#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(25)
প্রবাহমান নদীর স্রোতের ন্যায় পেরিয়েছে অনেকটা সময়। শীতের প্রকোপ কেটে চারিদিকে বসন্তের আলাপন। চারিদিকে খুশি খুশি রবের মাঝেও নেই সুখ প্রেমিক দুই হৃদয়ে। প্রেমের দহনে জর্জরিত কোনোরূপ যেনো সময় কেটে যাচ্ছে তাদের। দিনের শেষে রাত আরও বিষাদময় করে তোলে তাদের জীবন। অভিমানের পাল্লা ভারী করে অরুনিকা কলেজ থেকে ট্রান্সফার নিয়ে নিয়েছে। চাইলে চোখের দেখাও আর দেখতে পায়না আদাভান।
নিত্যদিনের অভ্যাস মতো কলেজের জন্য বেড়িয়ে গেছে আদাভান। বাড়ির সবাই অনেকটা স্বাভাবিক হলেও হয়নি শুধু আদাভান। নিজের কেবিনে বসে ফোনের স্ক্রিনে লাগানো অরুনিকার ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বারংবার হাত বুলাচ্ছে আদাভান। অনুভবে অনুভবে যেনো ছুঁয়ে দিচ্ছে প্রেয়সীকে।
অরুনিকা যে কলেজে ভর্তি হয়েছে সেটা কাব্যের অফিসের কাছেই। মূলত কাব্য ইচ্ছে করেই এখানে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে অরুনিকাকে। দিনের বেশিরভাগ সময়টা দুজনে একসাথেই কাটায়। পড়াশোনা সাথে কাব্যের পাগলামী, হুটহাট হাজির হয়ে এখানে সেখানে নিয়ে যাওয়া এসবের মাঝে আদাভানকে নিয়ে ভাববার সময়টাই দেয়না কাব্য। সারাদিন কোনো না কোনো ভাবে ব্যাস্ত রাখে অরুনিকাকে। কিন্তু রাত! সেতো একজনেরই দখলে। দুজনের মাঝে জমতে থাকা অভিমানে কেউ কারোর সাথে যোগাযোগ না করলেও মনের সর্বত্র তাদের বসবাস।
রাতের প্রারম্ভিক প্রহরে তাহসান সাহেব আর রুবিনা বেগমের সামনে বসে আছে অরুনিকা। জরুরী কিছু কথা বলার জন্য অরুনিকাকে ডেকেছেন তারা। অথচ বিগত পনেরো মিনিট ধরে তিন জনের নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া অর কিছুই শোনা যাচ্ছেনা এই কক্ষে।
“আম্মু, আব্বু! কি যেনো বলবে বলছিলে!”
মেয়ের কথায় একটু নড়েচড়ে বসলেন তাহসান সাহেব। আসলেই তাদের এভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক কিনা কিছুতেই ভেবে উঠতে পারছেন না। নিজেদের নেওয়া সিদ্ধান্তের কথা মেয়েকে জানাতে কেমন যেনো ভয় কাজ করছে তার মধ্যে।
“অরু, তোমার খালামণি আজ কল করেছিলেন। কাব্যের বিয়ের কথা বলতে।”
“কাব্য ভাইয়ার বিয়ে! এটা তো অনেক খুশির খবর আব্বু।”
“তোমার সাথে”
“মানে?”
“দেখো অরু, ওই ছেলেটা তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছিল। যে বিয়েতে তোমার কোনো মত ছিলোনা। আমরা চাইনা এমন ঠুনকো কোনো সম্পর্কের পিছনে নিজের জীবন নষ্ট করো তুমি। কাব্যের মতো ছেলে তুমি পাবেনা। ছোটো থেকে চেনো তোমরা একে অপরকে, দুজন দুজনকে বোঝো। ওর থেকে ভালো জীবনসঙ্গী তোমার জন্য আর কেউ হবেনা। ”
“আর ভালোবাসা? আব্বু কাব্য ভাইয়াকে আমি আমার ভাইয়ের মতো মনে করি। যদি ওনাকে ভাই না মনে করতাম তাহলে কখনোই এতোটা খোলামেলা ভাবে মিশতাম না। ওনার প্রতি কোনোদিনও অন্য কোনোরকম ফিলিংস আমার মনে তৈরি হয়নি আর না কখনও হবে।”
“আমরা তোমার ভালো চাই অরু।”
“আমি ভালোবাসি আদাভানকে। ওনার যায়গা আর কাউকে কখনোই দিতে পারবোনা আমি। আমি কখনো তোমাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওনার কাছে যাবনা তবে অন্য কাউকে বিয়ে, জীবনেও সম্ভব নয়।”
রাগ নিয়ে কথাগুলো বলেই নিজের রুমে চলে গেলো অরুনিকা।
___________
“মাঝে মাঝেই এক সমুদ্র কষ্ট আসে, কষ্ট পাওয়া স্মৃতি গুলো চোখে ভাসে, বিষাক্ত ছোবল মারে মনের ক্যানভাসে। তবুও মানুষ কষ্টকে কেন ভালোবাসে”
অরুনিকার ভাবনায় বিভোর আদাভানের ধ্যান ভঙ্গ হয় ফোনের আওয়াজে। অপরিচিত নম্বর দেখে ওঠানোর আগেই কল কেটে যায়। কল ব্যাক করার কথা ভাবতেই আবারো সশব্দে বেজে ওঠে রিংটোন। রিসিভ করে কানে
ধরতেই,
“আমার মেয়েকে বাড়ীতে পাঠিয়ে দাও।”
উক্ত কথায় ভ্রু কুঁচকে ফেললো আদাভান। গম্ভীর এই কণ্ঠস্বর শুনে একটুও অবাক হয়নি সে। বরং এই নিরর্থক কথাটা বোঝার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
“আপনার মেয়ে মানে?”
“আমার মেয়ে মানে তুমি জানোনা? ছেলেখেলা হচ্ছে? আমার মেয়েকে যেনো ত্রিশ মিনিটের মধ্যে আমার বাড়িতে দেখি।”
“আঙ্কেল আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। অরু আমার কাছে আসেনি। এমনকি সেদিনের পর থেকে আমাদের আর কখনো যোগাযোগই হয়নি।”
“এই ছেলে একদম মিথ্যে বলবেনা।”
“আচ্ছা আপনার আমাকে সন্দেহ করার কারণটা জানতে পারি কি?”
তাহসান সাহেব অরুর সাথে তাদের কথোপকথনের কথাগুলো বললেন আদাভানকে। শুধু লুকিয়ে গেলেন অরুনিকার ভালোবাসার কথাটা।
“অরু আমার কাছে আসেনি আঙ্কেল। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি দেখছি।”
বেশ থেমে থেমে কথাগুলো বলে ফোন কেটে দিলো আদাভান। এইমুহুর্তে ঠিক কি করা উচিৎ কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা সে। সকালে বেরিয়েছিলো অরুনিকা ভীষণ তারাহুরো করে, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের সন্ধিক্ষণ এখন। অথচ অরুনিকার কোনো খোঁজ নেই কারোর কাছে। কাব্যের ফোনে বার কয়েক কল করেও কোনো লাভ হচ্ছেনা। প্রতিবারই একই উত্তর আসছে ওপার থেকে,
“দুঃখিত, আপনার কাঙ্খিত নম্বরটি বর্তমানে সুইচ অফ আছে।”
এদিকে আদাভানের প্রায় পাগল পাগল অবস্থা। কোনোকিছু না ভেবেই অরুনিকার বাড়িতে চলে গেলো সে। খুব দ্রুত বাইক চালিয়ে দুইঘন্টার রাস্তা ত্রিশ মিনিটে পার করেছে সে। প্রতিটা মুহূর্ত এক দমবন্ধ করা অনুভূতির সাথে কাটছে আদাভানের। অরুনিকার বাড়িতে গিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থায় রুবিনা বেগমকে পড়ে থাকতে দেখে সেদিকে দৌড়ে যায় আদাভান।
রুবিনা বেগমকে কোনরকমে সোফাতে উঠিয়ে তাহসান সাহেবকে কল দেয় আদাভান।
“আঙ্কেল যতদ্রুত সম্ভব বাড়িতে চলে আসুন, আন্টি অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
অপরপক্ষের কিছু বলার অপেক্ষা না করেই কল কেটে দেয় আদাভান। টেনশনে মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। পুলিশ নিজের মত করে খোঁজার চেষ্টা করছে। তবুও যেনো কোনোভাবেই শান্তি পাচ্ছেনা আদাভান। কোনোভাবে নিজেকে সামলে রেখেছে।
তাহসান সাহেব বাড়ীর কাছেই ছিলেন। পুলিশ স্টেশনে যাচ্ছিলেন, মাঝপথেই আদাভানের কথায় ফিরে আসেন বাড়ীতে। বাড়ীতে ঢুকেই আদাভানকে উপেক্ষা করেই এগিয়ে জন স্ত্রীর কাছে।
“ঠিক আছো তুমি?”
“আজ ছেলেটা না আসলে কি হতো জানিনা। আমি ঠিক আছি এখন। অরু কোথায়? কোনো খোঁজ পেলে ওর?”
তাহসান সাহেব মলিন মুখে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। স্বামীর অসহায়ত্ব বুঝে ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। নিয়তি তাদের থেকে এক সন্তান কেড়ে নিয়েছে, তাই অরুনিকার খোঁজ না পেয়ে দুজনের অবস্থা ভীষণ খারাপ।
“আমার মেয়েটাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও তাহসান। আমার অরুকে আমার কাছে এনে দাও।”
“আঙ্কেল আপনার কাছে একটা রিকুয়েস্ট, প্লীজ আপনি আন্টিকে এই অবস্থায় রেখে কোথাও যাবেন না। আমি আপনাদের অবস্থা বুঝতে পারছি। আপনি চিন্তা করবেন না, যেভাবে হোক অরুনিকাকে আমি খুঁজে বের করবো। আমার বন্ধু পুলিশ কমিশনার, ওর সাথে কথা বলেছি আমি। পুলিশ ফোর্স খুঁজছে। আমি অরুনিকাকে নিয়েই বাড়ীতে ফিরবো কথা দিচ্ছি।”
দুজনে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকলো আদাভানের দিকে। এই দুঃসময়ে আদাভানই তাদের একমাত্র ভরসা। কাব্যকে অনেক বার কল করেও যোগাযোগ করতে পারেননি তারা।
অরুনিকাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আনমনে রাস্তায় হাঁটছে আদাভান। সবদিক থেকে সন্দেহের তীর কাব্যের দিকে গেলেও কিছুই করতে পারছেনা। কাব্য খুব বিচক্ষণতার সাথে কাজটা করেছে। ইচ্ছে করেই নিজের ফোন অফ করেছে, যাতে কেউ ট্র্যাক না করতে পারে। রাস্তার মাঝে হাঁটু গেঁড়ে নিজের মুখ ঢেকে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা চালায় আদাভান। চোখের অশ্রু গুলো কে সবাই দেখতে পারে। কিন্তু একটা মানুষের হৃদয়ের মধ্যে যে অশ্রু ঝরে। সেই অশ্রু কেউ দেখতে পারে না। একজন মানুষের বুকের মধ্যে যে কষ্ট জমা থাকে। সেই কষ্ট গুলো কেউ অনুভব করতে পারে না।
“কতটা তেপান্তর পার হলে সোনালী সন্ধ্যা নামে। কতটা বেদনা বহন করলে চোখের কোনে অশ্রু জমে।”
মেসেজ টোনের আওয়াজে সেদিকে তাকায় আদাভান। অচেনা নাম্বার থেকে শুধু একটা লোকেশন এসেছে। সাথে নীচে লেখা “আদা”। দুই চোখের পানি মুছে কাউকে কল দিয়ে সেখানে পৌঁছাতে বলে সাথে সাথে নিজেও বেরিয়ে পড়ে সেই উদ্দেশ্যে।
_________________
পূর্ণিমা ভরা আকাশের নীচে চন্দ্রবিলাসে মেতে উঠেছে প্রেমিক হৃদয়। আদিলের আবদারে সাদা শাড়ি, সাদা চুড়ি, চুলগুলো খোপা করে বেঁধে তাতে বেলী ফুলের মালা গেঁথে হাজির হয়েছে নূর। ছাদের দোলনায় দুজনে পাশাপাশি বশে উশখুশ করেই চলেছে কিছু বলার জন্য। সময়ের সাথে দুজনের সম্পর্ক স্বাভাবিক। নূর মেনে নিয়েছে নিজের ভাগ্যকে, তবে মনে প্রাণে চায় আদিত্যও যেনো জীবনে এগিয়ে যাক। যেভাবে সে অদৃষ্টকে মেনে নিয়ে এগিয়ে চলেছে জীবনে সেভাবে আদিত্যও যেনো সময়ের বহমান স্রোতে এগিয়ে যায়।
“কী দেখছেন ওভাবে আদিল সাহেব?”
“আমার নূরপাখীকে”
আদিলের এমন সাবলীল জবাবে অভ্যস্ত নূর। প্রতিবারের মতো এবারও লজ্জায় রাঙা হয়ে ওপর পাশে মুখ ঘোরাতেই,
“এই এই এদিকে তাকাও”
“উহু”
“আমার চন্দ্রবিলাসে বাঁধা দিলে খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু নুরপাখী। তুমি জানোই তো এসবের রিভেঞ্জ আমি কোথায় নিয়।”
“অসভ্য একটা। চুপ করুন প্লিজ।”
একহাতে আদিলের মুখ চেপে ধরে লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে বলা নূরের কথায় বেশ মজা পেলো আদিল। নূরকে আরও খানিকটা লাল আভায় রঞ্জিত করতে বলে উঠলো,
“আমার কাছে এখনও লজ্জা পাওয়ার মতো কিছু আছে বুঝি? সব লজ্জা তো ভেঙ্গে ফেলেছি।”
“চুপ করুন প্লীজ।”
“আচ্ছা, তুমি এভাবে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছ কেনো? আমি কি কিছু করেছি নাকি?”
“আপনি আমাকে এভাবে জলাচ্ছেন কেনো?”
অসহায় মুখে করা নূরের প্রশ্নে সশব্দে হেঁসে ওঠে আদিল।
“জ্বালানোর জন্য তো পুরো রাত পড়ে আছে নূরপাখি।”
নূরের কানের কাছে লো ভয়েসে বলা উক্ত কথায় কেঁপে ওঠে নূর। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া মাঝে মাঝে থেমে থেমে আসছে।
নূরকে দোলনা থেকে টেনে তুলে নিজের কোলে বসায় আদিল। দুইহাতের মাঝে আবদ্ধ করে নেয় তাকে।
“বেধে রাখবো তোমায় আমার ভালোবাসার শিকলে , পালাতে পারবেনা তুমি আমায় ছাড়া সময়ের অন্তরালে।
ভালোবাসার শিক্ত বাধনে বেধে রাখবো তোমায় সারাজীবন , তুমি শুধু আমারই হয়ে থাকবে জীবন থেকে মরন।”
ঠোঁটে হাঁসি ঝুলিয়ে নূর এলিয়ে দিলো নিজের শরীরের ভার এক ভরসাময় স্থানে। তার বিশ্বাস সেই ভরসার বুক হতে কখনও সে খালি হাতে ফিরবেনা। এই বুকে আছে শান্তি, পরম এক স্নিগ্ধতা।
“নূরপাখী!”
“খুব কি খারাপ আছো?”
“একদমই নাহ”
“এভাবে থাকতে পারবে তো? নাহলে আমরা আলাদা…”
“কখনই না। আমি এই পরিবারকে ছেড়ে কোথাও যাবনা।”
“কিন্তু ফুফি তোমাকে কতকিছু বলে, আমার একদমই ভালো লাগেনা নূরপাখি।”
“ফুফু তো আমাকে হিংসা করেন তাই বলেন ওসব। ফুফু ভাবেন মিষ্টার আদিল কতো ভালো ছেলে, নিজের মেয়ের সাথে তার বিয়ে দিতে পারলে মেয়ে সুখি হবে। উনি তো আর জানেন না এটা কতো বজ্জাত।”
“এই কি বললে? আমি বজ্জাত? তবে রে আমি দেখাবো আমি কতো বজ্জাত।”
নূরকে কোলে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে পড়ে আদিল। বিছানার মাঝে আলতো করে শুইয়ে দিয়ে আধসোয়া হয়ে নূরের মুখোমুখি হয়ে বলে,
“কাল ফুফিকে দেখানোর জন্য কিছু চিহ্ন এঁকে দিই? কি বলো?”
নূরের উত্তরের অপেক্ষা না করে দিব দিল নূরের মাঝে। নুরময় এক রাত্রি যাপনের পর ভোরের প্রারম্ভিক সময়ে নূরের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো আদিল।
____________
অন্ধকার একটা রুমের মাঝে আটকে রেখেছে অরুনিকাকে কিছু লোক। দুপুরের দিকে একজন এসে খাবার আর পানি দিয়ে গিয়েছিলো। মাক্স আর হুডি পড়া লোকগুলোর সাথে কখনোই পরিচিত নয় অরুনিকা। এই মুহূর্তে একমাত্র আদাভানের কথা ভীষণ ভাবে মনে পড়েছে অরুর।
“আদাভান আপনি কোথায়? আপনার অরু আপনাকে ডাকছে। প্লীজ চলে আসুন। আমাকে মেরে ফেলবে এরা। কেমন ভয়ংকর দেখতে সব। আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি আদাভান।”
চলবে?
#Fiza_Siddique
#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(26)
আতঙ্কের মাঝে হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজে চমকে ওঠে অরুনিকা। ভয়ে গুটিসুটি মেরে রুমের এক কোণে বসে আছে। চারপাঁচ জন লোককে একসাথে প্রবেশ করতে দেখে আত্মা যায় যায় অবস্থা তার। মনের মাঝে উঁকি দিয়ে বেড়াচ্ছে উল্টোপাল্টা নানা চিন্তাভাবনা।
নিশুতি রাতের গভীরতা ক্রমে বেড়েই চলেছে। চারিদিকের থমথমে আবহাওয়ার মাঝে কানে ভেসে আসছে শুধু শা শা শব্দ। অরুনিকার পাঠানো ঠিকানা অনুযায়ী পৌঁছাতে আরও মিনিট ত্রিশ লাগবে। মনের মাঝে উঠতে থাকা ঝড়ের বেগ কোনমতে কমার নয়। দুপুর থেকে খাওয়া তো দূর একটু পানিও স্পর্শ করেনি আদাভান। গলাটা কেমন যেনো শুষ্ক কাঠের মতো মনে হচ্ছে। অপেক্ষায় প্রবাহমান সময়ের সাথে বাড়ছে উত্তেজনা। অরুনিকার সাথে খারাপ কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবেনা আদাভান।
ঝড়ের বেগে বাইক চালিয়ে পনেরো মিনিটে পৌঁছেছে আদাভান। উত্তেজনায় হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে তার। পুলিশ ফোর্স আসতে আরও দশ মিনিট লাগবে, তাই নিজের জানের পরোয়া না করেই সামনে থাকা বাড়ীটার দিকে এগিয়ে যায়। জায়গাটা একেবারে শহরের মাঝবরাবর। বিশাল এক বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক পর্যবেক্ষণ করতেই হুডি পড়া কাউকে পাশ থেকে বেরোতে দেখে সরে যায়। লোকটা বেরিয়ে যেতেই ধীর পায়ে এগিয়ে যায় বড়ো বাড়ীর পাশের সেই জায়গাটাতে। ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গা ছাড়া কিছুই চোখে পড়লোনা সেদিকে। পিছন ঘুরে চলে যেতে নিলেই দূরে চিকচিক করা কিছুর উপর চোখ আটকে যায় তার। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে দৌড়ে যায় সেদিকে। ফোনের লাইট জ্বালিয়ে জিনিসটা দেখার চেষ্টা করতেই চমকে ওঠে আদাভান। কাঁপা কাঁপা হাতে ওঠায় সামনে পড়ে থাকা আংটিটা।
“এটা তো সেই আংটি, যেটা আমি অরুর জন্য বানিয়েছিলাম। এটা এখানে! তার মানে এদিকেই কোথাও আছে অরু।” ছলছল চোখে তাকিয়ে আংটিটা পকেটে ভরে নিলো আদাভান।
কিছুদূর এগোতেই কাউকে এদিকে আস্তে দেখে পাশে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে আদাভান। এদিকে অরুনিকা অনেক কষ্টে সেই রুম থেকে বের হতে সক্ষম হয়েছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনরকমে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দৌড় দেয়। আশেপাশের রাস্তা সম্পূর্ণই অচেনা তার কাছে। কোথায় আছে সেটাও জানেনা। কোনদিক দিয়ে বের হবে কোনো কুলকিনারা না পেয়ে সোজা দৌড়াতে থাকে। কিছু লোককে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে তাদের বিভ্রান্ত করে অন্ধকারে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে অরুনিকা। এতোক্ষণে আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটাই লক্ষ্য করেছে আদাভান। অরুনিকাকে এদিকে আসতে দেখে টান দিয়ে লুকিয়ে ফেলে ঝোপের মাঝে।
অচেনা জায়গায় এমন পরিবেশে হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনায় খেই হারিয়ে ফেলে অরুনিকা। কিছু বলতে উদ্যত হলেও আদাভান একহাতে তার মুখ চেপে ধরে অপরহাতে কোমড় জড়িয়ে আরোও কাছে নিয়ে আসে। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ছটফট করতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে শান্ত হয়ে আদাভানের বুকে মাথা এলিয়ে দেয়। অচেনা পরিবেশে প্রিয় মানুষটাকে কাছে পেয়ে মুখে হাত চেপে ডুকরে কেঁদে ওঠে অরুনিকা।
লোকগুলো আলোর পথে এগিয়ে গেলো অরুনিকার খোঁজে। এদিকে সুযোগ বুঝেই অরুনিকার হাত ধরে কোনোরকম দৌড়ে বাইকের কাছে পৌঁছায় তারা।
“অরু তাড়াতাড়ি ওঠো, এখান থেকে আগে বেরোতে হবে। হারি আপ।”
বিনাবাক্যে বাইকের পিছনে উঠে পড়ে অরুনিকা। যতদ্রুত সম্ভব সেই জায়গা থেকে বেশ কিছুটা দূরে এসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অরুনিকার দিকে তাকায় আদাভান। ছলছল দুই চোখে পুরো মুখে আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে জাপ্টে ধরে কান্না করে দেয় স্ট্রং পার্সোনালিটির আদাভান।
“আ..আমাকে মাফ করো প্রাণপাখি, আমি সঠিক সময়ে তোমার কাছে পৌঁছাতে পারিনি। এই আঘাতের চিহ্নগুলো থেকে আমি তোমাকে বাঁচাতে পারিনি। আমারই ভুল, আমার তোমাকে একা ছাড়া উচিত হয়নি। হু হু সব আমার জন্যই হয়েছে।”
“আদাভান শান্ত হন প্লীজ।”
“এই দেখো তোমার ঠোঁটের পাশে কতটা কেটে গেছে, ওরা তোমাকে অনেক মেরেছে তাইনা? ওরা তোমাকে কেনো মারলো? আমাকে মারলে তো আমি সেই আঘাত হাঁসিমুখে সহ্য করে নিতাম। এই দেখো তোমার কপালে কতোটা কেটে গেছে। আমি কিভাবে তোমাকে এভাবে সহ্য করবো প্রাণপাখি। আমার যে অনেক কষ্ট হচ্ছে। তুমি জানো আমার পাগল পাগল অবস্থা হয়েছিলো তোমাকে না পেয়ে। আমি মর……….”
আদাভানকে আর কিছু বলতে না দিয়ে অধরে অধর মিলিয়ে দেয় অরুনিকা। উষ্ণ আবেশে দুই চোখ বন্ধ করে সেই ভালোবাসা সাদরে গ্রহণ করে আদাভান। আদাভানকে কিছুটা শান্ত করে সরে আসতে নিলে ডান হাত অরুনিকার কোমরে রেখে বামহাতে মাথা আগলে ধরে আদাভান আবারো ডুব দেয় উষ্ণ আবেশে। বেশ কিছুক্ষন পর দুজনেই জোরে জোড়ে হাপাতে থাকে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে। আদাভানের চাহনিতে লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে চোখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকায় অরুনিকা।
“প্লীজ পাগলামি করিয়েন না। প্লীজ শান্ত হন।”
মেয়েকে পেয়ে তাহসান সাহেব কান্না করতে করতে বুকে জড়িয়ে নেন। রুবিনা বেগম অসুস্থ বলে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে।
“আঙ্কেল আমার মনে হয় অরুনিকার এবার রেস্ট নেওয়া দরকার। কাটা জায়গাগুলোতেও ওষুধ লাগাতে হবে। আপনার যা জিজ্ঞাসা করার কাল করবেন প্লীজ।”
“অরু মা ওকে নিয়ে নিজের রুমে যাও।”
রুমের মাঝে পিনপতন নীরবতার বিরাজমান। বাইরে থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা বাতাসে অরুনিকা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। গভীর রাতের নিস্তব্ধতার মাঝে আদাভানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে অরুনিকা।
“জানেন আদাভান, আমার কাছে যখন কল এসেছিলো যে আপনার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে আমার দুনিয়া পুরো থেমে গেছিলো। মনে হচ্ছিলো আমি বোধহয় হারিয়ে ফেললাম আপনাকে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো আমার। সব অভিমান ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে কাউকে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেছিলাম আমি।”
কথার মাঝে অরুনিকার ফুফানোর শব্দে দুহাতে আরো ভালোভাবে আগলে নেয় তাকে আদাভান।
” এমনিতেই আজকে আব্বু আমাকে বিয়ের কথা বলেন, তারপর আবার আপনার অ্যাক্সিডেন্টের খবরে আমার মাথা কাজ করছিলনা। পাগলের মতো এদিক ওদিক করে কোথাও একটা রিক্সা না পেয়ে পায়ে হেঁটেই এগিয়ে যাই। তারপর হঠাৎ করেই পিছন থেকে মুখে রুমাল চেপে ধরে কেউ। আর কিছুই মনে নেই আমার। যখন জ্ঞান ফেরে নিজেকে অন্ধকার এক রুমে আবিষ্কার করি। অনেক ধাক্কানোর পরেও কেউ এসে দরজা না খোলায় আশেপাশে তাকিয়ে একটা মাত্র জানলা দেখতে পাই। কিন্তু জানালাটার নীচে উঁচু পাঁচিল দেওয়া ছিলো। অনেক কষ্টে সেখান থেকে বেরোতে গেলেই পাঁচিলে থাকা কাঁচে হাত পা কেটে যেতো আমার। তাই ভয়ে ভয়ে সেখানেই অপেক্ষা করতে থাকি। দুপুরে একজন মাক্স পরা লোক এসে খাবার আর পানি দিয়ে যায়, অনেক রিকুয়েস্ট করার পরও কোথায় আছি বলতে রাজি হয়না সে। সারাদিন একটু পানিও মুখে দিয়নী, আপনার কথা অনেক মনে পড়ছিলো। আপনি কেমন আছেন ভাবতেই অনেক কষ্ট হচ্ছিলো। তারপর রাতের খাবার দিতে যিনি আসেন আমাকে না খেয়ে থাকতে দেখে কাউকে কল করে আমাকে ফোনটা দিয়ে চলে যান বাইরে কিছুক্ষনের জন্য। আমিও সেই সুযোগটা কাজে লাগাই, আপনার নাম্বারে মেসেজটা দিয়ে সাথে সাথে ডিলেট করে দিয়।”
“ফোনের ওপারে কে ছিলো?”
“আমি কিছু জানিনা, আমিতো তার কথাও শুনিনি ঠিকমতো। শুধু এটুকু বুঝলাম আমাকে খাওয়ার জন্য বললেন, নাহলে অনেক খারাপ হয়ে যাবে নাকি। ”
“কিছুক্ষনের মধ্যে এক লোক এসে আমার সামনে একটা কাগজ দিয়ে সাইন করে দিতে বলেন। আমি কিছুতেই সেটা হাতে নিয়না, আমাকে অনেকবার থাপ্পর মারেন উনি। অনেক জিজ্ঞাসা করার পর জানতে পারলাম ওটা নাকি প্রপার্টি পেপার। আমার দাদুর গ্রামের কিছু প্রপার্টি যেটা দাদু আমার নামে করে দিয়েছিলেন। সেই প্রপার্টি তাদেরকে দিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক মারধর করলেন। একসময় আমি অজ্ঞান হয়ে যাই তাদের অত্যাচারে। যখন চোখ খুলি কাউকে আশেপাশে পাইনি, আর কোনো উপায় না পেয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে জানলা দিয়ে লাফ দিয়। হাত,পা ও অনেকটা কেটে যায় তাও কোনরকমে দৌড় দিয়।”
চলবে?
#Fiza_Siddique