আমি তুমিতেই আসক্ত পর্ব-১৪+১৫

0
2100

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_১৪
#সুমাইয়া_মনি।

নদীর স্রোতের ন্যায় সময় কেঁটে যায়। কেঁটে যায় আরো এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে মানুষের জীবনে কম, বেশি অনেক কিছুই পরিবর্তন ঘটে। বদলে যেতে পারে জীবনের মোড়! যেমন মোড় ঘুরেছে নবনীর। এক সপ্তাহের মাথায় তার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছে। শুরু হয়েছে নতুন জীবনের প্রান্ত। যেখানে শুধু বিষাদে পরিপূর্ণ!
বেডের সঙ্গে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে নবনী। গরমে গা গেমে একাকার। কারেন্ট থাকা শর্তেও পাখা অন করেনি সে। তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। চুল গুলো ভেজা। পানি পড়ে ভিজে যাচ্ছে বিছানার চাদর। মন মরা হয়ে ভাবছে শুধু নিভ্রর কথা। যাকে সে মনের আসরে বসিয়েছে, বিষাদ যন্ত্রণা দায়ক অসহ্যকর কষ্ট দিয়ে সে বেরিয়েছে।
বার বার চোখের পাতায় সেই দিনটির কথা ভেসে উঠছে। যে দিনটি ছিল বিষাক্ত দিন! প্রচণ্ড বিষাক্ত জড়িত দিন।

অতীত…

সকাল সকাল তৈরি নবনী। খুশি,নোমানের বিয়ের উপলক্ষে ছোটখাটো আয়োজন করা হয়েছে । আয়োজনটি ঘরোয়া ভাবেই হবে। সেখানেই যাবে সে আর মায়া। সকালেই যেতে বলেছে ওদের। হলুদ রঙের গ্রাউন। হালকা সাজ। হাতে মেচিং কাঁচের চুড়ি। চোখে কাজল পড়ে পার্স হাতে ড্রইংরুমে আসে। নিলুফা বেগমের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলে বের হয় বাড়ি থেকে।
গ্রাউনটা একটু লম্বা হওয়ায় ধরে উঁচু করে হাঁটতে হচ্ছে তাকে। এতে সে বিব্রত হচ্ছে। মেইন রাস্তায় আসতেই নিভ্রর গাড়ি ওর ঠিক সামনে দিয়ে যেতে দেখে এক হাত তুলে স্যার বলে ডাক দেয়। নিভ্র নবনীর আওয়াজ শুনতে পায়। থেমে যায় সে। পিছনে গাড়ি ঘুরিয়ে এনে নবনীর সামনে থামায়। নিভ্র এখন পুরোপুরি সুস্থ। কাঁচ নামিয়ে নবনীকে জিজ্ঞেস করে,
-“কোথায় যাচ্ছো?”

-“খুশির বাড়িতে।” কোমল স্বরে উত্তর দেয় নবনী।

-“ওহ!”

নবনী মাথা চুলকিয়ে দৃষ্টি ওপর, নিচ করে বলে,
-“আপনি কী আমায় একটু সেই বাড়িতে পৌঁচ্ছে দিবেন?”

নিভ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রয়। মনে মনে কিছু একটা ভেবে বলে,
-“আসো!”

নবনীর খুশি কে দেখে! দরজা খুলেই ঢুকে পড়ে গাড়িতে। এক পলকে নিভ্রকে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয় সে। সাদা শার্ট।ফিট জামার হাতায় পেশিগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখে রে ব্যানের কালো চশমা। হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে তাকে। নবনী নিজে নিজেই সিট বেল্ট পড়ে নিয়ে বলে,
-“চলুন স্যার।”

নিভ্র নবনীর কথাতে গাড়ি স্টার্ট দেয়। চলতে আরম্ভ করে গাড়ি। মধ্যমমানের গতিতে গাড়ি ছুঁটে চলেছে। নবনী আড়চোখে নিভ্রর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। তার শান্ত শক্ত নজর স্থির সামনের দিকে। দু হাত গাড়ির স্টিয়ারিং এ রাখা। নিভ্রর এমন শান্তশিষ্ট রাগী ভাব নবনী তার মনের গোপন কোঠরিতে আবদ্ধ করে রেখেছে বহু আগেও।
তার কাছে বেশ ভালো লাগে নিভ্রর এমন মুখখানা।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে নিভ্র গাড়ি থামালের একটি নির্জন স্থানে।
নবনী কিছুটা অবাক হয়। আশেপাশে তাকিয়ে নিভ্রর দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টি ফেলতেই, নিভ্র গম্ভীর কণ্ঠে নিজ থেকে বলে উঠে,
-“আমি তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই নবনীতা। গাড়িতে বসেই।”

নবনী নিভ্রর কথায় ছোট্ট করে উত্তর দেয়,
-“বলেন স্যার!”

হঠাৎ নিভ্রর চোখেমুখে যেন রাগী ভাব ফুটে উঠলো। সে সেটা দেখে আরো অবাক হয়। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নিভ্রর দিকে। মাথায় একটি প্রশ্ন বেজে উঠলো, ‘কী বলতে চায় সে?’। বাঁকা চোখে তাকার তার দিকে। নিভ্র বড়ো একটা নিশ্বাস ফেলে চশমা খুলে নবনীর চোখে চোখ রেখে বলে,
-“তুমি আমাকে ভালোবাসো নবনীতা?”

নবনী চমকানো দৃষ্টিতে তাকায় নিভ্রর পানে। চোখেমুখে তার বিস্ময়! নিভ্রর এমন প্রশ্নে দৃষ্টি তার কিংকর্তব্যবিমূঢ! আশেপাশে যেমন নির্জন। তেমনই তাদের মাঝেও এখন নিরবতা বিদ্যমান। নিভ্র চোখেমুখে বিরক্ত বোধ নিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে শুধালো,
-“রোজ তুমি আমার বাড়ির সামনে গোলাপ ফুল রাখতে, রাইট?”

নজর নিচু করে ফেলে নবনী। সত্যতা আজ তার সামনে। হ্যাঁ! সে নিজেই প্রতিদিন সকালে নিভ্রর বাড়ির সামনে চুরি চুুপে ফুল রেখে আসতো। আর এমন ভান ধরে থাকত, সে কিছুই জানে না। কিন্তু তাকে খুব ভাবাচ্ছে। নিভ্রর তো এটা জানার কথা নয়। কিভাবে এই ছোট্ট রহস্য উদঘাটন করল ভাবছে সে। নিভ্র ফের নবনীর উদ্দেশ্য করে বলে,
-“বাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগান হয়েছে। আই থিঙ্ক, এবার তোমার বুঝতে সমস্যা হচ্ছে না। আমি কিভাবে জানলাম।”

ধরা সে পড়ে গেছে। এখন আর মিথ্যে বলে লাভ নেই। মিথ্যে বললে হিতে বিপরীত হয়ে যেতে পারে। তাই ছোট্ট করে উত্তরে বলে,
-“আমিই রাখতাম।”

রাগে নিভ্র বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে কপালে একবার স্লাইড করে। বলে,
-“ভালোবাসো তুমি আমাকে। সেটা আমি এ ক’দিনে বুঝতে পেরেছি। কিভাবে জানো?”

নবনী চুপ করে রয়। সে জানে কিভাবে। তবুও সে শুনতে চায় নিভ্রর মুখ থেকে। নিভ্র বলতে আরম্ভ করে,
-“আমার জন্য খাবার বাড়লে তার থেকে এক চামিচ আগে নিজে খেতে। গ্লাসে পানি ঢালার পর এক চুমুক পানি খেয়ে নেও। এবং-কি লাস্টের অবশিষ্ট খাবার ও গ্লাসের পানি টুকুও।”

লজ্জায় মাথা নইয়ে রাখে নবনী। কথা বলার কোনো ক্ষমতা তার মধ্যে নেই। নিভ্র যা যা বলেছে সবই ঠিক। এসব সে সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখেছে। নিভ্র চোয়াল জোড়া শক্ত করে বলে,
-“ছোট্ট থেকেই আমি ভালোবাসা নামক জিনিসটিকে ঘৃণা করি। ভালোবাসা মানে আমার কাছে পরিবার। তাঁদের ছাড়া ভালোবাসা আমার কাছে অতি ক্ষুদ্র বস্তু মাত্র। প্রথম থেকেই তোমাকে আমার ভালো লাগত না। এখনোও না। তুমি কিভাবে ভাবলে তোমার এমন পাগলামোকে আমি প্রধান্য দেবো, ভালোবাসার নজরে দেখবো। ভুল ধারণা ছিল তোমার।”

মুখের জবাব যেন বন্ধ হয়েগেছে তার। বার বার কানে প্রতিধ্বনি হচ্ছে তাকে ভালো লাগে না কথাটি। দ্রুত হৃৎস্পন্দনের ধকধকানি ভেড়ে গেছে।
নিভ্র কথা গুলো শান্ত ভাবে বললেও, একেকটা কথা বিষের চেয়ে কম লাগছে না তার নিকট। সে ফের ক্রোধমিশ্রিত কন্ঠে বলে,
-“ভালোবাসা ছাড়! তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী হবার ক্ষমতা রাখ না। সবে মেট্রিক পরিক্ষা দিয়ে কলেজে উঠেছো। তোমার মাথায় এমন অহেতুক পাগলামি কিভাবে চাপলো। এখনকার ছেলেমেয়েরা নাই-টেনে উঠলেই অনেক কিছু জেনে যায়, বাস্তবতা বুঝে যায়। কলেজে উঠে কেউ কেউ ম্যাচিউরডও হয়ে যায়। আর তুমি নিজেকে দেখো। ইমম্যাচিউর মেয়ে তুমি। যাই হোক, আজকের পর থেকে তুমি আমার বাড়ির ত্রিসীমার ধারে কাছেও ঘেঁষবে না। আমি চাই না তুমি আমার সামনে আসো।”

যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে বুকের মাঝে। এ যে কষ্টের যুদ্ধ!
সে বাকরুদ্ধ! অসহ্যকর কষ্ট হচ্ছে মনে। ভালোবাসার মানুষটির মুখে আজ এমন ধারালো কথা শুনতে হবে, জানা ছিল না। কথা গুলো না বললে কি হতো না। হৃদয় একবারও কেঁপে উঠলো না তার। কাঁপপেই বা কেন? সে তো তাকে ভালোবাসে না। চোখ ছলছল করে উঠে তার। মনে হচ্ছে এখনোই বৃষ্টিরূপে তা বর্ষিত হবে। যাবে না সে তার চোখের ত্রিসীমানায়! বেশ কিছুক্ষণ কেঁটে যায় এমন নিরবে। নবনী নিজেকে কোনোমতে স্বাভাবিক করে গাড়ির দরজা খুলে বের হতে নিলেই নিভ্র থামিয়ে দেয়।

-“আমি যখন এনেছি তোমাকে। আমিই বাড়িতে দিয়ে আসবো। গাড়ি থেকে বের হবে না।” কিছু ধমকের স্বরে বলে।

অসহ্য যন্ত্রণা দেওয়া মানুষটির কথা সে শুনবে নাকি বুঝতে পারছে না। তবে না শুনে উপায় নেই। সে নিভ্রর সামনে নিজের কষ্টকে প্রকাশ করতে চাইছে না। তাই সে গেট লাগিয়ে বসে। নিভ্র গাড়ির স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে মৃদুস্বরে বলে,
-“কোথায় যাবে ব…”

বাকিটা বলার আগেই নবনী দ্রুত আওড়ায়,
-“বাসায়!”

নিভ্র নববীর দিকে একবার তাকায়। দৃষ্টি নত, চোখে তার পানি ছলছল। পাত্তা না দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় সে। আগের ন্যায় গাড়ি চলতে থাকে। একেকটা মিনিট নবনীর কাছে অতি বিষাক্ত মনে হচ্ছে। ভাবছে কখন বাড়িতে পৌঁছাবে।
যে মানুষটি বলেছে তার ধারেকাছে না যেতে।এখন তার সঙ্গে বসে থাকতে মারাত্মক কষ্ট হচ্ছে। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে।
নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এই মুহূর্তে জোরে জোরে কাঁদতে পারলে ভালো হতো। তাও পারছে না সে। তার সামনে নিজেকে অসহায় ভাবে প্রকাশিত করতে চাইছে না।
কয়েক মিনিট পর বাড়ির সামনে এসে গাড়ি থামে। নবনী তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পা চালিয়ে ভেতরে চলে আসে। চোখের পানি তার এখনো চোখের কোটরেই জমাট বেঁধে আছে। যে কোনো সময় তা পড়ে যাবে। দু বার কলিং বেল বাজার পর দরজা খুলে দেয় নিলুফা বেগম। সে অবাক! চোখের কাজল লেপ্টান। চেহারার সেই হাসি-খুশির ভাব বিলিন হয়ে কান্নারতে পরিণত। মেয়ের চোখমুখ দেখে তার বুঝতে বাকি থাকে না কিছু একটা হয়েছে। ভালো বা খারাপ!

নবনী চোখ তুলে তাকায় তার দিকে। নিজেকে সামলে রাখতে পারে না। হাউমাউ করে কেঁদে জড়িয়ে ধরে তাকে। মেয়েকে এভাবে কাঁদতে দেখে অস্থির হয়ে যায় সে। তার বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠে। কোনোমতে পিঠে তার বুলিয়ে ভেতরে নিয়ে আসে নবনীকে। নবনীর কান্না শুনে নিয়ানও উপস্থিত হয় ড্রইংরুমে। বোনকে এভাবে কাঁদতে আজ প্রথম দেখল। মুখ কালো হয়ে যায় তার। সোফায় বসিয়ে মেয়েকে শান্ত করে শোনার চেষ্টা করে মূল ঘটনা। কিন্ত নবনীর কান্নার গতি যেন থামবার নয়। কেঁদে চলেছে সে একাধারে। মেয়ের এমন কান্না সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। শেষে ধমক দিয়ে থামানোর চেষ্টা করে। নবনী হেঁচকি টেনে পুরো ব্যাপার খুলে বলে তাকে।
সে পুরো থম মেরে যায়। নিয়ান তেমন কিছু না বুঝতে পারলেও, এতটুকু ঠিক বুঝেছে নিভ্র স্যার তার বোনকে কষ্ট দিয়েছে। মনে মনে ক্ষোভ জন্মায় তার মনে।

অতীত থেকে বেরিয়ে আসে নবনী। হুঁশ ফিরে তার কারো হাতের স্পর্শে। নিলুফা বেগম নবনী পাশে বসে ভেজা চুলগুলো তোয়ালে দিয়ে মুছে দিচ্ছে। অশ্রুসিক্ত চোখে তাকায় তার দিকে। চেহারার উজ্জ্বল, চঞ্চলতা ভাব নেই। মুখ শুকিয়ে গেছে মেয়ের। নিলুফা বেগম মেয়ের এমন কষ্ট সহ্য করতে পারছে না। স্বাভাবিক! কোনো মা-বাবাই সন্তানের কষ্টে সুখে থাকতে পারবে না।
নবনী ধীরেধীরে তার কাঁদের ওপর মাথা রাখে। নিলুফা বেগম নবনীর মাথায় বিলি কেঁটে দিয়ে বলে,
-“বাস্তবতা থেকে মানুষ শিখে। তুই এখন রিয়েল বাস্তবতার সম্মুখীন। তোর মধ্যে ম্যাচুরিটি ছিল না। নিভ্র তো ঠিক বলেছে। সারাদিন দুষ্টুমি, পড়া ফাঁকিবাজি আরো কত কি করতি তুই। মানুষ অন্যান্য বই পড়েও জ্ঞান অর্জন করে, শিখে। কিন্তু তুই ঠিক মতো একাডেমিক বই পড়তি না, আদার্স বই পড়া তো দূরের কথা! তাই তোর মধ্যে ম্যাচিউরিটি নেই বললেই চলে। নিভ্র তোকে কথা শুনিয়েছে। তোর ভালোবাসাকে অস্বীকার করেছে। এতেই তুই এভাবে ভেঙে পড়ছিস। কেন? সব কিছু ছুঁড়ে ফেলে নিজের মতো করে জীবন শুরু কর। নিজেকে সময় দেয়, ভালোবাসতে শিখ।”

অতি কষ্টে নবনী মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে। তার কথা গুলো সঠিক। সে চায় নিজেকে নতুন রূপে রুপান্তরিত করতে। পারবে কী? কিছু প্রশ্নের উত্তর অপূর্ণ থেকে যায়। নিলুফা বেগম নবনীর দিকে নরম ভঙ্গিতে তাকায়। নবনী চোখ মুছে তার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“অবুঝ মানুষরা ধাক্কা না খেলে কিছু শিখতে পারে না আম্মু। আমি বুঝেছি। চরম বাস্তবতা দেখিয়েছে আমাকে। নিজেকে নতুন ভাবে গুছিয়ে নিতে চাই।”

মেয়ের কথা শুনে কিছুটা হলেও খুশি হন সে। মাথায় হাত রেখে বলেন,
-“নামাজ শেষ করে খেতে আয়।”

-“আসছি!”
______________
জিনান মুখ ভার করে বসে আছে নিভ্রর পাশের সোফাটিতে। নিভ্রর ভাবভঙ্গি আগের দিনের মতো শান্ত। সে সযত্নে তার পিস্তল মুছতে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ আগেই জিনান বাড়িতে এসেছে। নিভ্র নবনীকে বলা সব কথা বলেছে। জিনান শুনে প্রথমে অবাক হলেও, পরক্ষণে মুখ কালো হয়ে যায়। নিভ্র জিনানকে নিরবতা পালন করতে দেখে বলে,
-“কিছু বলছিস না যে?”

সে আজ নিভ্রর ওপর বিরক্ত বোধ করছে। যেটা কখনো হয়নি। নিভ্রকে পারফেক্ট মনে হতো। সবার চেয়ে আলাদা সে। কিন্তু তার মধ্যেও যে এতটা কঁড়া বিবেকবুদ্ধি আবির্ভূত। অনুমান ছিল না তার। মেয়েটা না হয় ভালোবেসেছে। তার জন্য তাকে এভাবে অপমানসূচক কথা শুনাতে হবে। জিনান চুপ থাকতে পারে না আর। মেকি রাগ নিয়ে বলল,
-“তোর মনে নবনীকে নিয়ে কোনো অনুভূতি নেই মানলাম। তাই বলে তুই ওঁকে এভাবে অপমান করে কথা বলতে পারিস না।”

নিভ্র পিস্তল পাশে রেখে বলে,
-“অপমান তো করিনি। লাভ সাবজেক্ট এবং ম্যাচিউরিটি নিয়ে কথা বলেছি।”

-“অর্ধাঙ্গিনী হবার ক্ষমতা রাখে না। এটা কেন বলতে গেলি। আবার ত্রিসীমানায় আসতে নিষেধ করলি। ভুলে গেলি, নবনীর উপকারের কথা।”

-“নবনীতার হয়ে, আমাকে খোঁটা দিচ্ছিস। আর আমি তো কাউকে বলিনি আমাকে সাহায্য করতে। উপকারের কথা, সেটা তো দূরেই থাক!”

-“জাস্ট বলছি! এটাকে খোঁটা বলে না। তোকে কিছু বলার নেই আমার। যাই বলিনি না কেন, বেহুদা মনে হবে আমার কথা।”

-“নবনীতার সাবজেক্ট নিয়ে আমি কোনো কথা শুনতে চাই না।”

-“বলবও নাহ!”

-“ধন্যবাদ!” বলেই ফোন হাতে নেয় নিভ্র।

জিনান ওঠে গেটের সামনে আসে। বের হবার আগে বলে,
-“আমি গেলাম।”

-“আচ্ছা!”

জিনান প্রস্থান করে। নিভ্র ফোন ঘাটতে থাকে। জিনানের রাগকে সে পরোয়া করে না। তার কোনো ভাবান্তর নেই যে তার মাধ্যমে একজন মেয়ের মন ভেঙে গেছে। তাও করুণ ভাবে।
.
.
.
#চলবে?

কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।

#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_১৫
#সুমাইয়া_মনি।

আকাশের বুক চিঁড়ে পূর্বদিগন্ত থেকে সূর্য উদিত হয়। পাখিরা গাছের ডালে বসে কিচিরমিচির করে ডেকে চলেছে।
বেলা আটটা বাজে। নিলুফা বেগম নবনীকে সাতটা থেকে ডাকা আরম্ভ করেছে। কিন্তু নবনীর কোনো রেসপন্স নেই।
এক ঘন্টা যাবত সে ডেকে ডেকে অস্থির। পরিশেষে সে রান্নাঘরে চলে আসে। আটটা চল্লিশ মিনিটে সে ফের ডাকতে আসে। দরজায় করাঘাত করতে যাবার পূর্বেই নবনী দরজা খুলে দেয়। নিলুফা বেগম কিছুটা চমকে যায়। দরজা খোলার কারণে নয়, নবনীকে দেখে। টানা দু দিন নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে সে। নিজেকে সংযত করে পাল্টেছে নতুন রূপে। আজ নবনী অন্যরকম ভাবে নিজেকে সাজিয়েছে। ব্লু রঙের থ্রিপিস, সঙ্গে মেচিং করে হিজাব পড়েছে। ডান হাতে সাইট ব্যাগ। চেহারায় উজ্জ্বলতা ভাব নেই বললেই চলে। তবুও সাজসজ্জাহীন নবনীকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। নিলুফা বেগম নবনীকে দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরক্ষণে নিজেকে সামলে নেয়। মুখ খুলে কিছু বলতে নিলেই নবনী অতি গম্ভীর মুখে বলে,
-“রেডি হচ্ছিলাম। এত ডাকার কোনো কারণ দেখছি না আম্মু।”

সে কিছু বলে না। নবনী বের হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে। খাবার ভাড়া ছিল। অর্ধেক রুটি ছিঁড়ে ভাজি দিয়ে খেতে আরম্ভ করে। একটা রুটি খেয়েই পানি পান করে নবনী। নিলুফা বেগম এগিয়ে এসে আরেকটি রুটি প্লেটে দিতে নিলেই নবনী ওঠে দাঁড়িয়ে বলে,
-“খাওয়া শেষ। আমি কলেজে যাচ্ছি আম্মু।” বলে সে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় বাহিরে।

মেয়ের এমন গম্ভীর আচরণ দেখে সে হতবাক। তবে সে এটা ভেবে স্বস্তি পায় নবনী নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। পরিবর্তন করতে।
.
রিকশা নিয়ে সোজা কলেজে আসে নবনী। ক্লাস রুমে আসতেই মায়ার সঙ্গে তার দেখা হয়। মায়ার সিটে বসে সে। কোনো কথা না বলে ব্যাগ থেকে একটি উপন্যাসের বই বের করে পড়তে আরম্ভ করে। রীতিমতো মতো মায়া নবনীকে দেখে অবাক। কৌতুহল নিয়ে চেয়ে রয়। পরক্ষণে জিজ্ঞেস করে,
-“ফোন না ধরার কারণ বলবি? আর খুশিদের বাড়িতে যাওয়ার লাস্ট মুহূর্তে কী হয়েছিল। জানতে পারি কী?”

নবনীর বই পড়ায় মগ্ন। মায়ার প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত নয় সে। মায়া বড়ো নিশ্বাস ত্যাগ করে। নিচের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মৃদু স্বরে বলে,
-“আমি সব জানি নবনী। জিনান আমাকে সব বলেছে।”

নবনী পড়া বন্ধ করে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
-“এই প্রসংগে কথা না বললে আমি খুশি হবো মায়া।”

চোখ তুলে তাকায় মায়া নবনীর দিকে। নবনীর এমন পরিবর্তন মানা যাচ্ছে না। খুব ভাবাচ্ছে তাকে। সে চুপ করে রয়। আপাতত নবনীকে একা ছেড়ে দেওয়াই ভালো হবে ভেবে।
____________________
আপনের বিয়ের আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি আছে। কার্ড অলরেডি আত্মীয়দের বাড়িতে পৌঁছানো হয়ে গেছে। বাকি যারা আছে তাদেরকে আদি নিজে গিয়ে কার্ড দিয়ে এসেছে।
আপন তার কক্ষে ডায়েরীতে কিছু একটা লিখছিল। তখন আদির আগমনে সে লেখা বন্ধ করে দেয়। ডায়েরী বন্ধ করে ঢয়ারে রাখে। আদি বিছানার উপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। গরমে ঘেমে গেছে সে। আপন দৃষ্টি তার দিকে নিক্ষেপ করতেই আদি বলে উঠে,
-“বিয়ে তোর, সব কাজ করতে হচ্ছে আমার। হোয়াই ব্রো?”

-“ভাই ভাইয়ের বিয়েতে কাজ করতে না তো কে করবে বল?”

-“ভালো কথা! তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমি বিরক্ত করব কাকে? ইশশ! একটা বোনও নেই আমার। যাতে পরবর্তী তাকে টর্চার করব।” আফসোস নিয়ে বলে আদি।

-“কী আজব তুই আদি।”

-“ব্রো, তুই কাকি মাকে বলে একটা বোনের ব্যবস্থা করতে বল না।”

-“বোনের না। বউয়ের ব্যবস্থা করতে পারি করব?”

-“আহা! বউকে বিরক্ত টর্চার করা যায় নাকি।”

-“তাহলে কী রোমান্টিক টর্চার করবি?”

-“রাইট ব্রো! মনের কথা বলে দিলি তুই।” বলেই হেসে ফেলে।

আপন মনে মনে আওড়ায়,
-“শয়তান একটা।”

-“শয়তান না। ফাজিল বল, ফাজিল!”

-“হবে একটা।”

-“যাক! তনুজা ভাবির সঙ্গে আর কথা হয়েছে?”

-“তা জেনে তুই কী করবি?”

-“বাজার থেকে পেঁপে এনেছি। জেনে ব্লেন্ডারে পেঁপের সঙ্গে মিক্স করে খাব।”

-“দেখ আদি, বিরক্ত করবি না আমায়।”

-“আর ক’দিনই তো। তারপর আর বিরক্ত করব না ব্রো।”

আপন কথা বলে না। বিরক্ত হয়ে ফোন নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আদি বাঁকা হাসে।
__________________
নিভ্র তার কেবিনে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল। হঠাৎ তার ফোনের টোন বেজে উঠে। দৃষ্টি ফোনের দিকে নিবদ্ধ করে।
চট করে টেক্সটটি পড়ে ফেলে। সেখানে লিখা ছিল,
-“ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করতে চাই না। আমাকে সঠিক পথ দেখানো ও বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য শুকরিয়া! জায়রা।”

টেক্সটটি পড়ে নিভ্র স্মিত হাসে। পরক্ষণে সে তার মনোযোগ কাজে লাগায়। বেশ কিছুক্ষণ পর চেয়ারে হেলান দিয়ে হাই তুলে। ঘাড়ে হাত রেখে ডান দিক, বাঁ দিকে কাত করে।
ফোন হাতে নিয়ে ডায়ালিস্টে যেতেই নবনীর নাম্বার নজরে পড়ে যায়। লাস্ট কথা হয়েছিল পাঁচ-ছয় দিন আগে।
সে পাত্তা দেয় না। সেখান থেকে জিনানের নাম্বারটি বের করে কল দেয়। তাকে বাসায় আসতে বলে। জিনান বিকালে আসবে বলে জানায়। অতঃপর ফোন রেখে সে আবার তার কাজে মন দেয়।
——–
একটার দিকে বাড়ি ফিরে নবনী। রুমে ঢুকে প্রথমে ফ্রেশ হয়ে নেয়। তারপর হুমায়ুন আহমেদের একটি উপন্যাস নিয়ে পড়তে আরম্ভ করে। বেশ কিছুক্ষণ পর ক্যাথি নবনীর নিকট আসে। নবনী ক্যাথির পানে তাকায়। সেদিনের পর থেকে ক্যাথিকে টমির কাছে যেতে দেওয়া হয়না।যেতে দিতেও চান না। আর ক্যাথিকে তার নিকট আসতে দেয়নি। মন স্থির করে সে ক্যাথিকে দিয়ে দিবে কাউকে। কেননা ক্যাথিকে দেখলেই টমির কথা তার মরে পড়ে যায়, তারপর নিভ্রর কথা। তাই সে চায় না ক্যাথি তার সঙ্গে থাকুক।
নবনী সেই জানালার দিকে তাকায়। যেখান থেকে রোজ সে নিভ্রকে দেখতো। সে-ই জানালা নবনী সেদিনই বন্ধ করে দিয়েছে। আর খোলা হবে না সেটি। আগের মতো বন্ধ হয়ে থাকবে। নবনী হাঁকিয়ে নিয়ানকে ডাক দেয়।
নিয়ান পাশের রুম থেকে ছুঁটে আসে এ রুমে। এসে জিজ্ঞেস করে,
-“ডেকেছো আপু?”

-“ক্যাথিকে নিয়ে যা। আর ও যেন আমার রুমে না আসে।”

-“আচ্ছা!”

-“আর শোন।”

-“বলো আপু।”

নবনী ওর ব্যাগের ভেতর থেকে ওর মার্বেল গুলো বের করে নিয়ানের হাতে দেয়। বলে,
-“তোর মার্বেল গুলো নে। বাহিরে গিয়ে খেলা কর।”

আগের দিনের মতো হলে নিয়ান মার্বেল পেলে বেশ খুশি হতো। কিন্তু আজ কেন যেন ওর ভেতর থেকে খুশি ভাবটা প্রকাশ পাচ্ছে না। যেন সে অখুশি! বোনের কষ্ট সে ঢের উপলব্ধি করতে পারছে। বুঝতে পারছে সে এখন আর আগের মতো নেই। সারাক্ষণ কেমন মনমরা হয়ে রয়। মার্বেল দেওয়ার পরও নিয়ানকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নবনী বইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ক্যাথিকে নিয়ে যা নিয়ান। আর সন্ধ্যার পর আমার কাছে পড়তে আসবি। আজ থেকে তোকে আমিই পড়াবো।”

নিয়ান ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়। যে বোন তাকে পড়াতে ইচ্ছুক ছিল না। আজ সে পড়ানোর কথা বলছে। বোনের এমন পরিবর্তন সবার মতো তাকেও পীড়া দিচ্ছে। পরিশেষে সে ক্যাথিকে সঙ্গে নিয়ে রুম ত্যাগ করে। নবনী চুল তুলে কপালে আঙ্গুল বুলাতে থাকে। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বাহির থেকে নিলুফা বেগম নবনীর কথা সব শুনেছে। নবনী নিয়াককে ডাকার পর পরই সে রুমের বাহিরে এসে উপস্থিত হয়। অতঃপর সে তাদের কথা শুনতে পারে।
ভারী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। মেয়ের পরিবর্তন ঘটেছে। যাকে বলে মারাত্মক পরিবর্তন। এ পরিবর্তনকে আঁকড়ে ধরে সে যেন সামনে এগিয়ে যেতে পারে। ভবিষ্যত উজ্জ্বল করতে পারে।
এই কামনাই করে সে!
.
.
.
#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে