#আমিরাহ্
১১,
সকালে ঘুম ভাঙতেই নুঙ দৌড়ে এল,
– ছোটো বেগম আপনি উঠেছেন? সবাই কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনাকে দেখতে পারিবারিক বসারঘরে চলে আসবে। বড়ো বেগম আপনাকে জলদি তৈরি হতে বলেছেন।
আমিরাহ্ তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না সে কোথায়? কারা আসবে তাকে দেখতে? কেন আসবে? আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল। গতরাতে তার ঠিকমতো ঘুম হয়নি। একে তো নতুন পরিবেশ, নতুন বিছানা, তার নতুন জীবনের নানা আশঙ্কায় একদম শেষরাতে তার চোখ লেগেছে। এখন তাই কেমন আধো ঘুম আধো জাগরণে নুঙের কথা ঠিকমতো বুঝতে সময় লাগছে। নুঙ আবারও তাড়া দিল,
– ছোটো বেগম, জলদি উঠুন। আপনাকে কি গাওয়া এনে দেব? তাহলে ঘুম ভাবটা কেটে যাবে।
– উমম, দিতে পারো তবে ” র ” গাওয়া দিও না। নেসকাফি( নেসক্যাফে) থাকলে তাই দিও, সাথে বেশি করে দুধ-চিনি মেশাবে কিন্তু।
নুঙ মুচকি হাসল।
– আচ্ছা। আমি আপনার জন্য কাফি নিয়ে আসছি আর এই যে আপনার পোশাক ( আরব নারীরা বেশিরভাগ ম্যাক্সিই পরে) আর গয়না গুছিয়ে দিলাম, এগুলো পরে নিন।
আমিরাহ্ ফ্রেশ হয়ে খয়েরি রঙের দামি মখমলের সোনালি কারুকার্য করা ম্যাক্সিটা পরে নিল। সকাল সকাল এত ভারি পোশাক পরতে ভালো না লাগলেও চুপচাপ পরে নিল। এবার গয়নাগুলো দেখে ওর রীতিমত ভয় লাগল। এরমাঝেই নুঙ কফি নিয়ে আসল। সাথে বড়ো বেগমও আসলেন।
– আসসালামু আলাইকুম আমিরাহ্।
– ওয়ালাইকুমুস সালাম বড়ো উখতি।
বড়ো বেগম এসে আমিরাহ্কে আরবদের সাধারণ সৌজন্যমূলক আলিঙ্গন করলেন এবং আমিরাহ্ এর গালে হালকা চুমু খেলেন। প্রতি উত্তরে আমিরাহ্ ও তাকে আলিঙ্গন করে গালে চুমু খেল। তিনি আমিরাহ্ র গলায় একটা হার পরিয়ে দিলেন।
– রাত কেমন কাটল? ঘুম হয়েছিল? ভয় লাগেনি তো?
আমিরাহ্ শুধু মুচকি হেসে মাথা নাড়ল। সে নিশ্চিত যে বড়ো বেগম নিশ্চয়ই জানেন যে আব্বাস আল আবাদি কাল রাতে এ ঘরে থাকেননি। এবার তিনি নিজেই মুখ খুললেন।
– আব্বাস কাল আমার ঘরেই ছিল। সে নিজেও আসলে তোমার বয়স নিয়ে বিব্রত। কিছুদিন সময় দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে। আব্বাস খুব সকালেই কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেছেন। এখন তুমি তাড়াতাড়ি চলো সবার সাথে দেখা করবে। তারপর সবাই একসাথেই সকালের খাবার খাব।
– এতগুলো গয়না কি এখন পরা জরুরি?
– তুমি তো নতুন বউ। এটুকু তো পরতে হবে। পরে আস্তে আস্তে কমিয়ে দিও। তবে আল আবাদি পরিবারের বেগমদের পোশাকে, গয়নায় সবসময়ই পরিপাটি থাকাটাই এই বংশের নিয়ম। আমি যখন প্রথম এ বাড়িতে এসেছিলাম তখন তোমার বয়সীই ছিলাম। আমারও তখন এসব ভালো লাগত না। অথচ এখন না পরলে কেমন খালি খালি লাগে। তোমারও অভ্যাস হয়ে যাবে।
নববধূ আমিরাহ্ নবরুপে সজ্জিত হয়ে পারিবারিক বিশাল বসার ঘরে প্রবেশ করলে। রুমে ঢুকতেই তার হৃদয়ে ধাক্কা লাগল। একদম দরজার সামনেই যে বসে আছে সে আর কেউ না, আহমাদ। আহমাদ আমিরাহ্কে এক নজর দেখেই মাথানত করে ফেলল। সবার সাথেই একে একে আমিরাহ্ র সৌজন্য সাক্ষাত হলো। মেজ বেগমও এগিয়ে এসে ওর গলায় একটা হার পরিয়ে দিলেন, বেশ কিছুক্ষণ বুকের সাথে জড়িয়ে রাখলেন। আমিরাহ্ বুঝতে পারল মহিলার মনে বেশ কষ্ট হচ্ছে। এতদিন নিজে ছোটো ছিলেন। এখন তার জায়গা দখল হলো।
মেজ বেগমের বড়ো দুই মেয়ে আমিনা এবং আছিয়া মাপা মাপা সৌজন্য বিনিময় করল। দুজনেই বিবাহিত। এটুকু সময়েই তাদেরকে আমিরাহ্ র বেশ অহংকারি মনে হলো। সেই তুলনায় মেহমুদের বেগম রুকাইয়া এবং আহমাদের ছোটো বোন আয়শা বেশ আন্তরিক। রুকাইয়া পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। প্রথম মাতৃত্বের আলাদা আভা তার চোখে মুখে। আয়শাও বেশ মিষ্টি মেয়ে।
আলাপ পরিচয় শেষে মেয়েরা মেয়েদের খাবার ঘরের দিকে রওয়ানা হলো। মেহমুদ শুরুতেই পরিচয় সেরে চলে গিয়েছিল। শুধু আহমাদ এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। শুধু একবার সে আমিরাহ্কে সালাম দিয়েছে তবে মুখের দিকে তাকায়নি। আমিরাহ্ আড়চোখে বারবার আহমাদকে দেখছিল। এই নতুন সম্পর্কে তার প্রতিক্রিয়া কী সেটা আমিরাহ্ র খুব জানতে ইচ্ছা করছে।
– আহমাদ, তুমি নাস্তা খেতে যাচ্ছ না যে।
– যাব উম্মী এখানে একটু কাজ আছে।
আমিরাহ্ র মনে হলো আহমাদ ওর জন্যই এখানে বসে আছে। হয়তো কিছু বলতে চায়। তাই ইচ্ছা করেই সবার থেকে একটু পিছিয়ে থাকল। আমিরাহ্ দরজার বাইরে পা রাখার আগেই পিছন থেকে শুনতে পেল সেই পরিচিত কন্ঠস্বর,
– শুনুন।
চলবে…
#আমিরাহ্
১২,
আহমাদের ডাক শুনে আমিরাহ্ র বুক ধ্বক করে উঠল। সেই পরিচিত কন্ঠস্বর। সেই প্রথমদিন সন্ধ্যায় এভাবেই পিছন থেকে আহমাদ ডেকেছিল। এই ডাক উপেক্ষা করার শক্তি আমিরাহ্ র নেই। সে দাঁড়িয়ে সরাসরি আহমাদের চোখে তাকাল, শুধুই এক মূহুর্তের জন্য। এই এক মূহুর্তের দৃষ্টি বিনিময়ে হাজারো না বলা শব্দ বিনিময় হয়ে গেল। আমিরাহ্ র কেন যেন আহমাদের উপর প্রচন্ড রাগ লাগছে। সে কী চাইলে পারত না বিয়েটা আটকাতে? নিজের কথা কী কাউকেই বলতে পারত না?
আহমাদ কেশে গলা পরিষ্কার করল। যেন বিবেকবোধ, অপরাধবোধের শ্লেষ্মা জমে এতদিন তার কন্ঠরুদ্ধ হয়েছিল।
– পরিস্থিতি এমনভাবে বদলেছে আর এমনই আকস্মিকভাবে বদলেছে যে এখানে কারোই কিছু করার ছিল না।
– আচ্ছা, তাই বুঝি? নিজের কথা জানানোর মতো কেউ কি এই পরিবারে ছিল না?
– তাতে কী লাভ হতো? হয়তো নিকাহ্টা ভেঙে যেত। কিন্তু একবার বাবার জন্য যার সাথে নিকাহ্ র কথা হয় তার সাথে কী আর কখনোই ছেলের নিকাহ্ র আলাপ হতে পারে? মাঝখান থেকে আপনাদের পরিবারে আরও বিপর্যয় নেমে আসত। আমি আপনার বাবাকে চিনি, আপনার ছোটো ভাই আমার বন্ধু। আমি চাইনি আমার একটা কথায় তাদের জীবনে অশান্তি সৃষ্টি হোক।
– আর আমার জীবনে যে অশান্তির জন্ম হয়েছে তাতে কারও কিছু যায় আসে না তাই না? আমি তো শুরুতেই বুঝেছিলাম এখানে কিছু সম্ভব না। এইজন্য সবসময়ই নিজেকে দূরে রাখতে চেয়েছি। আপনি কেন বারবার আমার কাছে যেতে চেষ্টা করেছেন? আপনি এত বড়ো ব্যাবসা সামলান, এত বিচক্ষণ আপনি, এটুকু বোঝেননি?
– যা নিয়তি নির্ধারণ করেছে তার বিপক্ষে কিছু করার আর কিছু তো নেই। আপনার আর আমার একসাথে পথচলা এখানেই থেমে গেছে। ভালো হবে পুরোনো সবকিছু আমরা ভুলে যাই।
– জানেন তো মেয়েরা হচ্ছে পানির মতো বর্ণ, গন্ধ, আকারহীন। যে পাত্রে রাখা হয় তার রুপ ধারণ করে। আমি ঠিকই এই পরিবারের বর্ণ, গন্ধ, আকারে নিজেকে বদলে নেব। আপনি কি পারবেন?
আহমাদ এ প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। কথা ঘুরিয়ে বলল,
– আপনার কিছু আমানত আমার কাছে গচ্ছিত আছে। সেগুলো ফিরিয়ে দিতেই আপনাকে দাঁড়াতে বলেছি।
– আমার আমানত? আমি কি আপনাকে কখনও কিছু দিয়েছিলাম?
আহমাদ নীরবে চন্দন কাঠের কারুকার্য করা ছোটো একটা বাক্স আমিরাহ্ এর হাতে তুলে দিল। আমিরাহ্ কাঁপা হাতে বাক্সের ঢাকনা খুলল। সেখানে নীল মখমলে শুয়ে আছে সেই হীরাচূর্ণ খচিত পান্নার আঙটিটা, যেটা আহমাদ আমিরাহ্কে দিতে চাইলেও সে নেয়নি। পাশেই একটা কাগজ। কাগজের ভাঁজ খুলে আমিরাহ্ নিজের হাতের সেই মেহেদির ছাপ দেখতে পেল। ” এটাও আহমাদ এতদিন ধরে যত্ন করে রেখেছে!” আমিরাহ্ র চোখ ভরে এল।
– বস্তুগত যেটুকু ছিল ফিরিয়ে দিলাম। অবস্তুগত যা আছে তা তো ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব না। সেটুকু নাহয় মনের কোণের এক বিশেষ সিন্দুকে সুখ অথবা দুঃখের স্মৃতি হয়েই তোলা থাকুক।
শেষদিকে আহমাদের গলা ভেঙে আসল। আমিরাহ্ ওর চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু দেখতে পেল। আহমাদ তার চোখের পানি লুকাতেই যেন পালিয়ে বাঁচল। আমিরাহ্ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। বেশ কিছুক্ষণ কান্নার পরে একটু ধাতস্থ হয়ে সে খাবার ঘরের উদ্দেশ্যে বের হলো। দেখল আয়শা দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখমুখ লাল হয়ে আছে।
– ছোটো উম্মী, তুমি নিজের পরিবারের জন্য এত কষ্ট মাথা পেতে নিলে!
ওর কথায় আমিরাহ্ একটু থতমত খেয়ে গেল। আয়শা তার দুই হাত নিজের হাতে টেনে নিল।
– আমি তোমাদের সব কথা শুনেছি। তোমার দেরি দেখে ডাকতে এসেছিলাম। ভয় নেই, একথা আমার বাইরে আর কেউ জানবে না। তোমার হাতে যা আছে সেগুলো রেখে মুখ ধুয়ে এসো। তোমাকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে তুমি অনেক কেঁদেছ। আমার বোকা ভাইটার জন্য কষ্ট হচ্ছে। তার পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। দোয়া করি সে নিজেকে সামলে নিক। তুমি জলদি আস।
আয়শা আর দাঁড়াল না। আমিরাহ্ নিজের রুমে ফিরে গেলে। আলমারির লকার খুলে আঙটিসহ বাক্সটা রাখল। আমিরাহ্ নিজের অজান্তেই বলেছিল এটা যেন আহমাদ তার বেগমের জন্য রেখে দেয়। তখন সেই স্থানে নিজেকে কল্পনা করলেও আজ তার অবস্থান বদলেছে। এই আঙটি কখনও নিজের আঙুলে পরা আমিরাহ্ র পক্ষে সম্ভব না। তাই এটা সযতনে তোলাই থাক।
এরপর ওয়াশরুমে গিয়ে হাতের ছাপ লাগানো কাগজটা টুকরো টুকরো করে কমোডে ফেলে ফ্ল্যাশ করে দিল। সেই সাথে নিজের হৃদয়ের প্রথম সুখানুভূতিটুকুও যেন টুকরো টুকরো করে ফ্ল্যাশ করল। ঘুরতে ঘুরতে কোন এক অতল গহ্বরে হারিয়ে গেল সেই প্রথম ভালোলাগা, প্রথম আবেগ, প্রথম দেখা স্বপ্নগুলো। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে যে বেরিয়ে এলো সে এক অন্য আমিরাহ্।
চলবে…