ছোট বেলায় বাবা বলতো স্কুলে যাওয়ার পথে তৃতীয় লিঙ্গের কারো সাথে দেখা হলে কোথাও লুকিয়ে থাকবা। যে রাস্তা দিয়ে তারা হাঁটবে তুমি তার বিপরীত রাস্তা দিয়ে যাবে। খুব ভয় লাগতো বাবার কথায় তখন। একা একা রাস্তা দিয়ে চলতে পারতাম না। স্কুল ছুটি হলে তাদের ভয়ে বন্ধুদের সাথে বাসায় আসতাম। বাবার মুখে শুনেছিলাম, তারা নাকি রাস্তার মানুষের থেকে জোর করে টাকা আদায় করে। এক ধরনের ছিন্তাই কারীদের মত। ভয়টা মনে গেঁথেই চলেছি কয়েক বছর।
আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। আমাদের গ্রামে হাঁট বসতো মঙ্গলবার হলে। বাবা কাঁচা সবজি কেনাকাটা করছে আর আমি ব্যাগ হাতে নিয়ে বাবার পেছন পেছন ঘুরি। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ব্যাগ টেনে ধরে বুঝতে পারলাম। তাকিয়ে দেখি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। দেখতে অভিকল মেয়ে। কানে গহনাগাঁটি পরা, পরনে সবুজ রঙের শাড়ী। শাড়ীর সাথে আবার মিল রেখে ব্লাউজ পরা। কিছু না বলেই আমি বাবার সাথে হেঁটে যাচ্ছি। বাবা সামনে থাকায় কিছু টের পায়নি। মুহূর্তেই আবার হাত টেনে বসে। একটু বিরক্ত হয়ে বললাম,
-এমন করছেন কেনো?
তৃতীয় লিঙ্গের সেই ব্যক্তিটা হেসে বললো,
-তোমাকে প্রায় কয়েক সপ্তাহ ধরেই দেখি উনার সাথে ব্যাগ হাতে নিয়ে ঘুরাঘুরি করতে! কে উনি?
তার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই আবার বাবার পেছন পেছন হাঁটি। তিনি আবার বললেন,
-বলো কে উনি? ভয় পাও আমাকে দেখে?
যে ব্যক্তি বলতে পারে ভয় পাও আমাকে দেখে, তাকে নিঃসন্দেহ ভাবে বিশ্বাস করা যায়। এদের প্রতি কয়েক বছর জমানো ভয়টা পরক্ষণেই উধাও হয়ে গেল। আমি বললাম,
-ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়। বাবা জানতে পারলে সমস্যা হবে।
তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিটা মুচকি হাসি দিয়ে বললো,
-বাবাকে সব সময় বন্ধুর মত ভাববে। ভয়ের ব্যাপার গুলো বাবার সাথে শেয়ার করবে।
খুব অবাক হলাম তার কথায়। তখন ধারণা ছিল এদের হয়তো কোনো পরিবার নেই। মা বাবা বলতে কেউ থাকে না। এদের জন্মটা যেন মাটি ফেঁটে বের হয়েছে খানিকটা এমন ভাবনা ছিল। কয়েক বছরের পোষা ভাবনাও ভুল ভাবনা ছিল।
বাবা সঙ্গে থাকায় কিছু বলার আর সাহস হয়ে ওঠেনি।
পাঁচ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে কোচিং করতে যেতে হতো করটিয়া শহরে। কোচিং শেষ করে সব বন্ধু-বান্ধবী মিলে হোটেলে বসে পিঁয়াজু খাচ্ছি। রাস্তার বিপরীত মুখি হয়ে বসাতে দোকানের সামনের অংশটা দেখা সম্ভব হচ্ছিল না। হঠাৎ এক বান্ধবী অন্য বন্ধুকে হেসে বললো,
-দেখ সাব্বির তোর গার্লফ্রেন্ড আসছে। কী সুন্দর চেহারা। তোর সাথে বেশ ভালো মানাবে।
ব্যাপারটা চমকে উঠার মত। আমি মনে মনে বললাম, সাব্বির তো ভালো ছেলে। কোনো মেয়ের পিছু টান নেই। ভাবনা নিয়েই পেছনে তাকালাম। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখি সেই তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তি। তার সাথে আরও বেশ কয়েকজন। ঘুরে তাকাতেই তিনি আমাকে দেখে দোকানের ভিতরে আসতে চায়ছে। দোকানী কয়েকবার বাঁধা দিলেও জোর করেই সে ভিতরে আসবে। পাঁচ মিনিটের মত দোকানীর সাথে চেঁচামেচি করেও ভিতরে আর আসতে পারলো না। আমাদের খাওয়া প্রায়-ই শেষ। টিস্যু পেপার দিয়ে হাত মুছে তাড়াতাড়ি বের হলাম। সাথে বন্ধু-বান্ধবীও বের হয়। সাব্বির বিল দিবে ঠিক ঐ মূহুর্তে লোকটা বললো,
-তোমাদের টাকা দিতে হবে না। আমি দিয়ে দিবো।
সাব্বির টাকা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা সবাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাই। বান্ধবী বললো,
-খেয়েছি আমরা, টাকা আপনি দিবেন কেনো?
-আমি দিলে ক্ষতি কী? তোমরা পড়াশোনা করো, তোমাদের কাছে হিসেব করা টাকা থাকে। পিঁয়াজুর টাকা অন্য কাজে লাগাতে পারবে।
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের কথা শুনছি। এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম লজ্জার ভয়ে। বন্ধু-বান্ধবীদের সামনে তৃতীয় ব্যক্তির সাথে কথা বলবো! ব্যাপারটা অন্য রকম লাগছিল। স্থির থাকতেও পারলাম না। বুঝতে পারি লোকটা আমার জন্য টাকা দিতে চাচ্ছে। মনে মনে বলতেছি, “আমার প্রতি উনার কিসের এত পিছু টান? আমার মত রাস্তায় আরও অনেক ছেলে আছে।” বন্ধুরা সবাই অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকানো। আমি বললাম,
-আপনি আমার জন্য পিঁয়াজুর টাকা দিলেন বুঝতে পারছি। কিন্তু এমনটা কেনো করলেন?
শুরুতে সাধারণ মানুষের মত কথা বললেও পরক্ষণেই আবার ওদের ভাষায় বললো,
-তোমাকে খুব ভালো লাগে।
ভালো লাগার কথা শোনেই ওরা সবাই খিলখিল করে হেসে আমাকে বললো,
– তোকে সে বিয়ে করবে, তুই উনার সাথে যা।
সবাই হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত থাকলেও লক্ষ করি তৃতীয় লিঙ্গ ব্যক্তিটার মুখ মুহূর্তেই ম্লান হয়ে গেল। সে ম্লান সুরে বললো,
-তোমরা না পড়ালেখা করো? তোমাদের ভিতর তো পরিষ্কার থাকার কথা।
তার কথায় সবাই চুপচাপ খুঁটির মত দাঁড়িয়ে রইলো। আমি বললাম,
-আমাকে ভালো কেনো? রাস্তায় আমার মত শত শত ছেলে আছে।
-তোমার মত আমারও একটা ছোট ভাই আছে। দেখতে তোমার মতই। সেও পড়ালেখা করে। তার সাথে দেখা হয়না কয়েকবছর, কথা হয়না, কোনো যোগাযোগই নেই।
-বাসায় গিয়ে দেখে আসবেন।
-সমাজ আমাদের মেনে নেয় না। তাই নির্দিষ্ট স্থানে আমাদের বাস করতে হয়।
আমিও তার কথায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সে আবার বললো,
-তুমি আমার ভাই হয়ে থাকবে? তোমার সমস্থ খরচ আমি দিবো।
হ্যাঁ/না কিছু বললাম না। নাম জিজ্ঞেস করলাম,বললো, ফারহানা। আবার বললাম,
-আপনার মা বাবার সাথেও কথা হয়না?
-উনারাও নিরুপায়, যখন নিজের ভালো-মন্দ বুঝতে শিখেছি তখন মা বাবা এসেই হিজরাদের কাছে দিয়ে যায়। আমি খুব কান্না করলাম, এখানে থাকবো না, থাকতে পারবো না, আমাকে বাড়িতে নিয়ে যাও বললেও লাভ হয়নি।
আমিও অনেক ভেবে চিন্তে নিজের সম্মান আর স্বার্থের জন্য ফারহানাকে সোজা না বলে দেই। এটা কোনো ভাবেই সম্ভব না। আপনি আমাকে ছোট ভাই হিসেবে মেনে নিলেন, নয়তো আমিই বোন হিসেবে মেনে নিলাম। কয়েকদিন পর সত্যটা সবাই জেনে যাবে। তখন আমার জন্য সমাজ ক্ষেপে ওঠবে। সমাজ থেকে আমাকে বিতারিত করবে। সমাজেও আমার ঠাই হবে না, মা বাবার সম্মান হানি হবে। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি পারবো না আপনার প্রস্তাব রাখতে।
ফারহানার সাথে সেই যে কথা বলে বাসায় আসলাম, আর কোনোদিন, কখনো কোথাও দেখা হয়নি। ওদের জীবনটা আমাদের থেকে অনেক ভিন্ন। ওরা চাইলেও মা বাবার সাথে দেখা করতে পারে না, পরিবারের ভালোবাসা কেমন সেটা বোঝার ক্ষমতা রাখে না। ওরা যতই খারাপ থাকুক, ফারহানাকে দেখে ওদের প্রতি আলাদা এক পিছু টান আমার।
|| জহিরুল ইসলাম