#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_ ১০
#সুমাইয়া মনি।
-“যারা সত্যিকারের ভালোবাসে, সত্যিকারের ভালোবাসা পায়, আসলে তারাই ভালোবাসার মর্ম বুঝতে পারে।ভালোবাসা মানুষকে পরিবর্তন করে, নতুন কিছুর স্বাদ দেয়, অভ্যাস করায়। একবার তনুজাকে মন থেকে ভালোবেসে দেখ। তাহলেই বুঝতে পারবি ভালোবাসা কী।” আদি এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে আপনের পানে তাকায়।
বেশ কিছুক্ষণ ধরে আপনকে ভালোবাসার ব্যাথা বুঝানোর চেষ্টা করছিল আদি। কিন্তু আপন, সে বুঝতেই চাইছে না। আপন আদির ওপর থেকে নজর সরিয়ে নেয়। সামনের দিকে তাক করে বলে,
-“তুই তো কাউকে ভালোবাসিস না। ভালোবাসা নিয়ে এত ব্যাখ্যা কিভাবে দিলি?”
-“ভালোবাসলেই যে ভালোবাসার ব্যাখ্যা জানা থাকতে হবে। এমন তো কোনো কথা নেই। আমি তোর আর তনুজার ভালোবাসার কথা বলছি। একটা কথা বল। তুই কি অন্য কাউকে ভালোবাসিস বা পছন্দ করিস? ”
-“ফালতু কথা।”
-“কথার মধ্যে জ্বোল আছে।”
-“কিসের জ্বোল?” ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলে আপন।
-“পঁচা জ্বোল!” মৃদু হেসে।
-“মজা নিচ্ছিস?” মেকি রাগ দেখিয়ে বলে।
-“হয়তোবা! ”
আপন ক্ষেপে যায়। মানুষকে বিরক্ত করা আদির জন্মগত অভ্যেস বলা চলে। পৈচাশিক আনন্দ মিলে তাতে। বিষেস করে আপনকে বিরক্ত করতে আদি ঢের মজা পায়। আপন কিছু বলে না। ইচ্ছে করছে না কথা বলছে। আদি বলে,
-“আপন, আমার কাছ থেকে এমন কিছু গোপন কথা লুকিয়ে রাখিস না। যাতে করে ভবিষ্যতে তোর কোনো সমস্যা হয়। ”
আপন কিছুক্ষণ থম মেরে রয়। পরক্ষণে ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বলে,
-“এমন কোনো গোপন কথা থাকলে আমি অবশ্যই বলতাম।”
-“হলো না।” ঘাড়ে হাত রেখে বলে।
-“কী হলো না।”
-“জেনে বলছি।” বলেই প্রস্থান করে আদি। আপন বিরক্ত চোখে মুখে আদির যাওয়ার পানে তাকায়। সে ঠিক বুঝেছে, যাওয়ার আগে ওঁকে একটু বিরক্ত বানিয়ে গেছে। চোখ বন্ধ করে সরু নিশ্বাস ছাড়ে।
———————-
সকালে জিনান নিভ্রর বাড়িতে আসে। চোখাচোখি হয়ে যায় নবনীর সঙ্গে। সে তখন গাছে পানি দিচ্ছিল। মুখ ঘুরিয়ে নেয় নবনী। জিনান চোখ পিটপিট করে প্রশ্নাতীত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। নিভ্র তখন ইউনিফর্ম পড়ছিল।
জিনান ভেতরে ঢুকেই বিছানায় বসে পড়ে। নিভ্র জিনানকে দেখে অবাক হয়না। বরঞ্চ জিজ্ঞেস করে,
-“এত সকালে কী মনে করে আমার বাড়িতে আসলি?”
-“তোকে কিছু বলতে চাই।”
-“বল।”
-“মায়ার বিষয়।”
-“বল, আমি শুনছি।”
-“কাল মায়াকে….! সব ভাঙিয়ে বলে নিভ্রকে। নিভ্র ইউনিফর্ম পড়া অবস্থায় সব শুনে। জিনান থামে। নিভ্র হাতের ওয়াচ পড়তে পড়তে বলে,
-“লাভ সম্পর্কে আমার ধারণা অতি ক্ষুদ্র। কাঁচাও বলতে পারিস। আমি তেমন কিছু বলব না। শুধু বলব অপেক্ষা কর।”
-“যদি মিস কল না দেয়।” আহত কন্ঠে বলে।
-“ভাগ্যে নেই। ফরগেট ইট!”
-“এমন করে বলিস না, খুব লাগে।” বুকের বাঁ পাশে হাত রেখে বলে।
নিভ্র স্মিত হাসে। জিনান জিজ্ঞেস করে,
-“নবন্ন আই মিন নবনী এখানে কেন?”
-“গাছে পানি দেওয়ার জন্য।”
-“পানি দিচ্ছে কেন গাছে?”
-“শাস্তি?”
-“কিসের?”
-“গাড়িতে বলব চল।” বলেই নিভ্র বের হয়। জিনান পিছু পিছু যেতে থাকে। নিভ্র গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে। জিনান ওঠে বসে। গাড়ি চালিয়ে গেট বরাবর এসে থেকে যায়। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে নিভ্র নবনীকে বলে,
-“পানি দেওয়া হলে গেট বন্ধ করে দিয়ে চলে যেও।”
-“জি, স্যার।” মাথা নত করে।
নিভ্র চলে যাওয়া ধরলে নবনী পিছন থেকে ডাক দেয়। বলে,
-“শুনুন স্যার।”
-“বলো।” ঘুরে পিছনে তাকিয়ে।
ইনিয়েবিনিয়ে মাথা চুলকিয়ে লজ্জা ভঙ্গিতে বলে,
-“কালকের জন্য স্যরি স্যার!”
নিভ্র সুনিয়ত চেয়ে রয়। সেকেন্ড কয়েক পর ছোট করে ‘হু’ উচ্চারণ করেই গাড়ি স্ট্রাট দিয়ে গেট দিয়ে বের হয়। নবনী বড়ো নিশ্বাস ফেলে গেট লাগিয়ে দেয়।
.
-“মাথার মধ্যে প্রশ্ন ঘুরছে। উত্তর কী দিবি?”
-“বলছি..” নবনীর বিষয় সব খুলে বলে জিনানকে। সেই আগন্তুক ব্যক্তির কথাও বলে, যে রোজ গোলাপ ফুল দিয়ে যায় গেটের সামনে। আজ-ও দিয়েছিল। জিনান এক হাত জানালার সঙ্গে ঠেস দিয়ে বলে,
-“সব বুঝলাম। বাট ফুল দেওয়া ব্যক্তিটি কে? মেয়ে নাকি ছেলে?”
-“খুব শীঘ্রই জানতে পারব।”
-“হুমম!”
নিভ্র বলে,
-“নবনীতা এখনো ইমম্যাচিউর। বাচ্চামো স্বভাবগত।”
-“কিন্তু কাল যেটা বলেছে ও তোকে। তাতে মনে হচ্ছে সত্যি নবনী তোকে পছন্দ করে।”
-“সেটআপ! জিনান। কালকে ও আমাকে খেয়াল করে নি। কোনো ঘোরের মধ্যে ছিল। তাই বলেছে। হ্যাঁ! আমার রাগ হয়েছে। বাট পরে মানিয়ে নিয়েছি।”
-“এটাও বুঝলাম। বিয়ে-টিয়ে করবি না?”
-“দেরি হবে।”
-“পছন্দের কেউ আছে?”
-“নো ম্যান। আমি মেয়েদের প্রতি এতটা ইন্টারেস্ট নই।”
-“একদিন ঠিক হয়ে যাবি। যেদিন ভালোবাসার মানুষটিকে খুঁজে পাবি।”
-“সো, সেই দিন আসুক।”
-“এসে যাবে।”
-“ওকে।”
দু’জনের কথা বলার মাধ্যমে থানায় পৌঁছায়। কেবিনে না এসে লকাপে রাখা জায়রাকে দেখার জন্য যায়। সঙ্গে জিনান ও সে-ই দু’জন পুলিশ ছিল। রাতে ইলেকট্রনিক শক দেওয়া হয়েছে জায়রাকে। তবুও সে মুখ খুলে নি। সারারাত ঘুমাতেও দেওয়া হয়নি তাকে। নিভ্র ভেতরে এসে জায়রার মুখের দিকে তাকায়। কালকের উজ্জ্বল চেহারার মেয়েটিকে আজ মরা মরা লাগছে। মুখ শুকিয়ে কালো দেখাচ্ছে। পরিপাটি চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আদলে মাখোমাখো। এক কনস্টেবল নিভ্রর সামনে একটি চেয়ার এগিয়ে দেয়। চেয়ার টেনে বসে পড়ে সে। জায়রা নিভ্রর উপস্থিতি টের পেয়েছে। অগ্নিমুখে নিভ্রর পানে তাকায় সে। নিভ্র বেশ শান্ত স্বরে বলে,
-“এক দিনে কি হাল হয়েছে আপনার। সব কিছু বলে দিলে এমনটা হতো না মিস.জায়রা।”
-“বলব না।” ক্রোধ কণ্ঠে বলে জায়রা।
-“সত্যিই বলবেন না?”
-“মরে গেলেও না।”
-“আপনার বাঁচার কোনো উপায় আমি দেখছি না। ” বলেই লেডি কনস্টেবলকে চোখের ইশারা করে। লেডি কনস্টেবলটি পিস্তল তাক করে জায়রার মাথা বরাবর। জায়রা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পায়। নরম হয়ে আসে সে। নিভ্র চোখে চোখ রেখে বলে,
-“বলব!”
নিভ্রর ঠোঁট তৃপ্তিময় হাসি ফুটে ওঠে। বলে,
-“এই তো বললেন, মরে গেলেও বলবেন না।”
রাগে ফুঁসছে জায়রা। নিভ্র ফের বলে,
-“টেল মি?”
গড়গড় করে জায়রা সব সত্যি বলে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিভ্র তার পুলিশ ফোর্স নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মেইন সেই গ্যাংদের ধরার জন্য।
———————–
দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছে মায়া। জিনানকে মিস কল দিবে কী, দিবে না। ভেবেই অস্থিরতা এসে জেঁকে বসেছে ঘাড়ে, সরে যাওয়ার নাম নিচ্ছে না। নবনী জুস খাচ্ছে সঙ্গে মায়াকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
সান্ত্বনা কম বিরক্ত বেশি হচ্ছে। একটা মিস কল দেওয়ার জন্য এত ভাবার কি আছে বুঝতেছে না সে। সকালে জিনানের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথাটা বলে মায়াকে। তেমন কোনো রিয়াকশন দেয় না মায়া।
নবনী বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে বলে,
-“ক্লাসে যাবি, নাকি এখানেই বসে থাকবি?”
-“যাব!” ছোট করে উত্তর দেয়।
-“চল!” বলেই ওঠে দাঁড়িয়ে যায় নবনী। মায়া তখনো বসে থাকে। নবনী ফের বলে,
-“কী হলো?”
মায়া ওঠে দাঁড়ায়। নবনী মায়ার কাঁধে হাত রেখে বলে,
-“মায়া তোর মন যেটা বলে, সেটা কর। আমাকে দেখ। আমার যখন যা ইচ্ছে হয়, তখন তাই করি।”
-“তাহলে কল দিবো?”
-“যদি মন সায় দেয় তো!” দু কাঁধ উঁচু করে বলে।
মায়া পুনরায় ভাবতে আরম্ভ করে। নবনী হাত ধরে টেনে ক্লাস রুমে নিয়ে আসে। কিছুক্ষণ পর ঘন্টা পড়ে। ক্লাস শুরু হয় তাদের।
_____________
অন্যপ্রান্তে…
গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত অবস্থায় নিভ্রকে হাসপাতালে আনা হয়। ব্যাথায় কাতরাচ্ছে। ডান হাতের বাহুতে গুলি লেগেছে। রক্তে পুরো শরীর মাখোমাখো অবস্থা। পুলিশ ফোর্স নিয়ে আস্তানায় উপস্থিত হতেই আপর গ্যাংয়ের লোকরা টের পেয়ে যায়। অনবরত গুলিবর্ষণ করতে আরম্ভ করে নিভ্রদের ওপর। প্রায় অনেকের হাতে,পায়ে গুলি করে আহত করে নিভ্র। কিন্তু শেষ একটি গুলি এসে ডান পাশের বাহুতে লাগে তার। নিভ্র দূর্বল হয়ে যায়। তিনজন কনস্টেবল তাকে নিয়ে হাসপাতালে আসে। বাকিরা সেখানে থেকে তাঁদের গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। আহতদের হাসপাতালের উদ্দেশ্যে পাঠায়। ওটির ভেতরে ঢুকানো হয় নিভ্রকে। রীতিমতো অপারেশনও শুরু করা হয়েছে।
.
.
.
#চলবে?
#আমি_তুমিতেই_আসক্ত।
#পর্ব_ ১১
#সুমাইয়া মনি।
তড়িঘড়ি করে হাসপাতালে পৌঁছায় নবনী। বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে তার। ঝাপসা চোখ জোড়া বার বার মুছে নিচ্ছে ওড়না দিয়ে। আশেপাশে সব কিছুকে উপেক্ষা করে সে কেবিনের দিকে দৌড়ে আসতে থাকে।
পথ যেন কমছে না। দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছে।
সকালে গাছে পানি দিতে এসে তালা ঝুলানো দেখে বাড়িতে। টমি বাহিরে ছিল। বাগানের পাশে তার ছোট্ট ঘর আছে । নবনীকে দেখে এগিয়ে আসে। দেখে মনে হচ্ছে টমি বেশ খুদার্ত। টমির জন্য খাবার নিয়ে আসে বাসা থেকে। টমি দ্রুত খেতে শুরু করে। খুদায় এতটাই কাতর ছিল যে ক্যাথির দিকে আজ আর তাকানোর সময় হয়নি তার।
নবনী ভাবতে আরম্ভ করে, কখনোই তালা ঝুলানো দেখে নি। আজ হঠাৎ কি হলো? কোথাও গেলে তো বলে যেতো। তাহলে কি রাতে বাড়িতে ফিরে নি নিভ্র স্যার। আর ভাবে না। ডিরেক্ট কল দেয় নিভ্রর নাম্বারে। ফোন একবার বাজতেই পীক করে জিনান। তাঁদের মধ্যে কথপোকথন হয়। তখনই জানতে পারে নিভ্রর গুলি লাগার ব্যাপার। বাকরুদ্ধ সে। থম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাসায় ফিরে আসে। হাউমাউ করে কেঁদে নিলুফা বেগমকে বলে। সে দ্রুত হাসপাতালে যেতে বলে।
ঘোলাটে চোখে জিনান সহ আরো কিছু পুলিশকে নজরে পড়ে নবনীর। সে কেবিনের সামনে এসে দাঁড়িয়েই উত্তেজিত হয়ে জিনানকে প্রশ্ন করে,
-“এখন কেমন আছে স্যার? ডাক্তার কী বলেছে? সুস্থ হয়ে যাবেন তো তিনি?”
-“শান্ত হও নবনী, নিভ্র এখন ঠিক আছে। ঘুমোচ্ছে। গুলি বের করা হয়েছে। খুব দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবে।”
জিনানের কথা শুনেও নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে। একবার চোখের দেখা দেখতে চায়। চোখ পিটপিটে বলে,
-“ভেতরে যেতে পারব কী?”
-“ডাক্তার ভেতরে যেতে এলাউ করছে না।”
মনটা আরো খারাপ হয়ে যায় তার। তবুও এই ভেবে সে শান্ত হয় নিভ্র ঠিক আছে। পাশের একটি সিটে বসে চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে স্মরণ করে শুকরিয়া আদায় করে। ভয়টা তার একটু হলেও কেঁটেছে।
পুলিশদের আনাগোনা আরো বেড়ে যায়। কেউ ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলছে, আবার কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে জিনানের সঙ্গে আলাপনে ব্যস্ত। নবনীর মাথায় হঠাৎ নিভ্রর পরিবারের কথা খেয়াল আসে। এত বড়ো দুর্ঘটনা ঘটল অথচ, নিভ্রর পরিবারের কাউকে দেখতে পেল না। বেশ ভাবাচ্ছে ওঁকে। পুলিশরা জিনানের সামনে থেকে সরে যেতেই পুনরায় নবনী তাকে জিজ্ঞেস করে,
-“নিভ্র স্যারের পরিবারের কোনে সদস্য এলো না কেন ভাইয়া?”
-“তাদের জানানো হয়নি। নিভ্রর কঁড়া নিষেধাজ্ঞা আছে।”
-“কেন?”
-“কাউকে টেনশনে ফেলতে চায় না। আর এমনেতেও এটা নতুন কিছু নয়। এর আগেও কয়েকবার আহত হয়েছে। তখনো কিছু বলে নি তাদের। সুস্থ হবার পর জানিয়েছে।”
নবনী চুপ মেরে রয়। কি বলা উচিত বুঝতে পারছে না। এত বড়ো একটি ঘটনা ঘটে গেল, অথচ তাদের জানানোর প্রয়োজন মনে করছে না। শুধু মাত্র তার জন্য চিন্তিত হবে তাই? বিষয়টি কেমন বেমানান লাগছে নিজের কাছে। কী অদ্ভুত লোক নিভ্র!
দু তিন ঘন্টা অতিবাহিত হয়। এগারোটার দিকে নিভ্রর ঘুম ভাঙ্গে। প্রথমে কয়েকজন পুলিশরা তার সঙ্গে দেখা করে। বেশ কিছুক্ষণ আলাপ চলে তাদের মধ্যে। সবাই যাওয়ার পর, শেষে জিনান আর নবনী যায় নিভ্রর সঙ্গে দেখা করতে। নিভ্রর হাতে ক্যানেলা লাগান। বেডের সাথে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় আছে। নিভ্র নবনীকে দেখে কিছুটা অবাক হয়। কিন্তু সেটা তাদের বুঝতে দেয় না। নবনী নিভ্রর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিচুস্বরে বলে,
-“আপনি এখন কেমন আছেন স্যার?”
-“আলহামদুলিল্লাহ! ভালো ফিল করছি।”
কিছুক্ষণ চুপ করে রয়। পরক্ষণে দ্বিধাবোধ নিয়ে প্রশ্ন করে,
-“কিভাবে হলো এসব?”
-“আচমকাই ঘটে গেল। তুমি কী একা এসেছো এখানে?”
নবনী মাথা উপর নিচ নাড়ায়। নিভ্র ফের বলে,
-“এখন তাহলে বাড়িতে যাও। টমিকে কিছু খাবার খেতে দিও। আর তোমার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সকালের নাস্তা করো নি। ”
নিভ্রর কথায় নবনীর মনে পড়ে সকালের নাস্তার কথা। আসলেই সে নাস্তা না করেই এখানে চলে এসেছে। নিভ্রর কথা শুনেই সে টেনশনে বিদিক হয়ে গিয়েছিল। যার দরুণ নাস্তা করা হয়নি তার।
-” যাও নবনীতা!” কিছুটা জোরেই বলে ফেলে নিভ্র।
নবনী চোখ পিটপিট করে দৃষ্টি নিচু রেখে মিনমিন করে বলে,
-“যাব! কিন্তু আমি কী আপনার সঙ্গে থাকতে পারি বিকালে?”
-“কোনো প্রয়োজন নেই। জিনান আছে। ও থাকবে আমার সঙ্গে।”
নবনী আর কিছু বলে না। নিভ্র যখন একবার বলে দিয়েছে, তখন তার কথায় কোনো নড়চড় হবে না। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে কেবিন থেকে বের হয়ে যায়। জিনান পাশের টুল টেনে বসে। বলে,
-“এখন কেমন লাগছে তোর? হাতে কী ব্যথা করছে?”
-“আই এম আল রাইট! বাট সল্প ব্যথা আছে।”
-“ঠিক হয়ে যাবে। আমি ভাবছি আন্টিকে বলব…. ”
-“খবরদার! ভুলেও এ কাজ করিস না। আম্মুর সঙ্গে পরশুদিন রাতে কথা হয়েছে আমার। তারপর আর কথা হয়নি। আমার ফোন দে কথা বলি।”
জিনান ওর পকেট থেকে নিভ্রর ফোন বের করে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ ওর আম্মুর সঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলে। দুর্ঘটনার পুরো বিষয়টি চেপে যায়। এখন সে ডিউটিতে আছে, মিথ্যে বার্তাটি বলে তাকে। সে-ও সেটি বিশ্বাস করে নেয়। যাকে বলে অন্ধবিশ্বাস!
কথা শেষ করে ফোন পাশে রেখে দেয় সে। জিনান বলে,
-“এক্টিং ভালোই পারিস। বাই দ্য ওয়ে, নবনীকে আসতে বল।”
-“মাথা নষ্ট।”
-“কেন সমস্যা কী? আমি তো এখন থাকতে পারছি না দোস্ত। আমাকে মায়ার সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে।”
-“মায়া ফোন দিয়েছে?”
-“হ্যাঁ! সম্মতি পেয়েছি।”
-“যাক ভালো। তুই যা! কিছু দরকার পড়লে নার্সদের ডেকে নিবো।”
-“আমি যাব এবং নবনীকেও পাঠিয়ে দেবো।”
-“নাহ!”
-“বলতে হবে না তোকে। শুয়ে থাক। আমি গেলাম।” বলেই ওঠে দাঁড়িয়ে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যায় জিনান। নিভ্র অস্বস্তিকর নিশ্বাস ত্যাগ করে। নবনী মানেই অস্বস্তি! কেন যে ওঁকে মেনে নিতে পারছে না, অজানা!
__________________
অনেকক্ষণ যাবত তনুজা একটি রেস্টুরেন্টে বসে আছে। মূলত সে আপনের জন্য অপেক্ষা করছে। আজকে আপনের জন্মদিন। তাই সে আপনকে রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বলে। যাতে আপনের জন্মদিনটি সে উৎযাপন করতে পাবে। আজ তাদের ফাস্ট মিটও বলা চলে। তাই তনুজা একটু বেশিই এক্সাইটেড! সই একটার দিকে আপন রেস্টুরেন্টে এসে হাজির হয়। প্রথম টেবিলেই তনুজা বসে ছিল। চেয়ার টেনে বসতে বসতে অপরাধী স্বরে মৃদু হেসে বলে,
-“স্যরি! লেট করে ফেললাম।”
-“ইট’স ওকে।” মিষ্টি করে হেসে বলে।
আপন ঘড়ির দিকে একবার নজর বুলিয়ে বলে,
-“লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে। কি খাবেন বলুন?”
-“আগে কেক কেটে নিন, ওয়েটার!” বলেই ওয়েটারকে ডাকতে লাগলো।
একজন ওয়েটার এক পাউন্ডের চকলেট কেক নিয়ে এসে টেবিলে রেখে যায়। সঙ্গে কোঁকা কোলা। তনুজা হাতের ছুরিটা এগিয়ে দেয় আপনের দিকে। মোমবাতি বিহীন কেকটি কেটে তনুজাকে খাইয়ে দেয়। তনুজাও এক পিস নিয়ে আপনকে অল্প করে খাওয়ায়। দু’জনেই লাঞ্চ করতে করতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে।
———————
একটা পনেরো মিনিটে নবনী হাসপাতালে পৌঁছায়। জিনান ওঁকে ফোন দিয়ে হাসপাতালে আসতে বলে, নবনী অনেক খুশি হয়। তাই দ্রুত গোসল করে নামাজ পড়ে কোনোমতে খেয়েই রওয়ানা হয় হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার সময় নিলুফা বেগল বলে দেয় সে বিকালে যাবে নিভ্রকে দেখতে। এতে নবনীর আপত্তি নেই। সে আসুক যে কোনো সময়৷ কেবিনে প্রবেশ করতেই নবনীর মেজাজ তুঙ্গে ওঠে যায়। যখন দেখতে পায় একজন নার্স টিস্যু দ্বারা নিভ্রর মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে। সে আইডিয়া করে নেয়, নার্সটি ঠিক নিভ্রকে নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে। কারণ ট্রেতে এঁটো খাবারের বাটি,প্লেট ছিল। দাঁতে দাঁত চেপে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়। নিভ্রর দিকে কোনো মেয়ে তাকিয়ে থাকুক, সেটা সে কিছুতেই মেনে নিবে না। আর এদিকে নার্সটি কি-না ওঁকে খাইয়ে দিয়েছে। ভেবেই নবনীর মাথায় রাগ চড়ে বসে। নিভ্র নবনীকে মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। মনে মনে জিনানের ওপর বেশ বিরক্ত হয়। পরে নবনীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“দাঁড়িয়ে আছো কেন নবনীতা? ভেতরে এসো।”
নিভ্রর কথা শুনে নবনী নিজেকে কিছুটা প্রকৃতিস্থ করে। নার্সটিও নবনীর দিকে একবার আড়চোখে তাকায়। নার্স ট্রে হাতে বেরিয়া যাওয়ার ধরছিল। নিভ্রর আগচরে নবনী নার্সটির দিকে তাকিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়েই নবনী ল্যাং মেরে নার্সটিকে ফেলে দেয়। মুখ থুবড়ে পড়ে নার্স। হাতের ট্রেটি ফ্লোরে পড়ে ঝনঝন শব্দ হয়। নিভ্র একবার তাকিয়ে নজর সরিয়ে নেয়। ফোন টিপতে থাকে। নিভ্রর সামনে মানবতার খাতির দেখিয়ে নার্সটিকে ধরতে যায় নবনী। না বুঝার ভান ধরে বলে,
-“একটু দেখে হাঁটবেন তো। দেখলেন তো অবশেষে কি হলো। উঠুন!” বলেই নার্সটিকে টেনে তুলে। অপমানে নার্সটির মুখ থমথমে হয়ে যায়। হওয়াটা স্বাভাবিক। নিভ্রর মতো সুদর্শন যুবকের সামনে এভাবে পড়ে যেতে হবে। সেটা সে মেনে নিতে পারছে না। অবশ্য, এতে তার কোনো দোষ ছিল না। না সে ইচ্ছে করে পড়েছে। তাকে ফেলা হয়েছে। ল্যাং মেরে!
ট্রেতে সব কিছু পুনরায় উঠিয়ে দেয় নবনী। নার্স ট্রে হাতে নিয়েই দ্রুত প্রস্থান করে। নবনী মনে মনে বেশ আনন্দিত। চরম ভাবে শায়েস্তা হয়েছে সে। এগিয়ে এসে দৃষ্টি নিচু রেখে টুলে বসে। রুমে শুধু তারা দু’জন উপস্থিত। নার্ভাস লাগছে নবনীর। নিভ্র ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। একজন কনস্টেবলের মেসেজ পড়ছে। যেটা কনস্টেবলটি একটু আগে সেন্ড করেছে। হঠাৎ নবনীর দিকে তাকায়। চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,
-“আমি দেখেছি নবনীতা!”
চট করে মাথা তুলে নিভ্রর দিকে তাকায়। চোখেমুখে তার বিস্ময়! নিভ্রর নজর শান্ত এবং ফোনের ওপর। ছোট একটা ঢোক গিয়ে। নিভ্র কী দেখার কথা বলছে, সেটা নবনীর বুঝতে অসুবিধা হয়না। ভয়তে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে তার। আজ কপালে শনিরদশা আছেই, শিওর! ধুর! কেন যে ল্যাং মারতে গেল। ভেবেই সে নিজের ওপর ক্ষেপে যাচ্ছে।
.
.
.
#চলবে?
কার্টেসী ছাড়া কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
Sumaiya Moni