#আলো_অন্ধকারে (পর্ব ১)
১.
ছাই রঙের মার্সিডিজ সেলুন কার থেকে এইমাত্র যে ব্যক্তিটি নামলেন তার বয়স আনুমানিক বাহান্ন বছর। না, আপনারা যেমন ভাবছেন তেমন না, দেখলে এখনও তরুণ মনে হয়। লম্বায় তা পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চি তো হবেনই। গায়ের রঙ গৌর, উন্নত নাক, বুদ্ধিদীপ্ত দু’টি চোখ। নিয়ম করে জিমে যান, পরিমিত খাবার খান, নামী পার্লারে এন্টি হেয়ার ফল ট্রিটমেন্টও নেন নিয়মিত। তাই মাথার চুল সেভাবে পড়েনি। হাতের ঘড়িটা যদি একটু কষ্ট করে দেখতে পান তাহলে দেখবেন সেটি রোলেক্স ব্র্যান্ডের দামি একটা ঘড়ি। পায়ে মার্জিত ক্লার্ক ব্র্যান্ডের নামী স্যূ। আর গায়ে ধূসর রঙের ব্লেজার। একটা পাশ যদি উল্টে দেখা যেত তাহলে দেখতে পেতেন সেটাও অরিজিনাল ‘CK’ ব্রান্ডের। হ্যাঁ, লোকটা সৌখিন। তা তিনি হতেই পারেন। একটা মাঝারি সাইজের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিক, তাতে করে বছর শেষে বেশ ভালো মুনাফা জমা হয় ব্যাংক একাউন্টে। ওহ, ওনার নামটা এখনও বলা হয়নি। সার্টিফিকেটের নাম, জাফর খান। রাজধানী ঢাকা শহরের একটা নামকরা বিপণি বিতানে উনি ঢুকছেন। গল্পটা এখান থেকেই শুরু হলো।
কাচের দরজা ঠেলে জাফর খান ভেতরে ঢুকতেই দোকানের চৌকস ছেলেটা এক গাল হেসে সালাম দেয়, ‘স্যার, এবার একটু দেরি করে এলেন।’
জাফর ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তাই নাকি? গত মাসেই তো এখান থেকে এই ব্লেজারটা নিয়ে গেলাম।’
কথাটা বলে গায়ে চাপানো ব্লেজারের দিকে ইংগিত করেন।
ছেলেটা হেসে বলে, ‘আপনি তো স্যার প্রতি সপ্তাহে একবার হলেও আমাদের দোকানে আসেন।’
তা কথাটা মিথ্যে না। শীতের সময় নতু নতুন ব্লেজার পরা একটা নেশার মতো। আর গতকালই ফ্যাক্টরি থেকে সেই সুখবরটা এসেছে। মাস ছয়েক আগে প্রায় পঞ্চাশ লাখ পিস পোলো শার্টের অর্ডার পেয়েছিল। সেটার সব কাজ শেষ। এই একটা অর্ডার ঠিকঠাক সাপ্লাই দিতে পারলে সারা বছর আর কোনো কাজ না করলেও হবে।
জাফর খান ক্রিম কালারের একটা গুড়ি চেকের ব্লেজার হাতে নিতেই দোকানি ছেলেটা প্রশংসার গলায় বলে, ‘স্যার একদম এক নম্বর জিনিসটাতেই হাত দিয়েছেন। আপনার জহুরির চোখ। গতকালই এটা থাইল্যান্ড থেকে এসেছে, ইতালির বিখ্যাত ব্রিওনি ব্র্যান্ডের। এটা কিন্তু কপি না অরিজিনাল।’
জাফর ভারিক্কি গলায় বলেন, ‘আমাকে তুমি শেখাবে? জানো তো আমার নিজের গার্মেন্টস আছে।’
ছেলেটা সলজ্জ হাসে।
জাফর এবার পরে একবার ট্রায়াল দেন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুই কাঁধের দিকে খেয়াল করে দেখেন ব্লেজারটা নেমে গেল কি-না। মুখে একটা সন্তুষ্টির ছাপ ফুটে ওঠে। তারপর ছেলেটাকে ইশারা করতেই ব্লেজারটা খুলে নিয়ে যত্নের সাথে একটা কাভারে ভরে দেয়।
বিল দিতে যেয়ে একবার তাকান, তারপর ক্রেডিট কার্ডটা বাড়িয়ে দিতেই দোকানি ছেলেটা মেশিনে পঁচিশ হাজার টাকার অংক টাইপ করে। জাফর খান সাধারণত দামাদামি করেন না। তাতে ওরা হয়তো এক দু’হাজার টাকা বেশিই রাখে। তা রাখুক, কিন্তু দামাদামি জিনিসটা একদমই পছন্দ না।
বিল মিটিয়ে বের হতে যেতেই থমকে দাঁড়ায়, প্রবীণ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী হালিমুজ্জামান সাহেবকে দেখা যাচ্ছে। সাদা পাঞ্জাবির উপর সোনালি বর্ডার দেওয়া কালো কাশ্মিরী শাল পরেছেন।
ওকে দেখে সহাস্যে হেসে এগিয়ে আসেন, ‘আরে জাফর, কী অবস্থা। কেমন চলছে সব?’
জাফর এগিয়ে গিয়ে সালাম দেয়, ‘এই তো বড়ো ভাই। আপনাদের দোয়ায় ভালোই চলছে সব।’
হালিমুজ্জামান মাথা নেড়ে বলে, ‘চললেই ভালো। থেমে যাওয়া যাবে না।’
জাফর বিনয়ের সাথে বলে, ‘আপনারা যে পথ করে দিয়ে গেছেন, আমরা তার ফল ভোগ করছি।’
হালিমুজ্জামান স্নেহের চোখে তাকান, তারপর নরম গলায় বলেন, ‘হ্যাঁ জাফর। সেই আশি একাশি সালের দিকে আমি একটা স্যূটকেসে কিছু কাপড়ের স্যাম্পল নিয়ে লন্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্টে নামি। বায়ারদের যখন বলি আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি তখন ওরা দেশটা চিনতেই পারত না। বলত এটা ইন্ডিয়ার কোথায়? মুম্বাইতে? সেসময় পকেটে করে ওয়ার্ল্ড ম্যাপ নিয়ে যেতাম। বিন্দুর মতো ছোট্ট দেশটা দেখিয়ে বলতাম এই যে, এটা ইন্ডিয়ার পাশেই আলাদা একটা দেশ। বায়াররা স্যাম্পল দেখতে চাইত না। কত কায়দা কানুন করে ওদের কাছ থেকে অল্প অল্প করে অর্ডার নিতাম। আজ এখন সেই শিল্পটা সারা পৃথিবীতে আমরাই নেতৃত্ব দিচ্ছি।’
এই গল্পটা ওর শোনা। যতবার দেখা হয় উনি গল্পটা বলেন। কখনোই বিরক্ত লাগেনি। এই মানুষগুলোর কাছে মনের গভীর থেকে একটা কৃতজ্ঞতা বোধ করেন জাফর খান।
কিছুক্ষণ গল্প করে বিদায় নিয়ে গাড়িতে ওঠেন। একবার হাতঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখতে পান রাত নয়টা প্রায় বাজে। এবার ফোন বের করে স্ত্রী দিলশাদ খানকে ফোন করতেই কেটে যায়। ভ্রু কুঁচকে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকেন জাফর খান।
২.
দিলশাদ খান আগ্রহের সাথে একটা ডায়মন্ডের আংটি দেখছিলেন। বডিটা গোল্ডের, উপরে ছোট্ট একটা হীরককুচি। আলো পড়তেই সেটা ঝিকমিক করে উঠছে। আংটিটা ফর্সা আঙুলে পরতেই সেটা যেন আরও আলো ছড়াতে লাগল। দিলশাদ আজ কটন তন্তুজ এর একটা দামি শাড়ি পরেছেন আর সেটা তার দুধে আলতা শরীরে বেশ ভালো মানিয়েছে। এই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেও শরীরের খাঁজগুলো বেশ আবেদনময়ী। দিলশাদ হাতের আঙুলগুলো সামনে মেলে ধরতেই দোকানি টাক মাথা মধ্যবয়স্ক লোকটা বিগলিত হাসি দিয়ে বলে, ‘ম্যাডাম, আপনার হাতে কিন্তু খুব মানিয়েছে আঙটিটা। এটার দাম তো কিন্তু আপা লাখের উপর পড়বে।’
দিলশাদ কপাল কুঁচকে তাকায়, তারপর ক্ষুণ্ণ গলায় বলে, ‘আপনাকে আমি দাম জিজ্ঞেস করেছি? আপনার দোকানে সিংগেল স্টোনের এর চেয়ে দামি হীরে থাকলে দেখাতে পারেন।’
দোকানি লোকটা দমে যায়, তোতলানো গলায় বলে, ‘সরি ম্যাডাম। আসলে অনেকেই সিংগেল স্টোনের হীরের আঙটি কিনতে আসেন। কিন্তু পরে দাম শুনে রেখে দেন। আপনাকে দেখে অবশ্য বোঝাই যায় আপনি বনেদি পরিবারের। আমি দেখাচ্ছি ম্যাডাম।’
লোকটা একবার নিচ থেকে কাঠের ভারী একটা বাক্স বের করে। তারপর ডালা মেলে ধরতেই হীরককুচির আলোয় ঝিকমিক করে ওঠে। দিলশাদ খান বেছে বেশ বড়ো একটা সিংগেল স্টোনের আংটি পছন্দ করেন। অবশ্য দোকানি লোকটা ঢোঁক গিলে ভাবে এই মহিলা আসলেই এটা কিনবেন তো? এটার দাম তো তিন লাখের কাছাকাছি।
লোকটার মনের ভাবনা যেন দিলশাদ পড়তে পারেন। ব্যাগ থেকে একটা শক্তিশালী ব্যাংকের দামি ক্রেডিট কার্ড বের করে বলেন, ‘দামটা রাখুন। আর একটু ভালো করে দেখে দেবেন, স্টোনটা ঠিকঠাক সেট করা আছে কি-না।’
ঠিক এই সময় জাফর খানের ফোন আসে। ধরতে যেয়ে তাড়াহুড়ায় কেটে যায়। থাক, দাম মিটিয়ে তারপর ফোন দেওয়া যাবে, ভাবেন দিলশাদ খান। দোকানি লোকটা বিল রেখে যত্নের সাথে হীরের আংটিটা হাতে দেয়। ভাবভঙ্গীতে এখন শ্রদ্ধার ভাবটা প্রবল।
তেলতেলে মুখে দোকানি বলে, ‘ম্যাডাম, ভালো হীরে এলে আপনাকে জানাব। আপনার মতো এক দু’জন মানুষ হলেই আমাদের আর ভাবতে হয় না।’
দিলশাদ খান স্মিত হাসি হাসেন। মনের ভেতর একটা ভালো লাগা টের পান। জীবনটা আসলেই সুন্দর।
গাড়িতে উঠে এবার জাফরকে ফোন দিতেই ওপাশ থেকে চিন্তিত গলা পাওয়া যায়, ‘এই, তুমি কোথায়?’
দিলশাদ জবাবদিহিতার গলায় বলে, ‘এই একটু ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডে এসেছিলাম। তুমি বাসায় পৌঁছে গেছ?’
