#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(41)
গভীর বেদনামিশ্রিত ডাকে থমকে গেলো নূর। কাশ্মীরের শীতের মাঝেও কপাল আর গলায় ভেসে উঠছে ঘামের আভাস। বনফায়ারের আগুনে হালকা এই ঘর্মাক্ত নুরকে আরো মায়াবী লাগছে। দুটো তৃষ্ণার্ত চোখ প্রাণভরে নিজের তৃষ্ণা মেটানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মিটবে মিটবে করেও যেনো এই তৃষ্ণা নিবারণ হচ্ছেনা। প্রিয়জনকে দেখার তৃষ্ণা বুঝি এতটা পিপাসু করে তোলে এক প্রেমীক পুরুষকে! গভীর দৃষ্টি আঁকা বাঁকা পথে এগিয়ে পেটের কাছে স্থীর হতেই তড়িৎগতিতে নূরের মুখের দিকে তাকালো আদিত্য। শত প্রশ্ন আর অভিমান নিয়ে তাকালো নূরের স্নিগ্ধ মুখের দিকে। ততক্ষনে ঠোঁট কামড়ে কান্না নিবারণের চেষ্টায় মত্ত নূর এক খুঁটিতে ভর দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ঢলে যাওয়ার আগের মুহুর্তে পরিচিত বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে চোখজোড়া বন্ধ করলো সে।
“নূর! এই নূর। চোখ খোলো। একদম চোখ বন্ধ করবেনা। রিফাত তারাতারি স্টেথোস্কোপ আর বিপি মেশিন নিয়ে আয়। ফাস্ট। তুমি একদম চোখ বন্ধ করবেনা নূর, আমার দিকে তাকাও।”
গালে হালকা থাপ্পড় মারতে মারতে কোনরকমে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে আদিত্য। এই সময়ে শক পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মা আর বেবি দুজনের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই যেভাবে হোক নূরকে কোনমতে চোখ বন্ধ করতে দিচ্ছেনা আদিত্য। ততক্ষনে ডক্টর রিফাত প্রয়োজনীয় সবকিছু নিয়ে আসতেই হালকা করে মূখে পানির ছিটা দেয় আদিত্য। হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বসে নূরকে নিজের বুকের সাথে ঠেকিয়ে স্টেবেল করার চেষ্টা করে।
“আদিত্য!”
“ঠিক আছো তুমি? এতটা কেয়ারলেস কিভাবে হতে পারো তুমি? এখনও আগের মতই বাচ্চা রয়ে গেলে। কয়েকদিন পর বাচ্চার মা হবে এবার নিজের খেয়াল রাখা শেখো। টাকা দিয়ে আবার কেনা যায় কিনা দেখো। তোমার তো আবার টাকার অভাব নেই, আফটারঅল বড়লোকবাড়ির বউ।”
আদিত্যের তাচ্ছিল্যভরা কথায় হু হু করে কেঁদে উঠলো নূর। দুইহাতে আদিত্যের কলার ধরে টেনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
“এই তবে আমাকে চিনলে আদিত্য? তুমি নাকি তোমার নূরকে অনেক ভালো করে চেনো! নূরকে নূরের থেকে ভালো আদিত্য চেনে, এটাই বলতে তাইনা?”
“চিনতে তো তাকে লাগে যে হয় অপরিচিতা। পরিচিত নিজ আত্মাকে আলাদা করে কি চিনব?”
“আমি কিছু বলতে চাই তোমাকে।”
“শোনার ইচ্ছে নেই।”
“আমি যে বলবোই আজ আদিত্য।”
“কিসের এত তাড়া? ক্ষরা জমিতে নতুন করে আর ফসল ফলেনা।”
“আদিত্য”
হালকা হেঁসে খোলা আকাশের নীচে গিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টিতে তাকালো চাঁদের দিকে আদিত্য। পিছনে কারোর উপস্থিতি বুঝতে পেরেও চুপ করে তাকিয়ে থাকলো একইভাবে।
“আদিত্য আমার হাতে কিছুই ছিলনা। সময় আমাদের বিপক্ষে বড্ড জোরদার ভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো। চাইলেও আমি পারিনি সময়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে পরাজিত করে কাউকে পেতে। পারিনি আমি ভরা আলোকসজ্জায় নিজের বাবার মৃত্যুশয্যা দেখতে। পারিনি আমি নিজের ভালবাসা রক্ষা করতে। আমি ব্যার্থ ছিলাম, আমি তোমার গুনাহগার। আমাকে যা শাস্তি দেবে মাথা পেটে নেবো কিন্তু প্লিজ ভুল বুঝোনা। আমি চেয়েছিলাম তোমাকে এই জায়গায় দেখতে যেখানে তুমি আজ দাড়িয়ে আছো। ভেঙ্গে গুড়িয়ে নিজের অস্তিত্বকে তিলে তিলে শেষ করা আদিত্যকে আমি দেখতে পারতাম না।”
পিছনে ফিরে অবাক হয়ে এতোক্ষণ নূরের কথাগুলো শুনলেও কোনোকিছুই বোধগম্য হলোনা আদিত্যের। কপালের মাঝের ভাঁজটা আরো দৃঢ় হলো নূরের পরবর্তী কথাগুলোতে।
“আব্বুকে আমি বরাবর একটু বেশীই ভয় পাই তুমি জানো। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয় আম্মুকে সবকিছু জানানোর। বিয়ের কাজের ব্যাস্ততা থেকে একটু রেহাই পেয়ে রূমে আসতেই ছুটে যায় আম্মুর কাছে। আমার ভালোবাসার কথা জানামাত্রই দেখেছিলাম অন্য এক মানুষকে। আমাদের সম্পর্ক মেনে নেওয়া তো দূর, শোনা মাত্রই থাপ্পড়ের উপর থাপ্পর মেরে দুইগাল লাল করে দিয়েছিলেন। টাকার লোভে অন্ধ হয়ে বিসর্জন দিয়েছিলেন আমার সুখের কথা। একবারও ভেবে দেখেননি আমি সুখী হবো কিনা। বিশ্বাস করো আদিত্য আমি অনেক চেষ্টা করেছিলাম বোঝানোর। কিন্তু যখন আব্বুকে মেরে ফেলার হুমকি দিলো আমি আর পারিনি নিজের জেদ ধরে রাখতে। কোন মেয়ে পারবে বলো নিজের কয়েকদিনের ভালোবাসার জন্য ঊনিশ বছরের ভালোবাসাকে ভুলে গিয়ে তার লা*শ দেখতে চোখের সামনে। আ… আম…”
“হুশ হুশ! নূর আস্তে আস্তে। এভাবে কান্নাকাটি করেনা। প্লীজ চুপ করো। আই অ্যাম সরি। তোমার উপর অভিমান জমে ছিলো অনেক, তবে বিশ্বাস করো কোনো এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ভুলতে পারিনি। আর না রাগ করে থাকতে পেরেছি।”
নিস্তব্ধ রাতে পাশাপাশি বেঞ্চে বসে কেটে গেলো বেশ খানিকটা সময়। পাশাপাশি বসা দুটো মানুষের মাঝে রয়েছে কিঞ্চিৎ দূরত্ব। প্রবাহমান শীতল হাওয়ার সাথে মিশে একাকার হচ্ছে দুজনের দীর্ঘশ্বাসের উষ্ণ বাতাস। অনেককিছু বলতে চেয়েও কেউ কিছু বলে উঠতে পারছেনা। পরিবেশটা যেনো এখানেই থমকে গেছে।
“কেমন আছো নূর?”
“সত্যিটা বলবো নাকি মিথ্যেটা?”
“যেটা শুনলে আমার মনে প্রশান্তি আসবে। প্রথম নাহয় সেটাই বলো।”
“ভালো নেই আমি। একটুও ভালো নেই। প্রতিনিয়ত তোমার ভালোবাসা আমাকে ঘুমাতে দেয়না, নির্ঘুম প্রতিটা রজনী জানে আমার তীব্র ভালোবাসার কথা। আমার প্রতিটা দীর্ঘশ্বাস জানে কতো বেদনা লুকিয়ে আছে তাদের মাঝে। ছন্নছাড়া আমি কারো ভালবাসায়।”
নূরের কথা শুনে হালকা হাসলো আদিত্য। খানিক উৎসাহ নিয়ে ফিরলো নূরের দিকে। ঠোঁটের কোণে হালকা হাঁসি ঝুলিয়ে বললো,
“এবার নাহয় সত্যিটা বলো শুনি।”
“থাক না, কিছু জিনিস অজানা থাকাই ভালো। ভালো থাকার জন্য কিছু সত্যি যতটা বেশি অদেখা করা যায় ততই সুখী হওয়া যায়।”
“ভুল জানো তুমি। ভালোবাসা এমন এক তপস্যা যেটা পুরন হলেও লাভ আবার না হলেও লাভ। পূর্ণতা না পেলেও পেয়েছি সুখ, গভীর সুখ। কিভাবে জানো? এইযে তোমাকে পূর্ণ দেখে আমি সুখী। সুখ পাহাড়ী রাস্তার আনাচে কানাচে পথের সরু বাঁকের মধ্যেও খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের ভাঙ্গা জানালা দিয়েও আসতে পারে সুখের বাতাস। সুখ হলো কাল্পনিক, সুখ হলো আপেক্ষিক। একটা পাথর কুড়িয়েও মানুষ সুখ খুঁজে পায়, আবার দেখো সোনার পাত্রে পা ধুয়েও অনেকে সুখের সন্ধান করে। কড়া রোদ, ঝড়, বৃষ্টি উপেক্ষা করে একজন দুমুঠো অন্ন পরিবারের মূখে তুলে দিতে পেরে দুই ঠোঁটের মাঝে এক চিলতে হাঁসি নিয়ে কত সুখেই না দিন পার করছে। আবার কেউ বড়ো বড়ো রাজমহলে থেকেও ঠিকমতো একেক জন একেক জনের মুখও দেখার সুযোগ পায়না। আমি সুখ খুঁজে নিয়েছি তোমার সুখে নূর। শুধু একটাই অনুরোধ যে আসছে তাকে আমি একবার নিজের দুইহাতে নিয়ে একটু অনুভব করতে চাই। অনুভব করতে চাই আমার সুখের সুখপাখিকে।”
“আমি অনেক ভালো আছি আদিত্য। আদিলের মতো স্বামী ভাগ্যক্রমে পাওয়া যায়। আমি সেই সৌভাগ্যবতী যে শশুরবাড়ী, সমাজ সব জায়গায় আমার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ানো জীবনসঙ্গী পেয়েছে। আদিত্য জীবন কখনও থেমে থাকেনা, এটা সত্যি যে আমি যদি আদিলের মতো জীবনসঙ্গী না পেতাম তবে হয়তো আমার মনে আজও তুমি থেকে যেতে অনেকটা জায়গা জুড়ে। কিন্তু আদিল ত হতে দেয়নি, একটু একটু করে আমার মনের জমিনে যায়গা দখল করে নিয়েছে সে আমার অজান্তেই। ছোটো বীজের ন্যায় বপন হয়ে শেকড় দিয়ে আঁকড়ে নিয়েছে পুরো আমিটাকে। এই গাছ উপড়ে ফেলতে হলে পুরো আমিটাই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবো, হয়ে যেনো অগণিত টুকরোয় ভাগ। মনের ক্যানভাসের বেশিরভাগটাই তার দখলে। তুমি থেকে গেছো অতীত হয়ে।”
চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গড়িয়ে পড়া চোখের পানি হাতের পিঠে মুছে ফেলে আবারো বলে নূর,
“জানি কষ্ট হচ্ছে তোমার। অনেকটা খারাপ লাগছে ভালোবাসর মানুষের মুখে অন্য কারো নাম শুনে। কিন্তু সত্যি যে বরাবরই বেদনার হয় আদিত্য। সত্যের মুখোমুখি আমাদেরকে হতেই হয়। একটা সময় ঠিকই এই সত্যির মুখোমুখি তুমিও হতে সেদিন হয়তো আরো বেশী খারাপ লাগতো। আমি চাই তুমি এগিয়ে যাও। আমাকে ভালোবেসে আর পিছনে ফিরে না দেখো, সামনে অনেক কিছু অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।”
“একটা অনুরোধ রাখবে আমার?”
“বলো”
“একবার জড়িয়ে ধরবো তোমায়? প্লীজ একবার শুধু। কারো স্ত্রী, কারো মাকে জড়িয়ে ধরার সুযোগ তো আর কোনোদিন পাবোনা তাই এই শেষ আবদারে না কোরোনা প্লিজ।”
“আদিত্য তুমি অনেক পাল্টে গেছো। অন্য এক আদিত্য আজ আমার সামনে দাড়িয়ে আছে। ফাজলামিতে সবাইকে মাতিয়ে রাখা আদিত্য গাম্ভীর্যে ভরে গেছে। সবাইকে হাসানো আদিত্য হাসতে ভুলে গেছে। আর বাকিদের মতো আমি কখনো তোমাকে বলবোনা যে আমি আছি তোমার পাশে। বলবোনা আমরা তো বন্ধু থাকতেই পারি। কারণ আর যায় হোক ভালোবাসার মানুষকে দ্বিতীয়বার আর বন্ধু ভাবো যায়না। আমি চাই তোমার জীবনে এতো সুখ আসুক যে আমার সৃতীগুলো অতীতের ডাইরির পাতায় থেমে যাক। বর্তমানে তার ছায়াটুকুও না পড়ুক। আমি চাই তুমি দূরেই থাকো।”
হতাশার শ্বাস ফেলে নিচের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদিত্য। মাটিতে থাকা বরফের পর্যবেক্ষণের দায়িত্ত্ব যেনো কেউ দিয়েছে তার উপর। গভীর মনোযোগে সেই কাজই করে চলেছে। মাঝে মাঝে নীরবে একটা দুটো পানির ফোঁটা গাল গড়িয়ে গিয়ে মিশেছে সে বরফের মাঝে তরপর মিলিয়ে যাচ্ছে।
বেশ কিছুদূর চলে যাওয়ার পর পিছন ফিরে তাকায় নূর। আদিত্যের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে মুচকি হাঁসি দেয়।
“আদিত্য”
নূরের ডাকে হকচকিয়ে সামনে তাকাতেই বেশ কিছুটা দূরে দাড়ানো নূরের আহ্বানে ছুটে যায়। তারপর খুব সাবধানে আলগোছে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কয়েকফোঁটা জল নূরের চোঁখেও আসে। ভাগ্যের উপর তাচ্ছিল্য হেঁসে আদিত্যকে ছেড়ে এগিয়ে যায় সামনে। পিছন ফিরে আর তাকায় না। পিছন ফিরে তাকানোর আর বোধহয় কোনো কারণও নেই।
নূরের শেষ শব্দ “ভালো থেকো” শুনে সেখানেই হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে আদিত্য। আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকে অভিযোগের বুলি। দুই চোখের কার্নিশ ভেদ করে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে না পাওয়ার যন্ত্রণারা। হাঁটুর সাথে মাথা এক করে দেওয়া গর্জন মিলিয়ে ছড়িয়ে পড়ে নিস্তব্ধ পাহাড়ি শহরে। চারিদিকে সেই ডাক গুঞ্জিত হতে হতে একসময় মিলিয়ে যায় অনিমেষে।
চলবে?
#Fiza_Siddique
#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(42)
“আমি আপনার যোগ্য না আদাভান।”
অরুনিকার মুখে অসময়ে এমন কথা শুনে হতবাক হয়ে যায় আদাভান। ভ্রুদ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে কথাটা বোধগম্য করার চেষ্টা করে।
“আপনি কেন আমাকে ভালবাসলেন আদাভানে। আপনার দেওয়া গভীর ভালবাসার বদলে দুঃখ, কষ্ট ছাড়া কিছুই যে দিতে পারিনি আমি। প্রতিমুহূর্তে আমাকে সাজাতে চাওয়া আপনাকেই আমি বারবার বিপদে ফেলেছি, সহজ সরল চলার পথে বিছিয়ে দিয়েছি অজস্র কাঁটা। নিজের হাতে করা এই ভুলগুলো কিভাবে মেনে নেব আমি? কিভাবে ভুলে যাবো আপনার জীবন সংশয়ের জন্য একমাএ দায়ী ছিলাম আমি। আমার রক্ষকের ভক্ষক হয়ে উঠেছিলাম আমি। কিভাবে মেনে নেবো আপনার নিঃস্বার্থ ভালবাসার বাগানে একটু একটু করে বিষ ঢেলে গেছি আমি। উঠে পড়ে লেগেছিলাম ছারখার করে দিতে আপনাকে। আপনার কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচতাম বলতে পারেন? আমি যে প্রতি মুহূর্তে ধুঁকে ধুঁকে করছি। আমার করা ভুল, না না ভুল পাপ। আমার করা পাপগুলো আমাকে ঘুমাতে দেয়না। মনে করিয়ে দেয় আপনার সাথে করা অন্নয়গুলো। বর্ষা আপুর মৃত্যুর প্রতিশোধের নেশায় দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কি পরিমান আঘাত হেনেছি আপনার এই কোমল হৃদয়ে। বুকের বাম পাশের এই ভালোবাসার বক্সে নাজানি কতো আঘাত দিয়েছি। আপনার তখন অনেক কষ্ট হয়েছে তাইনা? মনে হয়েছে নিজের হাতেই আমি বারবার ছু*রি চালাচ্ছি এই বুকে। আমার পরম শান্তির এই বুকে মাথা রাখলেই তারা গেয়ে ওঠে অভিমানী গান, শুনিয়ে বেড়ায় দুঃখের কথা। বুঝিয়ে দেয় আমার বেইমানি।”
“হুশ। এই সময় এত কান্না করতে নেই প্রাণপাখি। তুমি জানোনা কতশত তপস্যার ফল তুমি। জানোনা কতোরাত তাহাজ্জতের আমানত তুমি। অদাভানের জীবনের আর এক নাম তার প্রাণপাখি। একটুতে রেগে যাওয়া, হুটহাট অ্যাটাক করা, অভিমানে গেল ফুলিয়ে রাখা এই স্ট্রং পার্সোনালিটির মেয়ের প্রেমে তো পড়েছিলাম বহুযুগ আগে। না ছিলো মায়াবী চেহারা, না ছিলো যৌবনের সৌন্দর্য্য। ছিলো শুধু একরাশ মুগ্ধতা। তার উষ্ণ ঠোঁটের ছোঁয়ায় পাগল করে দিয়েছিল এক কিশোরকে। নেশার চেয়েও বেশি নেশালো হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেই উষ্ণ ছোঁয়া। আচ্ছা, চুমুর সাথে কি আফিম মিশিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলে আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে? বলোনা প্রাণপাখি এই শিরায় শিরায় কিভাবে গেঁথে দিলে তোমার নাম?”
আদাভানের কথায় কান্না ভুলে খানিকটা লজ্জমিশ্রিত চেহারা নিয়ে তাকালো অরুনিকা। প্রেগনেন্সির জন্য বেশ মোটাসোটা হয়ে যাওয়ায় লজ্জায় রাঙ্গা অরুনিকাকে দেখতে আরোও আকর্ষণীয় লাগছে। সেই লজ্জার রেশ আরোও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে হালকা হেঁসে অরুনিকার পরনের শার্টের উপরের বোতামটা খুলে দিলো। লাজুকলতা অরুনিকা বিস্ময়ে চোখ বড়ো বড়ো করে আদাভানের দিকে তাকাতেই আরোও বেশি লজ্জায় পড়ে গেলো। দুজনের চোখাচোখি হতেই চোখ টিপ দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো আদাভানে। লজ্জায় পরনের ধিলে ঢালা শার্ট হাতের মাঝে নিয়ে ক্রমশ মুচড়াচ্ছে অরুনিকা।
“ককি করছেন?”
“বলবো?”
লজ্জায় রাঙা মুখে মাথাটা নীচু করে সম্মতি দিতেই আদাভানে কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বলতেই একহাতে শার্টের উপরের খোলা অংশ ধরে অপর হাতে নিজের মুখ ঢাকার বৃথা চেষ্টা চালায় অরুনিকা।
“দেখার কি আরোওওও কিছু বাকি আছে প্রাণপাখি? আমার সব কাজের প্রমাণ কিন্তু এইযে আমার লিটিল প্রিন্সেস।”
“উফ্! থামুন প্লিজ।”
“শুরুটা আর করলাম কই। শুরুটা তো করি, তারপর নাহয় থামবো।”
অধরে অধরে স্পর্শে, আদুরে আলিঙ্গনে ভরিয়ে তুললো আদাভান। কেটে গেলো ছোট্টো ছোট্টো ভালোবাসার অজস্র মুহূর্ত। জমে গেলো ডায়রির পাতায় ভালবাসাময় নতুন এক অধ্যায়।
নিকশ কালো অন্ধকারাচ্ছন্ন এক ঘরে আদাভান দাড়িয়ে আছে। সামান্যতম আলোর ছিটেফোঁটাও নেই সেখানে। চারিদিকে যেদিকে তাকানো যায় শুধুই কালো। হটাৎ বাচ্চার কান্নার আওয়াজে চমকে ওঠে আদাভান। কোমল এক শিশুকণ্ঠ যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়েও কোনোকিছুর নাগাল না পেয়ে জোরে আরোও বেশি ভয় পেয়ে যায়।
“আদাভান, আমি যেতে চাইনা। আমাকে বাঁচান প্লিজ। ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। এই দেখুন আমাদের সন্তানকে নিয়ে যাচ্ছে। কিছু একটা করুন। বাঁচান আমাদের।”
কথাটা শুনেই চমকে ওঠে। দিক বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। এই নিকশ কলো আঁধার পেরিয়ে কিভাবে পৌঁছাবে তার প্রাণপাখির কাছে? কিভাবে বাঁচাবে তাদের অংশকে? এসব ভেবে কোনো কূলকিনারা পায়না। নিজেকে কেমন যেনো অন্ধ অন্ধ বোধ হচ্ছে আদাভানের।
“অরু কোথায় তুমি?”
“আমি এইতো আদাভান, আপনার সামনে। না না আপনার পিছনে। কিজানি কোথায় আছি। সবই তো অন্ধকার।”
অরুনিকাকে হারানোর ভয়ে জোরে চিৎকার করে উঠতেই ঘুম ভেংগে যায় আদাভানের। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে পাশে তাকাতেই ঘুমন্ত অরুনিকাকে দেখে সস্তির শ্বাস ফেলে। অরুনিকার দুইহাত একসাথে করে এনে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিতে থাকে। কান্নার মাঝে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে রুক্ষ ঠোঁট ছোঁয়ায় অরুনিকার কপালে। অস্বস্তিতে আর ঘুম আসবেনা বুঝে উঠে গিয়ে দাঁড়ায় ব্যালকনিতে। ঘামে ভিজে লেপ্টে যাওয়া শার্টের দিকে একবার তাকিয়ে চলে যায় শাওয়ার নিতে।
কফি হাতে ব্যালকনির রেলিং ঘেঁসে দাড়িয়ে বিষণ্ণ মনে একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে আদাভান। হাজারো না বলা অভিযোগ ছুঁড়ে দিচ্ছে পরম ভারসাময় স্থানে। চোখের কোনে জমে থাকা অশ্রু জানান দিচ্ছে তার কষ্টের কথা। মাঝরাতে দেখা সেই স্বপ্নের পর আর এক মুহুর্ত ঘুমাতে পারেনি সে। দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলতে চেয়েও ভুলতে পারছেনা কিছু।
শরীরটা বেশ খারাপ লাগায় অরুনিকাকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছে আজ আদাভান। বাম হাতে অরুনিকার হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে একহাতে ড্রাইভ করছে। মাঝে মাঝে জানালার খোলা বাতাসে উড়তে থাকা প্রিয়তমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।
“আপনি এখানে আমাকে দেখে হাসছেন কেনো শুনি? এই এই একদম আমাকে দেখতে খারাপ হয়ে গেছে বলে অন্য মেয়ের দিকে তাকাবেন না। আপনার চোখ তুলে নেবো তাহলে।”
“আমি কি দেখছিলাম জানো? তোমার শাড়ি। মনে আছে কলেজে তোমার ওই ওড়নায় পমপম লাগানো থাকতো বলে মিস পমপম বলে ডাকতাম। হা হা। দেখো তুমি আজও সেই পমপম লাগানো শাড়ী পরেছো।”
“এটা তো আপনিই দিয়েছিলেন। মনে নেই বিয়ের পর আমাকে কত্তোগুলো পমপম লাগানো শাড়ী গিফট করেছিলেন।”
দুজনের কথোপকথনের মাঝে হটাত করে গাড়ির সামনে কাউকে আসতে দেখে বেশ জোরে ব্রেক কষে আদাভান। রাগে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে গাড়ি থেকে বেরোতেই সামনের মানুষটিকে দেখে চমকে ওঠে। অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“কাব্য!”
ততক্ষনে কয়েকজন পুলিশ এসে দুইহাত চেপে ধরে কাব্যের। পরণের জেলের পোশাক, বড়ো বড়ো গোঁফ দাড়ি, চেহারা শুকিয়ে গেছে, উজ্জ্বল মুখশ্রীতে কালো ছোপ ছোপ দাগ স্পষ্ট।
“অরু, এই অরু। কথা বলনা আমার সাথে। অরু তুই শুধু আমার। তোকে পেতে গিয়ে আমি কোনোকিছুর পরোয়া করিনি অরু। সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে আমি শুধু তোকেই ভালোবাসি অরু। অরু আমাকে মাফ করে দে অরু। আমাকে ফিরিয়ে এনে অরু তোর জীবনে। বিশ্বাস কর, অনেক সুখে রাখবো। এই এই ছেলেটার থেকে অনেক ভালো রাখবো। আমার কাছে ফিরে আয় অরু। আমি সেই তোর কাব্য ভাইয়া। দেখ, চিনতে পারছিসনা? আমার সাথে কথা বলনা অরু প্লিজ। তোর কণ্ঠস্বর শোনার জন্য আমি মরে যাচ্ছি।”
“ইন্সপেক্টর আপনি নিয়ে যান ওনাকে। একজন আসামি, খুনিকে এভাবে রাস্তায় ছেড়ে দেয় নাকি? আর কখনো যেনো বাইরে না বেরোতে পারে সেই ব্যাবস্থা করুন। আমার আপুর, খালামনির মৃত্যুর প্রতিশোধ নিজের হাতে নিতে পারলে সবচেয়ে খুশি হতাম আমি। কিন্তু আফসোস তাহলে আমার এই লোকটার মধ্যে কোনো তফাৎ থাকতোনা। নিয়ে যান প্লিজ ওনাকে। ঘেন্না করে আমার অনেক দেখলে।”
পেরিয়েছে আরোও একটা মাস। অরুনিকা হাঁটাচলা করতে পারেনা একদমই। খাওয়া দাওয়ায় সবটাই অরুচি। পানি ছাড়া আর কিছুই যেনো পেতে সয়না। কিন্তু বিগত দুইদিনে অরুনিকাকে দেখে বেশ অবাক হচ্ছেন আনিকা আহসান। প্রেগনেন্সির প্রথম থেকে শুরু করে যে মেয়েকে জর করে কিছু খাওয়ানো যেতনা সে নিজে থেকে ফ্রিজ খালি করছে। চকলেট থেকে শুরু করে আঁচার কিছুই বাদ দিচ্ছেনা। বিষয়টা যদিও চিন্তার না হলেও বেশ চিন্তা বাসা বাঁধছে আনিকা আহসানের মনে। কেমন যেনো অজানা এক আশঙ্কা ঝেঁকে ধরছে তাকে। ভাবনার মাঝে অরুনিকার আর্তনাদে ভয়ে শীতের মাঝেও ঘাম ছুটতে থাকে। শীতল স্রোত বয়ে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে। একমুহুর্ত অপচয় না করে দৌড়ে যান অরুনিকার রুমের দিকে।
রুমের সামনে গিয়ে আঁতকে ওঠেন আনিকা আহসান। বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে থাকেন সামনের দিকে। পা দুটো যেনো বরফের মতো জমে গেছে, এক পা এগোনোর শক্তিটুকু সঞ্চয় করে উঠতে পারছেন না। কিচেনে থাকা আদাভানকে ডাকার মতো সাহস বা শক্তি কোনোটুকুই যেনো অবশিষ্ট নেই। শুকনো কাঠ হয়ে যাওয়া গলায় কান্নাগুলো দোলা পাকিয়ে শ্বাসরোধের চেষ্টায় উন্মত্ত। শরীরের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে আদাভানকে ডাক দেন। আনিকা আহসানের ডাকে চমকে উঠে হাতে থাকা সদ্য বানানো কফির মগটা পড়ে যায় আদাভানের পায়ের উপর। হালকা শব্দে আঃ বলে উচ্চারণ করার আগেই শুনতে পায় আনিকা আহসানের কান্নার শব্দ। অজানা আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে বুকটা। চিনচিন ব্যাথায় এক হাত বুকে চেপে রূমে যেতেই থমকে যায়।
লাল রঞ্জিত ফ্লোরের মাঝে আনিকা আহসানের কোলে নিভু নিভু বোজা চোঁখে উপরের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে অরুনিকা। এক হাত পেটের মাঝে রেখে রক্তে রাঙ্গা ফ্লোরের মাঝে কাতরাচ্ছে সে। দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নেয় আদাভান অরুনিকা। কোনো কথা না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়ির পিছনে শুইয়ে দেয় আদাভান। আনিকা আহসানও দ্রুত পায়ে এসে অরুনিকার মাথা তুলে নেন নিজের কোলে। ঝড়ের বেগে ড্রাইভ করে দোষ মিনিটে হসপিটালে পৌঁছে পাগলের মতো এদিক ওদিক ছুটতে থাকে আদাভান। অবশেষে সব ফর্মালিটি পুরন করে অরুনিকাকে নেওয়া হয় ওটির উদ্দেশ্যে।
চলবে?
#Fiza Siddique