#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(29)
দীর্ঘ সাত বছর পর রোজকে দেখে চমকে ওঠে অরুনিকা। সুন্দর এক মুহুর্তে হঠাৎ করেই অতীত হানা দেয় যেনো। খুশিতে ভরপুর মুখ চুপসে কেমন এক আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে।
দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী হিসেবে একটা ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজনে হঠাৎ করে রোজের আগমন থমথমে এক পরিবেশের সৃষ্টি করে। রুবিনা বেগম আর তাহসান সাহেবও বেশ হতবাক। সবারকে স্বাভাবিক করতে আদাভান হালকা কেঁসে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। থমথমে পরিবেশে হালকা কাশির শব্দও যেনো বিকট ঠেকে অরুনিকার কানে।
“মিট টু মায় ফ্রেণ্ড, আমার অনেকবছর আগের ফ্রেন্ড রোজেলা মাহমুদ।”
“রোজি আপু”
ছলছলে দৃষ্টিতে রোজের দিকে তাকিয়ে আছে অরুনিকা। বহুবছর পরে মনে পড়ে যাচ্ছে বর্ষার কথা। মনের ক্যানভাসে ছবির আকারে ভেসে উঠছে রোজ, বর্ষা আর অরুর একসাথে কাটানো সময়গুলো। অনেকগুলো বছর পর আবারও দুচোখ ভিজে উঠছে বর্ষার স্মৃতিতে। উষ্ণ শুষ্ক মরুভূমির ন্যায় খা খা করছে বুকটা। বুকের বামপাশে ব্যাথা অনুভূত হতেই একহাত বুকে রেখে সামান্য পিছিয়ে যায় অরুনিকা। পিছাতে পিছাতে অবশেষে পিছনে দাড়ানো পুরুষটার বুকে গিয়ে ঠেকেছে অরুনিকার পিঠ। খানিক মুহূর্তও ব্যয় না করে পিছন ঘুরে জাপ্টে ধরে আদাভানকে।
“আদাভান, ব ব বর্ষা আপু! আমার বর্ষা আপু, আমার চাই। আপুকে চাই।”
“শান্ত হও অরু। এভাবে কান্না করেনা। দেখি আমার দিকে তাকাও।”
আদাভানের কোমল কণ্ঠের আদরে বোধহয় কাজ হলো। নিষ্প্রাণ চোখে তাকালো অরুনিকা।
“আমি জানি তুমি বর্ষাকে অনেক ভালোবাসো। আর এটাও জানি তোমার রোজি আপুকেও অনেক ভালোবাসো। যারা চলে যায় তাদেরকে তো ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা আমাদের নেই, তবে যারা আছে তাদের কষ্ট কেনো দিই?”
” রোজ যেদিন থেকে তোমার কথা শুনেছে বারবার ছটফট করেছে তোমাকে দেখার জন্য। আমার কথামতো আজকে বিশেষ দিনে এসেছে অনেক দূর থেকে শুধু তোমার জন্য অরু।”
আদাভানের কথায় মাথা নীচু করে পিছন ঘুরে একবার তাকালো অরুনিকা রোজের দিকে।
“আই অ্যাম সরি রোজ আপু। অনেক মিস করেছি আমি তোমাকে। আপু চলে যাওয়ার পর আর কখনো কারোর সাথে যোগাযোগ করতে ইচ্ছে করেনি, তবে আমার মনে সবসময় বর্ষা আপুর পরে তোমার স্থান ছিলো, আছে আর থাকবে সারাজীবন।”
“পুষি এটা কিন্তু ঠিক না, আমি তোর রোজি আপু, একদম রোজ বলবিনা। এইটুকু এক পিচ্চি, সেদিনই তো আমার কোলে চড়ে এটা ওটা বায়না করতো, কেঁদে কেটে ভাসিয়ে ফেলেছে দেখো। এজন্য পিচ্চি মেয়েকে বিয়ে করতে নেই বুঝলি আদাভান।”
“তো তোর মতো বুড়া বেটাকে বিয়ে করতাম নাকি?”
“মেরে একদম চেহারা বিগড়ে দেবো তোর, আয়ুশ যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। অন্তত তোর থেকে তো বেশিই, হুহ।”
“যা যা দূর হ। তোর ওই লাল হনুমানকে নিয়ে বিদেশেই ঠিক আছিস তুই। এদেশে আসলে সবাই তোদের দেখে বাপ মেয়ে বলবে।”
“আদাভান। ভালো হচ্ছেনা কিন্তু। মানছি ও একটু বেশি ফর্সা তাই এমন লাগে, তাই বলে তুই বুড়া বলবিনা একদম আয়ুশকে। নাহলে তোর একদিন কি আমার মুখে একদিন।”
“ভূরা মিনস খি রোজ?”
দুজনের খুনসুটি দেখে অরুনিকার মন কিছুটা ভালো হয়ে যায়। সত্যি তো যারা চলে গেছে তাদের জন্য বর্তমানে যারা আছে তাদের কষ্ট দেওয়া উচিত নয় একদম। সবার মিটিমিটি হাঁসির মাঝে হঠাৎ উপস্থিত হয় এক মাঝবয়সী ধবধবে ফর্সা লোক। পরনে ফর্মাল ড্রেস।
“আরে আয়ুশ তোমার বয়স অনেক বেশী বলছে আদাভান।”
“হোয়াট? হামার এজ বেশি? আই অ্যাম টু ইয়াং হানি।”
“আমি জানি তো, কিন্তু এই বাঁদরটা মানতে চাইছেনা।”
“হেয় আড্ডাভ্যান, ব্রো…….”
আদাভানের নামের বিকৃতি দেখে হা হা করে হেঁসে ওঠে অরুনিকা। হাঁসতে হাঁসতে পেটে ব্যাথা শুরু হলে, পেট চেপে ধরেই হাঁসতে থাকে।
“আড্ডাভ্যান, বাহ দারুন নাম দিয়েছে আপনার আদাভান।” বলেই আবারো হাসতে থাকে। সাথে যোগ দেয় বাড়ির সবাই।
অসহায় চোখে একবার অরুনিকার দিকে তাকায় আদাভান। কিছুক্ষন আগের অরুনিকার কান্না ভেজা চোখের বদলে এখনকার হাঁসির ঝিলিক দেখে নিজেও হেঁসে ওঠে।
“তোমার এই হাঁসির জন্য আমি সবার কাছে জোকারও হয়ে যেতে পারি প্রিয়।” বিড়বিড় করে কথাটা বলে রোজের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকায় আদাভান। আদাভানের তাকানোর ভাষা বুঝে শুকনো ঢোক গেলে রোজ। যার অর্থ, এবার তুই শেষ রোজ।
বেশ জাকজমকের মধ্যেই অনুষ্ঠান শেষ হয়। অনুষ্ঠান শেষে রোজ চলে যেতে নিলে দুজনের অনুরোধে আদাভানের বাড়িতেই থেকে যেতে হয় তাদের।
_________________
বন্ধুদের সাথে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রেস্টুরেন্টে এসেছে আজ অরুনিকা। মূলত আদাভানের নতুন কলেজের কাছে রেস্টুরেন্টটা হওয়ায় প্ল্যান করে বোরখা পড়েছে। সবাই মিলে বেশ হাসি ঠাট্টার মধ্যে দিয়ে লাঞ্চ কমপ্লিট করে বেরিয়ে যেতে গিয়ে আদভানকে সেখানে দেখে বেশ খুশি হয়ে যায় অরুনিকা। সবাইকে বিদায় জানিয়ে আদাভানের উদ্দেশ্যে আসতেই রোজকে দেখে অবাক হয়ে যায়। দুজনে একই বাড়ীতে থাকার সত্ত্বেও আলাদা করে এভাবে একসাথে আসাটা কেমন যেনো দৃষ্টিকটু ঠেকে অরুনিকার কাছে। কোনো বিশেষ দরকার হলে সেটা তো বাড়িতেও করা যেত, তবে আলাদা করে সবার আড়ালে কি কাজ!
কৌতুহলবশত দুজনের পিছনের টেবিলে গিয়ে বসে অরুনিকা। আদাভান দুজনের জন্য কফি অর্ডার করে আশেপাশে তাকিয়ে রোজকে বলে,
“অরুকে এসব ব্যাপারে কিছু জানাবোনা বলে আমি এখানে আসতে বললাম। ওকে বলেছি আমার জরুরি কিছু কাজ আছে, ফিরতে দেরি হবে।”
“ভালই করেছিস। অরু এগুলো জানলে অনেক কষ্ট পাবে।”
” বর্ষার মৃত্যুর ব্যাপারে আজ পর্যন্ত আমি কিছু জানতে দিয়নি। ওর সামনে এভাবেই থেকেছি যেনো বর্ষাকে আমি চিনিনা। একমাত্র তুই জানিস এসব কিছুর মধ্যে আমি কিভাবে জড়িত। এতগুলো বছরের অপেক্ষা শুধু বর্ষার বোকামির জন্য ভেস্তে গেছিলো। অনেক কষ্টে নিজের করেছি অরুকে। বর্ষা এভাবে হেরে গিয়ে চলে যাবে আমি বুঝিনি, নাহলে শেষ করে ফেলতাম ওই শয়তানকে যেভাবে হোক।”
ব্যাস এটুকু শুনেই সেখান থেকে বেরিয়ে যায় অরুনিকা। চারিদিকের সবকিছু অন্ধকার লাগছে অরুনিকার কাছে। মনের মাঝে একটা জিনিস বারবার উঁকি দিচ্ছে, “বিশ্বাসঘাতক”।
দুজনে বেশ কিছুক্ষন কথা বলে বেরিয়ে যায় একসাথে। এদিক অরুনিকাকে এতো তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরতে দেখে এগিয়ে এলেন আনিকা আহসান। ঠিক আছে কিনা জিজ্ঞাসা করতেই কোনরকমে হ্যাঁসূচক উত্তর দিয়েই নিজের রুমে চলে যায় অরুনিকা। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছেনা। একটা মানুষ এতটা নিখুঁত অভিনয় কিভাবে করতে পারে? দুটো বছর এক রুমের মধ্যে একই বিছানায় থেকেও কি মানুষের চরিত্র বোঝা যায়না? দুজনের মধ্যে কিয়ৎ পরিমাণ দূরত্ব ছিলোনা কখনও, তারপরও কিভাবে চিনতে পারলোনা আদভানকে?
“ভুলটা আমার নাকি আপনার আদাভান? ভুলটা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাসের নাকি পিছন থেকে ছুরি চালানো মানুষের? আমার কোন ভুলের শাস্তি দিলেন আপনি? নিঃস্বার্থ ভালোবাসার নাকি অতিরিক্ত বিশ্বাসের, কোনটার শাস্তি আপনি দিলেন? ঠিক এতগুলো টুকরোতে ভেঙ্গে ফেলার জন্যই কি এতদিন সামলে রাখতেন? আপনার আসল চেহারা যে আজ আমি দেখে ফেললাম। দেখে ফেললাম মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে রাখা হিংস্র মনোভাব। কেনো আদভান কেনো? আমাকে কি মানুষ মনে হয়না আপনার, কেনো এতোটা আঘাত দিলেন আমাকে? বিয়ের পর থেকে মনে প্রাণে চেয়ে এসেছি আপনি যেনো সেই মানুষটা না হন। ভীষণ ভালোবাসি যে আপনাকে, খুনটাও শান্তিমতো করতে পারবোনা। আপনাকে মেরে ফেললে জিতে গিয়েও হেরে যাবো যে আমি। হারাবো আমার অস্তিত্ব। কেনো আপনাকে একবুক ভালোবাসার পরিবর্তে আমাকে এক আকাশ সমান হাহাকার দিলেন? কেনো চিরতরে নিঃস্ব করে দিলেন আমাকে? আমি কি আজ জিতলাম নাকি হেরে গেলাম নিজের কাছেই!”
“মুক্তি আনন্দে আমিও হাঁসবো আমার সে হাঁসিতে থাকবে শুধু সুখের প্রলেপ ।আমি উড়বো আনমনে, আমি গাইবো প্রাণ খুলে, আমি তাকাবো অপলক নেত্রে, হাঁ ! এমনিভাবে আমি মরবো অকাতরে”
চলবে?
#Fiza_Siddique
#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(30)
মাত্র শাওয়ার নিয়ে বেরোনো আদাভানকে ভীষণ আকর্ষণীয় লাগছে। ফর্সা গায়ে ফোঁটা ফোঁটা পানিগুলো মুক্তোর মতো চিকচিক করছে। পরনে ঢিলেঢালা ট্রাউজার মাত্র। ঊর্ধ্বাংশ খালি রেখে আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সবচেয়ে কাছের মানুষটাকে বিরক্ত লাগছে অরুনিকার কাছে। যে স্নিগ্ধ সকালে খেলেছিলো কতো দুষ্টুমি সেই সকালকে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করছে। প্রতিটা ভালোবাসার পরশ ঘষে ঘষে মুছে ফেলতে ইচ্ছে করছে। লুকিয়ে লুকিয়ে আদাভানের সৌন্দর্য্য অবলোকন করা প্রেয়সীর দৃষ্টিতে আজ কোনো মুগ্ধতা নেই, বরং আছে একরাশ বিরক্তি আর ঘৃণা।
রোজকার অভ্যাসবসত কলেজে যাওয়ার আগে অরুনিকাকে বিভিন্ন বাহানা দিয়ে রুমে ডাকে আদাভান। সময়ের প্রহর পেরিয়ে যায় কিন্তু অরুনিকা একবারের জন্যও রুমে উঁকি দেয়নি। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে সময় অতিবাহিত হচ্ছে বিধায় বেরিয়ে পড়ে আদাভান। আদাভানের বেরিয়ে যাওয়া লক্ষ্য করে রুমে প্রবেশ করে অরুনিকা। দুহাতে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে ওঠে। ভেতরের চুরমার হয়ে যাওয়া হৃদয়টা কাউকে দেখাতে চায়না তাই সবার সামনে যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে যায়।
দিনের পুরোটা সময় আদাভানের কোনো কাজে মন বসেনি। ভাবনায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে একই চিন্তা বারংবার। অরুনিকার কাল রাত থেকে হঠাৎ হওয়া পরিবর্তন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা। কোনো এক ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েই এই পরিবর্তন তা আদাভান বেশ বিচক্ষণতার সাথে অবলোকন করেছে। তবে সেই বিষয়বস্তু সম্পর্কে একেবারেই অজানা সে। কাল থেকে অনেক জিজ্ঞাসা করার পরও অরুনিকা এই বিষয়ে সামান্য এক শব্দও উচ্চারণ করেনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাজে মনোযোগী হাওয়ার চেষ্টা চালালো আদাভান।
রাস্তার মাঝবরাবর দিয়ে বেখেয়ালিতে হেঁটে চলেছে অরুনিকা। আদাভানকে কলেজে যাবেনা বলেছিলো একসাথে না যেতে হয় সেই উদ্দেশ্যে। এক খুনির সাথে বাইকে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসতে আজ রুচিতে বাঁধছে, অথচ এই একসাথে বাইকে চড়ে কতোশত রোমাঞ্চকর মুহূর্ত পাড়ি দিয়েছে দুজনে। ভাবনার মাঝে হেচকা টানে ধ্যানভঙ্গ হয় অরুনিকার। অবাক হয়ে পাশে তাকাতেই কাব্যকে দেখে হতবাক হয়ে যায়। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকে কাব্যের দিকে।
“পাগল হয়ে গেছিস তুই অরু? এভাবে রাস্তার মাঝখান দিয়ে কেউ হাঁটে? এখনই কিছু অঘটন ঘটে যেতে পারতো তো! আর কবে বড়ো হবি তুই?”
এতো এতো প্রশ্নের মাঝে চাপা পড়ে হাসফাঁস করতে থাকলো অরুনিকা। মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,
“আমি আসলে বুঝতে পারিনি।”
“কেমন আছিস অরু?”
“এতোদিন পর জানতে ইচ্ছে হলো তোমার? আমার বিবাহবার্ষিকীর পর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই তোমার। আমাকে কি এতটাই পর করে দিয়েছো?”
“এমন করে বলিসনা প্লীজ। কিছু জিনিস থেকে পালিয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করছিলাম কিন্তু ঘুরে ফিরে ভাগ্য ঠিক একই জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে।”
“তোমার এসব কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমি কিছু জানিনা আমার সাথে বাড়িতে চলো তুমি।”
“তা হয়না রে অরু। প্লীজ লক্ষীটি জেদ করেনা।”
কাব্যের কথার প্রেক্ষিতে অরুনিকা মন খারাপ করে কোনো জবাব না দিয়ে চলে যেতে নিলে পিছু নেয় কাব্য।
“নিয়ে যাবিনা আমাকে?”
“না”
“রাগ করেছিস পুচকি?”
“নাহ। তুমি আবারও আমাকে পুচকি বলছো? ভালো হচ্ছেনা কিন্তু।”
“ছোটো থেকে তো পুচকিই বলি আমি তোকে।”
“তখন নাহয় ছোটো ছিলাম, এখন তো বড়ো হয়েছি।”
“তুই যতোই বড়ো হস আমার কাছে পুচকিই থাকবি। আমার পুচকি।”
শেষোক্ত কথাটা ধীমি আওয়াজে বলে ক্ষীণ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলো অরুনিকার সাথে।
“জানি ফিরবেনা এই মনের নিড়ে তবুও
অপেক্ষায় থাকবো সারা জীবন ধরে।
অবস্থান হোক না যতো দূর আত্মার,
মিলন নাহয় হবে অদৃশ্যের মাঝে।”
পাশাপাশি চলতে থাকা দুটি মানুষের মাঝে চলছে আলাদারকম অনুভূতি। কেউ তীব্র ভালোবাসার আবেগ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে তো কেউ ভালোবাসার গ্লানি মুছে ফেলার চেষ্টায় লিপ্ত।
“অরু সত্যি করে বল কি হয়েছে তোর? একদম মিথ্যে বলার চেষ্টা করবিনা। তুই জানিস তোর মুখ দেখে আমি মিথ্যে ধরে ফেলতে পারি।”
মলিন হেঁসে অরুনিকা কাব্যকে সবটা বলতেই মুচকি হাসলো কাব্য। নিজেকে স্বাভাবিক করে মূর্ছা যাওয়া কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমি ভাবতেও পারছিনা আদাভানের মতো ছেলে এত বড়ো গেম খেলতে পারে। কখনও কল্পনাও করিনি আদাভান এভাবে চিট করবে তোকে। আর আমাদের বর্ষার আসল খুনী তবে আদাভান।”
কিছুক্ষন থেমে আবারো বলে ওঠে,
“আমাদের কাছে কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই অরু। আর প্রমাণ জোগাড় করতে গেলে আদাভানের কাছেই থাকতে হবে তোকে। কোনোভাবেই বুঝতে দেওয়া যাবেনা ওকে যে তুই জানিস সবটা, আর খুব সাবধানে কাজ করতে হবে আমাদের।”
অরুনিকা মাথা নাড়িয়ে নাস্তা আনতে বেরিয়ে গেলো কিচেনে। অরুনিকা চলে যেতেই পৈশাচিক হাসি হাসলো কাব্য। মনে মনে কিছু বিড়বিড় করে সামনে তাকাতেই প্রাপ্তিকে দেখে হালকা হাসলো। বেশ কিছুক্ষন গল্পগুজবের মাঝে বুঝলো প্রাপ্তি মেয়েটা বেশ পছন্দ করে কাব্যকে। দুজনের কথার মাঝে যোগ দিলেন আনিকা আহসান আর অরুনিকা। আদাভানের ব্যাপারে সবকিছু জানলেও এই বাড়ির কারোর সাথে বিন্দুপরিমান খারাপ ব্যাবহার করেনি অরুনিকা। তাদের যত্নের কোনোরূপ ত্রুটি রাখেনা।
রুমে ঢুকে অরুনিকাকে না পেয়ে ব্যালকনির দিকে পা বাড়ায় আদাভান। একমনে আকাশপানে তাকিয়ে থাকা অরুনিকা হঠাৎ করে ঘাড়ে উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে চমকে ওঠে। পরমুহুর্তে চিরচেনা স্পর্শে আবেশে গা ভাসিয়ে দিতে গিয়েই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বর্ষার মুখ। রাগে গা রি রি করে ওঠে অরুনিকার। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করলেও কাব্যের বলা কথাগুলো মনে পড়ে দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যায়।
জীবন অদ্ভুত এক নাট্যমঞ্চ, কিছুকাল আগেও যে মানুষটা কতোটা আপন ছিলো আজ সে বহু অচেনা। কিছুসময় আগেও যে স্পর্শে ভালোলাগার অনুভূতিতে গা ভাসানো যেতো আজ তা তীক্তময়। কোমল ভালোবাসার ছোঁয়া আজ কাঁটাময় লাগছে। একটা সত্যি জীবনের পাশা ঠিক কিভাবে বদলে দেবে কেউ জানেনা। কেউ জানেনা পরমুহুর্তে ঠিক কি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। জীবনের গতি আসলে কোন পথে গড়াবে জানার সাধ্য কারোর নেই। আমরা শুধু এক একজন এক এক চরিত্রে নিখুঁত অভিনয় করে যাই।
অরুনিকাকে বাহুবন্ধনের মাঝে হাসফাঁস করতে দেখে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে আদাভান। মনের মাঝে অহেতুক অভিমানেরা ভীড় জমায়। এক পশলা বৃষ্টির মেঘের মতো অভিমানেরা জমাট হয়ে থাকে বুকের মাঝে। শূন্য বুকে কখনোই ঘুম আসেনা আদাভানের, বিয়ের পর থেকে শূন্য বুকে ঘুমানোর অভ্যাস নিজ ইচ্ছায় পরিবর্তন করেছে সে। বুকের মাঝে চলতে থাকা হাহাকারে কয়েকফোঁটা অশ্রু গাল গড়িয়ে বালিশে মিশেছে। নিমেষেই তুলোয় শোষিত হয়ে গেছে সেই অশ্রুকণা, শুধু রেখে গেলো ভেজা একটু দাগ। যেমনটা কারোর দেওয়া আঘাতে কষ্টটা হজম হয়ে যায় কিন্তু থেকে যায় একটা ক্ষতর চিহ্ন, যা বহু চেষ্টার পরেও মেটানো যায়না।
“মাঝে মাঝেই এক সমুদ্র কষ্ট আসে, কষ্ট পাওয়া স্মৃতি গুলো চোখে ভাসে, বিষাক্ত ছোবল মারে মনের ক্যানভাসে। তবুও মানুষ কষ্টকে কেন ভালোবাসে!”
পাশে এদিক ওদিক করে ছটফট করতে থাকা অরুনিকার দিকে এক পলক না তাকিয়েই চোখ বুঁজে ফেলে আদাভান। আবারও গড়িয়ে পড়ে কয়েকফোঁটা জল।
অপেক্ষার অবসান হয়ে অবশেষে অরুনিকা বেড থেকে নেমে অপরপাশ ফিরে শুয়ে থাকা আদাভানের বুকের মাঝে গুটিসুটি মেরে শুয়ে চোখ বুজলো। ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির হাঁসি হাসলেও আঁকড়ে ধরেনি অরুনিকাকে। আদাভানের অভিমান বুঝতে পেরে অরুনিকা নিজে থেকেই আদাভানের দুহাত নিজের কোমরে আবদ্ধ করে আরোও লেপ্টে যায় আদাভানের সাথে।
“ফিরে যদি আসারই ছিলো, তবে দূরে যাওয়ার বৃথা চেষ্টা করলে কেনো?”
“ভালো লাগছেনা, প্লিজ একটু শান্তিতে ঘুমাতে দিন।”
“আণ্টি কল করেছিলেন। একবার ঘুরে আসতে বলছেন আমাদের।”
“সত্যি! তবে চলুন কাল যাই।”
“আচ্ছা”
আমাকে তো যতোদ্রুত সম্ভব যেতেই হবে অরুনিকা। ওই বাড়িতে অনেক কাজ বাকি আছে আমার। অনেক কিছুর সন্ধান ওখান থেকেই পাবো আমি। মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো দুজনে।
চলবে?
#Fiza_Siddique