জাফর একবার বাইরে তাকায়, তারপর বলে, ‘না, কেএফসি পার হচ্ছি। আর পাঁচ মিনিট লাগবে।’
দিলশাদ উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘তাহলে তুমি আগে পৌঁছুবে। নওরিন আর আরুশ বাসায়ই আছে। তুমি যেয়ে ফ্রেশ হও, একসাথেই খেতে বসব।’
ফোনটা ছেড়ে দিয়ে দিলশাদ প্রথমে মেয়েকে ফোন দেন, কেটে যায়। মেয়েটার ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা সামনে অথচ এখনও মোবাইল বিজি। তারমানে কারও সাথে কথা বলছে। ছেলেকে এবার ফোন দিতেই ধরে, ‘আম্মু, তুমি কখন আসবে?’
দিলশাদ আদুরে গলায় বলে, ‘এই তো চলে আসব। তোমার আব্বুও কাছাকাছি। আপু কী করে?’
আরুশ ষড়যন্ত্রকারীদের মতো বলে, ‘জানো আম্মু, আপু দরজা বন্ধ করে গেম খেলছে। একটুও পড়া করছে না।’
দিলশাদ ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘তুমি ভালো করে পড়ো। আমি আসছি একটু পরেই।’
ফোনটা রেখে একটু ভাবেন। ছেলেটা এবার স্ট্যান্ডার্ড সেভেন এ। চেষ্টা করে ভালো করতে, কিন্তু ঠিক পেরে উঠে না। নওরিনের মাথা ভালো কিন্তু মেয়েটা পড়তে চায় না। এই যে এখন দরজা আটকে কার সাথে যে কথা বলছে কে জানে?
৩.
খান প্যালেসের ভেতরের দিককার একটা বেডরুম বাইরে থেকে বন্ধ। ভেতরে নিচু গলায় একজন কিশোরী কিছুদিন পরেই যে তরুণী হবে তার কথা শোনা যাচ্ছে।
‘সুইটহার্ট তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে’, ভিডিও কলে ওপাশ থেকে আহনাফ আদুরে গলায় বলে।
নওরিন লাজুক গলায় বলে, ‘সত্যি? দেখো এই জামাটা বাবা থাইল্যান্ড থেকে নিয়ে এসেছে। সুন্দর না?’
আহনাফ দুষ্ট গলায় বলে, ‘অনেক সুন্দর। কিন্তু জামাটা না পরা থাকলে আরও সুন্দর লাগত।’
নওরিন চোখ পাকায়, ‘ইউ ব্যাড বয়!’
ওপাশ থেকে আহনাফ আবদারের গলায় বলে, ‘একটু দেখি না।’
নওরিন এবার আদুরে গলায় ধমক দেয়, ‘একদম চুপ। শোনো, তোমার প্রিপারেশন কেমন? আমি বাবার সাথে কথা বলে রেখেছি। এ লেভেল শেষ করে ইউএসএ চলে যাব। ওখানেই গ্রাজুয়েশন করব। তুমিও চলো, আমরা একসাথেই ভর্তি হব, একই ইউনিভার্সিটিতে।’
আহনাফ এবার সিরিয়াস গলায় বলে, ‘আমার তো যাবার খুব ইচ্ছে। মাম্মি চায় না। বোঝই তো, আমি একমাত্র ছেলে। কিন্তু আমি যাবই।’
নওরিন এবার আনন্দে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরার ভঙ্গি করে, ‘ইয়েএএএ! লাভ ইউ সো মাচ।’
ঠিক এই সময় দরজায় কেউ ধাক্কা দেয়। নওরিন দ্রুত বিদায় নিয়ে ভিডিও কলটা কেটে দেয়। তারপর জামাটা ঠিক করে দরজা খুলতেই দেখে ছোট ভাই আরুশ দাঁড়িয়ে আছে।
বিরক্তির গলায় বলে, ‘কী? দরজা ধাক্কাছিস কেন?’
আরুশ ফিসফিস করে বলে, ‘বাবা, এসেছে। তাড়াতাড়ি পড়তে বস আপু।’
এবার নওরিনের মধ্যে চঞ্চলতা দেখা যায়, ভাইয়ের গাল টেনে বলে, ‘থ্যাংকিউ ছোটকু।’
নওরিন দ্রুত নিজের টেবিলে বই নিয়ে পড়তে বসে। যদিও চোখে এখনও আহনাফের মুখটাই ভাসছে। কী দুষ্ট একটা ছেলে!
৪.
ডাইনিং টেবিলের এক পাশে জাফর খান, বাম পাশে দিলশাদ আর আরুশ, ডান পাশে নওরিন বসেছে। একজন সহকারী খাবার বেড়ে দিচ্ছে।
জাফর খেতে খেতে মেয়ের উদ্দেশে বলেন, ‘নওরিন মা, তোমার প্রিপারেশন কেমন?’
পাশ থেকে দিলশাদ টিপ্পনী কেটে বলেন, ‘ওর তো পড়াশোনায় মন নেই। আমি তখন ফোন দিলাম, ফোন বিজি পেলাম। সারাক্ষণ কী করিস ফোনে?’
নওরিন মুখ চোখা করে বলে, ‘আম্মু, আমি গ্রুপ স্টাডি করছিলাম। পরীক্ষা শেষে রেজাল্ট হলে মিলিয়ে দেখো। আমি ভালো করব।’
জাফর সস্নেহে মেয়ের দিকে তাকান, ‘হ্যাঁ, আমাদের নওরিন তো মেধাবী। ও নিশ্চয়ই ভালো করবে।’
আরুশ মন খারাপ গলায় বলে, ‘আর আমি?’
জাফর ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তুমিও ভালো। পরীক্ষা শেষ হলে আপুর কাছে পড়বে তুমি।’
নওরিন নিচু গলায় বলে, ‘বাবা, আমি ইউএসএ তে পড়তে যাব। ইচ্ছে আছে ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে পড়ার। ওখান থেকে গ্রাজুয়েশন করতে চাই। একটু বেশি টাকা লাগবে, কিন্তু ওখানেই পড়তে চাই।’
জাফর খানের হাত থেমে যায়। মেয়েটা অনেক আদরের প্রথম সন্তান। একটা আবেগ কাজ করে। তখন এত টাকা পয়সা ছিল না। মনে আছে মেয়েটা একটা লাল রঙের সাইকেলের বায়না করেছিল, কিনে দিতে পারেননি। আজ দু’হাতে টাকা কামাচ্ছেন, তাই মেয়ের কোনো চাওয়া অপূর্ণ রাখেন না। কিন্তু মেয়েটা দূরে চলে যাবে ভাবতেই বুকে টান পড়ে।
মেয়ের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলেন, ‘ইয়েল ইউনিভার্সিটি তো খুবই ভালো ইউনিভার্সিটি। ওখানে পড়ার সুযোগ পেলে অবশ্যই যাবি।’
দিলশাদ খান এবার জোর গলায় বলেন, ‘হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে। এই দেশে ও কোথায় পড়বে? ইউএসএ তেই ভালো। আর তুই টাকার কথা কেন ভাবছিস। কত লাগবে?’
নওরিন একটু হিসেব করে বলে, ‘অন্যান্য ইউনিভার্সিটির চেয়ে এখানটায় খরচ একটু বেশি। বছরে সব মিলিয়ে চৌষট্টি হাজার ডলার লাগবে। পুরো কোর্স শেষ করতে আড়াই লক্ষ ডলার। তবে এর মাঝে আমি ঠিক স্কলারশিপ ব্যবস্থা করে ফেলব। তাতে করে খরচটা কমে যাবে।’
জাফর খান মনে মনে ডলারের অংকটা টাকায় হিসেব করেন, আড়াই কোটিরও বেশি খরচ হবে। এই টাকার জন্য মেয়ে এত ভাবছে! নাহ, মেয়েটা ওর মতোই লক্ষ্মী হয়েছে।
জাফর মজার ভঙ্গিতে বলে, ‘তোর স্কলারশিপের টাকা আমাকে দিয়ে দিস। আর টাকা নিয়ে ভাবিস না। ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ পেলে আমি খুব খুশি হব মা।’
সেদিন খাওয়া শেষে ঘুমোতে যাবার আগে দিলশাদ খান মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে বলেন,
‘আজ একটা হীরের আঙটি কিনেছি। এই যে এটা।’
একটা ছোট চৌকো বক্স খুলে আংটিটা পরে হাতের আঙুল মেলে ধরেন।
আলো পড়ে হাতের আংটিটা ঝিকমিক করে ওঠে। জাফর প্রশংসার গলায় বলে, ‘বাহ, দারুণ হয়েছে তো।’
দিলশাদ খুশি গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, খুব সুন্দর। ঠিক এমন একটা আংটি খুঁজছিলাম। পেয়েও গেলাম। দামটা একটু বেশি, লাখ তিনেকের মতো।’
জাফর হাত নাড়েন, ‘আরে, তোমার পছন্দ হয়েছে নিয়েছ। আমিও আজ একটা ব্লেজার কিনেছি। গাড়িতেই আছে।’
দিলশাদ এবার চুলটা বাঁধতে বাঁধতে বলে, ‘নওরিন কী লক্ষ্মী মেয়ে হয়েছে দেখেছ? ওর পড়াশোনার ওই ক’টা টাকা নিয়ে ও কেমন দুশ্চিন্তা করছিল?’
জাফর তৃপ্তি নিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, মেয়েটা আমার মতো হয়েছে।’
দিলশাদ একবার ঘুরে তাকায়, ‘ভালো হলে তোমার মতো, তাই না?’
জাফর হা হা করে হাসেন। ঠিক এমন সময় ফোনটা বেজে উঠে। রাত বারোটা বাজে, ফ্যাক্টরির জিএম মহিবুরের ফোন।
ভ্রু কুঁচকে ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে আতংকিত গলা পাওয়া যায়, ‘স্যার, সর্বনাশ হয়ে গেছে। ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছে।।আমি ফায়ার সার্ভিসে খবর পাঠিয়েছি। আপনি একটু আসবেন?’
জাফরের হঠাৎ করেই মনে হয় কোথাও যেন ভূমিকম্প হয়েছে। বুকের বাম পাশে একটা ব্যথা অনুভব করেন। মাথাটা কেমন ভারী লাগছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কোনোমতে বলেন, ‘ওয়্যারহাউজের ওদিকে আগুন লাগেনি তো?’
আজ সকালেই খবর পেয়েছিলেন পুরো শিপমেন্টটা রেডি করে ওয়্যারহাউজে রেখে দেওয়া হয়েছে।
মহিবুর কান্নাজড়িত গলায় বলে, ‘স্যার, ওয়্যারহাউজেই আগুন লেগেছে। আপনি আসেন।’
জাফরের মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। মাথাটা কেমন দপদপ করছে। দিলশাদ খান ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘এই কী হয়েছে? কোনো খারাপ খবর?’
জাফর খান এবার হাউমাউ করে বলেন, ‘আমার সব শেষ হয়ে যাচ্ছে পুড়ে। আগুন লেগেছে ফ্যাক্টরিতে। অর্ডারের পুরো লটটাই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আমি যে নিঃস্ব হয়ে যাব দিলশাদ।’
হাহাকার করা গলায় প্রলাপ বকতে থাকেন জাফর খান। হঠাৎ করে টের পান মাথায় তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। জ্ঞান হারাবার আগে দিলশাদের হাতের আঙুলে পরা হীরের আঙটিটা থেকে আলোর ঝিকিমিকি চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে যায়।
(চলবে)
মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর