আমিরাহ্ পর্ব-০৬

0
784

#আমিরাহ্

৬,

সাফাকে নিয়ে সন্ধ্যার একটু আগে আমিরাহ্ ছাদে উঠল। তিন বছর বয়সী সাফা খুব তুড়বুড়ি বাচ্চা। বাসায় থাকতে চায় না। তাই ওকে নিয়ে রোজ বিকেলেই আমিরাহ্ ছাদে আসে। পুরো ছাদের চারিদিকে বেশ উঁচু করে দেয়াল টানা আছে, যেন বাইরে থেকে কোনো পুরুষ অন্দরমহলের নারীদের দেখতে না পারে। একারণে ছাদে এসে আমিরাহ্ নিশ্চিন্ত মনে সাফাকে ছেড়ে দেয়। সে সারা ছাদ ঘুরে ঘুরে একা একাই খেলে।

এসময়টা আমিরাহ্ এর একান্ত সময়। সাফাকে খেলতে দিয়ে সে বসে বসে আকাশ দেখে। সে শুনেছে সাগরের বুকে অস্ত যাওয়া সূর্য না কী ভীষণ সুন্দর। অনেক অনেক কবি- সাহিত্যিক সে দৃশ্য নিয়ে অসংখ্য কবিতা, গল্প, উপন্যাস লিখেছেন। কিন্তু আমিরাহ্ মনে করে সেইসব সাহিত্যিকেরা যদি মরুভূমির বুকে অস্ত যাওয়া সূর্যের সৌন্দর্য দেখত তবে লেখার ভাষাই হারিয়ে ফেলত। অস্তগামী সূর্য আকাশের বুকজুড়ে যে কত রঙ ছড়িয়ে দিয়ে যায় তা কোনো চিত্রকরের রঙতুলিতে বুঝি ধারণ করা সম্ভব নয়।

এই রঙের খেলা দেখতে দেখতে আমিরাহ্ ভাবনায় ডুবে যায়। সে এখন পনেরো বছরে পদার্পন করেছে। তার বয়সী মেয়েরা যেখানে সাজগোজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সেই বয়সে আমিরাহ্ তার চারপাশ পর্যবেক্ষণ করতে ভালোবাসে। সে তার বয়সের তুলনায় অনেক বেশি বুদ্ধিমতী ও বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন। সে বুঝতে পারে তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা আগের চেয়ে অনেকটা খারাপ হয়ে পড়েছে। তার বড়ো দুই ভাই বিয়ে করেছে। পরিবারের সদস্য সংখ্যা দিন দিন বাড়লেও উপার্জন বাড়েনি। তাই সংসারে নানা টানাপোড়েন শুরু হয়েছে।

এসবের মাঝে আমিরাহ্ আহমাদের ভাবনাকে জোর করেই মন থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। সে ভাবে হয়তো আহমাদের জন্য তার পরিবার আমিরাহ্কে গ্রহণ করবে না। সেক্ষেত্রে দূরত্ব বজায় রাখাটাই ভালো। ওদের সম্পর্কটা এখনও আগের মতোই ভাসাভাসা রয়ে গেছে। আমিরাহ্ ইচ্ছা করেই আর আহমাদদের দোকানে যায় না। কিন্তু আহমাদ এসব বুঝতে চায় না। কিছুদিন পরপর আমিরাহ্ এর ছোটো ভাই এর সাথে গল্প করার ছুতোয় ওদের বাসায় আসে। আমিরাহ্ কখনো সামনে যায় না। তবুও যে সে কেন আসে আমিরাহ্ বোঝে না।

গত ঈদের চাঁদরাতে সে হঠাৎ এসে হাজির হয়েছিল। আমিরাহ্ তখন হাতে মেহেদি পরছিল। কিছুক্ষণ পরে সাফার হাতে একটা কাগজ পাঠিয়েছিল। তাতে লেখা ছিল ” ঈদ মুবারক”। আমিরাহ্ কাগজের উল্টো পিঠে শুধু নিজের মেহেদিরাঙা হাতের একটা ছাপ দিয়ে সাফার হাতেই আবার পাঠিয়ে দিয়েছিল। আর কিছু লিখেনি।

এসব ভাবনার মাঝেই সালমা দৌড়ে এল।

— আমিরাহ্! আমি যে আজ কী খুশি!

– কেন কী হয়েছে? বাবা তোমার জন্য নতুন গয়না এনেছে?

– আরে নাহ্, ধূর! তুমি আমাকে কী ভাবো বলো তো? আমি আজ তোমার জন্য খুশি। আল আবাদি পরিবার থেকে তোমার জন্য নিকাহ্ এর পয়গাম এসেছে। এতদিনে তোমার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।

আমিরাহ্ হতবাক হয়ে গেল।

– হঠাৎ? আমার জন্য? তুমি ঠিক জানো? পাত্র কে তা জেনেছ?

– কে আবার হবে? তার বড়ো ছেলে তো কিছুদিন আগেই নিকাহ্ করল। আহমাদ ছাড়া ঐ পরিবারের আর কারো নিকাহ্ তো বাকী নেই। তারা তো শুধুই দুই ভাই। আমি শুনেছি তোমার বাবা তোমার মায়ের কাছে বলছিল যে ঐ বাড়িতে তোমার নিকাহ্ হবে। এটুকু শুনেই আমি তোমাকে খবরটা জানাতে ছুটে এসেছি। আহমাদ তোমাকে পছন্দ করে। তার ভাই নিকাহ্ করেছে। নিশ্চয়ই সে এখন তোমার কথা তার পরিবারকে বলে নিকাহ্ এর পয়গাম পাঠিয়েছে।

আমিরাহ্ র কেন যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। এত সহজে স্বপ্ন পূরণ হয়?

মাগরিবের নামাজ পড়ে আমিরাহ্ জায়নামাজেই বসে রইল। তার কেন যেন খুব ভয় ভয় লাগছে। বুক ধরফর করছে। পাশে বসেই সাফা ছাগলের চামড়ার থলেতে রাখা তরল দই ঢেলে খাচ্ছে।

ছাগল জবাই করার পরে তার শরীর থেকে চামড়াটা আস্ত খুলে নেওয়া হয়। এরপর এর চার পায়ের জায়গায় দড়ি দিয়ে বেঁধে শুধু গলার জায়গাটা খোলা রাখা হয়। এরপর এটা ধুয়ে শুকিয়ে নিলে থলের মতো হয়। এবার থলের ভিতরে কাঁচা দুধ ভরে গলার কাছের মুখটাও দড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। এভাবে সারারাত থাকার পরে আরবের গরমে সেই দুধ প্রাকৃতিকভাবেই দই হয়ে যায়।

আমিরাহ্ নিজেও এই দই খুব পছন্দ করে। কিন্তু এখন সাফাকে খেতে দেখেই তার গা গোলাচ্ছে। এমন সময়ে বাবার ঘরে তার ডাক পড়ল। দুরুদুর বুকে বাবার ঘরে গিয়ে দেখল বাবা, আমিরাহ্ এর চার উম্মী এবং তার সব ভাই সেখানে উপস্থিত। কিন্তু সব মা এবং ভাইদের মুখ থমথমে। এমনকি সালমাও মুখ চেপে বসে আছে, যেন অনেক কষ্টে কান্না সামলাচ্ছে। শুধু আমিরাহ্ এর বাবাকে বেশ প্রসন্ন মনে হচ্ছে। তিনি গলা খাকারি দিয়ে কথা শুরু করলেন,

– মা আমিরাহ্, তুমি জানো আমাদের ব্যাবসা ইদানিং ভালো যাচ্ছে না। আসলে অনেকদিন থেকেই ভালো যাচ্ছে না। সাফার জন্মের সময় আল আবাদি পরিবার আমাদের বাড়িতে এসেছিল, তোমার নিশ্চয়ই তা মনে আছে। ঐসময়ে আমি আব্বাস আল আবাদির কাছ থেকে বেশ কিছু রিয়াল ধার নিয়েছিলাম। কথা ছিল এক বছর পরেই ফিরিয়ে দেব। তারপর একে একে তিন বছর চলে গেলেও আমি সেই অর্থ ফেরত দিতে পারিনি। আব্বাস আল আবাদি নিতান্তই সজ্জন বলে তিনিও কখনও চেয়ে পাঠাননি। কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পারছি যে এখন আমাদের ব্যাবসার যে অবস্থা তাতে সেই অর্থ ফেরত দেওয়া হয়তো কখনোই সম্ভব হবে না। তাই আজ আমি তার কাছে গিয়েছিলাম অর্থের বিনিময়ে সে যেন আমাকে দিয়ে কোনো কাজ করিয়ে নেয় অথবা আমার কোনো সম্পদ নিয়ে নেয়। আসলে এছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। আমি তার জন্য তোমার কাছে আগেই মাফ চেয়ে নিচ্ছি।

আমিরাহ্ কিছুই বুঝতে পারছে না। বিকালে সালমার বলা কথার সাথে এখন বাবার কথার কোনো মিল পাচ্ছে না। হঠাৎ এমন কী ঘটল যে তার বাবা তার কাছে মাফ চাইছে? নিকাহ্ কী ভেঙে গেছে? গেলে যাবে। সেসব নিয়ে আমিরাহ্ ভাবে না। তাই বলে সেজন্য বাবা তার কাছে মাফ চাইবে এটা সে মেনে নিতে পারল না।

– বাবা, আপনি কী বলছেন? আপনাকে মাফ চাইতে হবে কেন?

– তুমি তো জানো আমাদের সমাজে মেয়েদের নিকাহ্ এর সময় পাত্রের পরিবার পাত্রীর মা-বাবাকে অর্থ উপহার দেয়। এতকাল কন্যাকে লালন-পালন করে, বড়ো করে সেই আদরের সন্তানকে পাত্রপক্ষের হাতে তুলে দেওয়া হয় বলেই কন্যার মা-বাবাকে এই উপহার দেওয়া হয়।

– হ্যা জানি। আপনি কী আপনার ধার নেওয়া অর্থকে আমার নিকাহ্ এর উপহার দিয়ে বদলে নিতে চাচ্ছেন?

– হ্যা। আব্বাস আল আবাদি বিনাশর্তেই সেই অর্থ আমাকে দান করতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি দান নিতে চাইনি মা। তারপর অনেকদিক বিচার-বিশ্লেষণ শেষে তিনি বলেন যে আমি যদি চাই তাহলে তিনি আমার বিবাহযোগ্য কন্যাকে নিকাহ্ করে নেবেন। তাকে কথায় কথায় বলেছিলাম যে ঘরে আমার বিবাহযোগ্য একজন কন্যা রয়েছে। তাই সবদিক বিবেচনা করেই তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে করে কন্যার মা-বাবাকে দেওয়া উপহার হিসেবে ধারকৃত অর্থ তিনি মওকুফ করবেন। এভাবেই দান না করেই তিনি আমাকে দেনার দায় থেকে মুক্ত করলেন, আমার সম্মান রক্ষা করলেন আবার কন্যাকে সৎ পাত্রের হাতে তুলে দেওয়ার চিন্তা থেকেও আমাকে মুক্ত করেছেন। অতি বিচক্ষণ ব্যক্তি।

আমিরাহ্ এর কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। আব্বাস আল আবাদি ! মানে আহমাদের বাবার সাথে নিকাহ্ ! আমিরাহ্ এর বাবা তখনও বলেই যাচ্ছেন,

– ওনাদের মতো ধনী পরিবারের অংশ হতে পারলে তোমার ভবিষ্যতটাও নিশ্চিত হয়ে যাবে। তোমারও তো নিকাহ্ এর বয়স হয়েছে। আশেপাশে থেকে যতগুলো পয়গাম এসেছে তার চেয়ে আব্বাস আল আবাদিই সর্বোৎকৃষ্ট। সে খুবই ভালো মানুষ। তোমাকে সুখে রাখবে ইনশাআল্লাহ। উনি যে এমন প্রস্তাব দিয়েছেন সেটা আমাদের এবং তোমার পরম সৌভাগ্য।

আমিরাহ্ আর কিছু শুনতে পাচ্ছে না। তার চোখে আহমাদের হাসিমুখটা ভেসে উঠল। সে ঠিকই তো বুঝতে পেরেছিল আহমাদের জন্য তার পরিবার আমিরাহ্কে গ্রহণ করবে না। শহরের সেরা ধনীর ছেলের জন্য নিশ্চয়ই অপর কোনো ধনীর কন্যাই আসবে। যেমন আহমাদের বড়ো ভাইয়ের বেগম হয়ে এক ধনীর দুলালিই এসেছে।

তাই যদি হবে তবে নিয়তি কেন আহমাদের সাথে তার দেখা করিয়ে দিল? কেন এসেছিল আহমাদ তার জীবনে? এ কোন্ জীবনের পথে নিয়তি তাকে ঠেলে নিয়ে চলেছে। কীভাবে আহমাদের বাবার বেগম হয়ে সে আহমাদের সামনে দাঁড়াবে? আহমাদের সাথে নিকাহ্ না হলেও আমিরাহ্ মেনে নিত। অন্য কারো বেগম হলেও তার এত কষ্ট হতো না। কিন্তু তার বাবার সাথে নিকাহ্ এর বিষয়টা আমিরাহ্ সহ্য করতে পারল না। এত লজ্জার মাঝে ভাগ্য কেন তাকে ঠেলে দিল? কী দোষ ছিল তার? ভাগ্য কেন মানুষের জীবন নিয়ে, মন নিয়ে এরকম নিষ্ঠুর খেলা খেলে?

আমিরাহ্ আর কিছু ভাবতে পারল না, সে জ্ঞান হারাল।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে