#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_১৬
#সুমাইয়া_মনি।
নতুন এক সকালের সূচনা হল। আগের দিনের মতো নবনী রেডি হয়ে নাস্তা করে বের হয় কলেজের উদ্দেশ্যে। গেট দিয়ে বের হতেই একজন ডেলিভারি বয়কে নিভ্রর বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে দেখে। বুঝতে পারে খাবার দিতে এসেছে। সেদিনের পর থেকে নিভ্রকে খাবার দেওয়া তো দূর, নিলুফা বেগম তার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে বোধ করছে না। নবনী পাত্তা দেয় না। নিজের মতো হেঁটে চলেছে। কিছু দূর আসতেই রিকশা পেয়ে যায়। চলে আসে কলেজে। আজকের মতো ক্লাস রুমে এসে বই পড়তে আরম্ভ করে। মায়া তার পাশেই মুখ মলিন করে বসে আছে। দিন দিন নবনীকে নতুন রূপে উপস্থিত হতে দেখছে সে। অতি বকবক করা মেয়েটি, আজ নিরব! ক্লেশ অনুভব হয় তার। নবনীর আচরণ তাকে প্রচণ্ড ভাবাচ্ছে। ঘন্টা পড়ে। ক্লাস আরম্ভ হয়।
ঘন্টাখানিক পর তিনটি ক্লাস শেষ হয়। নবনী পরের ক্লাসটি করে না। তার আগেই মায়াকে কিছু না বলে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে লাইব্রেরির দিকে হাঁটা ধরে। তখনই সামনে নিভ্রকে দেখতে পায়। গতিপথ থেমে যায় তার। বুকের পুরনো ক্ষত গুলো ধকধক করে উঠে। নিভ্র একজন টিচারের সঙ্গে কথা বলতে। মন ও নিজেকে স্থির করে। হেরে গেলে চলবে না। নিজেকে শক্ত করতেই হবে।
হাতের মুঠ শক্ত করে আগের ন্যায় পা চালায়। দ্রুত তাদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। নিভ্র নবনীকে দেখেছে। একবার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নজর সরিয়ে ফেলে।
লাইব্রেরিতে এসে একটি সিটে বসে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। কষ্টে কান্না পাচ্ছে তার। কিন্তু নাহ! আর সে নরম হবে না। কয়েক বার বড়ো নিশ্বাস নিয়ে একটি বই পড়তে আরম্ভ করে। লাইব্রেরিতে তেমন কেউ নেই।
হঠাৎ করে সেদিনের সেই পাঁচজন মেয়ে লাইব্রেরিতে উপস্থিত হয়। যাদেরকে নিভ্রর থেকে দূরে থাকার ওয়ার্নিং দিয়েছিল নবনী। তারা নবনীকে একা পেয়ে ঘিরে দাঁড়ায়। নবনী মুখ তুলে তাঁদের দিকে তাকায়। চিনতে তার বেগ পেতে হয় না। তারা সবাই নবনীর এক বেচ সিনিয়র। নজর বইয়ের দিকে তাক করে সে ফের পড়তে আরম্ভ করে।
একজন মেয়ে নবনীর কাছ থেকে বই ছিনিয়ে নিয়ে সজোরে টেবিলের উপর রাখে। বলে,
-“কিরে তোর পুলিশ আশিক এসেছে। আর তুই এখানে বসে বই পড়ছিস। যা যা তার কাছে যা।”
নবনীর মুখ থমথমে হয়ে যায়। বুঝতে পারে সেদিনের সেই কথাটির ভিত্তি করে আজ তাকে এভাবে বলছে। নবনী নরম ভঙ্গিতে তাকিয়ে বলে,
-“সে আমার আশিক না। আর সেদিনের জন্য আমি দুঃখিত আপু। দয়া করে আমাকে বই পড়তে দিন।”
-“তুই বই পড়লে, তোর আসিক তো সেখান থেকে চলে যাবে। তখন কী হবে?” অন্য একজন মেয়ে বলে।
-“আশিকের সঙ্গে মনে হচ্ছে ঝগড়া হয়েছে। তাই তো বই পড়তে ব্যস্ত তার আশিকি।” অন্য একজন মেয়েকে চোখ টিপ মেরে করে মেয়েটি।
নবনী এবার রেগে যায়। মেকি রাগ নিয়ে বলে,
-“বার বার আশিক বলবেন না। সে আমার আশিক নয় আপু।”
-“এই তোর রাগ হচ্ছে। রাগ দেখাবো তো আমরা।” আঙ্গুল তুলে বলে একটি মেয়ে।
-“এভাবে বললে নিশ্চয় যে কারো রাগ উঠবে।” নবনী বলে।
-“সেদিন তোকে কিছু বলিনি। আজ তোকে ছোট একটা শিক্ষা দিবো আমাদের ওয়ার্নিং দেওয়ার জন্য।” রেগে বলে মেয়েটি।
নবনী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয় তাঁদের দিকে। আগের দিনের মতো হলে চওড়া জবাব দিয়ে দিতো তাঁদের। কিন্তু এখন আর তার কারো উপর রাগ বা কথা বলার ইচ্ছে নেই। সব যেন ভেতর থেকে মরে পঁচে গেছে। জীবিত হওয়া সুনিশ্চিত। আচমকা পিছন থেকে একটি ছেলের কঠোর কন্ঠের স্বর ভেসে আসে। সকলের নজর পেছনের দিকে অচেনা ছেলেটির ওপর। নবনী নিজেও সেদিকে তাকায় ।
-“এখানে বই-পুস্তক ব্যতীত অন্য কোনো বিষয়ের শিক্ষা দেওয়া হয়না। আর এটা লাইব্রেরি। লিভ!”
ছেলেটির কথা শুনে মেয়েরা খানিকটা ভয় পায়। দেরি না করে দ্রুত লাইব্রেরি ত্যাগ করে তারা। নবনী ছেলেটির দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায়। ছেলেটির নজর এখন নবনীর ওপর। দেখতে বেশ সুদর্শন সে। শ্যামলা গায়ের রং। কালো শার্ট-প্যান্ট পরিধান, শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা। ডান হাতে তার কালো ঘড়ি। বাম হাতে একটি বই।
বুকশেলফের পেছনে থাকায় কেউ তাকে খেয়াল করেনি। সে সেখানে দাঁড়িয়ে বই ঘাটছিল। ছেলেটি হাসি মুখে হেঁটে নবনীর সামনে এসে দাঁড়ায়। ততক্ষণে নবনী নজর সরিয়ে নিয়ে বই পড়ার প্রস্তুতি নেয়। ছেলেটি হাসি মুখে নবনীর উদ্দেশ্যে বলে,
-“এখানে বসতে পারি?”
নবনী না তাকিয়েই কোমল স্বরে বলে,
-“জি!”
ছেলেটি চেয়ার টেনে বসে বইটি টেবিলের উপর রাখে। নবনী কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে। একজন অচেনা অজানা ছেলের সামনে বসতে বিব্রত লাগছে। চোখ তুলে তাকায় না, বইয়ের দিকে তাকিয়ে রয় সে। ছেলেটি পুনরায় মৃদুস্বরে বলে,
-“আপনাকে কী তারা রোজ ডিসটার্ব করে?”
-“নাহ!” ছোট করে উত্তর দেয়।
-“আপনারা হয়তো আমাকে দেখেন নি। আমি পেছন দিকটায় ছিলাম। আপনাদের কথপোকথনের লাস্টের দিকে সামনে আসি। একটি মেয়ের কথা শুনতে পাই। তারা আপনাকে ডিসটার্ব করেছে দেখে তাদের চলে যেতে বলেছি। ভুল করেছি কি?” কথাটা শেষ করেই ভ্রু জোড়া হালকা উঁচু করে সে।
নবনী তার দিকে তাকিয়ে জোর পূর্বক হেসে বলে,
-“নাহ! আপনি ঠিক করেছেন। লাইব্রেরিতে বসে কথা না বলাই ভালো।”
-“অবশ্য! কেউ নেই এখানে। এই জন্য তারা বেশিই সুযোগ পেয়েছে। বাই দ্যা ওয়ে, আমি আদি মাহমুদ। আপনি?”
-“নবনী।”
-“শুধু?”
-“হুম।”
-“কোন ইয়ার?”
-“ইন্টার ফাস্ট ইয়ার।”
-“এখানেই থাকেন?”
-“জি সামনের কলোনিতে।”
-“নাম?”
-“বলতে ইচ্ছুক নই!”
-“আপনি মেবি আমার সঙ্গে কথা বলতে বিব্রত হচ্ছেন বা বিরক্ত?”
-“জি!”
-“আপনি পড়ুন। আমি উঠি। আল্লাহ হাফেজ! ”
-“জি, আসসালামু আলাইকুম!”
আদি মুচকি হেসে সালামের উত্তর নিয়ে লাইব্রেরি ত্যাগ করে। নবনী বই পড়তে আরম্ভ করে। আদি যেতেই মায়া সেখানে উপস্থিত হয়। চট করে বসেই তীব্র গতিতে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় নবনীর পানে,
-“ছেলেটি কে ছিল? তুই তাকে চিনিস?”
নবনী বিরক্ত নিয়ে মুখ তুলে তাকায়। বলে,
-“নিশ্চয় তুই এতক্ষণ বাহিরে দাঁড়িয়ে দেখেছিস আমার সঙ্গে তাকে কথা বলতে?”
-“তোর অনুমান সঠিক! আমি তোকে লাইব্রেরিতে খুঁজতে এসে দেখি তুই তার সঙ্গে কথা বলছিস।”
নবনী সরু নিশ্বাস ফেলে বলে,
-“আদি মাহমুদ তার নাম। বাকি ডিটেইলস জানি না। আর আমি তাকে চিনিও না।”
-“তাহলে কথা বললি যে?”
ছোট্ট করে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মায়াকে বলে সে। মায়া রাগ নিয়ে বলে,
-“সাহস তো কম না ওদের। প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে কমপ্লেইন করব।”
-“অযথা ঝামেলায় পরতে চাই না। বাদ দে!”
-“ঝামেলা কিসের? আমি তো…..”
-“স্টপ থাক, আমি বই পড়বো এখন।” বাকি কথা বলার আগেই মায়াকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠে নবনী।
মায়া চুপ করে চেয়ে রয় নবনীর মুখের দিকে। সে ভাবছে, যে মেয়ে নিজে থেকেই ঝামেলা ঘাঁড়ে করে নিয়ে আসতো, আজ সে নিজেই তার থেকে দূরে থাকতে চাইছে। বড়োই ভাববার বিষয়!
_____________________
বিকালে নবনী নিয়ানকে নিয়ে মার্কেট থেকে বাড়িতে ফিরছিল। কলোনির ছোট ছেলেরা তখন ক্রিকেট খেলছিল। কিছুটা সামনে এগোতেই অনিচ্ছাকৃত ভাবে আচমকাই একটি বল এসে নবনীর বাঁ পায়ের হাঁটুতে লাগে।
সেখানে উপস্থিত সবার নজর এখন নবনীর ওপর। ছেলে গুলো ভয় পেয়ে যায়। কারণ নবনীর রাগের ধারণা তাঁদের আছে। নবনী তাদের দিকে শান্ত চোখে তাকায়। বল এতোটা জোরেও লাগেনি। তেমন ব্যথা লাগেনি তার। নিয়ান রাগে ফুঁসছে। কেননা তার বড়ো বোনের গায়ে তারা বল মেরেছে। হোক সেটা অনিচ্ছাকৃত ভাবে।
রেগেমেগে বলে,
-“আপু বল নিয়ে নেও, ওদের দিবে না।”
নবনী নিয়ানের কথা শুনে কিছু বলে না। বল হাতে উঠিয়ে নিয়ানের হাত ধরে হেঁটে একটি ছেলের সামনে এসে বলটি তার হাতের মধ্যে দিয়ে সোজা হাঁটা ধরল। অবাক হয়ে তাকিয়ে রয় সবাই। নবনীর এমন আচরণ মেনে নিতে পারছে না তারা। নিয়ান নিজেও। কিন্তু পরক্ষণে নিয়ার তার বোনের পরিবর্তন কথা মনে পড়ে। মুখ কালো হয়ে যায় তার।
এই অবাক দৃশ্য আরো একজন ব্যক্তি পেছন দাঁড়িয়ে দেখছিল। ব্যক্তিটি ছিল নিভ্র। টমিকে নিয়ে পাশের পার্কে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়েছিল। কেননা ক’দিন যাবত টমি অদ্ভুত আচরণ করছে। ঠিক মতো খাচ্ছে না। ডাকাডাকিও করছে না। সেই জন্য নিভ্র টমিকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিল। ফিরে আসার সময় মাঝ পথে নবনী ও নিয়ানকে হেঁটে যেতে দেখে। সে বলের ঘটনাটিও দেখেছিল। কিন্তু নবনীর এমন নরমাল আচরণ দেখে সে আশ্চর্য! সে ভেবেছিল এই বুঝি ছেলেগুলোর ওপর চিল্লাপাল্লা আরম্ভ করবে। কিন্তু না! উল্টো তাকে বিস্মিত করে দেয়।
.
বাড়িতে ফিরে নিয়ানের জন্য কিনে আনা গেঞ্জিপ্যান্ট গুলো নিলুফা বেগমকে দেখায়। তারপর সে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। নবনী চলে যাওয়ার পর নিয়ান কিছুক্ষণ আগের ঘটনা তার কাছে পেশ করে। নিলুফা বেগম শুনে হতাশাজনিত গভীর সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায় নবনী। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। ডুবে যায় সেদিনের সেই মুহূর্তে। যেদিন নিভ্র তার হাত ধরে ছিল। এবং নিজে তাদের বদলে মা’র খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে হাত এগিয়ে দিয়েছিল। ডুকরে কেঁদে উঠে সে। দ্রুত হাতের উল্টোপিঠে চোখের পানি মুছে ফেলে। নাহ! কিছুতেই সে দুর্বল হতে চায় না৷ তাকে শক্ত হতে হবে। প্রচণ্ড শক্ত! কঠিন হতে হবে, নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে। বলহীন, দুর্বল হলে চলবে না।
.
.
.
.
#চলবে?
#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_১৭
#সুমাইয়া মনি।
সারাদিন রুমেই সীমাবদ্ধ সে। কারো সঙ্গে এখন আর নিজ থেকে কথা বলে না। পাঁচটি প্রশ্ন করলে উত্তর আসে এক দু’টির। মেয়েকে পরিবর্তন হতে বলেছে ঠিকিই। কিন্তু এমন পরিবর্তন নিলুফা বেগম কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। এতটা পরিবর্তন কেউ কি করে হতে পারে। ভেবেই সে ব্যাকুল! এতে করে সে নিভ্রর দোষ দিতে চায় না। সবার চয়েস, চিন্তাভাবনা এক নয়। তবুও তার এভাবে বলা উচিত হয়নি। নবনীর পরিবর্তন মাহবুব হাসানেরও নজরে পড়েছে। আগে বাড়িতে ফিরলে তার সঙ্গে তেমন কথা না হলেও, পাশের রুম থেকে নবনীর কথার আওয়াজ সে তার রুমে বসে শুনতে পেতো। মাঝেসাঝে সে নিজেও মেয়ের বাচ্চামো স্বভাবের কথাবার্তা শুনে হেসে ফেলতো। তার কাছে ভালো লাগত। কিন্তু ইদানীং নবনীর রুম থেকে আগের মতো কথার আওয়াজ সে শুনতে পায় না। এক দিন দু দিন মানা যায়। চার-পাঁচ দিনের বেশি হয়ে গেল তবুও একই অবস্থা। এ ক’দিনে নবনীর সঙ্গে তার ঠিক মতো দেখা হয়নি। সকালে নবনীর ঘুম থেকে উঠার আগে বের হয়ে যান তিনি, রাতে বাড়ি ফিরে। তখন নবনী ঘুমিয়ে যায়। সে এই বিষয়ে নিলুফা বেগমের কাছে আলাপ করেছিল। নবনীর অসুস্থতার কথা বলে কাটিয়ে দিয়েছে সে।
আজ সে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। সারাদিন বাড়িতে থাকবে। পরিবারের সবার সঙ্গে সময় কাটাবে।
ড্রইংরুমে বসে নিউজ পেপারে নজর বুলাচ্ছিলেন। তখনই নবনী ব্যাগ সঙ্গে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের এসে খেতে বসে।
মাহবুব হাসান পেপারের ওপর থেকে নজর সরিয়ে শান্ত গলায় শুধালো,
-“নবনী মা! এখানে এসো।”
নবনী পাথরের ন্যায় চুপ করে রয়। আব্বু ডাক শুনে যেতে ইচ্ছে করছে না। কেননা সে যে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। সেটা সে দেখলেই বুঝতে পারবে। সব চিন্তা ভাবনা জেড়ে ফেলে সে উঠে মাহবুব হাসানের পাশে গিয়ে বসে। এক নজরেই মেয়েকে দেখে তার মুখে মেঘের কালো ছায়া এসে জড়ো হয়। এ কি হাল মেয়ের! চোখমুখ শুঁকিয়ে গেছে। অনেকটা কালো দাঁগ পড়েছে চোখের নিচের অংশে। চেহারায় আগের মতো উজ্জ্বলতা ভাব নেই। কেমন রোগা রোগা দেখাচ্ছে। তিনি পরম আবেশে নবনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-“তোমার চেহারার এমন অবস্থা কেন মা? নিলুফা তোমার মেয়ের এমন অবস্থা কি করে হলো? কি হয়েছিল ওর।” হাঁকিয়ে বললেন তার উদ্দেশ্যে।
সে রান্না ঘর থেকে ছুঁটে আসে। নবনী ততক্ষণে কৃত্রিম হেসে বলে,
-“আব্বু আমার শরীর একদম ঠিক আছে। আমি পুরোপুরি সুস্থ।”
-“মোটেও না। মিথ্যে বলিস না।” নবনীর উদ্দেশ্যে কথাটি বলে নিলুফা বেগমের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে,
-“মেয়ের কী হয়েছে শুনি? সারাদিন ঘরে থেকে কি করো যে ছেলেমেয়েদের ওপর ঠিক মতো নজর রাখতে পার না।”
মুখ থমথমে করে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারছে না। তিনি ইনিয়েবিনিয়ে বলতে নিলে নবনী বলে উঠে,
-“আব্বু আমি এখন একদম ঠিক আছি সত্যি! আজ আমার ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে, তাই দ্রুত যেতে হবে। কলেজ থেকে এসে কথা বলব।” উঠে দাঁড়িয়ে একটি পরোটা ভাজ করে মুখে পুরে খেতে খেতে গেট খুলে হাঁটা ধরে।
মাহবুব হাসান মেকি রাগ নিয়ে বলেন,
-“এই জন্যই নবনীর শরীরের এই অবস্থা। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করছে না ও।”
-“বলে কয়ে খাওয়ানো যায় না তোমার মেয়েকে। কি করার আছে বলো?”
উত্তরে কিছু বললেন না তিনি। পেপার পড়তে আরম্ভ করলেন। নিলুফা বেগম সরু নিশ্বাস ত্যাগ করে রান্না ঘরে এলেন।
নবনী বাহিরে এসে হাতের পরোটাটি পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। খেতে তার মোটেও ইচ্ছে করছে না। টিস্যু দিয়ে হাত মুছে সামনের দিকে হাঁটা ধরল।
______________
আদি আপনকে জোর করে তার বিয়ের শেরওয়ানি পরাচ্ছে।
মূলত আপনের গায়ে ফিটফাট হবে কিনা সেটা দেখার উদ্দেশ্য আদির। আপন পরতে ইচ্ছুক নয়। বিরক্ত হয়ে আদির হাত থেকে শেরওয়ানি নিয়ে ছুঁড়ে মারে খাটের উপর। আঙ্গুল তুলে মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,
-“পড়ব না, বিরক্ত করিস না প্লিজ আদি!”
-“ওকে!” বলেই খানের ওপর শুয়ে এক হাত দিয়ে ভর রেখে আপনের উদ্দেশ্যে বলে,
-“কাল একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে।”
-“নিশ্চয় তাকে মারাত্মক ভাবে বিরক্ত করেছিস?” খেঁকিয়ে বলে উঠে আপন।
-“আরে না। উল্টো তাকে যারা বিরক্ত করেছে তাঁদের ভাগিয়েছি।”
কথাটা হজম করতে আপনের কষ্ট হচ্ছে। যে কি-না মানুষকে বিরক্ত করতে উস্তাদ! সে নাকি অন্য কাউকে বিরক্ত করার জন্য তাড়িয়েছে। বিষয়টি মানানসই নয়!
আদি ছোট করে কালকের ঘটনা বলে তাকে। আপন চোখ পিটপিট করে বলে,
-“মেয়েটির নাম?”
-“নবনী।”
-“শুধুই নবনী। আগে,পিছনে কিছু নেই?”
-“আছে মেবি। আমাকে বলেনি।”
-“দেখতে কেমন?”
-“আহামরি সুন্দরী না হলেও। যে কারো নজরে পড়ার মতো।”
-“তোর নজরে পড়ে যায় নি তো সে।”
-“হপ! একদিনের পরিচয় ভালোবাসা, নট সম্ভব!”
-“তোকে ভাউ দিলো না তাই তো।”
-“সে আমাকে দেখে কিছুটা বিরক্ত বোধ করেছিল। তাই আমি সরে গেছি। তবে একটা বিষয় নোট করার মতো।”
-“কী?”
-“মেয়েটি যথেষ্ট শান্তশিষ্ট নরম ভদ্র বলে মনে হলো। কথা কম বলতে মেবি পছন্দ করে। আর বই পড়তে ভীষণ পছন্দ করে।”
-“তোর মতো?”
-“আমি তো মাঝেমধ্যে বই পড়ি। সব সময় না।”
-“আর কিছু বলবি?”
-“কেন?”
-“লিভ মি।”
-“যাব না। এখনো তোর বিরক্তের চাপটার বাকি রয়েছে।”
-“এক্ষুনি যা এখান থেকে।” রেগে আঙ্গুল দিয়ে গেটের দিকে দেখিয়ে বলে আপন।
আদি হেসে ফেলে। আপনকে যেমন বিরক্ত করতে তার ভালো লাগে, তেমন রাগাতেই বড্ড আনন্দ মিলে তার। উঠে দাঁড়ায় সে বলে,
-“শেরওয়ানি ভাঁজ করে রেখে দিস। বিয়ের সময়ও যদি এটা না পড়িস, তাহলে আমিই পড়বো।”
-“ব্যস! তোর এই দোয়া আল্লাহ যেন কবুল করে নেয়।”
আদি ফের হাসে। আপনের কথায় সে তেমন গুরুত্ব দেয় না। হেসে বের হয়ে যায় রুম থেকে। আপন শেরওয়ানির দিকে নজর তাক করে রাখে।
_____________
কাল রাতে একটি ব্যাংক চুরি হওয়ার হাত থেকে রক্ষে পেয়েছে। চোরদের রাতেই গ্রেফতার করা হয়েছে। নিভ্র সকালে সেখানে এসেছে। দুপুর হয়ে এসেছে। এখনো অবধি সে এখানে রয়েছে। কিভাবে চুরি করার পরিকল্পনা করেছে। সেটার ইনভেস্টিগেশন করছে। ব্যাংকের মেনেজারের সঙ্গে অনেকক্ষণ যাবত কথা বলে। এবং তার হাবভাবের মধ্যমে বুঝতে পারে সেও চোরের সঙ্গে জড়িত। তাই তাকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
নিভ্র সেখান থেকে চলে আসার সময় রাস্তায় নবনী ও মায়াকে দেখতে পায়। খুব শান্ত ভঙ্গিতে নবনী হেঁটে চলেছে। আগের মতো উচ্ছ্বসিত হাসি মুখখানা এখন আর নেই তার। এক নজরে পর্যবেক্ষণ করে সরিয়ে নেয় দৃষ্টি। তাকে নিয়ে ভাবার সময় নেই তার। সে নিজের মতোই থাকতে চায়। হ্যাঁ! সে জানে তার মধ্যে পরিবর্তন এসেছে। এতে তার আপত্তি বা কোনো মাথা ব্যথা নেই বললেই চলে। সে ভুলে যেতে চায় নবনী নামের কোনো মেয়েকে চিনে কি-না। টনিও কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়েছে। আশা করছে সে ক্যাথিকে ছাড়া আরো ভালো থাকবে।
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
Sumaiya Moni