#আমি_দূর_হতে_তোমারে_দেখেছি
#তানিয়া_মাহি(নীরু)
#পর্ব_১৫
হাসপাতাল থেকে সবার বাড়ি ফিরতে ফিরতে নয়টা বেজে যায়। ইহান হাসপাতালের গেইটে গাড়ি নিয়ে সবার জন্য অপেক্ষা করছিল। সেখান থেকে গাড়ি করে নয়টার মধ্যেই বাড়ি ফিরে যায়। রায়া মা-বাবার সাথে নিজেদের বাড়িতেই যাবে তখন ইহান তাকে ডাক দেয়।
রায়া মা-বাবাকে বাড়ির ভেতরে যেতে বলে এগিয়ে যেতেই বলে, ” আমি গিয়ে ফ্রেশ হই, মাথাটা খুব ধরেছে৷ গোসল দিলে হয়তো একটু ভালো লাগবে। তুই কাকার সাথেই থাক একটু।”
” আচ্ছা ঠিক আছে। খেয়ে নিয়েন আপনি।”
” ঠিক আছে।”
ইহান বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। গেইটের ভেতরে প্রবেশ করলে রায়া নিজেও এবার বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।
বিকেল প্রায় চারটা, রায়া গোসল দিয়ে বের হয়। সকালবেলা বাড়িতে গিয়েছিল। সেখানেই সারাক্ষণ থেকে দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে ঘুমিয়েছিল।
রায়া ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে খেয়াল করে ইহান আগের মতই অন্যদিকে হয়ে শুয়ে আছে। রায়া চুল উঠতে মুছতে ইহানের দিকে যায়। ইহান যে দিকে মুখ করে শুয়ে আছে রায়া সেখানে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ইহানের তখনো চোখ পিটপিট করছে। ইহানের চোখ পিটপিট করা দেখে রায়া হেসে ফেলে। ইহান অন্যপাশ হলে রায়া টেনে তার পাশে করে ইহানকে। ইহান তখনও চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। রায়া তখন ইহানের মুখের ওপর চুল ঝারলে ইহানের মুখে ছিটেফোঁটা পানি পরে।
ইহান চোখ খুলেই বলে,” কী হচ্ছে?”
” ঘুমের অভিনয় বন্ধ করা হচ্ছে।”
” কীসের অভিনয়? আমি ঘুমোচ্ছি, ঘুমোতে দে।”
” যদি ঘুমোতে না দেই?”
” নিজের ঘুম তো ঠিকই হয়েছে তাহলে আমাকে কেন ঘুমোতে দিবি না? যা এখান থেকে।”
” কোথায় যাব?”
” যেখানে ইচ্ছে।”
রায়া নিজের মনে একবার হেসে বলে,” আমি শাওনের কথা মুখে আনলে আপনি কি আগের মতই আমাকে চুমু খাবেন?”
ইহান ভ্রু কুচকে রায়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার অন্যপাশে ফিরে বলে,” দুপুর থেকে অপেক্ষা করছিলাম আর আপনার আসার কোন নামই নেই।”
রায়া এবার বিছানায় উঠে গিয়ে ইহানের কাছে বসে। ইহানের মাথা নিজের কোলের ওপর নিয়ে বলে,” খাওয়া দাওয়া করে ওখানেই ঘুমিয়ে গেছিলাম। না ঘুমালে তো চলেই আসতাম তাই না? আর তাছাড়া একটু থাকছি তাতে কী হয়েছে?”
” আপনার বর যে একা একা ছিল, আপনাকে মিস করছিল সে বেলায়?”
” আমিও মিস করছিলাম ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে। অনেক মিস করেছি।”
” ওহ আচ্ছা।”
রায়া ইহানের রাগ ভাঙাতে ব্যস্ত। এমন সময় এশা এসে দরজায় নক করে। রায়া তাকে আসতে বললে এশা ভেতরে এসে বলে,” রাইয়ান ভাইয়া এসেছে।”
এশার কথায় রায়ার মুখে যেন আষাঢ়ের মেঘ জমে। রায়া পা নামিয়ে বসে কিছু একটা ভেবে বলে,” ওর বউও এসেছে?”
” কই? শুধু ভাইয়াকেই দেখলাম গাড়ি থেকে নামতে। আশেপাশে বা সাথে কাউকে দেখি নি।”
ইহান বিছানা ছেড়ে উঠে বসে রায়াকে উদ্দেশ্য করে বলে,” যা দেখ গিয়ে,তোর গুণধর ভাই এসেছে বলে কথা। না জানি এবার কী কী যে করবে!”
এশা চলে যাওয়ার আগে বলে,” আমি গেলাম, দেখ তোমরা কী করবে!”
এশা চলে গেলে রায়া ইহানকে বলে,” আমার যেতে ইচ্ছে করছে আবার ইচ্ছে করছেও না। অনেকদিন পর দেশে এসেছে ভাইয়া তার জন্য দেখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কিছু কারণে সামনে যেতে ভয় লাগছে।”
ইহান রায়ার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখে চোখ রেখে বলে,” আমি নিশ্চয়ই তোকে ভরসা করতে পারি তাই না? তুই আমাকে ভরসা করতে পারবি না? আমি বেশ বুঝতে পেরেছি ওর আমাকে সহ্য করতে না পারাটা আমাদের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে। তোকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করবে আমি তোর জন্য ঠিক না কিন্তু তুই তো জানিস তাই না আমি তোকে ঠিক কতটা ভালোবাসি!”
রায়া মুচকি হেসে ইহানের গালে হাত রেখে বলে,” বলতে গেলে আমি আপনার প্রথম ভালোবাসা, আমার হয়তো অন্যকেউ ছিল তবে সেটাকে ভালোবাসা বলব নাকি মন্দবাসা বলব আমি জানি না। সেসব কথা বাদ দেই। আমি এখন এবং ভবিষ্যতে শুধুমাত্র আপনাকেই চাইব। আপনাকে আমি কিছুতেই হারাতে পারব না।”
” রাইয়ান কোন ক্ষ*তি করবে না তো রায়া?”
” সুযোগটাই পাবে না।”
ইহান আলতো করে রায়াকে জড়িয়ে ধরে। রায়াকে বুকে জড়িয়ে নিয়েই বলতে থাকে,” ছোটবেলা থেকে রাইয়ানের সাথে আমার যে একটা রেশারেশি সেটা তো তুই জানিস। এখনও যদি ওসব মনে করে কিছু করতে চায় আমি ওকে করতে দেব না।”
” কিচ্ছু হবে না, আপনি চিন্তা করবেন না। ভাই হয়ে আর যাই হোক নিজের বোনের সংসার নিশ্চয়ই ভাঙবে না।”
” সেরকম হলে আমার চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবে না।”
রায়া তৈরি হয়ে নিলে ইহান আর রায়া দুজন একসাথে বাড়ি থেকে বের হয়। ইহান নিজের কাজের উদ্দেশ্যে আর রায়া ইহানকে বিদায় দিয়ে নিজের বাড়িতে যায়। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই বাবা আর ভাইয়ের কথা শুনতে পায় রায়া। রাবেয়া বেগমকে রান্নাঘর থেকে বের হতে দেখে রায়া আগে সেদিকে এগিয়ে যায়।
মেয়েকে দেখেই রাবেয়া বেগম বলে ওঠেন, ” রাইয়ানের সাথে দেখা হয়েছে তোর?”
রায়া এদিক ওদিক দেখে বলে,” না হয়নি। তোমার ছেলের বিদেশী বউ কোথায়? দেখছি না কেন?”
রাবেয়া বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,” এখন সে বাসায় ফিরে বলছে বিয়ে নাকি করেনি।”
” কী বলো? সেদিন তো সে নিজেই কল করে বলল ওখানকার একজনকে বিয়ে করে নিয়েছে।”
” বিয়েটা নাকি শেষ পর্যন্ত হয়নি। মেয়ে ধর্ম পরিবর্তন করতে রাজি হয়নি আর ধর্ম পরিবর্তন না করলে তো বিয়ে হবে না সেজন্য বিয়েটাও হয়নি। ”
” ওহ আচ্ছা তাই বলো। বিয়ে হয়নি এ কথা এতদিন জানায়নি কেন? আর তোমার ছেলে কি একেবারে চলে এসেছে এখানে?”
” বলছে তো তাই। তোর আব্বুর সাথে কথা বলছে, সে এখন রাজনীতিতে যোগ দেবে।”
” মুখের কথা নাকি রাজনীতি?”
” সেসব ওরা বাবা-ছেলে বুঝে নিবে। তুই চল, রুমে চল দেখা করবি।”
” হুম চলো।”
রাবেয়া বেগমের পিছে পিছে রায়া নিজেও রুমে প্রবেশ করে। রায়াকে দেখেই রাইয়ানের মুখে হাসি ফুটে যায়। বসা থেকে উঠে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরে। খানিকক্ষণ পর রায়াকে ছেড়ে বলে,” কেমন আছিস বোন?”
” ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
” আমিও ভালো আছি।”
” এতকিছুর পরও যে ভালো আছিস, এটা শুনে ভালো লাগছে। আমার বোনটা বড় হয়ে গেছে। কষ্ট লুকাতে শিখে গেছে।”
” বড় হয়েছি ঠিক আছে কিন্তু কষ্ট নেই তো, লুকোবো কেন? আমি কষ্ট লুকোনোর মেয়ে আমি নই ভাইয়া, সেটা তুমি ভালোভাবেই জানো।”
” আমি এখন এসে গেছি না? আমার বোনের আর কোন কষ্ট থাকতে দেব না।”
” আমার এমনিতেও কোন কষ্ট নেই ভাইয়া, আমাকে নিয়ে তোমার কোন চিন্তা করতে হবে না।”
” আমি সব জানি রায়া। তুই যতই বলিস তোর কোন কষ্ট নেই, আমি তোর ভাই আমি জানি তুই কোন পরিস্থিতিতে আছিস। ইহানের সাথে তোর বেশিদিন থাকতে হবে না। তুই আজকের থেকে আর ওই বাড়িতে যাবি না। আমি যেতে দেব না আর তোকে।”
রায়ার এতক্ষণে খারাপ লাগতে শুরু করে। রাইয়ানের এমন কথা তার মোটেও আর ভালো লাগছে না। রাইয়ানের কথার জবাব না দিয়ে বাবার দিকে তাকায়। শামসুজ্জামান ততক্ষণে মেঝের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে রাগে ফুসছেন ছেলের কথা শুনে। এক পর্যায়ে তিনি আর চুপ থাকতে না পেরে রাবেয়া বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ” রাবেয়া, তোমার ছেলেকে এবার থামতে বলো। সে রাজনীতিতে আসতে চেয়েছে আমি মেনে নিয়েছি। প্রয়োজনে আমি অবসরে গিয়ে তাকে আমার জায়গায় বসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব। আমার মেয়ের সংসার নিয়ে তার ভাবতে হবে না। আমি ভেবেচিন্তে আমার মেয়েকে আমি ইহানের হাতে তুলে দিয়েছি। আমার মেয়ে সুখী, তার ব্যাপারে আর কিছু আমাদের কারও ভাবতে হবে না। রায়ার জন্য একমাত্র আল্লাহ আর তারপর ওর স্বামীই যথেষ্ঠ।”
রাইয়ান বাবার দিকে এগিয়ে এসে বলে,” ও ছোটবেলা থেকে আমার সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। তুমি আমার চেয়ে ওকে বেশি ভালোবাসো। আমার মায়ের অবস্থা জানি না। আমার বোনটা একমাত্র ছিল যে কি না তোমাদের সবার বাহিরে এসে আমাকে সাপোর্ট করত, তাকেও ওই ইহান আমার কাছে থেকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমি সেটা কিছুতেই হতে দেব না। ও আমার বোনকে ভালো রাখবে না। ছোটবেলা থেকে আমার সাথে যে প্রতিযোগিতা করছে সেটায় জেতার জন্য আমার বোনকে বিয়ে করেছে। তোমরা কেউ ইহানের আসল রূপটা দেখনি।”
শামসুজ্জামান বলে ওঠেন,” নিজে যা বুঝবে সবসময় সেটা হয় না বা হবেও না। দেশে এসেছ কোন বিপদ না ডেকে ভালোভাবে থাকো। আমি তোমার বাবা, তোমার পাশে আছি। শুধু রায়াকে নিয়ে তোমার চিন্তা বাদ দাও।”
রাইয়ান চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে,” রায়া আমার বোন হয় বাবা। ওর ব্যাপারে আমি একশোবার ভাববো। ওর ওপর আমার অধিকার আছে।”
রায়া এবার রাইয়ানের দিকে এগিয়ে গিয়ে তার বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে, ” ভাইয়া হও তুমি আমার। আমার ওপর তোমার অধিকার আছে কিন্তু আমার সংসারের ওপর তোমার কোন অধিকার নেই। আমার সংসার বা ইহানের দিকে নজর দিলে আমি ভুলে যাব তুমি আমার ভাইয়া হও। আমি বারবার তোমাকে বলছি যে আমি ইহানের সাথে ভালো আছি। আজকের কথার পরও যদি আমার সংসারের দিকে আঙুল তুলো তাহলে আমি কিন্তু তোমার হাত কে*টে নেব বলে রাখলাম।”
#চলবে…….