝতে পারে।
দিলশাদ একটা একটা করে খরচের কথা বলছেন আর নওরিন সেটা খাতায় লিখছে –
আরুশের স্কুল ৫০০০টাকা
আরুশের টিউশন ১০০০০ টাকা
নওরিনের যাতায়াত ৩০০০ টাকা
হাতখরচ ২০০০ টাকা
সংসার খরচ ৪০০০০ টাকা
ফিজিওথেরাপি ১০০০০ টাকা
বাসা ভাড়া ৩০০০০ টাকা
গাড়ি খরচ ৩০০০০ টাকা
অন্যান্য ১০০০০টাকা
মোট এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা।
অংকটার দিকে চিন্তিত চোখে তাকিয়ে থাকেন। এত টাকা লাগবে? এর মাঝে কেউ যদি অসুস্থ হয়? নতুন জামা কাপড় লাগবে, তার খরচ আছে। ব্যাংকে যা সেভিংস আছে সেখান থেকে সব মিলিয়ে এক লাখ টাকা ত্রিশ হাজার পাবেন মাসে। কিন্তু এখানে তো এখনই এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা দেখাচ্ছে।
নওরিন মায়ের অসহায়ত্বটা টের পায়। লিস্টে একবার চোখ বুলিয়ে বলে, ‘আম্মু, আরুশকে আমি পড়াব। ওর টিউশনের দশ হাজার টাকা বাদ দাও। আর আমার জন্য যে পাঁচ হাজার টাকা আছে ওটাও বাদ দাও। আমি টিউশন করব, তাতে করে তোমার মোট পনের হাজার টাকা তো বাঁচবেই সাথে আমি যা পাব তা যোগ হবে। ভেব না আম্মু, আমরা ঠিকঠাক চলতে পারব।’
দিলশাদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। মেয়েটা কবে কবে বড়ো হয়ে গেল। ও টিউশন করবে!! এত দূর ভেবে ফেলল মেয়েটা?
ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলেন, ‘তোর টিউশন করতে হবে না, ব্যাংকে এখনো অনেক গহনা আছে। লাগলে ওগুলো বিক্রি করে ফেলব। তুই শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা কর।’
নওরিন মায়ের আদর নিতে নিতে ভাবে, আম্মু যতই না করুক ওকে কিছু একটা করতেই হবে।
পরের মাসের এক তারিখে আরুশকে নিয়ে দিলশাদ দুরুদুরু বুকে সেই স্কুলটায় যায়। নোটিশ বোর্ডে ঝোলানো ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে। ব্যাকুল চোখ ‘আরুশ খান’ নামটা খুঁজে বেড়ায়। তারপর যখন ওর নামটা লিস্টে দেখেন তখন যেন পরীক্ষা পাশের আনন্দ হয়।
সেদিনই আরুশকে ভর্তি করিয়ে বাসায় ফেরেন। বড়ো একটা চিন্তা গেল। এখন বাসা দেখতে হবে। ভাবনাটা ভাবতেই কেমন গুটিয়ে যান। কখনও বাসা ভাড়া করতে হবে ভাবেননি।
সপ্তাহখানেক পর একদিন দুপুরের পর দিলশাদ বের হন। ড্রাইভার ছেলেটা আজিমপুর এলাকায় কয়েকটা বাসা দেখে রেখেছে। এখানেই আরুশের নতুন স্কুলটা।
দিলশাদ প্রথম যে বাসাটায় যান সেটা একটা ফ্ল্যাট বাসা। গেটে দারোয়ান আছে। জিজ্ঞেস করতেই বলে, ‘তিন তলায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া হইব। দেখবেন? মালিক উপরের ফ্ল্যাটে থাকে। পছন্দ হইলে হেরে ডাক দিমু।’
দিলশাদ মাথা নেড়ে বলেন, ‘আচ্ছা, আগে দেখে নেই।’
লিফটে করে ওরা উপরে চলে আসে। দারোয়ান বেল বাজাতেই একজন বুড়োমতো মহিলা দরজা খুলে দেন। দারোয়ান একবার অনুমতি নেবার গলায় বলে, ‘নতুন ভাড়াটিয়া, বাসা দেখতে আসছে।’
বুড়ো মহিলা সরে জায়গা করে দেন। দিলশাদ দারোয়ানের পিছু পিছু ভেতরে ঢোকেন। পুরো বাসাটা এত ছোট! একটা ধাক্কা খান। বহুদিন এমন ছোট বাসায় ঢোকা হয়নি। একটা বেড রুম মোটামুটি বড়ো। বাকিগুলো বেশ ছোট। দুটো ছোট বারান্দা আছে। দিলশাদ বার বার হিসেব করছিল কী করে ওর সব আসবাবপত্র এই ছোট বাসায় ধরাবেন?
দেখা শেষে নিচে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করেন, ‘এত ছোট বাসা! এর ভাড়া কত?’
দারোয়ান চোখ কপালে তুলে বলে, ‘তিন বেডরুমের পনেরশ স্কোয়ার ফুটের বাসা আপনি ছোট কইলেন? এইটার ভাড়া মাসে ত্রিশ হাজার টাকা। গ্যাস, বিদুৎ, সার্ভিস চার্জ আলাদা।’
দিলশাদের কপালে ভাঁজ পড়ে, ‘এত বেশি? আচ্ছা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, সার্ভিস চার্জ মিলিয়ে কত পড়বে?’
দারোয়ান ঠোঁট উলটে বলে, ‘তা সব মিলাই আটত্রিশ হাজার টাকা তো পড়বই। আর দুই মাসের বাসা ভাড়া এডভান্স দিতে হইব।’
দিলশাদ মনে মনে একটা ধাক্কা খান। বাসা ভাড়া বাবদ ত্রিশ হাজার টাকা ধরে রেখেছিলেন। এই ছোট বাসা, এটার পেছনে বাড়তি আরও আট হাজার টাকা খরচ হবে?
দারোয়ান জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘মালিকের সাথে কথা বলবেন?’
দিলশাদ একটু ভাবেন। বাসাটা আরুশের স্কুলের একদম কাছাকাছি। তাছাড়া এটার নিরাপত্তা বেশ ভালো। একটু ভেবে বলেন, ‘ঠিক আছে তোমার মালিকের সংগে কথা বলব।’
দারুণ নিচে থেকে ইন্টারকমে ফোন দিতেই ওপাশ থেকে ফ্ল্যাটের মালিক উপরে যেতে বলেন।
দিলশাদ দারোয়ানের সাথে আবার লিফটে করে উপরে ওঠে। বেল বাজাতেই মাঝবয়সী টাক মতো একটা লোক দরজা খুলে ওকে ভেতরে যেয়ে বসতে বলে।
দিলশাদ ভেতরে ঢুকতেই একটা ধাক্কা খান। দেয়ালে কটকটে হলুদ রঙ, সিলিং জুড়ে ভারী কাঠের কাজ। এই দিনের বেলাতেও সিলিং থেকে লাল, নীল রঙের স্পট লাইট জ্বলছে।
বাড়িওয়ালা লোকটা ওর সামনের সোফায় বসে।
ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি বাসা ভাড়া নিবেন? আপনার সাথে পুরুষ মানুষ কেউ নাই?’
দিলশাদ কথাটার অর্থ বুঝতে না পেরে বলে, ‘আপনার কথা বুঝতে পারলাম না। পুরুষ মানুষ কেউ নেই মানে?’
বাড়ির মালিক হামিদ পাটোয়ারী এবার গম্ভীর মুখে বলেন, ‘আপনারা কে কে থাকবেন বাসায়?’
দিলশাদের মেজাজ খারাপ হতে থাকে। বাসা ভাড়া নিতে এসে এমন ইন্টারভিউ দিতে হবে এটা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি।
ও গম্ভীর মুখে বলে, ‘আমি, আমার স্বামী, আর এক ছেলে, এক মেয়ে। আর কিছু জানার আছে আপনার?’
হামিদের সুর এবার নরম হয়, ‘বাহ হ্যাপি ফ্যামিলি। কোন সমস্যা নেই, দুই মাসের বাসা ভাড়া এডভান্স দিয়ে উঠে পড়ুন। বাসা ছাড়ার দুই মাস আগে আগে অবশ্যই জানাবেন। আচ্ছা আপনার হাসবেন্ড কী করেন?’
দিলশাদক ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এটাও আপনাকে বলতে হবে?’
হামিদ এবার নরম গলায় বলে, ‘আসলে হয়েছে কী জানেন, যাকে তাকে তো ভাড়া দেওয়া যায় না। দেখা যায় কোন কাজকর্ম করে না এমন মানুষকে ভাড়া দিলে ভাড়াটা ঠিকঠাক পাওয়া যায় না। এই বাসা ভাড়া দিয়ে আমার মাসের খরচ চলে।’
দিলশাদ গম্ভীরমুখে বলে, ‘আপনার বাসা ভাড়া আপনি ঠিক সময়মতো পেয়ে যাবেন। কিন্তু বাসা ভাড়াটা কমাতে হবে। আর আমার গাড়ি আছে গ্যারেজও লাগবে।’
হামিদ একটু ভাবেন। মহিলাকে দেখে সম্ভ্রান্ত ঘরের বলে মনে হয়। ভাড়াটিয়া হিসেবে ভালো হবে। একটু ভেবে বলেন, ‘বাসা ভাড়া কমাব না। কিন্তু গ্যারেজ ভাড়া যে দু’হাজার টাকা সেটা দিতে হবে না। যদি বাসা নেন তাহলে সাতদিনের মধ্যে এডভান্স করে উঠে পড়ুন।’
দিলশাদ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। এখানে আট হাজার টাকা বেশি লাগল, কিন্তু বাসাটা ভালো। আরুশের স্কুলের একদম কাছ। কিছু গহনা বিক্রি করতেই হবে, উপায় নেই। ও হামিদ সাহেবকে জানিয়ে যায় সাত দিনের মধ্যেই যোগাযোগ করবে।
সেদিন বাসায় ফিরে এসে জাফরকে সব খুলে বলে। জাফর শুধু শুনে যান, কোন কথা বলেন না। একটা অক্ষম রাগ টের পান। মন খারাপ গলায় বলেন, ‘তোমাদের সবাইকে আমি কষ্ট দিয়ে ফেললাম। আমার দায়িত্ব ছিল তোমাদের সুখে রাখা। পারলাম না, আমাকে ক্ষমা করে দিও।’
দিলশাদ ওর হাত ধরে ফেলে। তারপর নরম গলায় বলে, ‘কথাটা ভুল। দায়িত্বটা তোমার একার না, আমারও। আমাদের এই পরিবারের সবার দায়িত্ব। আমরা সবাই মিলে ভালো থাকার এই লড়াইটা লড়ব।’
পরদিন দিলশাদ পুরো বাড়ির সব আসবাবপত্রের একটা লিস্ট বানিয়ে ফেলেন। তাতে দেখা যায় অর্ধেকের বেশি জিনিস ফেলে যেতে হবে। ফ্রিজ আছে চারটা – দুটো ডিপ, দুটো নরমাল। তিন সেটা সোফা। একটা বড়ো ওয়াশিং মেশিন। দিলশাদ অনেক ভাবনা চিন্তা করে প্রয়োজনীয় সব কিছুর লিস্ট আলাদা করেন। বাকিগুলো দারোয়ানকে বলেন বিক্রি করার জন্য।
সেই মাসের শেষে খান প্যালেসের সামনে ঢাউস একটা ট্রাক এসে থামে। চার পাঁচজন শ্রমিক গোছের লোক হইহই করতে করতে মালামাল ওঠাতে থাকে। তাতে করে প্রায় পুরোটা দিন লেগে যায়।
সেদিন ছিল ডিসেম্বরের ত্রিশ তারিখ। ওরা যখন খান প্যালেস থেকে বের হয় তখন শীতের শেষ বিকেল। একটা ঠান্ডা হাওয়ায় জাফর খান কেঁপে ওঠেন। একবার পেছন ঘুরে নিজের হাতে গড়া ঐশ্বর্যের দিকে তাকান। কষ্টে বুকের পাঁজর ভেঙে যায় যেন। দিলশাদ শক্ত করে ওর হাত ধরে বলেন, ‘এই ঐশ্বর্য এখন আমাদের না। ওদিকে আর তাকিও থেকো না। তাতে শুধু আফসোসই বাড়বে।’
জাফর কেমন পরাজিত মানুষের মতো বাম পা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসেন। পেছনের সিটে আরুশ মন খারাপ করে বসে আছে। নওরিন জানালার দিকে তাকিয়ে কান্না লুকাচ্ছে। দিলশাদ নিচের ঠোঁট চেপে কান্নাটা সামলান। ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দেয়। গেট দিয়ে বের হবার সময় দারোয়ান আমির মিয়া লম্বা একটা সেলাম ঠুকে।
ধীরে ধীরে গাড়িটা খান প্যালেস থেকে দূরে সরে যেতে যেতে একসময় পথের বাঁকে হারিয়ে যায়। জীবনের এই বাঁকে এসে এমন করে সব হারিয়ে ফেলবেন সেটা এই পরিবারের কেউ কখনও জানত না। শুধু বিধাতা জানতেন।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর