আম সন্দেশ পর্ব-০৪

0
1524

#আম_সন্দেশ
#পর্ব_০৪
#রিমি_ইসলাম

একটা মানুষের কতটা মাথা খারাপ হলে এমন আজেবাজে চিন্তা নিয়ে ঘুরে আমার জানা নেই। পুরো একটা মিস্টেরিয়াস ক্যারেক্টার!

খালি পেট আর শূন্য মাথায় হাসির দমক কমে এলো অল্পক্ষণে । নিরবে বসে শুধু একটাই চিন্তা মাথায় এলো, বাড়িতে সবাই কি ভাবছে? বেলা হয়ে উঠছে অথচ আমার স্থানান্তর ঘটেনি। দিব্যি পড়ে রয়েছি এখানে। ওদিকে প্রভাত ভাই এক মিনিটের কথা বলে বিশ মিনিট পার করে ফেলেছেন। প্রায় আরও দশ মিনিট কাটিয়ে তিনি ফিরলেন সাথে ফুপিকে নিয়ে। আমার মাথায় প্রথম যে প্রশ্নটা এলো তা হলো, ‘ নিচে কি বলেছেন প্রভাত ভাই?’ ফুপির মুখটা দেখার মতো না। প্রচন্ড আক্রোশে যেন এক্ষুনি আমার উপর দুম করে আছড়ে পড়বেন। ফুপির প্রথম প্রশ্ন হলো,

___’ সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছ তখন আমাকে একা জানিয়ে কাজ নেই। তোমার বাসায় জানে? আমি বাপু একা কোনো দায়ভার গ্রহণ করতে পারব না। যা হবে দুই পক্ষের সম্মতিতে হবে। শেষে ভাইজানের বিরূদ্ধে যেয়ে আমার বাপের বাড়ির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারব না। বুঝছ মেয়ে?’

নিতান্ত বাচ্চাদের মতো অসহায় মুখ করে ফুপির পাশে দাঁড়ানো প্রভাত ভাই। আর আমি শেকড় থেকে সবটা বুঝে ওঠার চেষ্টায় আছি। হঠাৎ ফুপি এমন কথা কেন বলছেন? উনি কি বলেছেন এমন? আমাকে ভাবতেও সময় দিচ্ছেন না কেউ। ফুপি ভাবনার মাঝে বার্তা ঢুকালেন। প্রভাত ভাইকে এক রকম আদেশ দিলেন এক্ষুনি রুম ছাড়তে। আমার সাথে একান্তে কথা বলবেন বলে। উনি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে হাসিমুখে চলে গেলেন। বুঝলাম এবার মস্ত রাগের তুফান চলবে একা আমার উপর দিয়ে। সব ক্ষেত্রে বলির পাঠা আমি। আরো একটা ব্যাপার, ফুপি আমাকে “তুমি” করে ডাকছেন যে এতকাল আমাকে ” তুই” বলে এসেছেন। সম্বোধনীতেও তফাৎ এসে গেছে। ফুপি চোখ ছোট ছোট করে বললেন,

___’ তুমি রাতভর বাড়ির বাইরে, আমার ছেলের সাথে এটা কেউ জানে? ‘

মুখ ফুটে কিছু বলার অধিকার পেলাম না বলে মাথা নেড়ে না জানাতেই ফুপি ক্ষেপে উঠলেন।

___’ সর্বনাশ! শেষে বিয়ে করতে এ পর্যায়ে নামলে তোমরা? একটু ধৈর্য্য সহ্য বলে তোমাদের কিছু নেই? কি বলবো ভাইজান ফোন করলে? যদি প্রশ্ন করে সন্ধ্যা তোর ওখানে আছে তবে? সর্বনাশ, ডাহা সর্বনাশী! সাথে এই সর্বনাশী মেয়ে। আমার ছেলের মাথার মগজ পুরো খেয়েছে।’

সত্যি এবার রাগ হলো। আমার কঠিন মুহূর্তেও সহজে চোখে পানি আসে না। যা আসে সেটা হলো তীব্র রাগ আর হতাশা। দোষ করলো তাঁর ছেলে আর দুর্নাম কামালাম আমি। একটু স্বাভাবিক হয়ে মিনতির গলায় বললাম,

___’ বিশ্বাস করো ফুপি আমি কিচ্ছু করিনি। আমিতো ঘুমিয়ে ছিলাম। তোমার ছেলে আমাকে কিডন্যাপ করে সারা রাত বাইরে রেখেছে। আর এভাবে আমাকে “তুমি” বলো নাতো। শুনতে খারাপ লাগে। আগের মতো হয়ে যাও প্লিজ? “তুই” বলো একবার?’

ফুপিকে জড়িয়ে ধরতে গেলে দূর দূর করে খেদিয়ে বলে উঠলেন,

___’ এই দূরে সরো, খবরদার এই আহ্লাদ আমাকে দেখাবা না। তুই বলার যোগ্যতা তুমি রেখেছ? ‘তুই’ শব্দটা একান্ত আপনজনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাছাড়া কয়েক ঘন্টার মধ্যে যে মেয়ে আমার ছেলের বউ হবে তাকে তুই বলা সাজে না। ‘

এবারের শেষ কথাটা আরও ভয়ংকর। কয়েক ঘন্টার মধ্যে মানে কি? এটা আবার কি ধরনের কথা? কনে রাজি না, কনের বাড়ির লোকজন না অথচ বরপক্ষ তুমুল আয়োজনে লেগেছে! ফুপি আর একদন্ত থাকলেন না। চলে গেলেন। তাঁর প্রস্থানের সেকেন্ড না পেরোতে প্রভাত নামক মহা সংকট এসে হাজির। আসামীও এত হাজিরা দেয় না যতটা হাজিরা তিনি আমার সামনে দেন। তিনি এসেই বললেন,

___’ সারপ্রাইজের ওপর সারপ্রাইজ। কেমন লাগছে? আমার বাতাসে আজ শান্তি আর শান্তি! তোর শাস্তি আর শাস্তি। আমাকে না বলবি কখনো? বিয়ের পর যদি কোনো কথায় না বলেছিস তবে….প্রচন্ড গরমের সময় রুম হিটার চালিয়ে তোকে ছেড়ে দেব। তেলাপোকার মতো পালাতে দিশা পাবি না। শীতের সময় এসি ছেড়ে রাখব। রিমোট থাকবে আমার কাছে। পেঙ্গুইনের মতো লাফাতে হুঁশ পাবি না। গট্ ইট?’

কি অদ্ভুত বাজে শাস্তির ধরন! এই মানুষটা সেকেন্ডে সেকেন্ডে আমাকে থ্রেড দেন। বিয়ের পর কি এ অবস্থার অবনতি দ্বিগুণ বেড়ে চলবে? থাকব কিভাবে এই ভিনগ্রহের মানুষের সাথে? অসম্ভব! এ বিয়ে হবে না। দরকার হলে পালাবো। গুপ্ত কোনো স্থানে কিছুদিন গা ঢাকা দেব। এতেও সমস্যার সমাধান না হলে অন্য কাউকে বিয়ে করে সোজা বরসমেত বাড়ি ফিরব। তবুও এই বিলেতি আপদকে বিয়ে নয়। আমার একমাত্র শ্লোগান।

” বিয়ে যদিও ফরয হয়, বিলেতি আপদকে বিয়ে তবুও নয়।”

বাহ! সুন্দর মিলেছে। প্রভাত ভাই প্রথমে একমনে ঘড়ি দেখলেন।তারপর হঠাৎ একহাত মাথায় রেখে বললেন,

___’ মাই ব্যাডনেস্, ঘড়ি ধরে দেখলাম তুই পুরো পনের মিনিট এভাবে বেখেয়ালি ছিলি। রাত দিন এত ভাবিস কাকে? হঠাৎ হঠাৎ এভাবে হারিয়ে গেলে বিয়ের পর দেখা যাবে তোকে একবার ডাকলে জবাব দিবি এক ঘন্টা পরে। কাজ হবে তাহলে? থাক আর অপমান না করি। আচ্ছা এবার ভদ্র মেয়ে হয়ে নিচে চল দেখি। আজকে আমাদের বিয়ে। শহরের সব কাজিরা প্রচন্ড ব্যস্ত। হয়রান হয়ে খুঁজে একজনকে পেয়েছিলাম তাও উনি বলেন কিনা এখন যেতে পারবেন না। কালকে বিয়ে করেন।মাথায় তুফান উঠে গেল। হাত ধরে টেনে এনেছি। কারো জন্য আমার বিয়ে আটকাবে না। ‘

বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলাম।

___’ তিন বছর কি বিদেশে গুন্ডামীর শিক্ষা নিতে গিয়েছিলেন? একবার আমাকে জোরপূর্বক ধরে আনলেন এবার কাজিকেও?’

___’ ওইসব শিখতে হয় না। পরিবেশ পরিস্থিতি মানুষকে শিখিয়ে দেয়। তোর কণ্ঠ এত স্বাভাবিক ঠেকছে, ব্যাপার কি রে? তলে তলে পালানোর ফন্দি আঁটছিস নাতো?’

আমি মুখ ঘুরিয়ে অযেতুক মুখে অসহায়ত্ব এনে বললাম,

___’ সেই পথ খোলা রেখেছেন? পালিয়েও বাঁচতে পারব না আপনার থেকে বুঝে নিয়েছি। ‘

প্রভাত ভাই মাথা চুলকে কতক্ষণ দোটানায় পড়ে থাকলেন। হয়তো আমার আচরণগত স্বাভাবিকতা তিনি নিতে পারছেন না। সন্দেহের আড়ালে আমাকে হাসিমুখে বললেন,

___’ তাই? সত্যি বলছিস? তাহলে নিচে আয়। কোনো সাজগোজ লাগবে না। কারণ ওই সামগ্রী আমার ঘরে পাবি না। দ্রুত পদে নিচে নামবি, কবুল বলবি তারপর আমার সাথে সংসার করবি। ‘

____
কাজি ঢকঢক করে একটু পর পর পানি খাচ্ছেন আর হ্যাবলাকান্ত হেসে বলছেন।

___’ আরেক গ্লাস পানি মিলবে?’

দফায় দফায় পানির ক্লাস ফাঁকা নিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় ছ’ গ্লাস শেষ। ফুপি হেলেদুলে বিচ্ছিরি মুখ করে কিছু একটা বিড়বিড় করতে করতে আরেক গ্লাস পানি এনে কাজি সাহেবের সামনের ছোট্ট টি টেবিলে রাখতেই উনি হামলে পড়লেন। এক চুমুক দিতে যাবেন এমন মুহূর্তে ফুপি চোখ রাঙিয়ে বললেন,

___’ এবার পানি ফুরালে আর পাবেন না বলে দিচ্ছি। আমার বাসায় আজকে পানি সংকট।’

বেচারা কাজি কথা শুনেই চুপসে যাওয়া বেলুন হয়ে গেলেন। গুটি গুটি হাতে পানির গ্লাসটা স্বস্থানে রেখে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। পিপাসায় আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। তবে কাজির এহেন কান্ড দেখে আমি আর পানি চাইতে সাহস পাচ্ছি না। বেচারা যে হারে ধমক খেয়েছে সেই পালা না আমার ওপর এসে পড়ে এই ভয়ে।
বিয়ে পড়ানোর জন্য কাজি তৈরি হয়ে গেলেন।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে