আমিরাহ্ পর্ব-১৫+১৬

0
747

#আমিরাহ্

১৫,

ভোরের আলো ফুটে উঠতেই সবাই খুবস, পনির, জয়তুন আর পুদিনা চা দিয়ে ঝটপট নাস্তা সেরে নিল। এবার ক্যাম্প গোটানোর পালা। সূর্য তেতে ওঠার আগেই আবার যাত্রা শুরু করতে হবে। সব গোছানো শেষে যাত্রা শুরু হলো।

প্রায় ঘন্টাখানেক চলার পরে আমিরাহ্ খেয়াল করল গাড়িতে আছিয়ার ছোটো মেয়েটা নেই। দুই বছর বয়সী বাচ্চাটা আমিরাহ্ র খুব নেওটা। তাই অনেকক্ষণ ওর সারাশব্দ না পেয়ে আমিরাহ্ ওর কথা জিজ্ঞেস করল। সে জিজ্ঞেস করতেই আছিয়ার মনে পড়ল নিজের সন্তানের কথা। পথের পাশে পুরো কাফেলা থামল। অপর গাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল সেখানেও সে নেই। এতক্ষণে আছিয়া কাঁদতে শুরু করল। আছিয়ার স্বামী এসে একবার চাপা স্বরে বকে গেছে,

– কেমন মা তুমি? নিজের বাচ্চা যে সাথে নেই সেই খেয়ালও নেই। ছোটো উম্মী জিজ্ঞেস না করলে তো এখনও তোমার মনে পড়ত না নিজের মেয়ের কথা। এখন আর ঢঙ করে কান্নার দরকার নেই।

মেহমুদ বোনকে বাঁচাতে এগিয়ে আসল।
– চল, কালরাতে যেখানে ছিলাম সেখানেই গিয়ে দেখি। ওখানে থাকার সম্ভাবনাই বেশি। আছিয়া, ওকে শেষবার কখন দেখেছ?

– ফজরের নামাজের সময় মসজিদে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের জামাতের পাশেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। বের হওয়ার সময় আমার বড়ো মেয়েটা এত কাঁদছিল যে ওকে সামলাতে গিয়ে ছোটোর কথা আর মনে ছিল না।

আছিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল।

– ও যদি ঘুম ভেঙে হেঁটে মরুভূমিতে চলে যায়, আর পাওয়া যাবে? সব কাজ তো আমরাই করলাম। শুধু বাচ্চাগুলোকে গুছিয়ে গাড়িতে তুলবে সেটাও পারলে না?
আছিয়ার স্বামীর কন্ঠে একইসাথে সন্তানের জন্য উৎকন্ঠা আর স্ত্রীর প্রতি ভর্ৎসনা প্রকাশ পেল।

আমিরাহ্ এবার আছিয়াকে উদ্ধার করতে বলল,

– এখানে সময় নষ্ট না করে চলেন আগে গিয়ে দেখি। বেশি সময় তো হয়নি। বাচ্চা মানুষ। এমনও তো হতে পারে যে সে এখনও ঘুমিয়েই আছে।

অগত্যা পুরো দল আবার ফিরে চলল পুরোনো পথে।

সেখানে গিয়ে সহজেই বাচ্চাটাকে পাওয়া গেল। সে ঘুম থেকে উঠে কাউকে না দেখে কাঁদছিল। কান্না শুনে সেখানকার এশিয়ান ম্যানেজার বাচ্চাটাকে তার অফিসেই বসিয়ে রেখেছিল।

বাচ্চাকে সহিসালামতে খুঁজে পেয়ে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। আছিয়ার স্বামী অত্যধিক খুশি হয়ে ম্যানেজারকে শুভকামনা দিল যেন সে শীঘ্রই আরেকটা নিকাহ্ করতে পারে। তবে ম্যানজার লোকটির কথাগুলো আমিরাহ্ র খুব ভালো লাগল। লোকটি বিনীতভাবে বললেন,

” আমার যে বেগম আছে আমি তাকে নিয়েই খুশি। আমার একজনই যথেষ্ট। আর নিকাহের প্রয়োজন নেই। দোয়া করবেন যেন তাকে নিয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারি।”

আমিরাহ্ ঠিক এমনটাই চেয়েছিল জীবনে। সে হবে তার স্বামীর একমাত্র বেগম, একমাত্র প্রেয়সী। কিন্তু একজন আরব মেয়ে হয়ে এমনটা ভাবাই যেন আমিরাহ্ র জন্য চরম বোকামি ছিল। মানুষের সব চাওয়া কী আর পূরণ হয়?

বি: দ্র: আরবরা পুরুষদের শুভকামনা জানাতে আরেকটা বিয়ের দোয়া করে। আমরা যেমন দোয়া করি ” ভালো থাকুন”, ” আল্লাহ আপনার ভালো করুক”, ” সুখে থাকুন” তেমনি এরা বিয়ের জন্য দোয়া করে।যেন এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না। তবে নারীদের ক্ষেত্রে শুভকামনা জানাতে কী বলা হয় তা আমার জানা নেই। সেখানে তো আর একাধিক বিয়ের দোয়া করা সম্ভব না।

বাচ্চা হারানোর ঘটনাটা কিন্তু সত্যি। এরকম একটা ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল।

চলবে…

#আমিরাহ্

১৬,

ইতোমধ্যে জোহরের ওয়াক্ত হয়ে গেলে সবাই নামাজ শেষ করে সেখানকার রেস্টুরেন্টেই দুপুরের খাবার খেয়ে নিল। মেন্দিল ভাত, আস্ত মুরগির গ্রীল আর শোরবা দিয়ে ভুরিভোজ সেরে আবার যাত্রা শুরু হলো। আজ আর কোথাও কাফেলা ফেলার পরিকল্পনা নেই। এমনিতেই যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। আজ সারারাত পালাক্রমে গাড়ি চালানো হবে।

রাত বাড়তেই ড্রাইভারের হাতে গাড়ির ভার ছেড়ে দিয়ে মেহমুদ বিশ্রাম নিতে গেল। গাড়িতে সব মেয়েরা নিকাব বেঁধে নিল। তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করে আমিরাহ্ ভয়ে শিউরে উঠল। ইন্ডিয়ান তরুণ হিন্দু ড্রাইভার আর আয়শা রিয়ারভিউ মিররে বারবার চোখাচোখি করছে। নেকাবের আড়ালে আয়শার হাসি আমিরাহ্ র নজর এড়াল না।

ঘটনার ভয়াবহতা আয়শা বুঝতে না পারলেও আমিরাহ্ ঠিকই বুঝে নিয়েছে। যদি ওদের মাঝে কোনো ধরণের সম্পর্ক থেকে থাকে আর সেটা যদি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছে যায় তাহলে অনর্থ ঘটে যাবে। দুজনেরই নিশ্চিত গর্দান যাবে। সৌদী আরবে প্রেম- ভালোবাসাকে যেনা হিসেবেই দেখা হয়। আর যেনার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এই কারণেই আমিরাহ্ আর আহমাদ একে অপরকে পছন্দ করলেও কখনও তা প্রকাশ করার সাহস পায়নি।

আমিরাহ্ সিদ্ধান্ত নিল সে আয়শার সাথে আগে এ ব্যাপারে কথা বলবে। অবস্থা বুঝে তারপর আব্বাসকে জানাবে। যে করেই হোক ব্যাপারটা জানাজানি হওয়ার আগেই মিটিয়ে ফেলতে হবে। এধরণের ভালোলাগা, ভালোবাসার পরিণতি বিপদ ছাড়া আর কিছুই নয়।

***
রাতভর যাত্রা শেষে ভোরে তারা মিকাত মসজিদে পৌঁছাল। পথে আমিরাহ্ দেখল জাবাল – এ-নূর এর সুউচ্চ চূড়ায় থাকা হেরা গুহা– যেখানে নবীজী দিনের পর দিন আল্লাহ্ র ইবাদত করেছেন। মিকাত মসজিদে দুই রাকআত নামাজ পড়ে হেরেম ( ওমরাহ্ ও হজ্জের জন্য নির্ধারিত পোশাক) বেঁধে সবাই হেরেম( কাবা) শরীফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।

হেরেম শরীফের বিশাল আঙিনায় পা রাখতেই আমিরাহ্ র শরীর মন শীতল হয়ে গেল। মার্বেল পাথরের মেঝে তপ্ত রোদেও সুশীতল। ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর উড়ে যাচ্ছে, নিচে বসে দানা খুঁটে খাচ্ছে। মানুষকে এরা ভয় পায় না। জমজমের ঠান্ডা পানি পান করে সবাই তাওয়াফ শেষ করল। আমিরাহ্ পরিবারের উপরে আসা এ নতুন মুসিবত থেকে তাদের রক্ষা করার জন্য আল্লাহ্ র কাছে খাস দিলে দোয়া করল।

তাওয়াফের পরে দুপুরের খাওয়া শেষ করে সবাই আশেপাশের দোকানে কেনাকাটা করতে গেল। মেয়েদের যা স্বভাব, কিছুই কেনার নেই তবুও দেখলেই কিনতে ইচ্ছা করবে। দোকানে দোকানে ঘুরতে ঘুরতে আমিরাহ্ আয়শা আর ড্রাইভারকে লক্ষ্য করতে লাগল। তার অনুমানই সঠিক। আমিরাহ্ এবার নিশ্চিত হলো যে তাদের মধ্যে অবশ্যই কিছু চলছে।

আরেকটা বিষয় আমিরাহ্ র খুব বিরক্ত লাগছিল। আমিনা আর আছিয়া যখনই কোনো পরপুরুষ দেখছে তখনই বোরকা ঠিক করার বাহানায় তাদের সেলাইবিহীন বোরকা সরিয়ে শরীর দেখাচ্ছে। আর সব আরব নারীদের মতো তারাও শরীর কেটে বসা ম্যাক্সি পড়েছে যার বুকের কাছে আবার জানালার মতো কেটে ডিজাইন করা হয়েছে।

আমিরাহ্ ভেবে পায় না, এরকম হিজাব-নেকাব করার মানে কী? নিজের কলবকেই যদি পর্দায় আবৃত না করা যায় তাহলে লোক দেখানো পর্দা করা কেন? মানুষ বা সমাজকে ভয় না করে ভয় করা উচিত আল্লাহ্ তায়ালাকে। অথচ অধিকাংশ আরব নারী-পুরুষ শুধু লোক দেখানো পর্দাই করে। আরব পুরুষ এবং ছেলেরা যেমন মেয়ে দেখলে বেহুশ হয়ে যায়, মেয়েরাও ঠিক তেমন।

এত নির্লজ্জ আচরণ আমিরাহ্ র আর ভালো লাগছিল না। তাই সে তাদের জন্য বুকিঙ দেওয়া হোটেলে রওয়ানা হলো। হোটেলে আমিরাহ্ আর আয়শা একরুমে থাকবে। আমিরাহ্ রাতেই আয়শাকে ড্রাইভারের বিষয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল।

চলবে …

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে