#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৪০ [অন্তিম পর্ব]
#Esrat_Ety
[১ম অংশ]
দুইশো আট নাম্বার কেবিনের বদ্ধ কামরায় একটা বেডে টানটান হয়ে শুয়ে আছে উর্বী। তার দু’চোখ বন্ধ। এটি মূলত হসপিটালের রেডিওলজি বিভাগের কামরা। যেখানে সবসময় দুজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার থাকেন। তবে আজ রাওনাফ নিজেই উর্বীর ইউএসজি করছে। সে বসে আছে আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যানারের সামনে,তার সামনে থাকা মনিটরে নিজের সন্তানের উপস্থিতি অবলোকন করে রাওনাফ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে।
এই ব্যাপারটা সে প্রচণ্ড উপভোগ করেছে নাবিল-শায়মী আর শর্মীর বেলাতে। শিমালার ইউএসজি সবসময় সে নিজেই করতো।হসপিটালে আল্ট্রসাউন্ডের কামরায় সবসময় ওয়াইফের সাথে হাজবেন্ডকে থাকতে দেওয়া হয় রাওনাফের নির্দেশে। রাওনাফ বিশ্বাস করে নয়মাস ধরে একটা নারীই শুধু একটু একটু করে মা হয়না বরং একজন পুরুষও একটু একটু করে বাবা হয়। তাই দুজনে মিলে উপভোগ করা উচিৎ সবকিছু।
হাতের ট্রান্সডিউসারটা উর্বীর তলপেটের উপরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সন্তানের সার্বিক অবস্থা নিশ্চিত করছে সে।
কামরায় তারা দুজন ব্যাতীত আর কেউ নেই। রাওনাফই টুক টাক কথা বলছে,উর্বীর থেকে কোনো জবাব আসেনা।
“লোয়ার এবডোমেন খিচিয়ে থেকো না, আমার অসুবিধে হচ্ছে। বি ইজি।”
মনিটরে দৃষ্টি রেখে রাওনাফ বলে।
উর্বী হাত পা ছড়িয়ে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। রাওনাফ হাত থেকে ট্রান্সডিউসার টা সরিয়ে রেখে বেবির ইমেজ প্রিন্ট করে নেয় উর্বীকে দেখাবে বলে। চোখ থেকে রিডিং চশমা খুলে ফেলে সে। তারপর উর্বীর দিকে তাকায়, দু চোখ বন্ধ মেয়েটার। কোর্টে অচেতন হওয়ার পরে সরাসরি এখানে নিয়ে আসা হয়েছে,জ্ঞান ফিরেছে ঘন্টাখানেক হয়ে গিয়েছে অথচ এখন অবধি একটি কথাও বলেনি। রাওনাফ খেয়াল করেছে,এমনিতে সবসময় ঠিকই থাকে তবে অতীত সম্পর্কিত বিষয়ের মুখোমুখি হতে গেলেই মেয়েটা ভয়াবহ মানসিক চাপে পরে যায়, তারপর জ্ঞান হারায়।
রাওনাফ উঠে দাঁড়ায়,টিস্যু পেপার দিয়ে উর্বীর তলপেটে লেগে থাকা লিকুইড মুছিয়ে দিয়ে উর্বীর পেটিকোটের ফিতে ঠিক করে লাগিয়ে শাড়ির কুঁচিগুলো কোমরে গুজে দেয়। উর্বী চোখ মেলে রাওনাফকে দেখে। রাওনাফের মুখভঙ্গি শান্ত, বরাবরের মতো।
রাওনাফ উর্বীর একটা হাত ধরে আরেকটা হাত মাথার নিচে রেখে বলে,”এখন উঠে বসো, সরাসরি উঠবে না। আগে কাত হও খানিকটা, তারপর ওঠো, ধীরে ধীরে।”
উর্বী উঠে বসে। রাওনাফ একগ্লাস পানি দেয় উর্বীর হাতে। উর্বী গ্লাসের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়,সরিয়ে নেয় হাত।
হাতের গ্লাসটা সরিয়ে রেখে রাওনাফ উর্বীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে উর্বীর থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে ধরে উর্বীর চোখে চোখ রাখে, তারপর একটা চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসে।
উর্বী তাকিয়ে আছে। রাওনাফ নিচুস্বরে বলে,”মাথার কোন পোকাটা কিলবিলিয়ে উঠলো? আমাকে বলো,সরিয়ে দিই।”
উর্বী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে,”আমার সাত বছরের মৃত্যুযন্ত্রণা একটা শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যা করা হলো। বেঈমান। ভালোবেসে আটকে রাখতে আরো অনেক উপায় আছে। সে বেছে নিলো প্রেয়সীকে কলুসিত করে তাকে বাধ্য করা থাকতে। সম্পর্কটাকে এতটাই সম্মান করতো যে প্রেয়সীর অসম্মান করতেও দু’বার ভাবেনি। তখন আমার বুক ফাটা আর্তনাদও তার কানে পৌঁছায়নি।”
রাওনাফ হাসে। উর্বী তার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। রাওনাফ হাসি থামিয়ে বলে,”হাসছি কেনো জানো? তুমি বরাবর একই রকম থেকে যাবে। তোমার কোনো উন্নতি হবে না। যতখানি দোষ না তোমার ছিলো তার থেকে বেশি লাঞ্ছিত হয়েছো তুমি নিজের দোষে। এই যে আজও নিজের জবাব গুলো ওর মুখের ওপর দিয়ে এলে না, জ্ঞান হারিয়ে ফেললে আর এখন আমার সামনে নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করছো যেখানে আমার কাছে কোনো জবাবদিহিতার কোনো প্রয়োজন নেই।”
_সত্যিই কোনো দোষ আমার ছিলো?
প্রশ্নটি করে উর্বী তাকিয়ে আছে রাওনাফের দিকে। রাওনাফ শুকনো হাসি হাসে, তারপর বলে ওঠে,”তা তো আমি জানি না। উর্বী জানে। ঘটনাগুলো উর্বীর সাথে ঘটেছে।”
উর্বী চেঁ’চি’য়ে বলতে থাকে,
_না ছিলো না, কোনো দোষ ছিলো না। আমি চেয়েছিলাম তাকে শোধরাতে, চেষ্টা করেছিলাম। তারপর যখন ব্যর্থ হলাম তখন হাতটা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
_তাহলে দোষ নেই।
ঠান্ডা গলায় বলে রাওনাফ। কিছুক্ষণ পরে আবারও বলে ওঠে,”এখন অস্বস্তি হলে চলো, ও এখনও পুলিশ কা’স্টডিতে আছে, জেলখানায় নেওয়ার আগে তোমার জবাব টা দিয়ে আসবে! সবসময় তো চুপ করেই থাকলে,আজ ওকে কিছু কথা শুনিয়ে দিয়ে আসবে চলো।”
উর্বী চুপ থাকে। রাওনাফ হাসতে থাকে। তারপর কিছুক্ষণ পর মুখটা শুকনো করে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”তোমাকে একজন মানুষ প্রশ্নবিদ্ধ করলো মাত্র। আর আমাকে রোজ,রোজ দুনিয়ার মানুষ প্রশ্নবিদ্ধ করে।”
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ বলতে থাকে,”মানুষের চোখে তোমার প্রতি আমার অনুভূতি আসাটাকে শিমালার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ভালোবাসাকে পানসে করে দিয়েছে। সেদিন বন্ধুদের মধ্যেও একজন মজার ছলে বলে ফেলেছে। এরকম টা আমি সবসময় ফেস করি উর্বী। করতে হয়। করতে হবে। তাই বলে কি শিমালার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ভালোবাসা ফিকে হয়ে যাবে? মানুষ তোমাকে বিচার করবে উর্বী। কিন্তু যেহেতু নিজের অনুভূতি নিজেকে বয়ে বেড়াতে হয় সেহেতু নিজের অনুভূতির বিচার তুমি নিজে করে যে ফলাফল টা পাবে,সেটা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে। তুমি নিজের অনুভূতি বিচার করে দেখেছো তুমি উচ্ছাসের এই অবস্থার জন্য দায়ী নও,তাহলে তুমি দায়ী নও। মানুষ তো তোমাকে কাঠগড়ায় তুলবেই উর্বী। আমি রোজ উঠি, চেনা পরিচিত মানুষের চোখে, আমার অবুঝ ছেলেটির চোখে। আর এমনিতেও মানুষ শিমালার স্থানে নিজেকে বসিয়ে আমাকে অযোগ্য বেঈমান স্বামী বলবে,আর উর্বীর স্থানে নিজেকে বসিয়ে আমাকে যোগ্য স্বামী বলবে। কিন্তু একটাবার কেউ রাওনাফের স্থানে নিজেকে বসিয়ে দেখবে না। তাই নিজের অনুভূতি নিয়ে জবাবদিহিতা আমি মানুষকে করতে বাধ্য নই। তুমিও বাধ্য নও মানুষের কাছে কৈফিয়ত দিতে।”
রাওনাফ থামে। উর্বী তাকিয়ে আছে মানুষটার দিকে তারপর বলে ওঠে,”রাওনাফের সম্পর্কে অনুভূতি কি জানাবো?”
রাওনাফ বলতে থাকে,”তুমি জানো!”
_নিজেকে কার স্থানে বসিয়ে দেখবো? শিমালার?
_বলো।
_শিমালা খুব ভাগ্যবতী।
_কেনো বলছো! আমি তো অবিচার করেছি তার প্রতি, মানুষের চোখে।
_অবিচার করেও যার কাছে প্রতিদিন আপনি জবাবদিহিতা করেন। নিজের অজান্তেই এক সমুদ্র অ’প’রা’ধ বোধ নিয়ে বাচ্চাগুলোর সামনে তাদের মাম্মার গল্প বলেন। এমন প্রতারক স্বামী কজন পায়? যার দীর্ঘশ্বাস নাম জপে তার,যার সাথে সে অবিচার করেছে।
রাওনাফ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে উর্বীর দিকে। কিছুসময় পরে বলে ওঠে,”আর উর্বীর যায়গায় বসিয়ে কি দেখলে?”
_উর্বী এই লোকটাকে ডি’জার্ভ করে না। একদমই করে না। এই অসম সম্পর্কটি আদতেই একটি অসম সম্পর্ক। শুধু অসম বয়সের নয়, অসম মানসিকতার। একজন শুদ্ধ পুরুষকে ভাগ্যক্রমে পেয়ে গিয়েছে একজন আত্মকেন্দ্রিক, লোভী, স্বার্থপর মেয়ে।
কথাগুলো বলতে বলতে টপটপ করে উর্বীর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরতে থাকে। রাওনাফ বলতে থাকে,”আর রাওনাফের স্থানে নিজেকে বসিয়ে কি দেখতে পাচ্ছো।”
উর্বী নিশ্চুপ কেঁদে যাচ্ছে। রাওনাফ বলে,”বলো।”
উর্বী রাওনাফের বুকে ঝাঁপিয়ে পরে রাওনাফের শার্ট খামচে ধরে থাকে চুপচাপ। খানিক বাদে আটকে আটকে বলে,”ধৃষ্টতা নেই আমার এই মানুষটার স্থানে নিজেকে বসিয়ে তার অনূভুতি ব্যাখ্যা করার। শুধু বলবো মাথায়,মনে, যায়গা না হলেও পায়ে একটু স্থান চাই এই মানুষটার। আমার মতো স্বার্থপর মেয়েকে আপনার মতো করে শাস্তি কেউ দিতে পারবে না শর্মীর পাপা।”
রাওনাফ ম্লান হাসে। উর্বী কাঁদছে। একটু পরপর কেঁপে কেঁপে উঠছে। একহাত উর্বীর মাথায় রেখে রাওনাফ একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। উর্বীর মাথাটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে বলতে থাকে,”স্বার্থপরতার শাস্তি পেতে চাও নিজের মনের মতো করে,আসলেই স্বার্থপর তুমি!”
****
মোট তিন হাজার আটশো সাইত্রিশ টাকা।
খুচরা টাকা গুলো পরপর তিনবার গুনেও অর্থের পরিমাণ বাড়ানো কিংবা কমানো গেলো না। মোট টাকা তিন হাজার আটশো সাইত্রিশ। শর্মীর অর্থায়ন। যা সে গত চার মাস ধরে,যবে থেকে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে সেদিন থেকে নিজের পকেট মানি থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে জমিয়েছে।
এই টাকা গুলো শর্মীর কাছে অনেক কিছু,কারন শর্মী একটা বিশাল পরিকল্পনা করেছে।
শায়মী হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকতেই শর্মী তার দিকে তাকিয়ে খিকখিক করে হেঁসে উঠে বলে,”তিন হাজার আটশো সাইত্রিশ টাকা।”
_হবে। আমার কাছেও পাঁচ হাজার আছে। আট হাজারেই হয়ে যাবে।
শর্মী তার চার ইঞ্চির মতো লম্বা চুল গুলোকে রাউন্ড হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে পেছনে ঠেলে রেখেছিলো। ব্যান্ড টাকে একটানে সরিয়ে মাথাটাকে এদিকে ওদিকে দুলিয়ে নিজের সিল্কি চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলে,”আপু আমরা ভিডিও গেমস সেট কিনি? সেদিন ঝুমুর খালামনির ছেলে প্রান্তর জন্য ওর বাবা একটা নিয়ে এসেছে দেখলাম, লেটেস্ট একেবারে।”
শায়মী মুখে চ কারন্ত শব্দ করে বলে,”তোর মাথায় সবসময় গোবরই থাকবে মাথামোটা। বেবি কি জন্মেই ভিডিও গেমস দিয়ে খেলবে? কি খাস রে তুই!”
শর্মী লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,”তাও ঠিক! তবে আমরা দেবো টা কি! দাদু গোল্ড দেবে, চাচ্চু চাচীরা গোল্ড দেবে,ফুপিরা গোল্ড দেবে। আমরা কি দেবো? গোল্ড তো দেবো না।”
_তুই আমার কাছে টাকাটা দে। আমরা কি দেবো সেটা পরে দেখতে পাবি।
এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে নাবিল ওদের ঘরে ঢোকে। তাড়াহুড়ো করে শায়মীকে বলে,”আন্ডাবাচ্চা গুলো চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে মাথা ধরিয়ে ফেলেছে। আমার হেডফোন খুজে পাচ্ছি না কোথাও,তোরটা দে।”
শায়মী মাথা নেড়ে তার হেডফোন খুঁজতে থাকে। শর্মী টাকাগুলো নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। শর্মীর হাতে টাকাগুলো দেখে নাবিল বলে,”এসব কি!”
_আমার।
_দেখে তো মনে হচ্ছে ভিক্ষে করেছিস। সব খুচরা নোট।
কথাটা বলে নাবিল হেসে দেয়।
শর্মী তেতে উঠে বলে,”জমানো টাকা।”
_বুঝতে পেরেছি। চেচাচ্ছিস কেনো! অভদ্র হয়েছিস! এসব তোদের নতুন মায়ের শিক্ষা?
শর্মী কপাল কুঁ’চ’কে দাঁড়িয়ে থাকে। বিরক্তিকর একটা ছেলে,একবার নতুন ভাই পৃথিবীতে আসুক। শর্মী পাত্তাই দেবে না এই ভাইটাকে।
নাবিল বলতে থাকে,”কি করবি এতো টাকা দিয়ে? চল পিৎজা অর্ডার করি।”
নাবিল টাকা গুলো মজার ছলে ছিনিয়ে নিতে যায়। শর্মী দুকদম পিছিয়ে গিয়ে বলে,”নতুন ভাইয়ের জন্য গিফট কিনবো।”
নাবিল থেমে যায়। শর্মীর মুখের দিকে তাকায়। তারপর কপাল কুঁ’চ’কে বলে ওঠে,”যত্তসব।”
“নাবিল বিহেভ ইওরসেল্ফ!”
শায়মী ধ’ম’কে ওঠে। নাবিল বলে ওঠে,”এসব আদিখ্যেতা আমার ভালো লাগে না।”
শর্মী বলে ওঠে,”ভাইকে তুমি আদর করবে না?”
নাবিল শর্মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”কোন দুঃখে?”
_আমাদের ভাই! তাই!
_আমার কেউ না। ও পাপা আর তার বৌয়ের বেবি। আমার কেউ না! বুঝেছিস তোরা! আমার কেউ না কেউ না কেউ না। তোরা যা ইচ্ছা কর। আমাকে টানবি না এসবে!
_তো জানতে চাস কেনো আগ বাড়িয়ে,ফালতু ছেলে।
চেঁ’চি’য়ে ওঠে শায়মী। শর্মী আহত গলায় নাবিলকে বলে,”তুমি সত্যিই আদর করবে না ভাইকে!”
_জীবনেও না, কখনোও না। যত্তসব!
কথাটা বলে নাবিল শায়মীর হাত থেকে থাবা মেরে হেডফোন টা নিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
শর্মী আর শায়মী একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে মুখ শুকনো করে।
আজ তারিখ কত! পাঁচ না ছয়! এমন হচ্ছে গত তিন মাস থেকে। কিছু মনে রাখতে পারছে না উর্বী। যত সময় ঘনিয়ে আসছে ততই তার হুঁশ জ্ঞান হারাচ্ছে সে। সময়ের তাল খুজে পায়না,আজ কি বার মনে করতে পারে না। শুধু বিছানায় শুয়ে হাঁসফাঁস করতে থাকে। বেশিরভাগ সময় কাটে তার খোলা বারান্দায়।
হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর থেকে ছোটো নকশি কাঁথাটা তুলে নেয় সে। এটা সে অর্ধেকটা সম্পূর্ণ করেছে, তারপর অলসতার জন্য করেনি। দু তিন দিন ধরে পরে আছে টেবিলের ওপর। অবশ্য রাওনাফ এসব দেখলে খুব রেগে যায়। তাই রাওনাফ বাড়িতে থাকাকালীন সময়টাতে উর্বী হাত লাগায়না এসবে।
বাড়ি থেকে তহুরা অসংখ্য নকশিকাঁথা সিলিয়ে পাঠিয়েছে। উর্বী হাত বাড়িয়ে ফোনটা তুলে নেয়। ও বাড়ির লোক গুলোর সাথে উর্বীর কথা হয়না অনেকদিন হয়ে গিয়েছে। তাই উর্বী ফোন লাগায় রেজাউলের কাছে। ওপাশ থেকে রেজাউল ফোনটা রিসিভ করেই বলে ওঠে,”ভুল করে ফোন দিলি!”
উর্বী হাসে,মুখে বলে,”হ্যা।”
রেজাউল বলতে থাকে,”মা খুব দেখতে চাইছে তোকে।”
_তো নিয়ে আসো। কেনো আসছো না এখনও তোমরা!
_মায়ের ইচ্ছে একেবারে নাতী নাতনির মুখ দেখবে গিয়ে। আর এদিকেও অনেক কাজ আছে। তোর শশুর বাড়ির জন্য এটা সেটা কত কিছু প্রস্তুত করছে নিয়ে যাবে বলে। নাতী নাতনির জন্য তার জমানো টাকা দিয়ে একটা আংটি গড়েছে।
_উনি রাগ করবে ভাইয়া শুনলে। ওসবের প্রয়োজন নেই।
_আছে। মা প্রথমবারের মতো নানী হচ্ছে। তার আনন্দটুকু বোঝ!
উর্বী হাসে। তহুরা রেজাউল কবিরের হাত থেকে ফোন নিয়ে অনেকটা দূরে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”কোনো অসুবিধে বুঝিস?”
_না ভাবী। ঠিকঠাক সব।
_শোন। আমরা দুদিন আগেই চলে আসবো সবাই। উপমাও যাবে। তুই ঘাবড়াস না! অসুবিধা ঠেকলে রাওনাফ ভাইকে জানাবি। পারিস তো মুখে তালা লাগিয়ে বসে থাকিস।
_ওনাকে কিছু জানাতে হয়না ভাবী। উনি আমার জানার আগেই সব কিছু জেনে যায়।
ফোনের ওপাশে থাকা তহুরা দেখলো না কথাটা বলতে গিয়ে উর্বীর চোখেমুখে কতরাজ্যের লজ্জা এসে ভীড় করেছে।
তহুরা জবাব দেয়,”হু। ডাক্তার স্বামী পেয়েছিস। আর এদিকে তোর ভাইকে দেখ। যদি বলি শুনছো,আমার শরীরটা কেমন করছে। বলে একটা নাপা খেয়ে নাও।”
উর্বী হাসে ভাবীর কথায়। হাসে তহুরাও। কথায় কথায় আটত্রিশ মিনিট কাটিয়ে ফোনটা কেটে দেয় উর্বী। ফোনের স্ক্রিনে আজকের তারিখ টা দেখে। আজ মার্চের সাত তারিখ। উর্বীর ভেলিভারির তারিখ ইউএসজির রিপোর্ট অনুযায়ী সতেরো তারিখ। এখনও হাতে দশদিন বাকি।
ফোনটা রেখে উর্বী ধীরে ধীরে নিজের পেটে হাতটা রেখে আয়নার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে নিজেকে। এতগুলো মাসে উর্বীর শারীরিক গঠন এবং চেহারার সাথে সাথে অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। রাওনাফের তার প্রতি যত্নের পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণ, শর্মী শায়মীর আন্তরিকতা বেড়েছে বহুগুণ। যেটা কখনও বদলায়নি সেটা হচ্ছে নাবিল উর্বীর সম্পর্ক। না উন্নতি ঘটেছে,না অবনতি।
উর্বী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দোতলার লিভিং রুমে আজমেরী আর রুমার বাচ্চারা হৈচৈ করে ক্যারাম খেলছে। গোটা রওশান মঞ্জিল গমগম করছে। চট্টগ্রাম থেকে মোহনা শাফিউল এসেছে, অন্তরা সামিউল এসেছে। মোহনার ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে এ বাড়ির সবাই নিমন্ত্রিত। তাই আজমেরী,রুমাও যার যার শশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছে।
উর্বী আয়নার সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়। আজ রাওনাফের লাঞ্চের আগেই বাড়িতে ফেরার কথা। এখনও ফেরেনি। দিন দিন লোকটা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। অবশ্য তাতে পরিবারকে সময় দেওয়ায় খুব একটা ব্যাঘাত ঘটে না।
উর্বী একটা সুতি কাপড়ের ম্যাটার্নিটি পোষাক পরে আছে। ঘর থেকে বেরোনোর আগে সে ও’ড়না দিয়ে পেটটাকে ভালো করে ঢেকে নেয়,এভাবে বাড়ি ভর্তি মানুষ,ননদদের স্বামীরা,দুজন দেবর, এদের সামনে হেঁটে বেড়াতে ভীষণ লজ্জা লাগে তার। তাই সে সকাল থেকে ঘর থেকে বেরোয় নি। কিন্তু এভাবে কতক্ষন ঘরে থাকা যায়! সবাই কিচেনে কত মজা করছে , হাসাহাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। সন্ধ্যায় বাড়িতে মেহমান আসবে মোহনাদের বাড়ি থেকে,সবাই কাল মোহনার বাপের বাড়িতে যাবে বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে,তাই সব পরিকল্পনা করে নিচ্ছে।
ওড়নাটা মাথায় টেনে উর্বী ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য দরজার দিকে যায়। উর্বী আর রাওনাফ দোতলা থেকে নিচতলায় নাবিলের ঘরের পাশের ঘরটিতে শিফট করেছে আরো তিন মাস আগে। এই অবস্থায় উর্বীর সিড়ি ভাঙা সেফ না তাই।
দরজার বাইরে পা রাখার আগেই রাওনাফ হুট করে ঘরে ঢুকে পরায় উর্বীর সাথে ধাক্কা লেগে যায় তার। মুহুর্তেই শক্ত হাতে উর্বীকে আগলে নেয় রাওনাফ। উর্বী হাপাচ্ছে। কিছুটা ভয় পেয়েছে সে। রাওনাফ উর্বীকে দাড় করিয়ে বলতে থাকে,”দৌড়াচ্ছো কেন?”
_দৌড়াচ্ছিলাম না তো।
কথাটা বলে উর্বী রাওনাফের ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকায়। মার্চের গরমেই ঘেমে নেয়ে একাকার! রাওনাফ বরাবর ছিলো মেদহীন একজন পুরুষ,এই কমাসে স্বাস্থ্য যেন আগের থেকেও কিছুটা কমেছে। চেহারায় খানিকটা মধ্যবয়সী ছাপ তো আছেই কিন্তু বডি দেখে কখনোই রাওনাফের বয়স আন্দাজ করা যাবে না। যেসব পুরুষ খুব আরামে থাকে, চল্লিশের পরে তাদের মুটিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে ডক্টর খানের জীবনে আরাম বলতে তো কিছুই নেই,শুধুই ছোটাছুটি, পরিশ্রম। তার ওপর উর্বী নামের আস্ত একটা ঝামেলা কাঁধে তার! তাই সে ফিট।
রাওনাফ বলতে থাকে,”এক্ষুনি পরে যেতে!”
উর্বী বলে,”আমি ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত নিয়ে আসছি। দুপুরে যা গরম পরতে শুরু করেছে। আপনি ফ্রেশ হোন।”
উর্বী ঘর থেকে বেরোতে গেলে রাওনাফ তার হাত টেনে ধরে। উর্বী রাওনাফের দিকে তাকায়। রাওনাফ টেনে উর্বীকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলে,”প্রয়োজন নেই। আপনাকে অসংখ্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”
উর্বী হাসে। রাওনাফ উর্বীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,”তোমাকে এখন আর হাসের ছানা লাগছে না।”
_কি লাগছে তবে।
_বলবো না,রেগে যাবে।
_আপনাকে কেমন লাগছে বলবো?
_বুড়ো লাগছে! আই নো!
উর্বী হাসে,হেসে মাথা নেড়ে বলে,”হ্যান্ডসাম লাগছে। হ্যান্ডসাম পাপা অব থ্রি চাইল্ড!”
_ফোর…ফোর চাইল্ড!
উর্বীকে শুধরে দেয় রাওনাফ। রাওনাফের কথায় উর্বী মাথা নিচু করে মুচকি হাসে।
রাওনাফ টাইয়ের নট খুলতে গেলে উর্বী উঠে নিজে খুলতে থাকে। সে তাকিয়ে আছে উর্বীর দিকে। বলে,”মেয়েরা তাদের ভাইদের জন্য একটা টয় সেট অর্ডার করেছে। তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চাচ্ছে। ওরা যখন জানবে ওদের ভাই না,বোন আসবে তখন ওরাই সারপ্রাইজড হয়ে যাবে। আমাদের উচিত ওদের সাথে শেয়ার করা।”
উর্বী মাথা নেড়ে বলে,”না। বলবো না। দেখি দুটোতে কি করে!”
রাওনাফ হাসছে। হাসতে হাসতে বলে,”তোমার স্বভাব থেকে বাচ্চামো গেলো না।”
উর্বী বলে,”আপনার স্বভাবে এতো লাই মিশে আছে তাই!”
ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে রাওনাফ বলে,”আমি তিনদিন হসপিটালে যাচ্ছি না।”
_ওমা কেনো!
_মোহনার বাপের বাড়ি থেকে এতো করে বললো। সবার যাওয়া উচিত। আমি ভাবছি আমি থেকে যাবো বাড়িতে, তোমার কাছে। সবার আনন্দ কেন নষ্ট করবো!
_আর আপনার আনন্দ?
প্রশ্নটা করে উর্বী তাকিয়ে থাকে রাওনাফের দিকে,কয়েক মুহূর্ত পরে আবারও বলে,”আপনার আনন্দ?”
রাওনাফ ম্লান হাসে। একটা হাত বাড়িয়ে উর্বীকে বলে,”এদিকে এসো।”
উর্বী দরজা চাপিয়ে দিয়ে রাওনাফের কাছে এগিয়ে যায়। রাওনাফ আদুরে হাতে উর্বীকে আগলে নিয়ে তার একটা হাত উর্বীর পেটের ওপর রেখে বলে,”আমার আনন্দ এখানে।”
****
লিভিং রুমে সবাই আড্ডা দিচ্ছে। মোহনার বাপের বাড়ি থেকে তার মা এবং বড় বোন এসেছে সবাইকে নিয়ে যেতে।
উর্বী তার ঘরে শুয়ে আছে। শরীরটা খুব একটা ঠিক নেই। খানিকটা অস্বস্তি লাগছে।
লিভিং রুমে রওশান আরার সাথে মোহনার মায়ের তর্কাতর্কি চলছে। রওশান আরার কথা,তার বড় বৌয়ের এই অবস্থাতে সে কিছুতেই যাবেনা কোথাও। বাকিরা গেলে যাক।
মোহনার মা আর বোন আপত্তি জানিয়েছে ।শুধু তাই নয় তারা চায় উর্বীকেও সাথে করে নিয়ে যেতে।
রওশান আরা চোখ কপালে তুলে বলে,”খেপেছেন বেয়ান? বৌমার এই অবস্থায় ও যাবে বিয়ে খেতে? অসম্ভব।”
মোহনার মা আফসানা বেগম একপর্যায়ে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে দেয়। রওশান আরা চিন্তায় পরে যায়।
রাওনাফ বলে,”মা তোমরা যাও না। উর্বী থাকুক। আর আমি তো আছিই। আমীরুন আছে। তোমরা না গেলে সাদিফ কষ্ট পাবে। আমাকে কিছুক্ষণ আগেও ফোন করেছিলো। দুটো দিনেরই তো ব্যাপার। খালাম্মা কষ্ট পাচ্ছেন।”
উর্বী ঘর থেকে বের হয়ে গুটি গুটি পায়ে লিভিং রুমে আসে। তার এভাবে আসতে ভীষণ লজ্জা লাগছে। তার পরনে একটি সুতি কাপড়ের ম্যাক্সি। ওরনা দিয়ে পেট ঢেকে রেখেছে।
আফসানা বেগম দেখে বলে,”ওই যে এলো বড় বৌ। আহারে! কি চাদপানা মুখটা একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। থাক ওকে আর কষ্ট দেবো না। একেবারে নাতী সহ বৌকে নিয়ে যাবো আমার বাড়িতে একদিন।”
রওশান আরা সাথে সাথে বলে,”আমিও থাকি বেয়ান। প্লিজ মনে কিছু নেবেন না। কখন কি হয়ে যায়, দুশ্চিন্তা হয়তো খুব।”
নাবিল এতক্ষন বসে ছিলো। উর্বীকে দেখে সে উঠে দাঁড়ায়। তারপর পাপার দিকে তাকায়। রাওনাফের মুখ হাসি হাসি। তাকে ভীষণ খুশি লাগছে। খুশি তো হবেই। তার আদরের বাচ্চা আসতে চলেছে। যাকে পেয়ে পাপা নাবিলকে ভুলে যাবে।
আফসানা বেগম নাবিলকে বলে,”কি দাদু ভাই। তুই দাড়িয়ে গেছিস কেনো। বস।”
_না, তোমরা গল্প করো দাদু। আর হ্যা, সাদিফ মামাকে বলে দিও তার বিয়েতে না যেতে পেরে দুঃখিত আমি। আসলে এই ডিবেট কম্পিটিশন টা আমার কাছে খুব ইম্পরট্যান্ট। মামাকে বুঝিয়ে বলো।
নাবিল চলে যায়।
আফসানা রওশান আরার দিকে তাকিয়ে বলে,”ব্যাস হয়ে গেলো। কি আর করা, এখন আপনি আর বাড়ির সবাই সব গুছিয়ে নিন। বেশি না,মাত্র দু’দিন কষ্ট দেবো সবাইকে।
রওশান আরা চিন্তিত ভঙ্গিতে উর্বীর দিকে তাকায়। তার মন একটুও সায় দিচ্ছে না।
****
বাড়ির সবাই সকাল সকাল ঝুম বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে পরেছে। দশ তারিখে একটা বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাই আবহাওয়া বৈরী কিছুটা। বাড়িতে আছে শুধু উর্বী, রাওনাফ, নাবিল এবং আমীরুন।
নাবিল নিজের ঘরে বসে পড়ছে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি পরছে, রাজধানীতে শুধু বৃষ্টিপাত হলেও দক্ষিনাঞ্চলের অবস্থা ভয়াবহ।
সন্ধ্যা পেরিয়ে প্রায় রাত হয়ে এসেছে।
রাওনাফ আর উর্বী তাদের ঘরে। উর্বীকে জরিয়ে ধরে রাওনাফ শুয়ে আছে।
উর্বী হাপাচ্ছে। রাওনাফ বলে,”কি হয়েছে? কষ্ট হচ্ছে?”
উর্বী মাথা নাড়ায়। সে রাওনাফের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে বসতে চায়।
রাওনাফ টেনে ধরে,”কোথায় যাচ্ছো।?”
_আপনাকে কিছু একটা বানিয়ে দেই। বৃষ্টি পরছে বাইরে। নাবিলকেও দেই।
রাওনাফ উর্বীকে জোর করে শুইয়ে দেয়, ধ’ম’কে বলে ওঠে,”বাড়াবাড়ি টা কম করলে হয়না?”
উর্বী উদাস ভঙ্গিতে তাকায়।
রাওনাফ উর্বীর কপালে চু’মু খেয়ে বলে,”আজ মনটা একটু খারাপ মনে হচ্ছে! কি হয়েছে?”
উর্বী মাথা নাড়ায়। কিছুই হয়নি তার। শুধু বৃষ্টি দেখলে তার ভালো লাগে না। বৃষ্টি তাকে সেদিনের কথা মনে করিয়ে দেয়।
রাওনাফ বলে,”আমার শাশুড়িকে ফোন করে আসতে বলেছি। দিন দুয়েকের মধ্যেই চলে আসবে। এখন ও মন খারাপ?
উর্বী মাথা নাড়ায়। মাথাটা রাওনাফের বুকে রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই মানুষটা তার জীবনে না এলে সে কি করতো! আদৌও কি এতদিন বেঁচে থাকতো! সেটাই ভাবছে সে।
রাওনাফ আর কোনো প্রশ্ন করার আগে তার ফোন বেজে ওঠে। সে বুক থেকে উর্বীর মাথাটা আলতো করে ধরে সরিয়ে দিয়ে উঠে ফোনটা রিসিভ করে।
কিছুক্ষণ পরে সে উঁচু গলায় ফোনে বলতে থাকে,”মানে টা কি? আমি তো আমার এস্কেজিউল ক্যানসেল করেছি আগে ভাগেই। আমার পক্ষে এখন সম্ভব না।”
ওপাশ থেকে লামিয়া বলছে,”বুঝতে পেরেছি রাওনাফ। তবে রোগীর অবস্থা খুব খারাপ। তারা এসে আমার হাতে পায়ে ধরছে। বড্ড মায়া লাগছে। তুমি ছাড়া এত বড় রিস্ক আমি নিতে পারবো না রাওনাফ। রোগীর পরিবার তোমার ভরসাতে আছে। প্লিজ রাওনাফ, বোঝার চেষ্টা করো।”
রাওনাফ ফোন কানে চেপে ধরেই উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী এদিকেই তাকিয়ে আছে।
ফোনের ওপাশ থেকে লামিয়া বলতে থাকে,”রাওনাফ একটু বোঝো! প্লিজ।”
_ঠিক আছে আমি জানাচ্ছি তোমাকে।
শুকনো গলায় জবাব দেয় রাওনাফ।
তারপর ফোন টা রেখে দিয়ে উর্বীকে ডাকে,”উর্বী!”
_জি। কি হয়েছে? কার ফোন ছিলো।
উর্বী পেটে হাত চেপে ধীরে ধীরে উঠে বসে।
রাওনাফ চিন্তিত ভঙ্গিতে তার পাশে গিয়ে বসে, উর্বী একটু ঝামেলায় পরে গেছি। আজ একটা পেশেন্টের ওপেন হার্ট সার্জারির কথা ছিলো। ক্রি’টিক্যাল কনডিশন। আজ অপারেশন টা না হলে হয়তো একটা অঘটন ঘটে যাবে। এটা ডক্টর মাহমুদের কেস ছিলো। ওর শাশুড়ি হঠাৎ মা’রা গিয়েছেন। এই মুহূর্তে পেশেন্টকে অন্য হসপিটালে শিফট করলে সেটা রিস্কি!
_সেকি কথা। আপনি যান এখনই।
রাওনাফ শুকনো গলায় বলে,”তোমার এই অবস্থায়!”
উর্বী রাগ দেখিয়ে বলে,”মানে টা কি! আজব লোক তো আপনি! মাত্র কিছু ঘন্টার ব্যাপার। আর এখনও হাতে ঢের সময়। আপনি এখনই এতো টেনশন শুরু করে দিয়েছেন। আরে আমি ঠিক আছি। এইযে দেখুন, একেবারে ঠিক।”
উর্বী উঠে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে রাওনাফকে তার সুস্থতা দেখায়।
রাওনাফ ই’তস্তত করে।
উর্বী বলে,”রোগীর জীবনটা বেঁচে গেলে আল্লাহ খুশি হবেন আর সেটাতে আমাদের সন্তানদের ভালো হবে। আপনি যান। আমীরুন আছে না? ওকে ডেকে আমার রুমে পাঠিয়ে দিয়ে যান। আমি এখানেই শুয়ে থাকবো আপনি না আসা পর্যন্ত। একটুও নড়বো না,লাফাবো না,কথা দিচ্ছি।”
রাওনাফ বসে থাকে। উর্বী রাওনাফকে ঠেলতে ঠেলতে বলে,”যান বলছি!”
রাওনাফ একরাশ অনিহা নিয়ে,চিন্তিত ভঙ্গিতে রেডি হয়ে চলে যায়।
যাওয়ার সময় আমীরুনকে আলাদা ডেকে নিয়ে বলে,”সারাদিন উল্টো পাল্টা কিসব ভাবে আর দুশ্চিন্তা করে। একটু চোখে চোখে রাখিস।”
আমীরুন বলে ,”আপনে একটুও চিন্তা করবেন না ভাইজান। আমি ভাবীর কাছ থেকে নরুমই না।”
চলমান…..
#আরেকটি_বার
#পর্বসংখ্যা_৪০ (অন্তিম_পর্ব)
#Esrat_Ety
[২য় অংশ]
রাওনাফ চলে যাওয়ার পরে উর্বীর মনটা আবারো খারাপ হয়ে যায়। কোনো এক অজানা কারনে সে ছটফট করছে। এই বৃষ্টি তার ভালো লাগছে না। বৃষ্টি কেনো থামছে না!
আমীরুন উর্বীর ঘরে আসে, বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,”ভাবি কোনো অসুবিধা?”
“না আপা। তুমি বসো। দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”
আমীরুন বসে। উর্বীকে দেখতে থাকে। হঠাৎ বলে ওঠে,”একদিন আমি বলছিলাম আপনি একদিন না একদিন ভাইজানের মায়ায় পইরা যাইবেন। কথাটা মিলছে নাকি বলেন। আইজ হের সন্তানের জন্য অপেক্ষা করতাছেন কত আনন্দ নিয়া।”
উর্বী চুপ করে থাকে। আমীরুন হাসতে হাসতে বলতে থাকে,”আমীরুনের কথা বাসি হইলে সত্য হয়।”
হঠাৎ লোডশেডিং হয়। উর্বী চ’ম’কে ওঠে। আজও বিদ্যুৎ এভাবে চলে গেলো। এটা কি কাকতালীয়?
অন্ধকারে উর্বীর ভীষণ ভয় লাগছে।
সে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলে,”কি হলো আমীরুন আপা। কি হলো?”
_জানি না ভাবি। দাড়ান আমি দেখতাছি।
_না তুমি যেও না। আমার ভ’য় করছে হঠাৎ। অস্থির লাগছে। যেওনা তুমি।
আমীরুন বসে থাকে।
বাইরে নাবিলের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। সে নিচের বারান্দায় দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে দা’ড়োয়ানকে ডেকে বলছে,”কি হলো দাদু? কোনো সমস্যা?”
_দেখতেছি আমি দাদুভাই।
দারোয়ান জবাব দিয়ে টর্চ জ্বেলে জেনারেটর রুমে চলে যায়।
অন্ধকারে উর্বীর ওয়াশ রুমে যেতে হবে। এতো ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ পায়। বড্ড হয়রান হয়ে গিয়েছে উর্বী। আমীরুনকে বলে,”একটু ওয়াশ রুমে দিয়ে এসো আমায়।”
আমীরুন তাই করে।
দশ মিনিট পরে বিদ্যুৎ চলে আসে। উর্বী স্বস্তি ফিরে পায়।
ও ঘর থেকে নাবিল আমীরুনকে ডাকে,”খালামনি ভাত খাবো। ভাত বেরে দাও তো।”
আমীরুন উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী বলে,”যাও তুমি। আমি ঠিক আছি।”
আমীরুন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়।
কিন্তু হঠাৎ করে উর্বীর শরীরটা খারাপ লাগতে শুরু করে। আমীরুন নাবিলের কাছে যাওয়ার পরে আরো দুইবার সে ওয়াশরুমে গিয়েছে,একা একা। এমনও হয়েছে ওয়াশরুম থেকে বেরোনোর এক মিনিটের মাথায় পুনরায় বেগ এসেছে।
পেটে হাত দিয়ে বিছানায় পাচ মিনিট হলো বসেছে, হঠাৎ উর্বী খেয়াল করে তার উরুর নিচ টা ভেজা। পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পেরে উর্বী হতভম্ব হয়ে যায় পুরো।
আমীরুন নাবিলকে খাইয়ে উর্বীর কাছে আসে। উর্বী ভীত চোখে আমীরুনের দিকে চায়!
“কি হইছে ভাবি? কোনো সমস্যা?”
আমীরুন ছুটে এসে উর্বীকে ধরে।
“এদিকে একটু দেখো আপা।”
ককিয়ে উঠে উর্বী বলে।
আমীরুন উর্বীর উরুর দিকে দৃষ্টি দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,”হায় হায়। আপনার তো পানি ভাঙছে ভাবি। হায় হায়,ওখন আমি কি করুম।”
উর্বী ছ’ট’ফ’ট করতে শুরু করেছে । সে এখন কি করবে।
তলপেটে প্রচুর ব্যাথা করছে। উর্বী স্থির হয়ে বসে থাকতে পারছে না।
আমীরুন ভীত কন্ঠে বলে,”ভাইজানরে ফোন দেন ভাবি। ফোন কই, আমিই দিতাছি।”
আমিরুন ফোন খুঁজতে থাকে। উর্বী পেটে হাত চে’পে ধরে কোনোমতে বলে,”লাভ নেই আপা। উনি ওটিতে। ফোন বন্ধ ওনার।
আমীরুন এখন কি করবে! সে তবুও রাওনাফকে ফোন লাগায়। রাওনাফের ফোন বন্ধ,যেমনটা উর্বী বলেছে।
উর্বীর ব্যাথা বাড়তে থাকে। সে সহ্য করতে পারছে না।
এখন এই মুহূর্তে আমীরুন কি করবে? সে দৌড়ে নাবিলের ঘরে যায়।
নাবিল ডিনার সেরে বই নিয়ে বসেছিলো একটা। আমীরুন হাপাতে হাপাতে বলে,”নাবিল বাবা। বড় ভাবীর শরীরটা ভালো না। খুব অসুস্থ। ভাইজানের ফোন তো বন্ধ। কি করুম এখন? মাইয়াডা বেজায় কষ্ট পাইতেছে।”
নাবিল খুবই মনযোগ দিয়ে বই পড়ছিলো। অবাক হয়ে সে আমীরুনের দিকে তাকায়। সে কি করবে এখন? আশ্চর্য!
****
উর্বী যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে “মাগো !” বলে মৃদু চিৎকার দিয়ে ওঠে।
তারপর সে নিজের মুখ চেপে ধরে। পাশের ঘরে নাবিল আছে। সে এভাবে চেঁচাতে সংকোচ বোধ করছে। কিন্তু তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করার মতো ক্ষমতা তার নেই।
নাবিল উর্বীর চিৎকার শুনে বিব্রত হয়। এতো মহা মুশকিল! এখন সে কি করবে !
উর্বী হঠাৎ একটা বিকট চিৎকার দিয়ে ওঠে।
আমীরুন উর্বীর চিৎকার শুনে দৌড়ে উর্বীর কাছে আসে।
নাবিল ফোন বের করে একবার রাওনাফকে ফোন দেয়। রাওনাফের ফোন একই ভাবে বন্ধ। এখন তবে উপায়!
এই বৃষ্টির রাতে এভাবে একটা প্রেগন্যান্ট মহিলা পরে পরে কষ্ট পাবে? নাবিল তো এতোটাও বিবেকহীন নয়। কিন্তু সে কি করবে? কাকে ফোন করবে? বাড়ির লোক গুলোর বিবেক দেখে নাবিল বিরক্ত হয়। নাবিল ছোটো হয়েও বোঝে এই সময়ে অসুস্থ ব্যক্তিকে বাড়িতে রেখে যাওয়া উচিত না, তবুও নাচতে নাচতে চলে গেলো! বিয়ে খেতে! যত্তসব!
নাবিল কিছু একটা চিন্তা করে সিটি মেডিকেয়ারের রিসিপশনে ফোন লাগায়।
রিসিপশনের মেয়েটা ফোন তুলতেই নাবিল দ্রুত বলে,”হ্যালো। সিটি মেডিকেয়ার? আমি ডক্টর রাওনাফ করীম খানের ছেলে বলছি। কাইন্ডলি আমার পাপাকে ডেকে দিন।”
রিসিপশনের মেয়েটি অবাক হয়ে বলে,”ও আচ্ছা আচ্ছা। ”
তারপর দুমিনিট এদিক সেদিক কথা বলে নাবিলকে বলে,”সরি। বড় স্যার তো ওটিতে। স্যার ব্যস্ত। এই মুহূর্তে দেয়া পসিবল না।”
নাবিল বলে,”দেখুন। ইটস আর্জেন্ট। ওনার স্ত্রী হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পরেছে।”
নাবিলের মুখে “ওনার স্ত্রী” কথাটি শুনে রিসিপশনের মেয়েটি আরো অবাক হয়। তারপর বলে,”আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। তবে স্যারকে দিতে পারছি না। আপনি চাইলে লামিয়া ম্যামের সাথে কথা বলে দেখতে পারেন। সে আপাতত ডিউটি ফ্রি।”
_আচ্ছা তাই করুন। দিন আন্টিকে ডেকে।
দ্রুত জবাব দেয় নাবিল।
লামিয়া সব শুনে ফোনের ওপাশ থেকে বলে,”ও মাই গড। নাবিল আমি এখুনি অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিচ্ছি। সাথে দুজন নার্স। ডোন্ট ওরি। রাওনাফ দু ঘন্টায়ও বের হতে পারবে না ওটি থেকে। সিরিয়াস কেস। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি অ্যাম্বুলেন্স!”
নাবিল “আচ্ছা আন্টি” বলে রেখে দেয়। পাশের রুমে উর্বীর গোঙানির আওয়াজ নাবিল শুনতে পায়। সে বিছানার উপর বসে থাকে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে, এ কোন ঝামেলায় পরলো সে!
উর্বী ছটফট করছে। আমীরুন উর্বীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে,”ও ভাবী একটু ধৈর্য্য ধরেন। নাবিল বাবা বলছে অ্যাম্বুলেন্স আসতেছে। আরেকটু কষ্ট সহ্য করেন।
উর্বী হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,”ওনাকে ফোনে পাওয়া যায়নি তাই না আপা?”
আমীরুন বিষন্ন ভঙ্গিতে উর্বীকে দেখে। মেয়ে মানুষ তো এমনই। কঠিন সময়ে প্রিয় মানুষকে দেখার জন্য মন ছটফট করে।
****
অ্যাম্বুলেন্স এসে গিয়েছে। দুজন নার্স উর্বীকে ধরে ধরে অ্যাম্বুলেন্সে তোলে। আমীরুন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠে। নাবিল দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ,এক হাত ট্রাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে।
আমীরুন নাবিলকে বলে,”নাবিল বাবা,যাইবা না?”
নাবিল অবাক হয়ে বলে,”আমি?”
_হ তুমি। যাইবা না?
নাবিল একবার বাড়ির অন্দরমহলের দিকে চায় একবার অ্যাম্বুলেন্সের দিকে চায়। সে দ্বিধায় পরে গিয়েছে। হঠাৎ-ই সে বাড়ির মধ্যে ঢুকে বাড়ির চাবি নিয়ে আসে,দরজায় তালা লাগিয়ে নিজেও অ্যাম্বুলেন্সে উঠে পরে।
****
ও.টির মধ্যে রাওনাফের ভয়ে ইন্টার্ন ডক্টর এবং নার্স তটস্থ হয়ে আছে। আজ বড় স্যার একটু বেশিই রাগারাগী করছেন সবার সাথে। সাথে “গাধা,হাদারাম” বলে গালাগাল তো আছেই।
রাওনাফের প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে। বারবার উর্বীর মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে শুধু। এর মাঝে একবার সার্জিক্যাল নাইফ দিয়ে নিজের আঙ্গুল কেটে ফেলেছে সামান্য। এতো অস্থিরতার কারণ সে বুঝতে পারছে না।
উর্বীর যন্ত্রনা বেড়েই যাচ্ছে। লামিয়া উর্বীকে চেক করে। বাচ্চার পজিশন ঠিক আছে। সব স্বাভাবিক একেবারেই। তবে হাতে সময় নেই। তাকে যা করার এখনি করতে হবে।
একজন সিনিয়র নার্স এসে বলে,”ম্যাম।”
_হু। সব রেডি করো।
তাড়াহুড়ো করে জবাব দেয় লামিয়া।
নার্স অবাক হয়ে বলে,”ম্যাম স্যার তো ও.টি. তে!”
_তোমাদের স্যার ও.টি.তে তো আমি কি করবো ফারিন? বাচ্চা প্রসব কি তোমাদের স্যার করবেন? কিচ্ছু করার নেই । আমাদের হাতে সময় নেই।
লামিয়া উঠে উর্বীর মাথার কাছে বসে। উর্বী কাতরাচ্ছে।
দাঁতে দাঁত চেপে সে বলে,”আপা। উনি কি আসবেন না? ওনাকে খবর দেননি? উনি কখন আসবেন?”
লামিয়া বলে,”আসবে উর্বী। অবশ্যই আসবে। একটু ধৈর্য ধরো। ”
বলে সে উর্বীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
উর্বী কাঁদছে। তার শরীরের যন্ত্রনার থেকেও বেশি কষ্ট হচ্ছে রাওনাফকে না দেখতে পেয়ে। শুধু মনে হচ্ছে উর্বী আর রাওনাফকে দেখতে পাবে না।
সে ফোপাতে ফোপাতে লামিয়াকে বলে,”আপা সব বুঝি শেষ হয়ে গেলো। আমি ওনাকে একটিবার দেখতে চাই।”
লামিয়া খুব স্বাভাবিক ভাবে বলে,”এটুকু ধৈর্য্য না ধরতে পারলে মা হওয়া যায়না উর্বী। মনকে শক্ত করো। তোমার কিচ্ছু হবে না। তোমার এই বড়বোনের ওপর ভরসা রাখো।”
উর্বী স্থির হতে পারছে না। কিছু একটা হারিয়ে ফেলার ভয় ক্রমশ তাকে ঘিরে ধরছে। সে কাঁদতে কাঁদতে বলে,”আমার মনে হচ্ছে আমি মরে যাবো আপা।”
লামিয়া উর্বীর মুখের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”হ্যা তো অসুবিধা কি? তখন আমরা রাওনাফকে আবার বিয়ে করাবো।”
উর্বী কান্না থামিয়ে তাকিয়ে আছে লামিয়ার দিকে। লামিয়া হেসে ফেলে। কিছুক্ষণ হেসে বলে,”চুপ করো মেয়ে! আল্লাহকে ডাকো।”
****
নাবিল একটা বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে আছে। রাওনাফ এখনো ওটিতে। ওদিকে আমীরুন এক এক করে সবাইকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছে। রওশান আরা কিছুক্ষণ পরপর নাবিলকে ফোন করছে। তারা বিয়ে বাড়ি রেখে রওনা দিয়ে দিয়েছে।
কিছুক্ষণ হলো সবার ফোনের যন্ত্রণা থেমেছিলো। হঠাৎ শায়মী ফোন দেয়। নাবিল কলটা রিসিভ করে এইবার বিরক্ত হয়ে বলে,”আবার ফোন দিলি কেনো?”
শায়মী বলে ,”কখন পৌঁছাতে পারি জানি না। বাবুর ছবি দিবি আমাকে। দেরি করবি না।”
নাবিল “হু” বলে ফোন রেখে দেয়।
শায়মীর উৎসাহ দেখে সে ভেবে পায়না এতো আনন্দের কি আছে! বেবিই তো আসছে একটা!
****
রাওনাফ পেশেন্টের স্টিচিং করছে। সে চায় খুব সাবধানে কাজটি করতে। কোনো অঘটন ঘটে গেলে সর্বনাশ। কিন্তু তাড়াহুড়ো হয়ে যাচ্ছে। নিজের প্রতিই প্রচন্ড বিরক্ত সে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সকে ধ’ম’কে বলে ওঠে,”ঘাম মোছো স্টুপিড! হা করে দাঁড়িয়ে আছো।”
নার্স কেঁ’পে উঠে টিস্যু পেপার দিয়ে রাওনাফের কপাল থেকে ঘাম মুছিয়ে দিতে থাকে।
রাওনাফ নিজেকে ধাতস্থ করে কাজে মনযোগ দেয়।
অন্যান্য ডাক্তার দুজন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। দ্যা গ্রেট রাওনাফ করীম খান আজ এতো অঘটন ঘটাচ্ছে! আজ কাজে মন নেই মনে হচ্ছে! এটাও আবার হয় নাকি।
রাওনাফ পেশেন্টকে পোস্ট অপারেটিভ রুমে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে হাত থেকে গ্লাভস খুলতে থাকে। কাজটা করছে সে অনেক দ্রুত।
****
উর্বীর আত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে। সে গগন কাঁপানো চিৎকার দিতে থাকে।
লামিয়া নার্স দুটোকে বলে,”ওর হাত পা ম্যাসাজ করতে থাকো। ”
নার্স দুটো তাই করে।
লামিয়া চেষ্টা করছে ধীরে সুস্থে কাজটি করতে কিন্তু উর্বীর অধৈর্য্য আর চিৎকারে তারও টেনশন হতে শুরু করে।
বাচ্চা প্রসবের সাথে সাথেই উর্বী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
ছোটো পুতুলের মতো মানুষটি ভুমিষ্ট হবার সাথে সাথেই হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে।
লামিয়ার কানে সেই কান্না পৌঁছায় না। সে উর্বীর দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। উর্বীর কি হয়েছে সে বুঝতে পারছে না!
লামিয়া নার্স দুটোকে ইশারা দিয়ে বাচ্চাটাকে নিতে বলে। সে এসে উর্বীকে ধরে। উর্বীর পালস রেট চেক করে।
তারপর আরেকজন নার্সকে ইশারা করে জলদি একটি ইনজেকশন দিতে বলে।
অন্য দুজন নার্স হাসিমুখে সেই পুতুলের মতো মানুষটিকে ওয়াশ করাতে থাকে। এ যে সে কেউ না। তাদের বড় স্যারের সন্তান।
****
নাবিল মাথা নিচু করে বসে ছিলো । এতক্ষণ ডেলিভারি রুমের ভেতর থেকে আসা উর্বীর আর্তনাদ শুনে সে বিব্রত। তার কাছে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে,তারও যথেষ্ট টেনশন হচ্ছে। সবার মতো। উর্বীর আর্তনাদের মৃদু আওয়াজে তার হাত পা রীতিমতো কাঁপছে।
হঠাৎ ডেলিভারি রুমের দরজা খুলে কেউ একজন বাইরে বের হয়। নাবিল সেদিকে তাকায়। একজন নার্স নরম কাপড়ে পেঁচিয়ে বাচ্চাটাকে এদিকে নিয়ে আসছে। তার মুখ হাসি হাসি।
নাবিল নিজের অজান্তেই উঠে দাঁড়ায়। একবার নার্সের মুখের দিকে তাকায়,একবার তার হাতের দিকে।
নার্স এসে আনন্দের সাথে নাবিলকে বলে,”বোনকে কোলে নেবে?”
নাবিল কিছু বলতে পারে না। সে বোকার মতো বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকায়। কি চমৎকার গোলাপী আভা লেগে আছে ছোট্ট দুই গালে। রক্তিম ঠোঁট দুটো,মনে হচ্ছে এই মাত্র কেউ লাল রং লাগিয়ে দিয়েছে। নাবিল চোখ ফেরাতে পারে না।
নার্স আবারও বলে,”বোনকে কোলে নাও!”
নাবিল নার্সের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,”বোন?”
_হ্যা। তোমার বোন।
নাবিল খানিকটা অবাক হয়,সে শুনেছিলো তার ভাই হবে।
আমীরুন দৌড়ে আসে। বাচ্চার মুখ দেখে চেঁ’চি’য়ে ওঠে,
“ওমাহ। মাশাআল্লাহ নাবিল বাবা। এইডা তো পুতুল।”
নার্স নাবিলকে বলে,”নাও হাত পাতো। বোনকে কোলে নেবে না?
নাবিল রোবটের মতো হাত বাড়িয়ে শিশুটিকে কোলে নেয়। যদিও তার বুক ধুকপুক করছে। আলতো করে কাপড়ের পুটলি টাকে আগলে নিয়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে।
টুকটুকে পুতুলের মতো একখানা মুখ। ছোট্ট ছোট্ট চোখ দুটি পিটপিট করছে।
নাবিল খেয়াল করে তার বুকে সুক্ষ্ম আনন্দ হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে এই শিশুটি তার অতি আপন। সে একদৃষ্টে শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে মুখে রাজ্যের মুগ্ধতা এসে ভীড় করেছে।
****
রাওনাফ অপারেশন থিয়েটার থেকে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বের হচ্ছে। তার মনটা কেমন জানি করছে। যার কারন সে বুঝতে পারছে না।
রাওনাফকে দেখে দুজন নার্স দৌড়ে আসে। রাওনাফ তাদের দিকে তাকায়।
একজন নার্স বলে ওঠে,”স্যার। আপনি ঠিক আছেন?”
_হ্যা,কেনো? আচ্ছা শোনো,আমি সব বুঝিয়ে দিয়েছি। ঘন্টা খানিক পরে পেশেন্টকে ইনজেকশনটা দিয়ে দিও। আর রুমিন কোথায়? ও.টি. তে ওকে “গাধা” বলেছি, ওকে সরি বলতে হবে। আমি এখন বাড়ি যাবো।
নার্স দুজন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপর রাওনাফকে বলে,”স্যার। আমরা আপনাকে জানাতে পারিনি। দুঃখিত। ম্যাম অসুস্থ হয়ে পরায় তাকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়। এবং আপনি কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন স্যার।”
রাওনাফ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। এরা কি মজা করছে তার সাথে!
নার্স বলে,”কংগ্রাচুলেশন স্যার। বাচ্চা সুস্থ আছে। নরমাল ডেলিভারি। তবে ম্যাম একটু জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। লামিয়া ম্যাম দেখছেন। ডোন্ট ওরি।”
রাওনাফ কিছু বলে না। গায়ের এপ্রোন খুলে মাটিতে ফেলে সে হাঁটতে থাকে। সে নিজেকে নিজে কখনো মাফ করতে পারবে না।
নাবিল বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি ওই চাঁদ মুখ থেকে সরছে না। নাবিলের অদ্ভুত লাগছে। তার এতো আনন্দ হচ্ছে কেন! এমন তো হবার কথা ছিলো না!
আমীরুন খুশিতে একপ্রকার লাফাতে থাকে। সে একের পর এক ফোনকল রিসিভ করে কথা বলছে বাড়ির সবার সাথে।
রাওনাফ এসে গাইনী ওয়ার্ডের নরমাল ডেলিভারী রুমের লবিতে দাড়িয়ে পরেছে। নাবিলের দিকে একবার তাকিয়ে সে সেদিকে এগিয়ে যায়।
লামিয়া ডেলিভারি রুম থেকে বেরিয়ে এসে রাওনাফকে দেখে। তারপর উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে ওঠে,” মেয়ে একেবারে মায়ের মতো হয়েছে তাই না? সৃষ্টিকর্তা মায়ের রুপ ঢেলে দিয়েছে মেয়ের মধ্যে।”
রাওনাফ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারছেনা,সে লামিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। লামিয়া বলে,”আমাকে শাড়ি দিতে হবে রাওনাফ।আমি তোমার মেয়ের ধাই মা।”
রাওনাফ ম্লান হেসে অস্ফুট স্বরে বলে,”উর্বী!”
_উর্বী ঠিক আছে। জ্ঞান ফিরেছে। তুমি এভাবে দাড়িয়ে থাকবে? মেয়েকে ধরবে না?
রাওনাফ তার উত্তর দেয়না। সে সোজা উর্বীর কাছে চলে যায়।
লামিয়া নাবিলের দিকে তাকায়,নাবিল বোনের দিকে তাকিয়ে হাসছে। লামিয়া এসে বাচ্চাকে কোলে তুলে নেয়। বাচ্চাকে খাওয়াতে হবে।
নাবিল লামিয়াকে বলে,”কোথায় নিচ্ছো লামু আন্টি!”
_বোন খাবে তোমার।
****
রাওনাফ উর্বীর পাশে গিয়ে বসে। তার মুখ শুকিয়ে একটুখানি হয়ে আছে। উর্বীর চোখের দিকে সে তাকায় না।
উর্বী রাওনাফের হাত নিজের কাছে টেনে নেয়। নরম গলায় বলে,”মেয়েকে দেখেছেন? ”
রাওনাফ মাথা নাড়ায়,মুখে কোনো জবাব দেয়না। উর্বী বলে,”আমি দেখিনি। ওকে নিয়ে আসুন না।”
রাওনাফ উর্বীর হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে উর্বীর দুহাত আকরে ধরে। ব্যাকুল কন্ঠে বলে ওঠে,
“তুমি আমার উপর রাগ করে আছো তাইনা? বিশ্বাস করো। আমি নিজেই নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবো না। কোনোদিনও না।”
উর্বী রাওনাফের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর হেসে ফেলে। বলে,
“ধুর। আমি রাগ করবো কেনো? আপনি বুঝি ইচ্ছে করে আমার কাছে আসতে পারেন নি?”
কথাটি বলতে বলতে উর্বীর মুখে বিষন্নতা এসে ভিড় করে । রাওনাফ তা খেয়াল করে।
উর্বী বলে,”তবে কি জানেন শর্মীর পাপা,একটা সময় আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমি আর আপনাকে দেখতে পাবো না।”
রাওনাফ উর্বীর কথায় চ’ম’কে উঠলেও নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,”কেনো! একদিন তো খুব সাহস দেখিয়ে আমাকে দেখবে না বলে চলে যাচ্ছিলে!”
উর্বী রাওনাফের কথায় ম্লান হাসে। দু’চোখের কার্নিশ বেয়ে তরল গড়িয়ে পরে। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”এখানেও আমার লোভ আর স্বার্থপরতা কাজ করেছে শর্মীর পাপা। লোভ আপনার কোলে আমার মেয়েকে দেখার,আর স্বার্থপরের মতো ভেবেছি আপনাকে আরো ঝামেলা দিতে কিভাবে আপনার জীবনে থেকে যাওয়া যায়। আপনার থেকে শুধু নেওয়া যায়।”
রাওনাফ উর্বীকে জরিয়ে ধরে। উর্বী রাওনাফের বুকে মাথা রেখে কাঁদছে,শান্তিতে।
লামিয়া বাচ্চাটাকে এনে কেবিনে ঢোকে। তারপর উর্বীর পাশে শুইয়ে দেয়। উর্বী তার জীবনের নতুন ফুলটির দিকে তাকায়। তার গাল বেয়ে পানি গড়িয়ে পরছে। অস্ফুট স্বরে রাওনাফকে বলে,”কোলে নিন তো ওকে। একটু দেখবো।”
রাওনাফ হাত বাড়িয়ে উর্বীর চোখের পানি মুছিয়ে দেয়। তারপর মেয়েকে উর্বীর পাশ থেকে উঠিয়ে কোলে নিয়ে কপালে একটা চুমু খায়।
লামিয়া তাকিয়ে তাকিয়ে স্বামী স্ত্রীর সে অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যটি দেখতে থাকে।
কিছুসময় পরে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে,”অভিনন্দন রাওনাফ। আপনাদের বাপ বেটিকে দারুণ লাগছে।
রাওনাফ ম্লান হাসে, মেয়েকে উর্বীর কোলে তুলে দেয়। তারপর বলে,”সবকিছু তো নরমাল ছিলো। এরকমটা হবার তো কথা ছিলো না লামিয়া।”
_উর্বীর এংজাইটি থেকে প্রেশার বেড়ে গিয়েছিলো সম্ভবত রাওনাফ।
রাওনাফ উর্বীর দিকে তাকায়। উর্বী তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসছে। রাওনাফ মা মেয়ের থেকে চোখ সরাতে পারছে না।
****
রওশান আরা হসপিটালে পৌঁছেছেন। সে এসেই পুরো হসপিটাল মাথায় তুলে ফেলেছেন। তার নাতনি কোথায়।
রওশান আরার নাতনি নাবিলের কোলে। সে ভিডিও কলে সব বন্ধুদের দেখাচ্ছে। শর্মী শায়মী অবাক হয়ে বাচ্চাটাকে দেখছে। তাদের হতভম্ব ভাব কাটছে না। তাদের ভাই তাদের বোন হয়ে গেলো কি করে?
রাওনাফ কেবিনের বাইরে যায়না। সবাই বাইরে হৈ হুল্লোড় করছে। সে উর্বীর কাছে বসে আছে। সকাল হয়ে এসেছে প্রায়।
রওশান আরা এসে প্রায় থাবা মে’রে তার নাতনিকে কোলে তুলে নেয়। বাকিরা উঁকি দিচ্ছে। একজন আরেকজনকে সরিয়ে বাবুর মুখটা একটু বেশি দেখতে চাচ্ছে।
উর্বী আর রাওনাফ তাদের হাসাহাসির শব্দ শুনতে পায়। রওশান আরা বলে,সব ঠিক আছে। তবে নাকটা এমন কেনো? আমাদের বাড়ির কারো নাকতো বোচা না। বৌমার নাকও তো ঠিকঠাক!
নাবিল বলে ওঠে,”ও শর্মীর মতো হয়েছে। শর্মীর নাক তো বোচা দাদু,ভুলে গেলে।”
সবাই চুপ হয়ে যায়। রওশান আরা এতক্ষন খেয়াল করেনি বিষয়টি। আসলেই। এই মেয়ে পুরোপুরি শর্মীর ফটোকপি।
রওশান আরা নাতনিকে নিয়ে দুলতে দুলতে উর্বীর কাছে আসে,উর্বী শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে শুকনো হাসি হাসে। রওশান আরা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে,
“রাগ করলে? তোমাকে না দেখতে এসে নাতনি নিয়ে পরে আছি তাই?”
উর্বী হেসে মাথা নাড়ায়।
রওশান আরা বলতে থাকে,”কি বলো তো। শাশুড়িরা এমনই।”
উর্বী ফিক করে হেসে দেয়। রওশান আরাও হাসতে থাকে।
শায়মী আর শর্মী কেবিনে ঢোকে। রওশান আরা ওদের দেখে উর্বীকে বলে,”নাও,তুমি তোমার মেয়েদের নিয়ে থাকো। আমি গেলাম।”
বলেই রওশান আরা তার ছোটো নাতনিকে উর্বীর পাশে শুইয়ে দিয়ে চলে যায় কেবিন থেকে। উর্বী শর্মী আর শায়মীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর শর্মীকে বলে,”বোনকে কোলে নেবে না?”
শর্মী মাথা নাড়ায়। এগিয়ে এসে বোনকে কোলে নেয়। শায়মীর হাত নিশপিশ করছে,সে শর্মীকে বলে,”তুই ফেলে দিবি। দে আমার কাছে দে।”
বোনকে জোর করে নিয়ে যায় শর্মীর কোল থেকে। উর্বী শর্মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”মন খারাপ হয়েছে ভাই হয়নি বলে?”
শর্মী মাথা নেড়ে অস্ফুট স্বরে বলে,”না।”
_বোন বাবুকে কম ভালো বাসবে?
শর্মী খিকখিক করে হেঁসে ওঠে, তারপর বলে,”আরো বেশি ভালোবাসবো।”
উর্বী হাসে। শায়মী বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”আমি একটু কম ভালোবাসবো।”
শর্মী শায়মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তাহলে ওকে আমার কাছে দাও।”
শায়মী দেয়না। হাসতে থাকে। শর্মী তার ছোটো বোনকে টানছে শায়মীর কোল থেকে। দুইবোনের মধ্যে যু’দ্ধ লেগে গিয়েছে।
উর্বী মুগ্ধ চোখে সে দৃশ্য দেখতে থাকে।
****
নাবিলকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে লামিয়া এসে নাবিলের পাশে বসে। নাবিলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কি ভাবছো নাবিল?”
নাবিল নড়েচড়ে বসে,বলে,”কিছু না আন্টি!”
_খুব ধকল গেছে তাই না নাবিল? আসলে সব দোষ আমার। রাওনাফকে আমিই ফোন করে জোর করেছি আসার জন্য। ও থাকলে ব্যাপারটা অন্যরকম হতে পারতো।
_না আন্টি। ইট ওয়াজ অ্যান এক্সিডেন্ট। এতে তোমার হাত নেই। দূর্ঘটনা ঘটার থাকলে ঘটবেই। আমরা চাইলেও,আগে থেকে জানলেও তা আটকাতে পারবো না।
লামিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে ,”সেটাই। দূর্ঘটনা ঘটার থাকলে ঘটবেই, আমরা চাইলেও আটকাতে পারবো না। শর্মীর সেই এ্যাক্সিডেন্ট টাও এরকম একটা দূর্ঘটনা ছিলো। হওয়ারই ছিলো।ওভাবে না হলে অন্যভাবে হতো। এতে উর্বীর হাত ছিলো না নাবিল। আমি এটাই বিশ্বাস করি।”
নাবিল কোনো জবাব দেয় না। সে চুপ হয়ে বসে থাকে ।
****
উর্বীকে আর তার মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। বাড়ি ভর্তি মেহমান। উর্বীর বাপের বাড়ি থেকে সবাই এসেছে।
সে সারাদিন রুমে বসে থাকে। সবাই বাচ্চাটাকে নিয়ে হৈ হৈ করে। উর্বী তাকে খুব একটা কাছে পায়না। শুধু ঘুমানোর সময় আর খাওয়ানোর সময়টাতে সে তার মেয়েকে ধরতে পারে। উর্বী বাধা দেয় না। এর মাধ্যমে যদি সবাই একটু ভালো থাকে খারাপ কি তাতে? সবচেয়ে বড় কথা, নাবিল তার বোনকে চোখে হারায়।
সে নিজেই উদ্যোগ নিয়ে তার বোনের নাম রেখেছে “রাহা”!
কি সুন্দর নাম! উর্বীর ভীষণ পছন্দ হয়েছে।
কখনো কখনো সব সম্পর্কের সমীকরণ মেলানো যায়না। সমঝোতাও হয় না। উর্বী আর নাবিলের সম্পর্কটা ঠিক সেরকম। তবে রাহা একটা বিরাট অবদান রাখতে পারে।
আজ দুপুরে যখন সবাই নিচে খাচ্ছিলো। উর্বী তখন ওয়াশ রুমে ছিলো। হঠাৎ রাহা কাঁদতে শুরু করলে উর্বী তড়িঘড়ি করে ওয়াশ রুমের দরজা খুলে দেখে নাবিল তার বোনকে কোলে তুলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। উর্বী আবার ওয়াশ রুমে ঢোকে। সে নাবিলের সামনে পরতে চায়নি । নাবিল লজ্জা পাবে। এমনিতেই নাবিলকে শর্মী আর শায়মী সারাদিন ক্ষেপাতে থাকে কারণ নাবিল একদিন বড় গলা করে বলেছিলো,”ঐ বেবীকে আমি একটুও আদর করবো না।”
এভাবেই উর্বীর দিনগুলো কেটে যাচ্ছে।
সে চায় তার জীবনটা যেন এভাবেই কেটে যায়। আর বেশি কিছু সে চায়না। আর বেশি কিছু যে চাওয়ারই নেই উর্বীর।
***
উর্বী রাহাকে খাওয়াচ্ছে। সারাদিন পরে এই একটু সে নিরিবিলি হয়েছে তার মেয়ের সাথে। রাহা সারাদিন তার তিন ভাইবোনের হাত বদল হতেই থাকে।
খাওয়ানো হয়ে গেলে উর্বী রাহার সাথে গল্প করতে থাকে। রাওনাফ ঘরে ঢুকে মা মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
উর্বী রাওনাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”ক্লান্ত খুব?”
“হু, আমার মাকে দাও।”
বলেই রাওনাফ রাহাকে টেনে নিয়ে নিজের বুকের উপর শুইয়ে দেয়। তার দু’চোখ বন্ধ করে থাকে।
উর্বী চেঁচিয়ে ওঠে,”এটা কি হলো? সারাদিন আমি মেয়েকে কাছে পাই? এভাবে নিয়ে নিলেন?”
“তবে কি আমি পাই?
রাওনাফ বিরক্ত হয়ে বলে।
উর্বী রাহাকে নিতে যায়। রাওনাফ দেয়না। দুজনের টানাটানির এক পর্যায়ে দরজায় টোকা পরে।
রাওনাফ বলে,”কে?”
_পাপা আমি নাবিল।
রাওনাফ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। অবাক হয়ে বলে,
_কি হয়েছে বাবা?
নাবিল উর্বীর দিকে না তাকিয়ে রাওনাফকে বলে,
_বোনকে দাও।
উর্বী রাওনাফ একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। বাধ্য হয়ে উর্বী রাহাকে দিয়ে দেয়। নাবিল তাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে যায়। আজ সারাদিন সে বাড়ির বাইরে ছিলো,বোনকে কোলে নিতে পারেনি একটুও।
রাওনাফ দরজা লাগাতে লাগাতে বলে,”এই তিন ভাইবোন বড্ড বিরক্ত করছে।”
উর্বী হাসে।
রাওনাফ বলে,”তুমি জানো না। যখন শর্মী হয়েছিলো। তখন শর্মীকে নিয়ে এদের মধ্যে কি ঝগড়া! সারাদিন শর্মীর কাছে দুজন উবু হয়ে বসে থাকতো। স্কুলে যেতো না!”
উর্বী কিছু বলে না। রাওনাফ এসে উর্বীর পাশে বসে। উর্বী রাওনাফের কাধে মাথা রাখে।
রাওনাফ উর্বী মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বলে,”অন্তরা ফোন দিয়েছিলো?
_হু। ও প্রেগনেন্ট। আপনাকে জানাতে বললো।
_মোহনা আর ও কি বুদ্ধি করেছে নাকি! দু’জনেই একসাথে প্রেগনেন্ট!
উর্বী হাসে,বলে,”মা খুশিতে লাফাচ্ছে।”
পাশের ঘর থেকে নাবিল আর শর্মীর ঝগড়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।রাহাকে নিয়ে টানাটানি লেগে গিয়েছে তিনজনের মধ্যে।
শক্তিতে নাবিলের সাথে কেউ না পেরে হার মেনে নিয়ে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে রাহার দিকে।
শর্মী ঠোঁট উল্টে বলতে থাকে,”কখন দেবে?”
নাবিল বোনকে কোলে নিয়ে দোলাতে দোলাতে বলে,”আমার মন ভরে গেলে।”
শায়মী চেঁ’চি’য়ে বলে,”আর সেটা কখন?”
_কখনও না।
কথাটা বলে নাবিল ফিক করে হেসে দেয়। তারপর শর্মীর দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি খারাপ তাই ভাই চেয়েছিলি, আর দেখ আল্লাহ আমাকে বোন দিয়েছে কারণ তোরা দুইজন শাকচুন্নী।”
দোতলার লিভিং রুমে তিন ভাইবোন চেঁচামেচি করছে। ঘরের ভেতরে বসে রাওনাফ আর উর্বী হাসছে। উর্বী রাওনাফের কাঁধে মাথা রেখেই একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে রাওনাফের একটা হাত ধরে। রাওনাফ নিজের আরেক হাতে উর্বীর অন্য হাতটা আকরে ধরে। পাশাপাশি বসে দু’জনেই চুপচাপ তাকিয়ে আছে নিজেদের হাতের দিকে, একে অপরের হাতের দিকে। যে হাত তারা ধরেছিলো আরেকটি বার মায়ায় জড়াতে। আরেকটি বার লোভী হতে, জীবনের প্রতি। আরেকটি বার ভালোবাসতে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~সমাপ্ত~~~~~~~~~~~~~~~~