আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে পর্ব-৩৭+৩৮

0
678

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(37)

“আপাতত বিয়ের প্ল্যান ক্যান্সেল করে বর্ষার সাথে প্রেমের কাহিনী আরোও গভীর করি। একটু একটু করে ওকে বোঝাতে থাকি ওকে পাগলের মত ভালোবাসি। ওকে ছাড়া থাকতে আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এমনিতেই মেয়েটা প্রেমে পাগল তার উপর আমার কথাগুলো আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করলো। দেখা করার জন্য ছটফট করে শুরু করলো। বাহানা দিয়ে আমি না না করে কাটালাম আরোও কিছু দিন। অবশেষে আসলো সেই দিন, বর্ষা কান্না করতে করতে আমাকে কল দিলো। আমি কোনো কথা বলে চুপচাপ শুনছিলাম ওর কান্না আর পৈশাচিক হাসি হাসলাম”

“দেখো বর্ষা, আমি এসব তোমাকে এখন বলতে চাইছিলাম না। আমাকে খারাপ ভাববে অনেক তুমি। তাই দেখা করতে চাইছিলাম না। কিন্তু তুমি এভাবে কান্নাকাটি করলে আমি যে আরও কষ্ট পাচ্ছি। তোমার কান্না শুনলে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে। প্রেমিক হিসেবে ব্যার্থ মনে হয়।”

“তুমি আমার কাছে যা চাইবে আমি দেবো। বাট প্লিজ দেখা করো একবার। কতোদিন তোমাকে একটু ছুঁয়ে দেখিনি। খুব কাছ থেকে দেখতে ইচ্ছে করছে যে আমার।”

“আমিও তো দেখতে চাই খুব কাছ থেকে সবকিছু।”

“মমমমানে?”

“আমি তোমাকে কাছে পেতে চাই বর্ষা। দেখো এমন ত নয় যে তুমি আমাকে চেনোনা? খুব ভালো করে চেনো আমাকে। তবে কিসের এত ভয়। আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি সোনা। পৃথিবীর সবকিছুর ঊর্ধ্বে তুমি আমাকে কাছে।”

“কিন্তু আদাভান…”

“আমি জানতাম তুমি ভুল বুঝবে। ধুর, কেনো যে বলতে গেলাম। আচ্ছা, আই অ্যাম সরি। আমাকে একা ছেড়ে দাও একটু। ভালো লাগছেনা কিছুই। ভালোবাসার মানুষ যখন অবিশ্বাস করে তার থেকে বেশি কষ্টের আর কিছুই হয়না। ভালো থেকো।”

“ব্যাস আরকি লাগে। কয়েকঘন্টা শুধু ফোনটা অফ রেখেছিলাম। মেয়ে একেবারে কেঁদে কেটে ভাসিয়ে ফেলেছে। বর্ষা প্রথমে যদিও অনেক অবাক হয়েছিলো আমার প্রস্তাবে। ভাবতে পারেনি আদাভান এরকম প্রস্তাব রাখতে পারে। পরে যেহেতু অনেক দিনের ফ্রেন্ড, বেশ ভালো করেই চেনে তাই রাজি হয়ে যায়। আমার জয়ের শুরুটা এখানেই।”

অরুনিকার অবস্থা প্রায় কাহিল। কোনোরকম দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। একসাথে এত ধাক্কা কোনমতে নিতে পারছেনা। লোহা দিয়ে লোহাকে পেটানো হয় তাই লোহা বেশি আওয়াজ করে। কারণ আপন মানুষের দেওয়া যন্ত্রণা সহ্য করা বেশ কঠিন। সেই আঘাতের যন্ত্রণা যে কতটা ভয়ানক হয় সেটা যারা সহ্য করে তারাই জানে। ছোটো থেকে অগাধ আদরে বড়ো হওয়া অরুনিকা একের পর এক ধাক্কায় ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। ভেতরের ক্ষতগুলো দেখানোর জন্য এতদিন থাকলে সে গুরুত্ব দেয়নি। অথচ এখন খুব সুন্দরভাবে আদাভান উপেক্ষা করে চলে অরুনিকাকে।

