আমি দূর হতে তোমারে দেখেছি পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0
1228

#আমি_দূর_হতে_তোমারে_দেখেছি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৯(অন্তিমপর্ব)

রাইয়ান আর ইহান দুজন অতীতের সবকিছু ভুলে মাঠে বসে গল্প করছে। দুনিয়ার সবকিছু যেন এতদিন পর দুজন ভুলতে বসেছে। রাইয়ান বিদেশে কীভাবে সময় কাটিয়েছে,পড়াশোনা সবকিছু ইহানকে বলতে থাকে। ইহানও রাইয়ানকে তার সবকিছু জানায় বিদেশ থেকে ফিরে কীভাবে রাজনীতিতে এসেছে আবার রায়ার কথা ভেবে ওসব ছেড়ে ব্যবসার কাজে মন দিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

দুজনের কথা বলার সময় ইহানের হঠাৎ মনে পড়ে রায়াকে রিকশায় তুলে দিয়ে সে বলেছিল বাসায় পৌঁছে কল দিতে কিন্তু প্রায় আধাঘণ্টার বেশি হয়ে গেছে রায়া কল দেয় নি। ইহান সাথে সাথে রায়াকে কল দেয় কিন্তু কল রিসিভ হয় না।

ইহানকে চিন্তিত দেখে রাইয়ান বলে,” কী হয়েছে? এমন করছিস কেন?”
” রায়া কল রিসিভ করছে না।”
” বাসায় হয়তো ব্যস্ত আছে।”
” না, আমি আর রায়া বেরিয়েছিলাম একটু আর তখনই তোদের ঝামেলা লাগে। রায়াকে রিকশায় তুলে দিয়ে বলেছিলাম বাড়ি পৌঁছে কল দিতে। ও আমাকে এখনো কোন কল দেয় নি এমনকি কল রিসিভও করছে না।”
” হয়তো….”
” আমার চিন্তা হচ্ছে। চারপাশে শ*ত্রুর তো অভাব নেই তাই না?”
” ওপরে আল্লাহ আছে, তারপর ওর বাবা,ভাই আর স্বামী আছে। কেউ ওর কোন ক্ষতি করতে পারবে না। ”
” চল বাসায় যাই।”
” এখনই?”
” হ্যাঁ, এখানে আমার মন টিকছে না।”
” আমারও একটু কেমন যেন লাগছে। রায়া ঠিক আছে তো!”
” চল তো ভাই প্লিজ।”

ইহান আর রাইয়ান দুজনই বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। দুজনে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাটতে শুরু করে। রাইয়ানের বাইকের কাছে এসে দুজন বাইকে উঠে পড়ে। রাইয়ান ইহানকে বাইকের চাবি দিতে চাইলেও ইহান জানায় এখন সে পিছনে উঠেই যাবে তাই রাইয়ান আর জোর করেনি। দুজন মিনিট দুয়েকের মাঝেই বাসায় পৌঁছে যায়। শামসুজ্জামান সাহেব তখন এশারের নামাজ পড়ে বাসায় আসছিলেন। ইহান আর রাইয়ান দুজনকে একসাথে দেখে যেন ভূত দেখার মতো তাকিয়ে থাকেন তিনি।

“রাইয়ান সেটা খেয়াল করে বলে ওঠে,” কী হয়েছে আব্বু? ভূত দেখেছ নাকি?”

শামসুজ্জামান ধীরে বলে ওঠেন,” ভূত দেখার চেয়েও ভয়ংক**র জিনিস দেখেছি? ”
” কী?”
” ইহান আর রাইয়ান একসাথে!”
” এখন ভালো লাগছে?”
” সেটা পরের বিষয়। কীভাবে কী হলো? আমার দুই ছেলে একসাথে!”

ইহান এতক্ষণ কোন কথা বলেনি এতক্ষণ। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে বলে ওঠে,” কাকা, বাড়িতে আসেন। এখানে আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। তখন রায়াকে রিকশায় তুলে দিয়ে বলেছিলাম বাসায় এসে জানাতে কিন্তু সে জানায়নি এমনকি আমার কল ও রিসিভ করছে না। ও ঠিক আছে কি না কে জানে!”

মেয়ের জন্য ইহানের এমন চিন্তা দেখে শান্তি অনুভব করেন শামসুজ্জামান সাহেব। তিনি ইহানকে বলেন,” এত চিন্তার কিছু নেই। রায়া হয়তো ভুলে গিয়েছে কল করতে।”
” দুই মিনিট আগে বলে দেওয়া কথা ভুলে যায় কীভাবে ও?”
” এই ইহান, এটার জন্য তুই যদি আমার বোনকে রাগ দেখিয়েছিস তাহলে কিন্তু তোর অবস্থা খারাপ করে দেব বলে দিলাম।” রাইয়ানের কথা শামসুজ্জামান এবার শব্দ করেই হেসে ফেলেন৷ এতদিন পর তিনি দুজনকে এই অবস্থায় দেখছেন।

ইহানকে শান্ত করতে তিনি বলেন,” আমি যখন নামাজে যাই তখন রায়া রিকশা থেকে নেমেছে। রায়া আমাদের বাড়িতেই আছে। আমি ওকে ওর মায়ের কাছে রেখে এসেছি। বলেছিলাম ইহান বাড়ি ফিরলে বাসায় নিয়ে যাবে।”

ইহান এতক্ষণে শান্ত হয় এটা ভেবে যে রায়া ঠিক আছে। বাহিরে তিনজনের কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয়। স্টলে হয়ে যাওয়া ঘটনাটা দুজনে জানায় শামসুজ্জামানকে। তিনিও বলেন এবার তিনিই সব দেখে নেবেন।

তিনজনে কথা শেষ করে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। রায়া আর তার মা রাবেয়া বেগম তখন রান্নাঘরে। রাবেয়া বেগম রুটি বানাচ্ছেন আর রায়া মায়ের সাথেই রান্নাঘরে বসে আছে। রায়া মাঝে মাঝে চুলায় বসানো গরুর মাংস নেড়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে রাবেয়া বেগম এশা আর ইরিনা বেগমকে বলে এসেছেন রাতে এখানে খাওয়ার কথা। রায়ার কথা শুনে রাবেয়া বেগম মনে মনে আশার আলো সঞ্চার করেছিলেন এটা ভেবে যে আজ হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ইহান আর রাইয়ান হয়তো আবার সেই ছোটবেলার মতো এক হবে।

রান্না করতে করতে মা-মেয়ে গল্প করছিলেন এমন সময় তিনজনকে একসাথে দেখে রাবেয়া বেগম রায়াকে ডাকতে থাকে। রায়া সামনে তাকিয়ে দেখে রাইয়ান আর ইহান একসাথে। রায়া কেমন একপলকে চেয়ে থেকে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। রাইয়ান রান্নাঘরের দিকে আসতে থাকে। ইহানও রাইয়ানের পিছু পিছু সেদিকেই আসছে। শামসুজ্জামান সোফায় গিয়ে বসেন৷ তিনি আজ শুধু সবার একত্র হওয়াটা দেখবেন।

রাইয়ান ধীরপায়ে রায়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রায়ার চোখ টলমল করছে। এতগুলো মাস পর সে তার ভাইয়ের মুখোমুখি হয়েছে। এতগুলো দিন সে লুকিয়ে লুকিয়ে ভাইকে দেখেছে আর কান্না করেছে। ভেবেছে কাছে থেকে দূরত্ব বাড়ানোর চেয়ে দূরে থাকাই তো ভালো ছিল।

রাইয়ান কিছু বলছে না। রায়া আর ওভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে বলে ওঠে,” ভাইয়া!”

রাইয়ান তার বোনকে এক ঝটকায় নিজের বুকে নিয়ে নেয়। রায়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে থাকে। রাইয়ান নিজেও কান্না করছে। রাবেয়া বেগম আর ইহানের চোখ টলমল করছে কিন্তু শামসুজ্জামানের মুখে হাসি লেগে আছে। ছেলে-মেয়ে দুজনকে এক হতে দেখে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন শামসুজ্জামান সাহেব।

রায়া ভাইয়ের বুক থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নাক টানতে টানতে বলে,” এতদিনে আমার কাছে আসার কথা মনে পড়লো?”

দুই হাত দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে বলে ওঠে,” আমি তো দূরের মানুষ। দূরের মানুষ দূরে থাকবে না তো কোথায় থাকবে?”
” তুমি দূরের মানুষ? ”
” কাছের মানুষ হয়ে উঠতে পেরেছি কি?”
” ভাইয়া হও তুমি আমার।”

দুই ভাইবোনের মান অভিমান চলতে থাকে। রায়া হঠাৎ খেয়াল করে রাইয়ানের নাকের পাশে কেটে গেছে। ড্রয়িংরুমে রাখা ফাস্টএইড বক্স নিয়ে এসে রাইয়ানকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে কথা শোনাতে থাকে। রাইয়ান ইহানের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। মেয়েরা বুঝি তার ব্যক্তিগত মানুষদের প্রতি এরকমই যত্নশীল হয়!

রায়ার শাসনের রাইয়ান হাসতে হাসতে ইহানকে উদ্দেশ্য করে বলে,” ইহান, তোর মনে হচ্ছে না রায়া ছোট হয়ে আমাকে একটু বেশিই শাসন করছে?”

ইহান সিরিয়াস হওয়ার অভিনয় করে বলে ওঠে,” একদম ঠিক করছে। আমার রায়া ভুল কিছু করতেই পারে না। ও যা করবে সেটাই ঠিক।”
” বউয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলা শিখে গেছিস!”

মুহুর্তের মধ্যে এশা এবং ইরিনা বেগম বাসায় প্রবেশ করে। রায়া আর রাইয়ানের এমন হাসিখুশি মুহুর্ত দেখে দুজন বেশ অবাক হয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুই ভাইবোনের কীর্তি দেখছে। বিষয়টা কেমন যেন আশ্চর্যজনক লাগছে তাদের কাছে।

ইরিনা বেগমকে দেখতে পেয়েই রাইয়ান বলে ওঠে,” বড়মা আপনার ছেলে কিন্তু সব বিষয়ে বউকে সাপোর্ট করা শিখে গেছে।”

রাইয়ানের মুখে ‘বড়মা’ ডাক শুনে ইরিনা বেগম হেসে দুজনের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলেন,” আমিও তো আমার ছেলের বউয়ের সাপোর্টে আছি। কি গো রাবেয়া তুমি নেই?”
” হ্যাঁ হ্যাঁ আমিও রায়ার দলে৷ ”

সবার কথা শুনে রায়া হেসে ফেলে। আজ তার ঈদের মতো আনন্দ লাগছে। সবকিছু কতদিন পর ঠিক হলো! ধৈর্য্য ধরে থাকলে আল্লাহ কখনো নিরাশ করেন না।

সবার এত হাসিখুশি মুহুর্ত দেখে এশা বলে ওঠে,” এত ভালো একটা মুহুর্ত ক্যাপচার করে রাখলে কিন্তু মন্দ হতো না। আজকের দিনটা বারবার ফিরে তো আসবে না, ফ্রেমবন্দী করে রাখলে মাঝেমাঝে অনুভব করা যেত।”

শামসুজ্জামান সাহেবও বলে ওঠেন,” হ্যাঁ সবাই এদিকে এসো। আজকে একটা ছবি ওঠা যাক।”

সবাই সানন্দে একসাথে হতে এগিয়ে আসে। ইহান ছবি তোলার প্রস্তুতি নিয়ে বলে ওঠে,” সবাই ওখানে বসো, এশা আর রাইয়ান নিচে বসবি। আর সবাই সোফায় বসুক। আমি ছবি তুলে দিচ্ছি।”

রায়া ইহানের দিকে এগিয়ে এসে হাত ধরে টেনে সবার কাছে নিয়ে এসে বলে,” আজ কারও দূরে থাকা চলবে না। ফোন সামনে রেখে টাইমার সেট করলেই হয়ে যাবে। ”
” আমি দূর থেকে ভালো করে দেখেশুনে ছবিটা তুলে দেই, পরবর্তী ছবিতে আমি আসব।”
” দূর থেকে দেখতে হবে না, আসুন তো।”

রাইয়ান নিজের ফোনটা সামনে রেখে ইহানের হাত ধরে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে দেয়। রায়া টাইমার সেট করে মা আর বাবার মাঝে গিয়ে বসে পড়ে। সাথে সাথে দারুণ একটি ক্লিক হয়ে যায়।
________

রাত দশটা। রায়া বেলকনিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চাঁদ দেখছে। ইহান এতক্ষণে বেলকনিতে পা রাখে। হাতে ধোয়া ওঠা নুডলসের বাটি। রায়ার পাশের চেয়ারটায় বসে রায়ার হাতে নুডলসের বাটি ধরিয়ে দিয়ে বলে,” নে, খেয়ে নে। বরের হাতে নুডলস না খেয়ে তোর ভালোই লাগছিল না। এবার খেয়ে নে।”

রায়া বাটিটা ইহানকে ফিরিয়ে দিয়ে বলে,” আপনি খাইয়ে দেন।”
” রান্না করে নিয়ে আসলাম এখন আবার খাইয়েও দিতে হবে?”
” হ্যাঁ, খাইয়ে দিতেই হবে। দিবেন না?”
” দিচ্ছি।” বলেই ইহান রায়াকে খাইয়ে দিতে শুরু করে। খানিকবাদে ইহানের হাত থেকে বাটিটা নিয়ে রায়া ইহানকেও খাইয়ে দেয়।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে দুজন কিছুক্ষণ চন্দ্রবিলাস করে রুমে আসে। হঠাৎ মেসেঞ্জারে মেসেজ আসার শব্দ পেয়ে রায়া ফোনটা হাতে নেয়৷ রাইয়ান তার ফোনে তোলা ছবিগুলো পাঠিয়েছে। সাথে ছোট করে একটা মেসেজ লেখা,” ছবিগুলো সুন্দর না? আমার বোনের পছন্দের মানুষটাও আসলেই সুন্দর। আমিই শুধু দেরিতে চিনলাম। আমার বোনটা সবসময় ভালো থাকুক তার মানুষটাকে নিয়ে।”
রাইয়ানের মেসেজ দেখে মুচকি হাসে রায়া। মেসেজের উত্তর হিসেবে ” ভালোবাসি ভাইয়া।” লিখে পাঠিয়ে দেয়।

ইহান শুয়ে শুয়ে ফোন চাপছিল। রায়া তার দিকে এগিয়ে এসে রাইয়ানের পাঠানো ছবিগুলো ইহানকে দেখিয়ে বলে, ” কতশত মানুষের সুখ, ভালোবাসা আমি দূর হতে দেখেছি আর ভেবেছি এতকিছু কি আমি কখনো পাব? অতঃপর আজ আমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবতী। আমার ভাগ্যকে আমারই কেমন হিংসে হচ্ছে। এত ভাগ্যবতী আমি! ”

ইহান মুচকি হেসে রায়াকে বুকে জড়িয়ে নেয়। পরম যত্ন আর ভালোবাসায় ইহানের বুকে মাথা রাখে রায়া। এ যেন একপ্রকার স্বর্গসুখ।

~ সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে