#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(33)
এতবছর পর চোখের সামনে হিয়াকে দেখে অবাক হয়ে যায় আদিল। শুকনো একটা ঢোক গিলে আড়চোখে পিছনে তাকাতে গেলে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে হিয়া। এবার আদিলের গলা শুকিয়ে কাঠ। কাকে রেখে কাকে বোঝাবে এবার।
“কেমন আছো তুমি? ইউ নো কতো মিস করেছি তোমাকে? তুমি তো আমাকে আর একটা কল পর্যন্ত করোনা কয়েক বছর ধরে। ভুলেই গেছো।”
হিয়ার অভিমানী কণ্ঠ শুনে আড়চোখে পাশে দাড়িয়ে থাকা নূরের দিকে হালকা হেঁসে বলে উঠলো,
“আরে না না ভুলবো কেনো? তুই আমার একমাত্র ফুফাতো বোওওওন। কিভাবে ভুলি।”
“বোন এটা এত জোরে বললে কেনো? আমরা কি কালা নাকি?”
“যাতে আমার উপর আক্রমণ না হয় পরে।”
আড়চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে কথাটা বললো আদিল। নূর নির্বিকার ভাবে দুজনের কথোপকথন শুনে আদিলকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো খাওয়ার টেবিলে। আদিল আর হিয়াও ডাক পড়ায় আর কোনো কথা না বলে চলে আসলো খেতে।
“দেখ রে আদিলের মা, দুজনকে কি দারুন মানিয়েছে। কতো করে বললাম আমার হিয়ার মতো স্মার্ট মেয়ে কোথায় পাবি তুই। তারউপর দুজনে একে অপরের সাথে কতো সহজ। শুনলিনা আমার কথা। এই মুখপুড়ি মেয়ে কি দিয়েছে তোকে বলতো? এতো বছরে একটা বাচ্চার মুখও তো দেখাতে পারলোনা। বলি কি শোন, এখনও সময় আছে। তালাক দিয়ে দিতে বল আদিলকে এরে। আমার হিয়ার সাথে এই মেয়ের কোনদিক দিয়ে যায় শুনি?”
“আহ আপা, বাদ দিন না এসব। যা হাওয়ার তা তো হয়েই গেছে। দুজনে ভালো আছে এটাই তো অনেক আমাদের জন্য তাইনা। ওরা নিজেদের জীবন নিজেদের মতো করে গুছিয়ে নিক। এটাতে আমরা বড়রা না বলাই ভালো। আর আদিলকে তো আমি চিনি। ও যা করবে ভেবে চিন্তেই করবে। ”
“ওর আর দোষ দিয় কি করে বলতো? তোরা তো ধরে বেধে বিয়েটা দিলি। মনে নেই, বিয়ের আগের দিনও বিয়ে করবেনা বলে চলে যাচ্ছিলো। তোর কসমের জন্য তো শুধু থেমে গেলো।”
এতক্ষন কথাগুলো নূরের খারাপ লাগলেও নিজের মতো করে কিচেন থেকে সব এনে সাজাচ্ছিল টেবিলে। কিন্তু আদিল বাধ্য হয়ে নূরকে বিয়ে করেছে, কথাটা শোনামাত্র হাতে থাকা পানির মগটা পড়ে গেলো। নিজেকে কেমন যেনো শূন্য শূন্য লাগছে। আদিত্যকে ভুলে নতুন করে আদিলের ভালোবাসায় বাঁচতে শিখেছিল সে। ভালোবাসাও কি জোর করেই ছিলো তবে?
আওয়াজ পেয়ে সেদিকে দৌড়ে আসে আদিল। নূরকে থম মেরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। অথচ চারিদিকে কাঁচের ছড়াছড়ি। সাবধানে দুইপা এগিয়ে কোলে তুলে নিলো নূরকে। সাবধানে পরিস্কার জায়গা দেখে নামিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো।
“এতো কেয়ারলেস কেউ হয় নূর? একটু হলেই তো পায়ে ফুটে যেতো কাঁচ।”
ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নুর আদিলের দিকে। বোঝার চেষ্টা করছে আসলে কোনটা ঠিক। উৎকণ্ঠা নিজের মাঝে চেপে রাখতে না পেরে বলে উঠলো,
“আমাকে আম্মুর কসমের জন্য বিয়ে করেছিলেন আপনি?”
নূরের কথা শুনে চমকে উঠলো আদিল। কড়া চোখে তাকালো ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত সবার দিকে। পরক্ষনেই নিজের রাগ সংযত করে কোমল চোখে তাকায় নূরের দিকে।
“কে বলেছে নূর এসব তোমায়?”
“আমি হ্যা অথবা না শুনতে চাই।”
বিয়ের এত বছরেও নূরের কঠিন কণ্ঠ কখনও শোনেনি আদিল। হাজার কটু কথাও চুপচাপ সহ্য করে যাওয়া নূরকে অন্যরকম লাগছে আজ। চোখ কেমন জানি রক্তিম হয়ে আছে। মিথ্যে বলা কোনোদিনও আদিলের স্বভাবে পড়েনা। তাই নিঃসংকোচে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলতেই প্রাণহীন হাঁসি হাসলো নূর। নূরের হাসি দেখে ভয়টা আরো গাঢ় হয়ে উঠলো আদিলের।
“নূর আই ক্যান এক্সপ্লেইন।”
“উত্তর জেনে গেছি।”
আদিলকে থামিয়ে দিয়ে উল্টোপথে হেঁটে সদর দরজার দিকে এগোতেই ফুফি বলে ওঠেন,
“যাক এতদিনে আপদ বিদেয় হয়েছে। শোন রে আদিল, সত্যি কখনও ঢাকা দেওয়া থাকেনা। জোর করে তোর আর সংসার করতে হবেনা। দিন কয় পরে ডিভোর্স দিয়ে হিয়াকে বিয়ে করে নিবি। এমনিতেই এই মেয়ে তোকে সুখ দিতে পারতনা। এতগুলো বছরে বাপ ডাকটাও তো শুনাইতে পারলোনা। ভালো হইছে জেনে গেছে। অপয়া মে……”
“ফুফি।”
আদিলের হুংকারে দরজার কাছে গিয়েও কেঁপে ওঠে নূর। ভয়ে ভয়ে পিছনে ফিরে ফুফুর দিকে আদিলের রক্তচক্ষুতে তাকানো দেখে ভয় পেয়ে যায়।
“তোমার সাহস কি করে হয় নূরকে নিয়ে এসব বলার? সুখের তুমি কি জানো? সারাজীবন তো শশুরবাড়ীতে এই কুটনামি করেছো বলে ভাইয়ের ঘরে পড়ে থাকতে হয়। এতোদিন অনেক সম্মান করেছি তোমাকে ফুফি, আর নয়। আজ তুমি সব সীমা অতিক্রম করে গেছো। আর কি বললে তুমি, নূর আমাকে সুখ দিতে পারবেনা? তবে শোনো নূরের কাছে আমি যে সুখ খুঁজে পাই তা আর কারোর কাছে পাবোনা। তোমার কাছে যদি শারীরিক সুখ শুধু ম্যাটার করে, তবে সেটা আমি নূরকে নিয়েই সুখি। কিন্তু আমার কাছে সুখ বলতে মানসিক। ক্লান্ত শরীরে একমাএ নূরের কাছে গেলেই আমি শান্তি খুঁজে পাই। জ্বরের ঘোরে বমি করে সারাগা ভাসিয়ে দিলেও নূরের একটাও অভিযোগ থাকেনা, বরং আমাকে পরিষ্কার করে আমার নূর। তোমার হিয়া স্মার্ট হতে পারে তবে আমার নূরের ধরে কাছেও না সে। ও পারে বিজনেস ডিল করতে, আমার নূর পারে একা হাতে পুরো পরিবার সামলাতে। তোমার এই তিন বেলার খাবার ভাগ্য হয় নূরের জন্য।”
“আদিল প্লিজ চুপ করুন। শান্ত হোন।”
“তুমি আজ একটা কথাও বলবেনা নূর। তোমার মেয়ে হিয়ার মত শরীর দেখায়না বলে নূর আনস্মার্ট? ছেলেদের গায়ে ঢলে পড়েনা বলে আমাকে সুখ দিতে পারেনা? আমাদের বন্ধ দরজার মধ্যে কি হচ্ছে সেসব নিয়ে কথা বলতে তোমার লজ্জা করেনা? এতো যে ডিভোর্স ডিভোর্স করে চিল্লাচ্ছ, নিজের সময় ভুলে গেলে? ফুফা যখন ডিভোর্স দিতে চেয়েছিল মনে পড়ে সেই সময়? তুমি একজন মেয়ে হয়ে আর একজন মেয়েকে কিভাবে এমন বলতে পারো আমি সত্যি বুঝতে পারছিনা।”
“আর বাচ্চা! বাচ্চা আমি নিতে দিয়নি নূরকে। আমি চাইনি অল্প বয়সে নূরের উপর এত চাপ পড়ুক। এটা ঠিক যে আমি বিয়ে করতে চাইনি, কারণ আমার বিয়ে করার কোনরকম ইচ্ছে ছিলোনা। তবে নূরের সংস্পর্শে আমি বুঝেছি আসল ভালোবাসার মানে। নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে ভালোবেসে ফেলেছি আমি নূরকে। ভীষণ ভালোবাসি আমি তোমাকে নূর। প্লীজ ছেড়ে যেওনা। সহ্য করতে পারবোনা আমি।”
রাগে, অপমানে ফুঁসছেন ফুফি। কোনো কথা না বলে তিনি বেরিয়ে যান। আদিলের মা অনেক আটকানোর চেষ্টা করলেও তিনি থামলেন না। মায়ের পিছু পিছু অশ্রুসিক্ত চোখে বেরিয়ে গেলো হিয়া। যাওয়ার আগে একবার হিংস্র চোখে তাকালো আদিল আর নূরের দিকে।
_________________
সকাল থেকে আদাভানের ব্যবহারে অবাক হচ্ছে অরুনিকা। কেনো যেনো এই অবহেলা সহ্য হচ্ছেনা। অরুনিকা তো কোনো দোষ করেনি, তবে কেনো আদাভান তাকে অবহেলা করছে?
“মুখের সামনে দাঁড়িয়ে না থেকে সরে দাঁড়াও।”
“আপনি কাল থেকে এমন বিহেভ করছেন কেনো?”
“হা হা হা হাসালেন মিস অরুনিকা। আপনি যে কতোগুলো মাস ধরে দিনের পর দিন আমাকে অবহেলা করে গেছেন। তবে আমি কিভাবে সহ্য করেছি ভাবুন। যদিও আপনার অবহেলার কারণ আমার কাছে স্পষ্ট এখন।”
“আপনি কি বলতে চাইছেন আদাভান। আর এটা কিভাবে কথা বলছেন আমার সাথে? আমি মিসেস এটা কি ভুলে গেছেন নাকি? নাকি মাথায় অন্য কিছু ঘুরছে?”
“মাথায় আমার না তোমার ঘুরছে। ওহ সরি সরি মনে ঘুরছে। তোমার পুরোনো প্রেমিক। তো ডিভোর্স কবে দিচ্ছ আমাকে? নাকি দুটো একসাথে চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে?”
“নিজের দোষ ঢাকতে একদম আমার চরিত্রে আঙ্গুল তুলবেন না আদাভান। এর ফল ভালো হবেনা তবে।”
“আমি প্রমাণ ছাড়া কাউকে কিছু বলিনা মিস অরুনিকা। ডিভোর্স লেটার আসলে বলবেন আমি সই করে দেবো। আমার সাথে সম্পর্কে থেকে এইসব নোংরামি অন্তত চলবেনা।”
“আদাভান বাড়াবাড়ি করছেন আপনি। নিজের চরিত্রের ঠিক নেই, সে আবার এসেছে আমার চরিত্র নিয়ে কথা বলতে। হাহ।”
ঠাস করে পড়া থাপ্পড়ে অবাক হয়ে তাকায় অরুনিকা। অরুনিকার দুই গালে হাতের আঙ্গুল ডেবে ধরে একদম কাছাকছি নিয়ে আসে আদাভান।
“কি পেয়েছিস তোর ওই প্রেমিকের মাঝে যা আমি দিতে পারিনি? এতো ভালোবাসলাম তারপরও তুই আমার হলিনা কেনো? সবজায়গায় মুখ মারা কি তোর স্বভাব নাকি?”
গালে আঙ্গুল ডেবে কোনরকম কথা বলতে পারছেনা অরুনিকা। অনেক কষ্টে বলে উঠলো,
“আপনি কার কথা বলছেন আদাভান। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা। প্লিজ এসব বলবেন না। আর যায় হোক আমি চরিত্রহীন নই।”
খোপা করা চুলের মুঠি ধরে মুখটা আরো কাছে টেনে এনে,
“আমিও আগে সেটাই ভাবতাম। তুমি আমাকে ঠকিয়েছ অরুনিকা। আমি ঠকে গেছি।”
এটুকু বলেই দুই ঠোঁট এক করে দিলো। প্রথমে আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলেও পরে হাত পা ছুড়তে থাকে অরুনিকা। একের পর এক কামড়ে কষ্টে যন্ত্রণায় দম বেরিয়ে আসছে অরুনিকার। এদিকে একের পর এক কামড় বসিয়ে যাচ্ছে আদাভান। পশুদের মতো হয়ে উঠেছে সে। এবার ঠোঁট ছেড়ে গলায় একের পর এক কামড় বসাতে থাকে। ধাক্কা দিয়ে একবিন্দু সরাতে পারছেনা অরুনিকা। অবশেষে বিছানায় ফেলে পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়লো আদাভান। খুবলে খুবলে যেনো শেষ করে দেবে আজ সব। এই আদাভানকে চিনতে খুব কষ্ট হচ্ছে অরুনিকার। রাগে ঘৃণায় আল্লাহর কাছে নিজেকে বাঁচানোর ফরিয়াদ করতে থাকে।
শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে উঠে দাঁড়ায় অরুনিকা। কোনরকমে ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে আঁতকে ওঠে। ঠোঁট ফুলে লাল হয়ে আছে, গলা থেকে শুরু করে পুরো শরীরে কামড়ের দাগ। পানির ফোঁটা গায়ে পড়তেই আগুনে ছেকা লাগার মতো জ্বলে উঠছে পুরো শরীর। শাওয়ারের নিচে বসে নীরবে চোখের জল বিসর্জন দিতে থাকে অরুনিকা। কিছু বলার মত ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা। বিয়ের এতগুলো বছরেও এই হিংস্ররূপ কখনও দেখেনি আদাভানের। অবশ্য এই কয়েকমাসে অনেক নতুন করেই চিনছে আদাভানকে। তাচ্ছিল্য ভরা হাসি দিয়ে শাওয়ার সেরে বেরিয়ে এলো।
খাটের সাথে হেলান দিয়ে আদাভানকে বসে থাকতে দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয় অরুনিকা। হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় ব্যালকনির দিকে। ব্যালকনিতে রাখা সোফায় বসে হাতার উপর মাথা এলিয়ে নীরবে চোখের পানি ফেলতে থাকে। হঠাৎ পাশে কারোর উপস্থিতি বুঝতে পেরে নড়েচড়ে উঠতে গেলে হাত ধরে থামিয়ে দেয় আদাভান। এক হাতে গ্লাস আর পানি এগিয়ে দিয়ে চলে যায় সেখান থেকে।
পাঁচদিন পর বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়েছে অরুনিকা। কাব্যের সাথে দেখা করাটা জরুরি, এই কয়দিন শরীরের অবস্থা খারাপের জন্য বের হতে পারেনি। বিশেষ দরকারের জন্য ডেকেছে আজ কাব্য। রাস্তা পার হতেই কাব্যকে দেখে এগিয়ে যায় অরুনিকা। দুজনে মিলে সামনের এক রেস্টুরেন্টে গিয়ে কফি অর্ডার করে নিজেদের মতো কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
“আমি তো ভাবতে করছিনা অরু, আদাভান এত নিষ্ঠুরভাবে তোকে আঘাত করবে। তুই ছেড়ে দে আদাভানকে। এরকম মানুষের সাথে একসাথে থাকা অসম্ভব।”
“আমি বর্ষা আপুকে কথা দিয়েছি ওনার মৃত্যুর প্রতিশোধ আমি নিয়েই ছাড়বো। আমাকে আমার প্রতিশোধ নিতেই হবে যেভাবে হোক।”
“তবে তার জন্য আদাভানকে আঘাত করতে হবে। তুই কি আদৌ এই কাজটা পারবি? ভেবে দেখ।”
“আমি পারবো।”
“বেশ, তবে কালকেই হবে ওর শেষ দিন।”
“কিভাবে?”
“সেটা আমার উপর ছেড়ে দে। তবুও যদি কাজ না হয় তবে অন্য পদ্ধতি দেখতে হবে।”
অরুনিকাকে কি করতে হবে সবটা বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যায় কাব্য।
চলবে?
#Fiza_Siddique
#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(34)
সকাল থেকেই বেশ উশখুশ করছে অরুনিকা। কোনোমতেই কাব্যের প্ল্যানে মন সায় দিচ্ছেনা। এদিকে আদাভানকেও জোর করে কিছু বলা যাচ্ছেনা। রুমের মধ্যে পায়চারি করতে করতে হুট করে আদাভান সামনে এসে পড়ায় থেমে যায়।
“পাগল হয়ে গেছো?”
“বলছিলাম কি আজকে না গেলে হয়না?”
বিরক্তিতে এবার মেজাজ চরমে আদাভানের। কপাল কুঁচকে বিরক্তিকর চাহনিতে তাকায় অরুনিকার দিকে।
“সকাল থেকে এই একই কথা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করে যাচ্ছ কেনো তুমি? সমস্যা কি তোমার? তোমার সাথে এক ছাদের তলায় বাধ্য হয়েই থাকতে হচ্ছে। নাহলে কবেই…”
আদাভানের কথায় এতক্ষনের চিন্তা ভুলে অবাক হয়ে তাকায় অরুনিকা। যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কি ঘৃণা করা যায়? তবে আদাভানের কথার মাঝে এত ঘৃনা কেনো? কি এমন কারণ যার জন্য এতো অবহেলার পরও না বদলানো মানুষটা হুট করেই বদলে গেলো।
আদাভান বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ছটফটানি আরো বেড়ে গেছে অরুনিকার। আদাভানের সাথে আজ ছোটো মতো অ্যাক্সিডেন্ট হবে এটা জানে, তবে কখন কিভাবে কিছুই জানেনা সে। ভাবনার মাঝে হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে আসা প্রাপ্তিকে দেখে ভয়টা আরো বেড়ে যায়।
“ভাবি ভাবি, ভাইয়া”
“প্রাপ্তি শান্ত হও। কি হয়েছে ভাইয়ার?”
“ভাইয়ার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। অনেক খারাপ অবস্থা।”
এটুকু শুনেই থমকে যায় অরুনিকা। দাড়িয়ে থাকার মতো ক্ষমতাও অবশিষ্ট নেই তার মাঝে। ধপ করে বসে পড়ে মেঝেতে। চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুধারা।
“এমনতো কথা ছিলোনা। কাব্য ভাইয়া তো বলেছিল অল্প একটু চোট পাবে। তাহলে এসব কি হয়ে গেলো।”
মনে মনে কথাগুলো বলে ছুটে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে। রাস্তায় এসে একটা রিক্সা করে বেরিয়ে পড়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
“তুমি জানতে সবকিছু তাইনা?”
আদাভানের কথায় চমকে ওঠে অরুনিকা। ছিটকে কয়েক হাত সরে যেতেই উচ্চস্বরে হেসে ওঠে আদাভান।
“আমার ভালোবাসার প্রতিদানে ফেরালে একবুক ঘৃনা, আমার আগলে রাখার পরিবর্তে করলে আমায় পথহারা।”
“কল্পনাতেও ভাবিনি আমি তোমার হাতে আঘাত পাবো। বিশ্বাস করো এখন মনে হচ্ছে কেনো বেঁচে ফিরলাম। ওখানেই মরে গেলে অন্তত এই কঠিন সত্যির মুখোমুখি তো হতে হতো না। আমি তো এমনিতেই মরে গেছি তোমার বিশ্বাসঘাতকতায়। সবকিছু যেনো কোনো দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। একটু পরেই ঘুম ভেংগে যাবে আর দেখবো তুমি আমার বুকের মাঝে। কিন্তু আফসোস, এটা সত্য, চরম বাস্তব। ছল চাতুরির আড়ালে লুকানো সত্যি চেহারা এটাই। কেনো করলে অরু? কেনো এতো আঘাত দিলে? উহু আমি আমার শরীরের আঘাতের কথা বলিনি, আমার মনের ক্ষতর কথা বলছি। দেখতে পাচ্ছো? এই দেখো এই বুকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। আরে এই মাথার ক্ষত, এই হাতের ক্ষত এগুলো তো কয়েকদিনেই সেরে যাবে। ওষুধে সব সেরে যাবে, শুধু সারবেনা অন্তরের ক্ষত। আমার কি মনে হচ্ছে জানো? কেউ তলোয়ার নিয়ে বারবার এই বুকের মধ্যে গেঁথে দিচ্ছে আর বের করছে। আবার সেই ক্ষততে মলমের বদলে ফুটন্ত পানি ঢেলে দিচ্ছে। কি ভীষণ যে জ্বালা পোড়া, উফ্! বোঝাতে পারবোনা তোমাকে প্রাণপাখি। এসব ক্ষত তো তার কাছে কিছুই না।”
কথা বলে শেষ করে এক এক করে হাতের মাথার ব্যান্ডেজ খুলে ফেলছে। আদাভানকে উন্মাদের মতো আচরণ করতে দেখে এগিয়ে আসে অরুনিকা। কান্না করতে করতে জড়িয়ে ধরে আদাভানকে।
“প্লীজ একটু শান্ত হোন। আমি জানতাম শুধু একটু আঘাত পাবেন আপনি, এত বড় কিছু হয়ে যাবে ভাবতেও পারিনা আমি। বিশ্বাস করুন, আমি কখনও আপনার কিছু হলে ভালো থাকতে পারবনা। আমি এসব করিনি বিশ্বাস করুন। আমি জানি আপনার অনেক কষ্ট হচ্ছে। প্লীজ নিজের ক্ষতি করিয়েন না।”
“দূরে সরো। আমি বলছি দূরে সরে যাও আমার থেকে। তোমার কোনো কথাই আমি আর বিশ্বাস করিনা। আমি ভেবেছিলাম আমার ভালোবাসার রঙে রাঙিয়ে দেবো তোমাকে। তোমার মনেও আমার জন্য ভালোবাসা জন্মাবে, আমাদেরও সুন্দর একটা সংসার হবে। কিন্তু তুমি, ছি! আমার ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে। এতই যখন ঐ কাব্যকে ভালোবাসো তাহলে কেনো এসেছিলে আমার কাছে? আমি নাহয় জোর করে বিয়ে করেছিলাম, থাকতে তো আর বাধ্য করিনি। কেনো আমার কাছাকাছি এলে? কেনো দিনের পর দিন ভালোবাসার নাটক করে গেলে? দিনশেষে তোমার ঐ কাব্যকেই প্রয়োজন পরে তো।”
“আদাভান”
“একদম চেঁচাবেনা। এই প্রাণপাখি! ফিরে এসোনা আমার কাছে। আমি অনেক ভালো রাখবো তোমাকে। ওই কাব্যের থেকেও বেশি ভালোবাসবো। যা চাইবে তাই এনে দেবো। সব সুখ এনে রাখবো তোমার পায়ের কাছে। প্লীজ ফিরে এসো, আমার হয়ে থাকো।”
“আপনি এসব কি বলছেন আদাভান? কাব্য ভাইয়া আমার কাছে নিজের ভাইয়ের মতো। ঠিক যেমন আপনার কাছে প্রাপ্তি। ওনার সম্পর্কে এই খারাপ কথাগুলো ভাবতে আপনার একটুও রুচিতে বাঁধলনা?”
“হা হা হা হাসালে তুমি। প্রাপ্তির আর আমার এমন ছবি দেখেছো কখনো?”
সামনে ধরা আদাভানের ফোনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরুনিকা। কিছুই মাথায় ঢুকছেনা। প্রতিটা ছবি এমনভাবে তোলা হয়েছে যার ভাষা আদাভানের কথার সাথে মিলে যায়। কোনোটাতে কাব্য অরুনিকার কোমর ডান হাতে ধরে বেডে ঝুঁকে পরে আছে। অরুনিকার মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা, মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিল অরুনিকা। তাই কাব্য কোলে করে এনে বেডে শুইয়ে দেয়। কিন্তু ছবিটা যেভাবে তোলা যেকেউ দেখলে ভুল বুঝবে।
“বিশ্বাস করুন, এসব মিথ্যে। কোনোটাই সত্যি না। ছবিগুলোতে যেমন দেখছেন একদমই তেমন না। কেউ ইচ্ছে করে আমাদের ফাঁসানোর চেষ্টা করছে।”
আদাভান কিছু বলতে গেলে আনিকা আহসানকে দেখে থেমে যায়। গভীর ভাবে অরুনিকাকে একবার পরখ করে চোখ সরিয়ে নেয়।
“এসব কিভাবে হলো আদাভান। এতো অসাবধান কেনো তুই বলতো? খবরটা পেয়ে আমাদের কি অবস্থা হয়েছিল জানিস তুই? কিভাবে হলো বল।”
” ইশ আম্মু কাঁদতে কাঁদতে চেহারার কি অবস্থা বানিয়েছো দেখো। আমি একদম ঠিক আছি তো দেখো। এবার কান্না বন্ধ করো তো দেখি।”
দুজনের কথোপকথনের মাঝেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় অরুনিকা। সবকিছু মিলিয়ে কেমন যেনো থম মেরে গেছে। একদিকে আদাভানের গুরুতর অ্যাক্সিডেন্ট অপরদিকে কাব্যের সাথে ঐ ছবিগুলো। কোনোকিছু মাথায় ঢুকছেনা। আদাভান যে খুব বাজে ভাবে ভুল বুঝেছে সেটা বুঝতে আর বাকি নেই অরুনিকার। সব মিলিয়ে মাথা যন্ত্রনায় ঢলে পড়তে দেখে এগিয়ে আসেন একজন ডক্টর।
“আপনি ঠিক আছেন?”
“….……….”
“একি আপনাকে তো অনেক দুর্বল লাগছে। দেখি আমার সাথে আসুন ”
অরুনিকাকে নিজের সাথে কেবিনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গিয়েই অজ্ঞান হয়ে যায় পথিমধ্যে।
আধো আধো চোখে চারিদিকে তাকিয়ে কোথায় আছে মনে করতেই কারোর আওয়াজে সেদিকে তাকায় অরুনিকা।
“কংগ্রেচুলেশন মিসেস। আপনি মা হতে চলেছেন। এই সময়ে নিজের প্রতি এত অবহেলা চলে নাকি? নিজের জন্য না হলেও আগত বেবির জন্য নিজের খেয়াল রাখতে হবে আপনাকে।”
________________
“আরে হিয়া যে, আসো আসো।”
দুপুরের খাবারের জন্য সবাই বসেছে মাত্র সেসময়ে হিয়াকে দেখে অবাক হলেও তেমন গুরুত্ব দেয়না আদিল। তবে নূরের অনেক জোরাজোরিতে সবার সাথে খেতে বসতে বাধ্য হয় হিয়া।
“হিয়া আই অ্যাম সরি। আমি কোনোভাবে তোকে অপমান করতে চাইনি। কিন্তু করে ফেলেছি। প্লীজ আমার কথায় কিছু মনে করিসনা। এট লিষ্ট তুই অন্তত আমাকে বুঝবি আমি জানি।”
“ইটস ওকে।”
” তোর প্রতি আমাদের কারোর কখনও অভিযোগ ছিলোনা, তোর যখন ইচ্ছে এখানে আসবি, থাকবি। এটা তোরও বাড়ি।”
“আমি অনেক লাকি, নাহলে তোর মত ফ্রেন্ড পেতাম না। এতকিছুর পরও আমাকে তুই এই বাড়িতে আসার কথা বলছিস এজন্যই আমি কৃতজ্ঞ। নাহলে আম্মুর ব্যবহারে কোথাও মুখ দেখাতে পারছিলাম না।”
সবার খাওয়া শেষ হতেই নূর বলে ওঠে,
“আজকে আম্মু স্পেশাল পায়েস বানিয়েছে। আমি নিয়ে আসছি সবার জন্য দাড়াও।”
“নূর দাড়াও আমি সাইডে আছি, আমিই নিয়ে আসছি।”
হিয়ার কথায় হাল্কা হেসে সায় জানায় নূর। হিয়াও সৌজন্যমূলক হেসে এগিয়ে যায় কিচেনের দিকে।
“আদিল, আদিল কি হয়েছে আপনার? এমন করছেন কেনো? আম্মু, আব্বু তাড়াতাড়ি এসো।”
“কি হয়েছে হিয়া, এভাবে চেচাচ্ছে কেনো?”
“আম্মু আদিল কেমন করছে, নিঃশ্বাস নিতে পারছেনা। ছটফট করছে। আমাদের এখুনি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে ওকে। আব্বুকে গাড়ি বের করতে বলুন প্লিজ।”
চলবে?
#Fiza Siddique