“তারপর আর কি, ওয়েটারকে মোটা অঙ্কের টাকা খাইয়ে বর্ষার পানির গ্লাসে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিলাম। টেবিলে রাখা পানির গ্লাস থেকে পানি খাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই ঢলে পড়লো টেবিলে। মাস্ক পরে বর্ষাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম সেখান থেকে। একটা হোটেলের রুমে ঢুকে আমাদের প্রাইভেট পিকচার তুললাম কিছু। এমনকি প্রাইভেট টাইমের পুরোটা ভিডিও বানালাম। হোটেল থেকে বেরিয়ে আসার আগে টেবিলের উপর একটা কাগজ রেখে বর্ষার ফোনে ভিডিও আর ফটোগুলো পাঠালাম। সাথে ছোট্ট একটা মেসেজ পাঠালাম। যাতে লেখা ছিল, যদি এই পেপারে সাইন না করে তাহলে এগুলো আমি ইন্টারনেটে ভাইরাল করে দেবো। তারপর দেখবো কথায় মুখ লুকায়। হা হা হা।”

হাসতে হাসতে কথাগুলো বলে মুহুর্তেই অঙ্গভঙ্গির পরিবর্তন ঘটলো কাব্যের। রাগী কণ্ঠে গর্জে উঠলো,

“কিন্তু ওই মেয়ে আমার এতদিনের প্ল্যানে পানি ঢেলে প্রপার্টি পেপারে সাইন না করে সুইসাইড করলো। আমি জাস্ট কল্পনাও করিনি এই মেয়ে এমনভাবে হারিয়ে দেবে আমাকে। আর এরপরে কি হলো সবতো তুমি জানোই ড্যাড। মামনিকেও মেরে দিলে কেনো? ড্যাড ওইদিন মামনি আমার লকারে থাকা বর্ষার ডাইরি পড়ে নিয়েছিলো আর সবকিছু জেনে আমাকে যা নয় তাই বলেছিল। তাই তোমার কথায় মামনিকে মেমোরি লস ইনজেকশন দিলাম। অথচ আমি জানতামই না ওটা পয়েজন ছিলো। কেউ জানতেই পারলোনা মামনিকে আমি মেরেছি। কিন্তু ড্যাড আমাকে দিয়ে এই কাজটা কেনো করালে? উই নো ড্যাড হাও মাচ আই লাভ অরুনিকা। সেই ছোট্ট থেকে…..”

কাব্যের বলা ড্যাড শব্দটা শুনে চমকে ওঠে অরুনিকা। অনেক ছোট ছিল যখন কার অ্যাক্সিডেন্টে খাদে পড়ে যায় কাব্যের বাবার গাড়ি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও দেহের কোনো চিহ্ন খুঁজে পায়নি পুলিশ। তাহলে কি সেদিন তিনি মারা যাননি! পিছনে থেকে এসবের ঘুটি সাজাচ্ছেন কাব্যকে দিয়ে! নিজেকে সামনে নিয়ে কোনরকমে ছুটে পালাতে গিয়ে অরুনিকার হাত লেগে পড়ে যায় একটা গ্লাস। ভীতসন্ত্রস্ত চেহারা নিয়ে পালাতে গেলেই ধরে ফেলে কাব্য।

“একদম ছোঁবেনা আমাকে। তোমার ঐ পাপী হাত আমার শরীরের যে অংশে লাগবে তা যেনো ভষ্ম হয়ে যাক।”

“অরু তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। আমার কথাটা….”

“কি শুনবো আমি? কিভাবে বর্ষা আপুকে মেরেছেন? নাকি কিভাবে খালামনিকে মেরেছেন? আর কিছু বলার বাকি থাকলে বলে দিন। একসাথে সব ধাক্কা খেয়ে মরে যাই আমি। আর সহ্য করতে পারছিনা আমি। আপন মানুষের মুখোশ পরে থাকা এই বহুরূপী মানুষটাকে কিভাবে আমি চিনতে পারলাম না বলুন তো? বলতেই হবে দারুন মানুষ আপনি। কি সুন্দর আমাদের মাঝে থেকে এক এক করে আমার সব আপন মানুষগুলোকে শেষ করে দিলেন। এর পরের টার্গেটটা নিশ্চই আমি ছিলাম? তো নিন আমি আপনার সামনে আছি। মেরে ফেলুন আমাকে। আপনার এই চেহারা দেখেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। কতো ভালো ভাবতাম আমি আপনাকে। নিজের ভাই ভাবতাম। বন্ধুদের যখন দেখলাম বড়ো ভাইয়ার সম্পর্কে কথা বলতে তাদের নিয়ে গর্ব করতে, আমিও বলতাম আমারও বড়ো ভাইয়া আছে। কাব্য ভাইয়া আমাদের ওনেক ভালোবাসেন। কোনোকিছু চাওয়ার আগেই এনে দেন। আমার সব আবদার ওনার কাছেই থাকে। তখন তো আর বুঝিনি ভালো মানুষের মুখোশ পরে এক নোংরা মানুষের এত প্রশংসা করে যাচ্ছি আমি। বিশ্বাস করুন আমার ইচ্ছে করছে আপনার ওই মুখে একদলা থুতু দিয়ে পুরো দুনিয়াকে জানিয়ে দিতে কেউ যেনো কোনো আপনকে বিশ্বাস না করে। অতিরিক্ত বিশ্বাস করা কাছের মানুষগুলোই পিছন থেকে ছুরি মারে। এতো জঘন্য কাজ আপনি কিভাবে করতে পারলেন? একটুও বুক কাঁপলো না? শেষ পর্যন্ত নিজের মা কেও মেরে ফেললেন? ছিঃ ছেলে নামের কলঙ্ক আপনি।”

“আমি আমার মাকে মারিনি। ওনাকে মারার কোনো ইচ্ছে আমার ছিলোনা। আমি তো শুধু গত কিছু বছরের স্মৃতি ভুলিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভুলবশত মা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। অরু তুইও দেখেছিলিস আম্মুর মৃত্যুতে আমি কতোটা ভেঙে পড়েছিলাম।”

“আপনার করা দোষে আমি আদাভানকে দোষী ভেবে এসেছি বারবার। আমার মন বলেছে আদাভান এমন কিছু করতে পারেনা কিন্তু আমি শুনিনি। আপনার পাতা জালে আমিও পা দিয়ে গিয়েছি দিনের পর দিন। অথচ প্রতিটা মুহূর্তে ছায়ার মতো পাশে থেকেছে আদাভান। কখনও কোনো আঁচ লাগতে দেয়নি আমার। আমি অনেক বড়ো অন্যায় করে ফেলেছি আদাভানের কাছে আমাকে মাফ চাইতে হবে। আমাকে এখুনি যেতে হবে।”

“হা হা হা! ভাবলি কিভাবে এতকিছুর পর আমি তোকে এখান থেকে যেতে দেবো? আমাকে কি পাগল কুত্তায় কামড়েছে নাকি?”

“দেখো অলরেডি অনেক খারাপ কাজ করে ফেলেছ তুমি। আর অন্তত এমন কিছু করোনা যাতে নিজেকে নিজে আর ক্ষমা করতে না পারো। আয়নায় দাড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবির সাথেই নজর মেলাতে না পারো। যেতে দাও বলছি আমাকে।”

আজ দুইদিন অরুনিকার কোনো খোঁজ নেই। আদাভান এদিক সেদিক সব সম্ভাব্য জায়গায় পাগলের মতো খুঁজছে অরুনিকাকে। পাগলের মত অবস্থা হয়েছে।

চেয়ারে বাধা অবস্থায় পড়ে আছে অরুনিকা। ঠোঁটের কোণে কেটে গিয়ে রক্ত শুকিয়ে গেছে। শরীরের বিভিন্ন অংশে মারের চিহ্ন স্পষ্ট। মুখের উপর ঠান্ডা পানি পড়ায় হকচকিয়ে যায় অরুনিকা। সামনে তাকিয়ে মানুষটাকে দেখে তাচ্ছিল্য হাসি হাসলো।

“কিরে আমাকে দেখে ভয় করছেনা?”

“এই কয়েকদিনে তোমার করা অত্যাচারে ভয়টা ভেঙ্গে গেছে। তোমাকে খালু বলে ডাকতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। তোমার মতো নিচ চরিত্রের লোক এসব ছাড়া আর কি বা করতে পারে। বিয়ের পর খালামনিকে পেটাতে, দিনের পর দিন সব অত্যাচার সহ্য করেছে খালামনি কাব্য ভাইয়ার জন্য। অথচ সে তো জানতোই না যে ছেলের জন্য সারাজীবনে এই অমানুষটার মার সহ্য করেছে সে নিজেই এত অমানুষ হবে। জানলে হয়তো জন্মের পরেই গলা টিপে শেষ করে দিত এমন সন্তানকে।”

সামনের লোকটা রেগে অরুনিকার ঝুটি ধরে চেয়ারের হাতলে ঠুকে দেয়। কপাল কেটে গলগল করে পড়া রক্তে মুখের একপাশ ভিজে যায় অরুনিকার।

“ড্যাড প্লিজ অরুকে ছেড়ে দাও। ওকে নিয়ে আমি অনেক দূরে চলে যাব। তোমাকে প্রোপার্টি দিয়ে আমি ওকে নিয়ে চলে যাবো প্লিজ ওকে মেরোনা। অরুর কান্না আমি ছোটো থেকে কখনও সহ্য করতে পারতাম না সেখানে ওর এতো রক্ত দেখে আমি মরে যাচ্ছি ভেতরে ভেতরে। অরু যেনো কোনো কষ্ট না পায় তাইতো আদাভানকে ভালোবাসে জেনে নিজেই সরে গেছিলাম।”

“কাব্য তুমি এই মেয়ের জন্য আমার কাছে এসে হাত জোড় করছো ভাবতেই রাগ লাগছে আমার। তুমি আমার ছেলে হয়ে এসব মানায় না। এসব মেয়েকে ইউজ করতে হয়, লাইফে রাখতে হয়না।”

“আপনি ভাবলেন কিভাবে মিষ্টার কাব্য। আপনার মত জঘন্য লোকের সাথে আমি সংসার করবো। আপনাকে দেখলেই আমার মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আর আমি কিনা আপনার সাথে দূরে কোথাও চলে যাবো? হা হাসালেন। আই হেট ইউ। শুনেছেন আপনি? ঘৃণা করি আমি আমার বর্ষা আপুর খুনিকে। আপনার লজ্জা করা উচিত এসব বলার আগে।”

কাব্য কিছু বলতে যাবে তার আগেই ফোনের আওয়াজে বিরক্তিকর চোখে তাকিয়ে পকেটে থাকা ফোনটা বের করতেই রহস্যময়ী হাঁসে। অরুনিকার মুখের কাছে ফোনটা নিয়ে দেখাতেই স্ক্রিনে লেখা নামটা দেখে করুন চাহনিতে তাকায় অরুনিকা।

চলবে?
#Fiza Siddique

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(38)

“উপস্! আদাভান আমাকে কেনো কল করছে বলতো অরুনিকা। আমি তো জানিনা ওর অরুনিকা কোথায় আছে। আমি তো শুধু জানি আমার অরুর কথা। আমার অরু ছাড়া আর বাকি কোনো মেয়ের কথা জানার আমার টো প্রয়োজন নেই।”

অরুনিকার সামনে ফোন ধরে গালে স্লাইড করতে থাকে কাব্য। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে অরুনিকার। কোনরকমে মুখ বাড়িয়ে ফোনটা ছুঁতেই হাত সরিয়ে নেয় কাব্য।

“কাব্য ভাইয়া প্লীজ আমাকে একবার কথা বলতে দাও আদাভানের সাথে। একটা বার আমাকে নিজের ভুলের জন্য মাফ চাওয়ার সুযোগটা অন্তত দাও। প্লীজ।”

“উহু ডিয়ার অরু, তা তো হচ্ছেনা। আদাভানের তোমাকে খুঁজে পাওয়ার আগেই আমরা ফুস। এমন জায়গায় চলে যাবো তোমাকে নিয়ে যে আদাভান কেনো আমার বাপও জানতে পারবেনা। আদাভান খুঁজে মরবে পুরো শহর অথচ তোমার টিকিটুকুও ওর হাতে আসবেনা। ও ভাববে আমি তোকে নিয়ে কোনো লুকানো জায়গায় যাবো কিন্তু আমি তো আছি আমার বাড়িতেই। আর একটা সিক্রেট কি বলতো, আমার বাড়ী কোনোক্রমে এসেও গেলে এই রুম পর্যন্ত কখনও পৌঁছাতে পারবেনা। কারণ আমার রুমের আন্ডারগ্রাউন্ড এই রুম। যার রাস্তা কারোরই জানা নেই।”

কাব্যের হাঁসি দেখে মুহুর্তেই রেগে লাল হয়ে গেল অরুনিকা। বর্ষার মৃত্যুর জন্য কাব্য দায়ী এটা জানার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও সহ্য হচ্ছেনা কাব্যকে। করুন চোখে পেটের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বাহিরের চাঁদনী রাতের থালার মত চাঁদ থেকে একফালি এসে মুখে পড়তেই মনে পড়ে গেলো আদাভানের সাথে কাটানো সুখের সময়গুলো। দুজনের একসাথে চন্দ্রবিলাস, ছোটোখাটো দুষ্টুমি, দুজনে একসাথে বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে আম্মুর বকা শোনা, আদাভানের কেয়ার সবকিছু একে একে মনে পড়ছে। কিছুদিন যাবৎ করা নিজের ব্যাবহারের জন্য ভীষণ কান্না পাচ্ছে অরুনিকার।

“প্রাণপাখি!”

চিরপরিচিত নাম শুনে চমকে সামনে তাকাতেই অবাক হয়ে যায় অরুনিকা। সামনে দাড়ানো বিধ্বস্ত আদাভানকে দেখে অনুতাপের পরিমাণ আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। চোখে চোখ মেলানোর ক্ষমতাটুকুও জুটিয়ে উঠতে পারেনা। মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাতেই এগিয়ে যায় আদাভান। চেয়ারের বাঁধন খুলে সামনে দাড়াতেই জড়িয়ে ধরে অরুনিকা। কিছু বলতে যাবে তার আগেই,

“তুই! তুই এখানে কিভাবে?”

কাব্যর কথা শুনে ব্যাঙ্গাত্মক হাঁসে আদাভান। অরুনিকাকে সরিয়ে দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় কাব্যের দিকে।

“চোর যত বড়োই হোক না কেনো কিছু না কিছু ক্লু ঠিক রেখে যায়। আর তুই তো শুধু ক্লু না আমাকে পুরো ঘটনাই বলে দিলি। হা হা হা।”

“মানে? আমি কখন তোর সাথে কথা বললাম?”

“লেটস চেক ইওর ফোন।”

আদাভানের কথায় ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করতেই চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় কাব্য।

“ইয়েস। তুই যেটা ভাবছিস একদম ঠিক ভাবছিস। কোনোভাবে ভুলবশত আমার ফোনটা রিসিভ হয়ে যায় আর তোর বলা সব কথাই আমি শুনে ফেলি। তারপর আর কি, চলে এলাম তোর রূমে। তোকে যতটা চালাক ভেবেছিলাম টুই ততটাও নাহ। রামছাগল একটা। সিক্রেট রূমের দরজা ঢাকতে সবসময় ভারী কিছু ইউজ করতে হয় রে পাগল। যদিও প্রথমে আমিও বলে বনে গেছিলাম। কোথায় রুম, কোথায় আমার প্রাণপাখি এসব ভেবে ভেবে কোনো কুল খুঁজে পাচ্ছিলামনা। হতাশাগ্রস্থ ক্লান্ত শরীর নিয়ে সোফাতে বসতে গিয়ে বুঝলাম ভীষণ হালকা এটা। সাধারণত বাড়ির ফার্নিচার কেউ এতো হালকা ইউজ করবেনা। তাই সন্দেহবশত হালকা ধাক্কা দিতেই পিছনে সরে গেলো আর নীচে পাশাপাশি সব টাইলস এর চকচকের মাঝে ওই কাঠের সাদা রংটা কেমন ফিকে লাগছিল। সন্দেহবশত হাত দিয়ে টোকা দিতেই বুঝে গেলাম এটা টাইলস না, কাঠের। ব্যাস আর কি, চলে এলাম তোর সিক্রেট রুমে আমার বউকে নিতে।”

নিজের করা ভুলের জন্য সাপের মতো ফোঁসফোঁস করছে কাব্য। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অরুনিকার হাত ধরে বেরোতে গেলে আটকে দেয় আদাভান।

“দেখ অনেক জ্বালাতন করেছিস এইকয়দিন। এবার আমার বউকে ছাড়। কতোদিন বউকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানো হয়নি। আহ, এবার একটু শান্তি মত বউয়ের কোলে ঘুমাবো।”

আদাভানের আয়েশি ভঙ্গিতে বলা কথা শুনে শশব্দে হেসে ওঠে কাব্য। নিজের সাথে চেপে ধরে অরুনীকাকে।

“অরু আমার। শুধু আমার। ওর জন্মের পর থেকেই ওকে আমার নামে লিখে নিয়েছি। ভালোয় ভালো সরে যা আমাদের রাস্তা থেকে।”

“চারিদিকে তাকিয়ে দেখ একবার।”

হাই তুলতে তুলতে বলা আদাভানের কথা শুনে আশেপাশে তাকাতেই চমকে ওঠে কাব্য। রুমের চারিদিক পুলিশ ঘিরে রেখেছে। অবস্থা বেগতিক দেখে অরুনিকার দিকে করুন চাহনিতে তাকায় কাব্য। কাব্যের তাকানো দেখে সেদিকে ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে নিজের ফোনে করা কাব্যের সব দোষ স্বীকার করার ভিডিও এগিয়ে দেয় পুলিশের হাতে।

অরুনিকাকে গাড়িতে করে বাড়ির দিকে পৌঁছে দিয়ে আদাভান চলে যায় পুলিশ স্টেশনে। সব কাজ শেষে হাতে কিছু গোলাপ নিয়ে খোশমেজাজে বাড়ি ফেরে আদাভান। বাড়ীতে ঢুকে কাউকে না দেখে অবাক হয়ে যায়। পুরো বাড়ীতে সবাইকে খুঁজে খুঁজে নিজের রুমে যেতে আরও একদফা অবাক হয়ে যায়।

ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে লাইট জ্বালানোর জন্য সুইচ খুঁজতেই দরজা বন্ধ করার আওয়াজে পিছনে তাকায়। ততক্ষনে চোখ অন্ধকারে সহনীয় হয়ে হালকা হালকা বোঝা যাচ্ছে সবকিছু। দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাড়ানো রমণীকে দেখে গলা শুকিয়ে যায় আদাভানের। বারান্দা থেকে আসা চাঁদের আলোয় আরোও স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে অরুনিকাকে।

আদাভানের সাদা রঙের একটা শার্ট পরে সাথে চুলগুলো উঁচু করে পনিটেল করে আবেদনময়ী ভঙ্গিতে দাড়িয়ে আছে অরুনিকা। নিজের অজান্তেই একপা একপা করে এগিয়ে যায় আদাভান। আদাভানের এগোনোর সাথে সাথে বেড়ে চলেছে অরুনিকার হার্টবিট। নিঃশ্বাসের ওঠানামাও বেড়েছে কয়েকগুণ। দরজার পর্দা খামচে ধরে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টায় মগ্ন অরুনিকাকে টান দিয়ে পিছন ঘুরিয়ে দাঁড় করে আদাভান। হাতে রাখা গোলাপগুলো এক হাতের মুঠোর মাঝে রেখে কোমর জড়িয়ে ধরে। আর একহাতে টান দিয়ে খুলে ফেলে পনিটেল। তারপর কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,

“আর কতো পাগল বানাবে আমাকে? এবার তো দেখছি সোজা পাবনাতে ভর্তি হতে হবে।”

দুইহাতে আদাভানের হাত আঁকড়ে ধরে সামনে ঘরে অরুনিকা। ছলছল চোখে তাকায় আদাভানের দিকে।

“আই অ্যাম সরি। আমি সত্যি বুঝতে পরিনি এসবের পিছনে কাব্য ভাইয়া ছিল। প্রথম থেকে আপনাকে অপরাধী মনে করে যা নয় তাই ব্যবহার করেছি। আপনি কখনও একটুও প্রতিবাদ করেননি। বরং সবসময় আমার রাগগুলো ভালোবাসা দিয়ে মিটিয়ে দিয়েছেন। আপনার ভালোবাসায় আমাকে বারবার আপনার আরও কাছে আসতে বাধ্য করেছেন। বারবার আপনাকে নিয়ে কনফিউশনে ভুগতে বাধ্য করেছে। আই অ্যাম সরি। আমি অনেক খারাপ বিহেভ করেছি আপনার সাথে। আমাকে মাফ করে দিন প্লিজ। আপনি সবসময় আমাকে ভালোবেসে আগলে রেখেছেন আর আমি আপনাকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আর না। আমাকে আপনার করে নেবেন আদাভান? সারাজীবন আপনার হয়েই থাকতে চাই। আপনার এই বুকে মাথা রেখে শুরু করতে চাই প্রতিরাত্রিযাপন। ঘুম থেকে উঠে আপনার এই উষ্ণ বুকে আলতো চুমু এঁকে দিতে চাই। দিবারাত্রি শুধু আপনার আলিঙ্গনে মত্ত হয়ে চাই। দেবেন কি আমাকে সেই সুযোগ?”

“হুম দেওয়াই যায়। তবে আমিও কিন্তু একটা সুযোগ চাইবো।”

“তোমার শাড়ি……”

“বুঝেছি। ঠিক আছে আপনার কাছেই শাড়ী পড়বো। এবার কি মাফ করা যাবে?”

“হুশ। শাড়ী পরানোর না খোলার সুযোগ চাই। হা হা হা। দেবেন?”

“অসভ্য। বাবা হতে চললো একনো লুচ্চামি গেলোনা।”

“মমমানে!”

“মানে আরকি বেবী আদাভান আসতে চলেছে।”

অরুনিকাকে বুকের মাঝে চেপে ধরে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দাড়িয়ে আছে আদাভান। এখন কি করা উচিৎ কিছুই মাথায় আসছেনা।

“তুমি সত্যি বলছো? আমি আমি বাবা হবো। আমাদের সন্তান তোমার এই পেটে? আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবোনা আজ আমি কতোটা খুশি। দুনিয়ার সবচেয়ে খুশি মানুষ আমি আজ। আই অ্যাম সো হ্যাপি প্রাণপাখি। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছেনা।”

“এইযে কিউটি, একদম মাম্মামকে জ্বালাতন করবেনা। যা লাগবে পাপ্পাকে বলবে। পাপ্পা সব সহ্য করতে পারে শুধু মাম্মাম এর কষ্ট পারেনা সহ্য করতে। আর শোনো, পাপ্পা এখন মাম্মামকে অনেক আদর করবে, তুমি চুপচাপ থাকবে ওকে!”

অরুনিকার পেটের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কথাগুলো বলে অরুনিকাকে কোলে তুলে নিলো আদাভান। ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে পার হলো আরও এক রজনী। বারান্দার খোলা দরজা দিয়ে উঁকি মারা চাঁদ সাক্ষী হয়ে থাকলো এক ভালোবাসার জুটির ভালোবাসার।
___________

নূরের অনেক বোঝানোর পর অবশেষে বাড়ি ফিরেছে আদিল। তবে মায়ের সাথে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেছে। নূরের প্রেগনেন্সি নিয়ে কোনরকম রিস্ক নিতে চায়না আদিল, তাই নীচের একটা ঘরে সবকিছু শিফট করে বেডে বসতেই,

“আদিল! মায়ের সাথে এমন কেনো করছেন? উনি আপনার মা। সন্তানের কতো ভুল মা মাফ করে দেয়, আর আপনি মায়ের এই ছোট্ট একটা ভুল মাফ করতে পারছেন না?”

“নূর, এমনিতেই আমি তোমার উপর অনেক আপসেট। আমাকে আর এসবে ঘাটিওনা। তবে মার একটাও মাটিতে পড়বেনা।”

“আমি বিরক্ত করছি তো আপনাকে। ঠিক আছে থাকুন আপনি। আমি অন্য রূমে গিয়ে ঘুমাবো আজ।”

নূর চলে যেতে গেলে পিছন থেকে কোলে তুলে নেয় আদিল। নূরের নাকের সাথে নাক ঘষে হালকা হেসে বলে ওঠে,

“এটুকু শরীরে এত রাগ কোথায় থাকে বলোতো? আমাদের মাঝে যায় হয়ে যাক থাকতে তো হবে তোমাকে আমার সাথেই। তোমাকে জড়িয়ে না ঘুমালে আমার ঘুম আসেনা জানোনা?”

“ছাড়ুন আমাকে। আমি এসব কোথায় ভুলবোনা আজ। অনেক খারাপ আপনি। বেবি শোন, তোর পাপা অনেকক খারাপ। একদম পাপার সাথে কথা বলবিনা। তাড়াতাড়ি চলে আয় আমরা একসাথে তোর পাপার সাথে ফাইট করবো।”

হালকা হেসে দু হাতে নূরের চোখ চেপে ধরে রূমের সাথে এটাচ পুলের কাছে নিয়ে যায় আদিল। চোখ খুলে চারিদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় নূর। পুরো পুল সাইট ছোটো ছোটো লাইট দিয়ে সাজানো, মাঝে মাঝে তাদের সুন্দর সুন্দর মুহূর্তের কিছু ছবি আটকে দেওয়া। বিস্ময়ে চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে একটা কাগজের মতো জিনিস দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় নূর। ফেরারী লাইটের তারে ক্লিপের সাথে আটকানো কাশ্মীরের এর দুটো টিকিট দেখে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় নূর। খুশিতে দৌড়ে গিয়ে আদিলের গলা জড়িয়ে ঝুলে পড়ে।

“আরে আস্তে আস্তে। বারণ করেছি না তোমাকে এই সময়ে একদম দৌড়াবেনা। তোমার পছন্দের জায়গায় নিয়ে যেতে পারি তবে একটা শর্তে, নো লাফালাফি ন ঝাপাঝাপি। আমি যেমন ভাবে বলবো সেভাবেই চলতে হবে। রাজি?”

“ডান।”

“চলো এবার ঘুমাতে যাবে। কাল সকাল সকাল বেরোতে হবে। প্যাকিং আমি করে নিয়েছি হালকাপাতলা, বাকি কিছু লাগল ওখান থেকেই কিনে নেবো।”

চলবে?
#Fiza_Siddique

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে