#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ৫)
১.
নওরিন হাসপাতালের ধবধবে সাদা বিছানায় নিঃসাড় পড়ে আছে। চোখ দু’টো বন্ধ। মৃদু নিশ্বাসের সাথে বুক উঠানামা করছে, তাতে করে বোঝা যায় বেঁচে আছে। দিলশাদ বেগম ভেবে পান না ওর এই ফুলের মতো মেয়েটার কে এত বড়ো সর্বনাশ করল। ডাক্তার বলেছেন অল্পের জন্য বেঁচে গেল। ঠিক কত ব্যাগ রক্ত লেগেছে ওর হিসেব নেই। জাফর পাগলের মতো করছিল। উত্তেজনায় হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে যেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গিয়ে উলটো মাথায় জোর ব্যথা পেয়েছে। দিশেহারা একটা অবস্থা। নওরিনকে হাসপাতালে নেবেন না জাফরকে সামলাবেন। জীবন এত দুঃসহ হয়ে গেল কেন? কী পাপ করেছিলেন যে তার শাস্তি পেতে হচ্ছে?
ভোরবেলা একটা কোনো একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ইশ! ভাগ্যিস ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। উঠে প্রথমেই আরুশের রুমে একবার গিয়েছিলেন। তারপর নওরিনের রুমে যেতেই মনে হলো মরে যাবেন। নওরিন অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে আছে, আর পুরো বিছানা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ওর আর্তচিৎকারে রান্না করার মেয়েটা ছুটে এসেছিল। জাফর কী করে হুইলচেয়ারে একা একা চড়ল সেটা ও বলতে পারবে না। দিলশাদের শুধু মনে হচ্ছিল ওর মেয়েটা মরে যাচ্ছে। ওকে পাঁজাকোল করে ওরা দু’জন নিচে নামিয়ে গাড়িতে তুলেছিল। তারপর নিজেই চালিয়ে নিয়ে এসেছিল হাসপাতালে। আহারে জীবন! আর কতবার ওর বুকে ছুরি চালাবে? প্রথমে জাফরের এমন ভয়ংকর বিপদ সাথে স্ট্রোক আর তারপর মেয়েটার সংগে এমন অসম্ভব একটা ঘটনা ঘটল। এটা ধামাচাপা দেবেন কী করে?
নওরিন চোখ মেলে তাকায়। দিলশাদ ঝুঁকে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘কেমন লাগছে মা? এখন মাথা ঘোরানোটা কমেছে?’
নওরিন বিষণ্ণ হাসে, দূর্বল গলায় বলে, ‘আম্মু, আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি তোমার খারাপ মেয়ে।’
দিলশাদ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘চুপ, আর কিচ্ছু বলিস না। তুই বেঁচে আছিস এটাই আমার বড়ো পাওয়া। আমি আর কিছুই চাই না।’
নওরিন বুকের ভেতর একটা যন্ত্রণা অনুভব করে। বিবেকের যন্ত্রণা। বাবা মা বুঝি এমন হয়! এত বড়ো অপরাধ করেও আম্মু ওকে নির্দ্বিধায় বুকে টেনে নিয়েছেন।
মায়ের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে, ‘আম্মু, বাবা আর আমাকে আদর করবে না, তাই না?’
নওরিন নিচের ঠোঁট কামড়ে কান্না সামলান, ভাঙা গলায় বলে, ‘মাগো, আমরা সবাই তোকে আদর করব। তুই যে তোর বাবার প্রথম সন্তান। তুই যখন হলি তখন তোর বাবা কী খুশিই না হয়েছিল। মানুষকে ডেকে ডেকে মিষ্টি খাইয়েছে। তুই শুধু ভালো হয়ে উঠ মা।’
নওরিনের দু’চোখ বেয়ে তপ্ত জল গড়িয়ে পড়ে। সেই তপ্ত জল ওর ঠান্ডা গালে একটা মায়ার উষ্ণতার স্পর্শ বুলিয়ে দেয়।
এমন সময় কেবিনে একজন পরিপাটি চেহারার বয়স্ক গাইনি ডাক্তার ঢোকেন, সাথে একজন নার্স। দিলশাদ সোজা হয়ে বসেন। দ্রুত হাতে চোখের জল মুছে একটু হাসার চেষ্টা করেন।
নিজের পরিচয় দেন, ডা. সায়মা। বেডের কাছে এসে হেসে নওরিনকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কী অবস্থা তোমার? আজ ভালো লাগছে তো?’
নওরিন বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ে। ডাক্তার সাহেব রিপোর্টগুলো দেখে সন্তুষ্টির সাথে মাথা নাড়েন। পাশ থেকে দিলশাদ জিজ্ঞাসু গলায় বলেন, ‘আপা, ওকে ছাড়বেন কবে?’
সায়মা একটু ভেবে বলে, ‘কালকেই নিয়ে যেতে পারবেন। এখন সব ঠিকঠাক।’
তারপর নওরিনের দিকে ফিরে নরম গলায় বলে, ‘কিন্তু মামণি, তুমি তো আমাদের ভীষণ বিপদে ফেলে দিয়েছিলে। নিজে নিজে এমন করে ওষুধ খেতে আছে? বিপদের কথা সবার আগে তো বাবা মাকে জানাতে হয়। এই যে দেখো, যে বন্ধুটার জন্য তুমি আজ এমন বিপদে সে কিন্তু একবারও তোমার খোঁজ নেয়নি। মনে রেখো, পৃথিবীতে বাবা মায়ের চেয়ে আপন কেউ নেই। যা হবার হয়ে গেছে। এখন সব ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’
নওরিনের মুখটা বুকের কাছে লেগে আসে। কোথায় এই মুখ লুকাবে? এখন সবাই যে ওকে এমন করে উপদেশ দেবে।
ডাক্তার সাহেব চলে যেতেই দিলশাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘তুই যদি একবার আমাকে বলতি! আচ্ছা, এবার আমাকে বল, কে করেছে এটা? কার সংগে তোর এত গভীর সম্পর্ক ছিল যে আমি জানতেই পারলাম না?’
নওরিন জানত এই প্রশ্নটা আসবে। গতকালই আহনাফকে মেসেজ করে জানিয়েছিল ও হাসপাতালে ভর্তি। আহনাফ মেসেজটা সিন করেছে কিন্তু কিছুই বলেনি। পরে আবার মেসেজ দিতে যেয়ে দেখে মেসেজ যাচ্ছে না। কল করতে যেয়েও একই অবস্থা। তার মানে ওকে ব্লক করে রেখেছে আহনাফ! ব্যাপারটা বুঝতে পারার পর ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে৷ আহনাফ সত্যিই ওকে ভালোবাসেনি। ওর কথা আর লুকিয়ে লাভ নেই। যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে। ভেবেছিল চুপিচুপি সব ঠিক করে ফেলবে। কিন্তু পারল না। উলটো সেই চুপিচুপি কথাগুলো বড্ড বেশি শব্দ করে চারপাশে আলোড়ন তুলে ফেলেল।
ও নিচের ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘আহনাফ।’
দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এটা সেই গাড়ির বিজনেস করে করিমুল্লাহ সাহেবের ছেলে না?’
নওরিন মাথা নাড়ে।
দিলশাদ গম্ভীরমুখে বলে, ‘তুই ওদের বাসায় কেন গিয়েছিলি?’
নওরিন কিছুক্ষণ চুপ থাকে, তারপর জবাবদিহিতার ভঙ্গিতে বলে, ‘আমি ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে এপ্লাই করার জন্য ওর ওখানে গিয়েছিলাম। একশ ডলার টাকা ওই আমাকে দিল তো, তাই।’
দিলশাদ চোখ বড়ো বড়ো করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। সেদিন নওরিন টাকা চেয়েছিল, ইচ্ছে করেই দেননি। বিদেশে পড়া এখন সম্ভব না সেটা ওকে বুঝিয়ে বলেছিলেন। অথচ মেয়ে ওর কথা শুনল না? দিলশাদের হঠাৎ করেই রাগ হয়ে যায়। এই আহানাফ ছেলেটাকে প্রথম থেকেই অপছন্দ। আর সেকথাটা ওকে বার বার বলেছিলেন। কিন্তু তখন মেয়ে কথা কানে নেয়নি। আর পরিবারটাও খুব একটা ভালো না। কাঁচা টাকা হয়েছে, তার গরম দেখায়। এদের শিক্ষা দিতে হবে। আমার ফুলের মতো মেয়েটাকে ওরা মেরে ফেলতে চেয়েছিল।
দিলশাদ গম্ভীরমুখে বলে, ‘কাল আমরা থানায় যাব। তুই আমার সাথে যাবি।’
নওরিন বুঝতে না পেরে বলে, ‘থানায় কেন আম্মু?’
দিলশাদ কঠিন গলায় বলেন, ‘ওই বদমাশ লাফাঙ্গা ছেলেটার নামে রেপ কেসের মামলা দেব। ওকে আমি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব।’
নওরিন কাতর গলায় বলে, ‘না আম্মু, প্লিজ এটা করো না। তাতে করে আমার সব বন্ধুরা ব্যপারটা জেনে ফেলবে। আমি কারো কাছে মুখ দেখাতে পারব না।’
দিলশাদ রাগী গলায় বলে, ‘তুই কি ভাবিস এই খবর কারও জানতে বাকি আছে? তুই যখন সুস্থ হয়ে বাসায় চলে যাবি তখন ওই ছেলেই সবাইকে ডেকে ডেকে তার এই কীর্তির কথা রঙ চড়িয়ে বলবে। তারপর আরেকটা মেয়ের সর্বনাশ করবে। এদের প্রথমেই শাস্তিটা দিয়ে দিতে হয়।’
নওরিন চেয়ে থাকে। আম্মু ঠিক কথাই বলছেন। আহনাফের তো কিছুই হলো না। ও ওকে ভোগ করেছে। এখন দেশের বাইরে পড়তে চলে যাবে। ওকে কোনোদিন বিয়েও করবে না। আর সবার কাছে ওর সাথে ঘটে যাওয়া কুৎসিত ঘটনাটা রসিয়ে রসিয়ে বলবে। কথাটা মনে হতেই ওর সারা শরীরে আগুন ধরে যায়। শক্ত গলায় বলে, ‘আম্মু, আমি যাব তোমার সাথে থানায়।’
২.
করিমুল্লাহ মানুষটা ছোটখাটো। মানে সর্ব অর্থেই ছোটখাটো। হাত দুটো স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট, চোখ দুটো ছোট ছোট, কানগুলোও। মাথাটাও ছোট্ট নারকোলের মতো গোল। কিন্তু একটা জিনিস করিমুল্লাহকে সৃষ্টিকর্তা একটু বেশিই দিয়েছেন। আর সেটা হলো বুদ্ধি। না হলে পাঁচ বছরের মাথায় ঢাকার নামীদামী সব গাড়ি ব্যবসায়ীকে হঠিয়ে একচেটিয়া ব্যবসা করতে পারতেন না। আরেকটা বড়ো গুণ আছে করিমুল্লাহর, যেকোন পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন। এই যে এখন যেমন। বাসায় পুলিশ এসেছে আধা ঘণ্টা আগে। এরা লিভিংরুমে বসে আছে, আহনাফকে নাকি গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে। অপরাধও গুরুতর, রেপ কেস। নাহ, ছেলেটা ডোবাবে।
করিমুল্লাহ ছেলের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলেন, ‘আমাকে শুধু তুই একটা কথা বল, ওই মেয়ে নিজে থেকে এই বাসায় এসেছিল?’
আহনাফ মাথা নিচু করে বলে, ‘হ্যাঁ বাবা। আমি ওকে ভালোবাসি, বলেওছিলাম পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করব।’
করিমুল্লাহ ভ্রু কোঁচকায়, পাশে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোমার ছেলে তো দেখি নিজের বিয়েও ঠিক করে রেখেছে। তা মেয়ে ভালোই পছন্দ করেছিলি। বড়ো ব্যবসায়ী জাফর খানের মেয়ে। কিন্তু এখন তো কিচ্ছু নেই ওদের। তুই বিয়ে করতে চাইলেও আমি রাজি না।’
আহনাফের মা সালেহা চোখ পাকিয়ে বলে, ‘ওই বজ্জাত মেয়েকে ও বিয়ে করবে? অসম্ভব। যে মেয়ে আমার ছেলের নামে রেপ কেস দেয়, এ তো ভবিষ্যতে আমাদের নামেও নির্যাতনের কেস দেবে।’
আহনাফ এবার কান্না গলায় বলে, ‘বাবা, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমিও ওকে বিয়ে করব না। ও আমার নামে এত জঘন্য একটা কেস দিতে পারল!’
করিমুল্লাহ মাথা নাড়েন, ‘যাক, বাস্তবতাটা বুঝেছিস। এখন রেডি হয়ে চল, থানায় যেতে হবে।’
সালেহা আর্তনাদ করে বলে, ‘তুমি এসব কী বলছ, থানায় যাবে মানে?’
করিমুল্লাহ কঠিন গলায় বলেন, ‘অপরাধ করলে তার শাস্তি পেতে হয়।’
সালেহা এবার কান্না জুড়তেই করিমুল্লাহ কঠিন ধমক দেন, তারপর বলেন, ‘আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। রাতে ফিরতে দেরি হবে। তুমি পোলাও মাংস রান্না করো, এসে খাব।’
সালেহা হতভম্ব গলায় বলেন, ‘ছেলে জেলে যাচ্ছে আর তুমি বলছ পোলাও মাংস রান্না করতে? খেতে পারবে তুমি?’
করিমুল্লাহ হেসে বলেন, ‘তুমিও খাবে, সাথে তোমার ছেলেও।’
কথাটা বলে আর দাঁড়ান না। দ্রুত রেডি হন। প্রিয় বাদামি রঙের সাফারি স্যুটটা পরে নেন। এই ড্রেসটা কেন জানি খুব আত্মবিশ্বাস দেয় করিমুল্লাহকে। একটা ধোপদুরস্ত ভাব আসে। তা করিমুল্লাহ সবসময় এমন থাকতে পছন্দ করেন। বড়ো বড়ো ক্লায়েন্ট আসে, তারাও পরিপাটি মানুষ পছন্দ করে।
লিভিং রুমে আসতেই ওসি মহসিন সাহেব উঠে দাঁড়ায়, বিগলিত গলায় বলে, ‘স্যার, আপনার ছেলেকে তাহলে নিয়ে যাই এখন?’
করিমুল্লাহ মাথা নেড়ে বলেন, ‘ওসি সাহেব, আমি আমার গাড়িতে ওকে নিয়ে বের হচ্ছি। আপনারা আমার পেছন পেছন আসেন। বোঝেন তো, বাসা থেকে পুলিশের গাড়ি চড়ে ছেলে বেরোলে আর মান সম্মান থাকে না।’
ওসি মহসিন মধুর গলায় বলে, ‘কিন্তু স্যার এই নিয়ম তো নাই। ধনী গরীব সবার জন্য আইন সমান। ওনাকে পুলিশের গাড়িতেই যেতে হবে।’
করিমুল্লাহ হাসেন, ‘আপনি বৃহস্পতিবার রাতে আসামিকে গ্রেফতার করতে এসেছেন। তার মানে হলো আপনি দুটো দিন ওকে অনায়াসে থানায় আটকে রাখতে পারবেন। তাতে করে দর কষাকষির সুযোগ থাকে। আইনের দাড়িপাল্লাটা আমার দিকে একটু হেলিয়ে দিতে যা লাগে আপনাকে আমি তাই দেব। চলুন এবার।’
শেষ কথাটা একটু শক্ত গলাতেই বলেন।
থানায়া পৌঁছুতে খুব বেশি একটা সময় লাগে না। ওসি মহসিন খাতির করেই ওদের বসায়। তারপর চিন্তিত গলায় বলে, ‘স্যার, এখন কী করব আপনি তাই বলেন।’
করিমুল্লাহ ছোট্ট একটা নিশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘শুনুন মহসিন সাহেব, ছেলে মেয়েরা এই বয়সে প্রেম করে, ভালোবাসে। তাতে এক দুটো ভুল হয়ে যায়। যা হয়েছে ওই মেয়ের সম্মতিতেই হয়েছে। আর সে আমার বাসায় এসেছে। তাকে তো জোর করে উঠিয়ে আনা হয় নাই। ঘটনার এতদিন পর কেন তারা মামলা করল?’
মহসিন একটু গম্ভীর গলায় বলে, ‘স্যার, মেয়েটাকে আপনার ছেলেই ওই এবরশনের ওষুধ খেতে বলেছিল। তাতে মেয়েটা মরতে বসেছিল।’
করিমুল্লাহ ওর দিকে তাকায়, তারপর গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘এটা খুব দুঃখজনক। আপনি ওদের থানায় আসতে বলেন, আমি ওদের কাছে ক্ষমা চাব।’
মহসিন একটু অবাক গলায় বলে, ‘আপনি ক্ষমা চাইলেই উনি মেনে নেবেন?’
করিমুল্লাহ মিটিমিটি হেসে বলেন, ‘আপনি দেখেন মেনে নেয় কি-না। ক্ষমা চাওয়ার নানান ধরন আছে। আপনি শুধু আসতে বলেন।’
মহসিন মাথা নাড়ে। এই লোক ভীষণ ধুরন্ধর। এ ঠিক ম্যানেজ করে নেবে। ইশ, ভেবেছিল এই কেস থেকে অনেকগুলো টাকা হাতিয়ে নেবে, তা বোধহয় হলো না। আবার একে খেপিয়েও কাজটা করা যাচ্ছে না। এর হাত অনেক লম্বা।
দিলশাদ সবেমাত্র নওরিনকে রাতের খাবার খাইয়েছেন। ঠিক তখন থানা থেকে ফোন আসে, আহনাফ গ্রেফতার হয়েছে। খবরটা শুনে চোখমুখ শক্ত হয়ে যায়। বারান্দায় এসে ওসি সাহেবের সাথে কথা বলেন। জাফরকে আপাতত কিছুই বলেনি। শুনলে ও হয়তো উলটো অসুস্থ হয়ে যাবে। বাসায় ফিরে আসার পর থেকে সারাক্ষণ মেয়ের পাশে পাশে। নওরিনও কেমন পালটে গেছে। যে মেয়ে এতদিন বাবার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকত সেই মেয়ে এখন বাবার পাশেই বসে থাকে। জাফর কিছু বলে না, শুধু মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
ওপাশ থেকে ওসি মহসিন যখন থানায় যেতে বলে তখন দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কেন, থানায় আসতে হবে কেন?’
মহসিন বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলে, ‘ম্যাডাম, এটা কেসের নিয়ম। আসামি গ্রেফতার হলে বাদীপক্ষকে সেটা সনাক্ত করে দিতে হয়।’
দিলশাদ একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘আমি আসছি।’
ঘন্টাখানেক পর দিলশাদ এসে পৌঁছে। করিমুল্লাহ উঠে দাঁড়ায়, সালাম দিয়ে বলে, ‘ভাবি, আমি করিমুল্লাহ, আহনাফের বাবা।’
দিলশাদ কড়া চোখে একবার তাকায়, তারপর ওসি সাহেবের দিকে ফিরে বলে, ‘আসামি কোথায়? চলুন আপনার সনাক্তকরণের কাজ শেষ করি।’
মহসিন তেলতেলে হাসি দিয়ে বলে, ‘ম্যাডাম, আপনি একটু বসুন। একটু কথা বলতে হবে।’
দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কিসের কথা আবার?’
এবার করিমুল্লাহ বিনয়ের সাথে বলে, ‘ভাবি, ছেলে মেয়ে দু’জন দু’জনকে ভালোবাসে। তারা ভুল করে ফেলছে। তাই বলে তাদের তো আমরা ফেলে দিতে পারি না। আহনাফকে আপনার নিজের ছেলে মনে করে ক্ষমা করে দেন। ওদের সামনে পুরো জীবনটা পড়ে আছে।’
দিলশাদ মুখ কঠিন করে বলে, ‘ক্ষমার প্রশ্ন আসছে কেন? আপনার ছেলে জোর করে কাজটা করেছে। আর সেটা রেপ কেস।’
করিমুল্লাহ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকেন, তারপর বলেন, ‘আপনার মেয়ে স্বেচ্ছায় আমার বাসায় এসেছিল। যা হয়েছে দু’জনের সম্মতিতেই।’
দিলশাদ চিৎকার করে বলে, ‘কী হয়েছে না হয়েছে আমি জানি না। আপনার ছেলের জন্য আমার মেয়ে মরতে বসেছিল। আপনার গুণধর ছেলে আমার মেয়েকে ওষুধ কিনে দিয়েছিল তার প্রমাণ আছে। তাই আদালত সিদ্ধান্ত নেবে আপনার ছেলে অপরাধী কি-না।’
করিমুল্লাহ লম্বা একটা নিশ্বাস নেন, তারপর নিচু গলায় বলেন, ‘আপনাদের একটা মার্সিডিজ গাড়ি ছিল না?’
দিলশাদ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে, তারপর কপাল কুঁচকে বলে, ‘হ্যাঁ, তো?’
করিমুল্লাহ নাক টেনে বলে, ‘ওটা আমরা কিনে নিয়েছিলাম। আমার তো গাড়ির ব্যবসা। অনেকেই বিপদে পড়ে গাড়ি বিক্রি করে। তাই বলছিলাম কী আপনার তো এখন বিপদ চলছে। শুধু শুধু কোর্ট-কাচারি করে এতগুলো টাকা নষ্ট করার কোন মানে নেই। তার চেয়ে আমি আপনাকে একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। নওরিন মামনি তো বিদেশে পড়তে যেতে চায়, আমি ওর পড়ার জন্য দশ লাখ টাকা দিচ্ছি। ওরা দুজনেই একসাথে পড়তে গেল।’
দিলশাদ চেয়ে থাকে। এই লোকটা ওকে কেসটা আপোষ করার জন্য প্রস্তাব দিচ্ছে। তাও একদম ঠান্ডা মাথায়। দিলশাদ কেটে কেটে বলে, ‘আপনার টাকায় আমার মেয়ে বিদেশে পড়তে যাবে না। আর আপনার ছেলে জেলেই থাকবে, সেও বিদেশে যেতে পারবে না।’
করিমুল্লাহ চোখ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। তারপর গম্ভীর মুখে বলেন, ‘আদালতে কেস উঠলে একটা সময় আমার ছেলের জামিন হবেই। কিন্তু আপনার মেয়ের নামে যে বদনাম জুটেছে সেটা কি ঘুচবে? আর আদালতে আমার উকিল যখন ধর্ষণের বর্ণনা শুনতে চাবে তখন সেটা আপনার মেয়ে নিতে পারবে তো? ভেবে দেখবেন। আর টাকাটা আমি দ্বিগুণ দেব। বিশ লাখ টাকা দেব, আপনি কেস উঠিয়ে নেন। আর তা না হলে আমি আমার পথে এগোব। আপনার কাছে যেমন কিছু প্রমাণ আছে তেমনি আমার কাছেও আছে। আপনার মেয়ে আমার ছেলের কাছ থেকে একশ ডলার নিয়েছে। আমি বলব আপনার মেয়ে টাকার বিনিময়ে এসব করে। তখন বুঝবেন কেস করার মজাটা।’
দিলশাদ শিউরে ওঠে। সামনে বসা লোকটাকে এখন বিষাক্ত সাপের মতো মনে হচ্ছে। যেকোনো সময় মরণ ছোবল দিতে পারে।
দিলশাদ গম্ভীর গলায় বলে, ‘সেটা পরে দেখা যাবে। ওসি সাহেব, আপনি কেসটা আদালতে তোলার ব্যবস্থা করুন। আমি এখন বাসায় যাব।’
করিমুল্লাহ উঠে দাঁড়ায়, ‘ঠিক আছে, বাসায় যেয়ে ভাবুন। আমার ফোন নম্বর আপনাকে দিয়ে রাখছি, ভেবে আমাকে জানাবেন।’
দিলশাদ করিমুল্লাহর দিকে একবার কঠিন চোখে তাকায়, তারপর বেরিয়ে পড়ে।
দিলশাদ চলে যেতেই ওসি মহসিন বলে, ‘স্যার, তাহলে কী করব এখন?’
করিমুল্লাহ কপাল কুঁচকে একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘হাতে তো এখনও দু’দিন সময় আছে, দেখা যাক কী হয়।’
সেদিন রাতে করিমুল্লাহ যখন বাসায় ফেরেন পোলাও মাংসের একটা সুঘ্রাণ পান। কিন্তু সেই ঘ্রাণটায় কেন জানি আজ মাথা ধরে যায়। সালেহা বার বার আকুল গলায় ছেলের কথা জানতে চান। সেদিন রাতে ওদের কারও খাওয়া হয় না।
এদিকে দিলশাদ বাসায় ফিরতেই জাফর জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘এত রাতে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?’
দিলশাদ গম্ভীর গলায় বলে, ‘কাজ ছিল। তুমি ঘুমাও। আমি আজ নওরিনের সাথে ঘুমোব।’
জাফর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। একটা সময় ও এমন গলায় কথা বলত। ব্যবসার কাজে প্রায়ই ফিরতে রাত হতো। তখন দিলশাদ জানতে চাইলে অতটা ভেঙে বলত না। দিন কেমন পাল্টে যায়, মানুষ অক্ষম হয়ে গেলে কেউ তাকে পাত্তা দেয় না। একটা হীনমন্যতা জাফরকে ঘিরে ধরে।
সেদিন সারারাত দিলশাদের ঘুম আসে না। করিমুল্লাহ লোকটা ভয়ংকর মানুষ। একটা আগুন ওর সব কেড়ে নিয়েছে। এখন এই আগুন না আবার ওর মেয়েকেও কেড়ে নেয়। এরা যদি নোংরামি করে ওর মেয়ের নামে ওই কুৎসিত কথাটা চালু করে দেয়? আর সাংবাদিকরাও যদি লিখে টাকার বিনিময়ে…’
কথাটা ভাবতেও পারে না দিলশাদ। এই কথা একবারও যদি নওরিনের কান পর্যন্ত পৌঁছায় ও বাঁচবে না। সাথে সাথে সুইসাইড করে ফেলবে। দিলশাদ বিছানা ছেড়ে উঠে বসে। কেমন বুক ধড়ফড় করছে। নাহ, এদের সাথে লড়াটা বোকামি। এরা ওর সব কেড়ে নেবে। এমনিতেই হাসপাতালে নওরিনের পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। গহনাগুলো বিক্রি করে নগদ টাকা যা পেয়েছিল তার প্রায় সবটুকুই শেষ। হাত একদম খালি। টাকার কথা মনে হতেই দিলশাদ একটু ভাবে। তারপর সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলে।
বাইরে ফজরের আজান দিচ্ছে। দিলশাদ করিমুল্লাহ সাহেবের ফোনে একটা মেসেজ পাঠায়। তারপর ওজু করে নামাজে দাঁড়ায়। এখন কেন যেন মনটা শান্ত লাগছে।
করিমুল্লাহর আজ ফজরের নামাজের ওয়াক্ত ছুটে গেছে। কোনোদিন এমন হয় না। রাতে ভালো ঘুম হয় নাই, তাই দেরি করে ঘুম ভাঙল। মন খারাপ নিয়ে ওজু করে কাজা নামাজে দাঁড়ান। নামাজ শেষে অনেকক্ষণ দোয়া করেন। তারপর কী মনে হতে মোবাইলটা হাতে নিতেই একটা মেসেজ দেখতে পান।
মেসেজটা খুলে পড়তেই মুখ উজ্জল হয়ে ওঠে। চিৎকার করে সালেহাকে ডাক দেন। সালেহা ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। বিহবল গলায় বলেন, ‘এই তুমি এমন পাগলের মতো চিৎকার করছ কেন?’
করিমুল্লাহ খুশি গলায় বলে, ‘কালকের বাসি পোলাও মাংস গরম করো। আমরা সবাই একসাথে খাব।’
সালেহা বুঝতে না পেরে বলে, ‘কী বললে? সেটা কী করে সম্ভব?’
করিমুল্লাহ রহস্যের গলায় বলে, তোমার এত কিছু বুঝতে হবে না। আমি বাইরে যাচ্ছি আহনাফকে নিয়ে আসতে। আর আমার চেক বইটা দাও তো।’
সালেহার কেমন সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগে। সত্যিই আহনাফ আজ বাড়ি ফিরে আসবে?
সেদিন আহনাফ ঠিকঠাক বাড়ি ফিরে আসে। বাবা মায়ের সাথে একসাথে বসে বাসি পোলাও মাংস খুব মজা করে খেতে থাকে।
আর দিলশাদ বিশ লাখ টাকার একটা চেক সন্তর্পণে নিজের ওয়ারড্রব এর ড্রয়ারে তালা দিয়ে লুকিয়ে রাখে। এই জীবনে এই চেকের কথা ও কাউকেই বলতে পারবে না। করিমুল্লাহর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছে যে উনি এই টকা লেনদেনের কথা যেন কাউকে না বলেন। নগদ টাকার ভীষণ দরকার ছিল। দিন দিন ওর মনে একটা ভয় ঢুকে যাচ্ছিল, জাফর বুঝি আর কোনদিন আগের মতো উঠে দাঁড়াতে পারবে না। ছেলে মেয়ে বড় হচ্ছে, সামনে অনেক খরচ। আর টাকা ছাড়া যে সেগুলো সবই অসম্ভব। তাই শেষ পর্যন্ত টাকার কাছে নতি স্বীকার করতে হলো। পৃথিবীতে মানুষ আসলে ভীষণ অসহায়। মানুষের ক্ষুধা পায়, অসুখ হয় – তার জন্য প্রতিটি মুহুর্তে অর্থের জোগান লাগে। বেঁচে থাকার জন্য কত কী-ই না করতে হয় মানুষকে।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর