আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি পর্ব-০৫

0
1188

#আমি_দূর_হতে_তোমারে_দেখেছি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_০৫

” আমি যেভাবে যে পরিস্থিতিতে তোকে ছুঁয়েছি, তোর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভালোবাসা চাপিয়ে দিয়েছি এটা আমার ভুল। ভুল না অন্যা*য় করেছি আমি মেনে নিলাম কিন্তু তুই যেটা করতে চেয়েছিলি সেটা কী ছিল? তোর আর আমার কাজে কী কাটাকুটি করে মিলমিশ হওয়া যায়?”

ইহানের প্রশ্নের উত্তরে রায়া কিছুই বলতে পারছে না। চুপচাপ বসে নিরবতা পালন করছে আয়োজন করে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ” মানুষ প্রতারিত হওয়ার পর নতুন করে ভালোবাসতে ভয় পায়। আমি খুব বাজেভাবে প্রতারিত হয়েছি, খুব খুব খুব বাজেভাবে। আমি নিজেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে নিচ্ছি নিজেকে বদলে ফেলছি। আমার পৃথিবীতে আমার মানুষ বলতে একজনও নেই এটাই কি বড় শিক্ষা না আমার জন্য? মানুষ মাত্রই তো…”

ইহান ধমকের সুরে বলে ওঠে,” একদম এটাকে ভুল বলবি না। এটা অন্যা*য়, মাত্রাছাড়া অন্যা*য়।”
” ক্ষমার অযোগ্য?”
” আপাতত ক্ষমার বিষয়টা মাথায়ও আনতে চাইছি না।”
” একাকিত্ব আমাকে গিলে খাচ্ছে, সঙ্গ প্রয়োজন।”
“কিছু সময় মানুষের একাকিত্ব প্রয়োজন। নিজের ভুল বোঝার জন্য, নিজেকে চেনার জন্য প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য একাকিত্ব প্রয়োজন।”
” আমার প্রয়োজন আর অনুভব করেন না? নাকি মৃ*ত্যুসম অপরাধ করার ফলে আমার প্রতি থাকা ভালোবাসা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে? ভালোবাসতে ভুলে গিয়েছেন? একটা অ*ন্যায় করার পর যতটুকু অপরা*ধবোধ হওয়া প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক হয়েছে এবং হচ্ছে। ”
” হতে থাকুক।”
” একবার আসবেন না? সামনে দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলবেন না যে, রায়া, অনেক তো হলো চল আবার শুরু করি?”
” তুই বিয়ের পর প্রাক্তনের সাথে চলে যেতে চেয়েছিলি, তোর মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি তুই ক্ষমা পাবি?”

রায়া কিছুক্ষণ নিরব থেকে আবার বলে ওঠে, ” মৃ*ত্যুদ*ন্ড দেবেন? বেঁচে যেতাম। দম বন্ধ হয়ে আসে আমার সময় সময় বাঁচার তাগিদে ছটফট করি, এসব আর করতে হতো না। এত অসম্মান নিয়ে বাঁচা যায় না। আপনি এটুকু চিন্তা করছেন না যে আপনার সাথে যদি এমন হতো যে আপনি কাউকে ভালোবাসেন আর বাড়ি থেকে আপনাকে অন্যকারো সাথে বিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ আগের সেই ভালোবাসার মানুষকে দেখলে হৃদয়টা লাফিয়ে উঠবেই।”
” আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না যে আমার বউ অন্যকারো সাথে….”

ইহান কথা বলতে গিয়ে থেমে যায়। নিজের বলা বাক্যটা কিছুতেই শেষ করতে পারে না, মুখ দিয়ে বের হয় না কথা।

ইহানকে চুপ করে যেতে দেখে রায়া বলে ওঠে, ” মৃ*ত্যু প্রয়োজন হয় এমন পরিস্থিতিতে ফেলে দেবেন না। এমন পরিস্থিতি তৈরি করবেন না প্লিজ যেটায় ভুলের বা অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করতে করতে নিজের মৃ*ত্যু কামনা করতে হয়। মানুষের নিজের ভুল বুঝতে একটা ধাক্কা-ই যথেষ্ট। এই ধাক্কা আমার হাড়গোড় ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে, আমি আর উঠে দাঁড়াতে পারছি না। মানুষের মন থেকে যখন ভালো লাগা হারিয়ে যায় তখন ভালো থাকাটাও বিদায় নেয় আর ভালো থাকা বিদায় নিলে মানুষ তখন মৃ*ত্যুর সাথে বন্ধুত্ব করতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। ”

ইহান তখনও চুপ করেই আছে। রায়া নিজেই কান্না করতে করতে আবার বলে, ” আমি কিন্তু যেভাবেই হোক নিজেকে বাঁচিয়ে নিতাম। আমি আমার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথম ধাপ ফেলার আগেই সবটা জেনে গিয়েছিলাম। যেটা করতে চেয়েছিলাম সেটা চাওয়া পর্যন্তই আর এটাই আমার অপরা*ধ। ”

রায়া আর কথা বলতে পারছে না। কান্না করে তার নাক-মুখ বন্ধ হয়ে আসছে। গলা থেকে কথা বের হচ্ছে না। রায়া ফোনটা কেটে পাশে রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে থাকে৷ গোটা চার সপ্তাহ পর ইহান রায়ার কল রিসিভ করেছিল। এই চার সপ্তাহ রায়া প্রতিটা সেকেন্ডে নিজেকে পু*ড়িয়েছে। পু*ড়িয়ে নিজেকে খাঁটি করে তৈরি করছে প্রতিনিয়ত।

রায়ার কান্নার আওয়াজে দরজায় এসে নক করেন ইরিনা বেগম। রায়া চোখ মুছে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে দেয়। ইরিনা বেগম শাড়ির আঁচল দুই ভাজ করে কাধে তুলে নিয়ে রুমে প্রবেশ করেন৷ রায়াও ইরিনা বেগমের পিছে পিছে গিয়ে সামনেই দাঁড়ায়। ইরিনা বেগম ইশারা করে বসতে বললে রায়া বাধ্য মেয়ের মতো বসে পড়ে।

” কান্না করছিলি?”

ইরিনা বেগমের হঠাৎ করা প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে যায় রায়া। ইরিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নেয় কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু উচ্চারণ করতে পারে না।

ইরিনা বেগম রায়ার কাছাকাছি গিয়ে বসেন। এক হাত দিয়ে রায়াকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলেন, ” এই কয়েকদিনে তো কম কান্না করলি না, আর কত?”
” আপনার ছেলে আমাকে মাফ করবে না বড়মা। আমি যে খুব বড় অপরা*ধ করে ফেলেছি। ”
” হ্যাঁ অপরা*ধ করেছিস, কিন্তু আমি মেয়ে হিসেবে যেটুকু বুঝি মেয়েদের মায়া অনেক গভীর, খুব বেশি ভালোবাসতে পারে। আর এই অতিরিক্ত ভালোবাসা যখন ভুল মানুষের প্রতি এসে তখন আর কান্নার সীমা থাকে না৷ একটা মানুষের ভুল ঠিক করে নিয়ে নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য একটা মাস কম সময় না। কান্না করে নে, যত ইচ্ছে আজ কান্না করে নে। এরপর আর কোনদিন যদি আমি তোকে কান্না করতে দেখেছি তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না বলে দিলাম।”

রায়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে থাকে। কান্না করতে করতেই বলে, ” আপনার ছেলে আমাকে আর কোনদিন ভালোবাসবে না বড়মা। আগে আপনার ছেলের ভালোবাসা অসহ্য লেগেছে আর এখন তার ভালো না বাসা অসহ্য লাগছে।”
” সব ঠিক হয়ে যাবে। ইহানকে বাসায় আসতে দে। পুরুষ মানুষকে ঠিক করে রাখতে নরম না কঠোর হতে হয়৷ আমি সবসময় তোর পাশে আছি, শুধু আমার ছেলেকে একটু ভালোবাসিস। ইহান তোকে খুব ভালোবাসে তাই তো এতকিছু সহ্য করে নিতে পারছে না কষ্ট পাচ্ছে তোর মতোই। ”
” আমি নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারছি না বড়মা,উনি কীভাবে ক্ষমা করবে? তবে গোটা একটা মাস আমার কাছে এক যুগ মনে হয়েছে। উনি দূরে থেকে কেন এত শা*স্তি দিচ্ছে আমাকে? বাসায় এসে কি শা*স্তি দেওয়া যায় না?”
” আসবে,অপেক্ষা কর৷ এসে আর শা*স্তি দেবে না সবকিছু ঠিক করে নেবে দেখিস। এখন ঘুমিয়ে পড় তো, ঘড়িতে দেখ দেড়টা বাজে। না খেয়ে,না ঘুমিয়ে নিজের কী অবস্থা করেছিস দেখেছিস একবারও?”
“হুম ঘুমোবো অনেকদিন ঠিকমতো ঘুমাই না। আপনার ছেলে তো শান্তি দিচ্ছে না আমায়।”
” আমি কিন্তু পুরোনো রায়াকেই চাই। যে মিশুক প্রকৃতির, বেশি কথা বলতে পছন্দ করে, সারাক্ষণ এর ওর পিছনে লেগে থাকে, যার জীবনে মজাটাই সব। কথা দে আমাকে, তুই আর কান্না করবি না।”
” কথা দিলাম বড়মা। খুব বেশি কষ্ট না হলে কান্না করব না। ”
” ঠিক আছে। এবার শুয়ে পড় তো দেখি।”

ইরিনা বেগম রায়াকে শুইয়ে দিয়ে রুমের লাইট বন্ধ করে রুম থেকে বেরিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আর ভাবেন কবে যে সবকিছু ঠিকঠাক হবে!
ইরিনা বেগম চলে গেলেও রায়ার সারা রাত আর ঘুম হয় না। বিছানা এপাশ ওপাশ করতে করতেই সময় কেটে যায়। ফজরের আজান শুনে বিছানা ছেড়ে উঠে ওজু করে নামাজটা আদায় করতে দাঁড়িয়ে যায়। সিজদাহ্-তে যেতেই যেন কান্না নির্দ্বিধায় ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। রায়ার ঘুমোতে ঘুমোতে ভোরের আলো ফুটে যায়।
___

দুপুরের রান্না বসিয়েছেন ইরিনা বেগম। এশা রান্নার কাজে সাহায্য করছে। ইরিনা বেগম মাছ ভাজছেন, ইহানের পছন্দের রান্নাগুলো প্রায় সবগুলোই শেষ করেছেন তিনি। রান্নাঘরের একপাশে রাখা ফোনটা বেজে উঠতেই ইরিনা বেগমের মুখে হাসি ফুটে যায়।
এশাকে ডেকে বলেন, ” এশা, মা যাতো দরজা খুলে দিয়ে আয়।”

এশা কলিংবেলের আওয়াজ না পেয়ে জিজ্ঞেস করে, ” কেন? কেউ তো আসেনি। রায়া আপুর মা চলে যাওয়ার পর তো আমি দরজা আটকে দিয়ে এসেছি।”
” খুলে দেখ কে এসেছে।”
” আমি তো কলিংবেলের আওয়াজ শুনলাম না, তুমি শুনেছ?”
” বেশি কথা না বলে যা তো।”
” আচ্ছা যাচ্ছি।” বলেই এশা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খুলে দিতে চলে যায়।

কিছুক্ষণ পর এশা দৌঁড়ে রান্নাঘরে এসে ইরিনা বেগমকে বেশ উচ্ছ্বাসের সাথে বলে, ” মা, ভাইয়া এসেছে। তুমি বুঝলে কী করে?”
” ফোন দিয়েছিল৷ তুই যা তো ছাদ থেকে ধুয়ে দেওয়া কাপড়গুলো নিয়ে আয়। অনেক রোদ বাহিরে। বেশিক্ষণ জামাকাপড় বাহিরে থাকলে রং নষ্ট হয়ে যাবে।”
” আচ্ছা যাচ্ছি।”
ইরিনা বেগম রান্না করতে করতে আল্লাহকে ডাকতে থাকেন। দোয়া করতে থাকেন যেন এবার এতদিন পর ইহান আর রায়ার মাঝে সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। অনেক তো হলো ভুল বুঝে, ইগো নিয়ে, কষ্ট নিয়ে দূরে থাকা৷ ওরা দুজন ভেতরে ভেতরে শক্ত সম্পর্ক তৈরি না করলে যে কেউ এসে তাদের আলাদা করে দিয়ে চলে যাবে।

ইহান রুমে প্রবেশ করে দেখে রায়া তখনো বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। ছোটো বাচ্চা ছেলেমেয়ে যেমন সমস্ত বিছানা দখলে নিয়ে ঘুমোয়, রায়াও ঠিক ওভাবেই ঘুমোচ্ছে। ইহান নিজের ব্যাগটা রেখেই রায়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে মাথার পাশে বসে। প্রায় একমাস পর এই মুখটা সে দেখে মখটা মলিন হয়ে যায় ইহানের। কী অবস্থা হয়েছে রায়ার! এই মেয়েটা রাতে তাকে কল দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছিল। ইহান মনে মনে ভাবতে থাকে এই মেয়েটা কী জানে তার কান্নার আওয়াজ বুকের ভেতরের সবকিছু একদম তছনছ করে দেয়?
ইহান আলতো করে রায়ার গালে ঠোঁট ছুয়ে দেয়। কপালে,মুখে এলিয়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিতেই রায়া চোখ মেলে তাকায়। ইহানকে দেখে তার চোখ দুটো যেন আরও বড় আর গোল হয়ে যায়। চিৎকার দিয়ে বলে, ” আম্মা ভূউউউউউউউউউউউউউত!”
ইহান চকিতে রায়ার মুখ চেপে ধরে নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ইশারায় চুপ করতে বলতেই থাকে।

#চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে