আমি খুব ভীতু মানুষ। আমার সবচেয় বড় ভয় হলো প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়। এই ভয়ের শুরুটা ছোটবেলায়, স্কুলে।
তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি। আমাদের ক্লাসে চল্লিশ জন ছাত্র-ছাত্রী। একদিন ক্লাস টিচার অনেকগুলো গিফট নিয়ে এসে আমাদের সামনে রাখলেন এবং বললেন
– তোমাদের সবার জন্য একটা করে গিফট আছে। তোমরা একজন একজন করে আসবে আর ক্লাসের অন্য কারো প্রশংসা করে গিফট নিয়ে যাবে। একবার কারো প্রশংসা হয়ে গেলে তার সম্পর্কে আর কেউ প্রশংসা করতে পারবে না।
সেদিন শুধু আমার প্রশংসাই কেউ করেনি। খুব কান্নাকাটি করেছি। আমার ধারনা আমার চেয়েও বেশি অপ্রস্তুত হয়েছিলেন আমাদের ক্লাস টিচার। তবে এই ঘটনা আমার জীবনে প্রবল প্রভাব ফেলল। আমি কোনদিন কারও কাছে কিছু চাইতে পারতাম না। যদি না দেয়! প্রত্যাখ্যাত হওয়ার এই ভয় প্রবল হয়ে উঠল যখন চাকরি করার পালা আসল। দুইটি ইন্টারভিউতে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আমার ভয় আরো বেড়ে গেল। সিদ্ধান্ত নিলাম, চাকরিই করব না, ব্যবসা করব। রেডিমেড কাপড়ের একটা দোকান দিলাম। কিন্ত দোকানে কাউকে কাপড় দেখালেই যদি প্রত্যাখ্যান করে! ভয়ে দুইজন কর্মচারী রেখে দিলাম। ফলাফল যা হওয়ার তাই হলো। ছয় মাসের মধ্যে দোকান বন্ধ করে দিলাম প্রচুর লস করে। পরিবারের সবাই আমার উপর বিরক্ত। আমাকে দিয়ে যে কিছু হবে না সেটা সবাই নিশ্চিত হয়ে গেছে অনেক আগেই।
কিন্ত আমার একটা গুন হলো, আমি হাল ছাড়ি না। কিভাবে এই ভয় দুর করা যায় তাই নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। একটা আইডিয়া খুব পছন্দ হলো। যে জিনিসটা তোমাকে ভয় দেখায় সেটা গুনে গুনে একশবার কর, দেখবে ভয় কেটে গেছে। আমিও চিন্তা করলাম, এমন একশটা কাজ করব যাতে একশবার প্রত্যাখ্যাত হই।
প্রথম কাজ, কোন অচেনা কারো কাছে একহাজার টাকা ধার চাব। চলে গেলাম নিউ মার্কেটে। বিশাল দেহের এক লোককে দেখলাম বসে আছে, তার কাছেই চলে গেলাম সাহস করে।
– আপনি কি আমাকে একহাজার টাকা ধার দিবেন?
– না। কিন্ত টাকা দিয়ে তুমি কি করবে?
আমি কোনদিকে না তাকিয়ে দৌড়ে পালালাম। যাক একবার হয়ে গেছে, আরো নিরানব্বই বার দরকার, ভয় কেটে যাবে। ভেবে দেখলাম, লোকটা তো আমাকে একটা প্রশ্ন করেছিল! উত্তর দিলে হয়তো ঘটনা অন্য রকম হতে পারত! ঠিক করলাম, এর পরে কেউ প্রশ্ন করলে পালাব না, উত্তর দেব।
এভাবে চলতে লাগল। পনের তম কাজ, অপরিচিত কারো বাসায় একটা ফুল গাছ লাগাব। নার্সারি থেকে একটা গোলাপের চারা নিয়ে চলে গেলাম এক বাসায়। এক ভদ্রলোক দরজা খুললেন।
– আমি কি এই গোলাপ গাছটা আপনার বাসায় লাগাতে পারি?
– না।
আমার কাজ হয়ে গেছে, এখন না শুনে আর ছুটে পালাই না। কিন্ত কি মনে করে এই ভদ্রলোককে একটা প্রশ্নও করে ফেললাম
– কেন জানতে পারি? ফুলগাছতো সবাই পছন্দ করে।
– আসলে আমার ছোট বাচ্চা আছে। গাছ লাগালে পাতা ছিড়ে ফেলবে আর গোলাপের গাছের কাঁটা লেগে হাতও কাটতে পারে। আপনি বরং আমার পাশের বাসায় যান, ওনি খুব পছন্দ করেন ফুলগাছ।
ঢং করে আমার মাথায় ঘন্টাটা বেজে উঠল। আরে আমার মধ্যে তো প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় না, ভয় হচ্ছে প্রশ্ন করার। সঠিক সময়ে প্রশ্ন না করে করে আমি আজকে এখানে। উত্তর নয়, প্রশ্ন করার সামর্থ্যই মানুষকে সফল করে তুলে।
কেমন লাগল আমার গল্পটা?