#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(31)
বহুদিন পর অরুনিকাকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন রুবিনা বেগম। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেটে একেকার অবস্থা। সবকিছু সামলে নিজের রুমে যেতে বেশ ঝক্কি পোহাতে হলো অরুনিকাকে। আসার পর থেকেই মায়ের কথায় এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছিলো। অবশেষে দুপুরের খাবার শেষ করে নিজের রুমে প্রবেশ করেছে। আদাভান ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা চিন্তা করে যাচ্ছে একমনে। অরুনিকা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে ওয়াশরুমে চলে গেলো চেঞ্জ করতে।
ক্লান্ত শরীর বিছানায় পড়তেই দ্রুত ঘুমে ভারী হয়ে আসে অরুনিকার চোখ। অরুনিকার ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে এতক্ষন ঘুমের ভান ধরে সজাগ থাকা আদাভান উঠে পড়ে। অরুনিকার কাছে গিয়ে আরোও একবার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে বেরিয়ে পড়ে রুম থেকে।
এইবাড়িতে এটা নিয়ে মাত্র চারবার এসেছে আদাভান। তেমনভাবে কখনও ঘুরে দেখা হয়নি বাড়িটা, তাই বাড়ির আর রুমগুলোর ব্যাপারে জানা নেই কিছুই। ঘুরতে ঘুরতে একটা রুমের সামনে এসে থমকে যায় আদাভান। বন্ধ দরজার তালায় ক্ষয়ের চিহ্ন স্পষ্ট। এখানে সেখানে মরিচা পড়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বহুবছর ধরে কারো আনাগোনা নেই এই রুমে। তবে কি সব রহস্যের চাবিকাঠি এখানেই পাওয়া যাবে? ঘুরে ঘুরে আর কোনো রুমের প্রতি সন্দেহ না হওয়ায় ফোন বের করে বেশ কয়েকটা ছবি তুলে নেয় তালাটার। তারপর বিচক্ষণতার সাথে এদিক ওদিক তাকিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ির বাইরে।
বেশ সন্ধ্যা গড়িয়ে বাড়ি ফিরে সবার মাঝে আড্ডায় শামিল হয় আদাভান। টুকটাক কথা বলে পানি খাওয়ার বাহানায় কিচেনের দিকে এগিয়ে যায়। গ্লাসে পানি ঢেলে পাশে রেখে এদিক ওদিক দেখে পকেট থেকে এক শিশি বের করে ঢেলে দেয় ডালের মধ্যে। পাশে থাকা চামচ দিয়ে ভালো করে সেই তরল মিশিয়ে আবারও হাতে পানির গ্লাস নিয়ে বেরিয়ে আসে কিচেন থেকে স্বাভাবিক ভাবেই।
আনুমানিক রাত প্রায় দুটো বাজে। বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এতটাই ঘুমের মধ্যে আচ্ছন্ন সবাই যে বাড়িতে ডাকাত পড়লেও কারোর চোখ খুলবেনা। হাই ডোজের ঘুমের ওষুধ ডালের মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছিলো আদাভান। তবে সেটা নির্দিষ্ট মাত্রায়। সকাল নয়টার আগে কারোর চোখ খুলবেনা। এই সময়ে আদাভান নিজের কাজ খুব সহজে করে নিতে পারবে।
পকেট থেকে একটা নতুন চকচকে চাবি বের করে তালায় প্রবেশ করিয়ে বেশ এদিক ওদিক করার পরও ব্যর্থ হয় আদাভান। বহুবছর ব্যবহার না হওয়ায় ভেতরেও মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। একটু চাপ প্রয়োগ করতেই আদাভানকে অবাক করে দিয়ে সহজেই খুলে যায়। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আশেপাশে তাকিয়ে দরজাটা খোলে। ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছু টের পাওয়া মুশকিল। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট অন করতেই সামনে দেওয়ালে টাঙানো বর্ষার হাসিমুখের ছবি দেখে মুহূর্তের জন্য ভয় পেয়ে যায় আদাভান। নিজেকে সামলে নিয়ে হালকা করে দরজা চাপিয়ে পুরো রুমটা ভালো করে দেখে বুঝতে পারে এটা বর্ষার রুম ছিলো। বর্ষার ব্যবহৃত যাবতীয় জিনিস এই রুমের মধ্যে রেখে তালাবন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পুরো রুম তন্ন তন্ন করে খুঁজে কাজের কোনো জিনিস না পেয়ে হতাশ হয়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই একটা বইয়ের দিকে তাকিয়ে থমকে যায় আদাভান। এই বইটা বইমেলাতে গিয়ে জোর করে আদাভানের থেকে আদায় করেছিলো বর্ষা। কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা হাতে নিতে পাতা ওল্টায় আদাভান, যেখানে বড়ো বড়ো করে আদাভান নিজের নাম লিখে দিয়েছিলো। চোখের কোনে হালকা পানির আভাস পেতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলো আদাভান। পুরোনো স্মৃতিগুলো স্মৃতিপল্লবে জমাট বাঁধে এক এক করে। বইটা যথাস্থানে রেখে দিতে গেলেই এক আনকোরা ভাঁজ করে রাখা কাগজ পড়ে পায়ের কাছে। কাগজটা উঠানোর জন্য নিচু হতেই খেয়াল করে দরজার একদম কোণের অংশে কিছু একটা চিকচিক করছে। কাগজটা উঠিয়ে সেদিকে এগিয়ে একটা ছোট্ট চাবি পেতেই অবাক হয়ে যায় আদাভান। এটা কিসের চাবি ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে যায় সেদিনের কথোকথন।
অতীত……….
“এই বর্ষা, অরু আর তোর সবসময় একই জিনিষ পছন্দ হয়। কিন্তু যখন কোনো জিনিস এক পিস থাকে সেটা কে নিস?”
“অবশ্যই আমি নিই। পুষি আমাকে অনেক ভালোবাসে, আমি নিতে চাইলে ও আর ঘুরেও তাকায়না সেদিকে। এইযে দেখ সেদিন এই আংটিটা মেলায় এক পিস ছিলো। পুষি আমাকেই দিয়ে দিলো। একবারের জন্যও জেদ করেনি এটা নেওয়ার জন্য।”
“অরুর সখের সবকিছু এনে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। খুব তাড়াতাড়ি আসবো আমি তোমার জীবনে প্রাণপাখি, সেদিন আর কোনো চাহিদা অপূর্ন রাখতে দেবোনা তোমার।”
মনে মনে এসব ভেবে মুচকি হেসে এগিয়ে যেতে গিয়ে আবারও বর্ষার কথায় থেমে যায় আদাভান।
“জানিস, আমি আমার সব সিক্রেট জিনিসগুলো একটা বক্সে রাখি। যেটার নাম মিষ্ট্রিবক্স। আর তার চাবি আমি ছাড়া কেউ কোনোদিন পাবেনা।”
“বক্সটা দেখে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেনা?”
“আরে পাগল ওটা আমি এমন জায়গায় রাখি কেউ খোঁজই পাবেনা কখনও। আমার টেবিলের তলার ড্রয়ারের পিছনের ফাঁকা অংশে ওটা আটকানো থাকে সবসময়।”
“ওরিব্বাস কি বুদ্ধি তোর। আমি একদিন গিয়ে চুরি করে আনবো তোর মিষ্ট্রিবক্স দেখিস।”
“হা হা হা! চাবি কোথায় পাবি?”
বর্তমান……..
“বলেছিলাম না, তোর মিষ্ট্রিবক্স চুরি করে নিয়ে যাবো একদিন। দেখ আমি আমার কথা রেখেছি, চলে এসেছি তোর মিষ্ট্রিবক্স নিতে। কিন্তু তুই তোর কথা রাখলিনা। চলে গেলি বহু দূরে, আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে একেবারে।”
ক্ষীণ এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বের করে নিলো সেই মিস্ট্রিবক্স। আদাভানের বিশ্বাস এর মধ্যে কিছুনা কিছু তো পাবেই। চিঠি আর বক্সটা নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আগের মতোই চটাল লাগিয়ে দিলো। চারপাশ দেখে নিয়ে ধীর গতিতে রুমে ঢুকে দরজা আটকে ফেললো। বক্সটা নিজের ব্যাগের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো অরুনিকাকে আস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে ঘুমের ঘোরে অরুনিকাও এগিয়ে এলো খানিকটা আদাভানের দিকে। হালকা হেসে অরুনিকার কপালে এক দীর্ঘচুম্বন দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো অরুনিকার পাশেই।
___________
প্রাপ্তির থেকে জেনেছে কাব্য আদাভানদের ওই বাড়িতে যাওয়ার কথা। দুজনের মাঝে কথোপকথন বেশ জমেছে। কাব্য খুব ভালো করে বুঝে গেছে প্রাপ্তি পছন্দ করে তাকে। আর সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে আদাভান আর অরুনিকার প্রতি মুহূর্তের খবর নেয়। রোজকার মতো আজও বেশ রাত পর্যন্ত কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে প্রাপ্তি।
কাব্য পৈশাচিক হেঁসে খালি গলায় গেয়ে ওঠে,
বিষাদের দুপুর
গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে,
চাঁদ নামেনি এখনোও
প্রাণহীন সন্ধ্যাতারা ফুটেছে।
ইচ্ছে ও স্বপ্ন
মিশে গেছে আঁধারে,
তোমার চলে যাওয়া
বদলে দিয়েছে আমাকে।
অহেতুক তুমি ছুটেছো
মিঠি স্বস্তি খুঁজেছো,
তোমার আমার ব্যবধান
এখনো সর্বোচ্চ।
আয়নায় চেয়ে দেখো
চোখ কী বলে,
ঠোঁটে হাসি নেই তোমার
আমি আজ নেই বলে।
বিষাদের দুপুর
গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে,
চাঁদ নামেনি এখনো
প্রাণহীন সন্ধ্যাতারা ফুটেছে।
ইচ্ছে ও স্বপ্ন
মিশে গেছে আঁধারে,
তোমার চলে যাওয়া
বদলে দিয়েছে আমাকে
বদলে দিয়েছে পুরোটা আমাকে,
তোমার চলে যাওয়া
বদলে দিয়েছে আমাকে।
চাইলে তুমি পারতে
একটু আস্থা রাখতে
আমি ঠিকই, সব গুছিয়ে নিতাম।
তুমি বিশ্বাস রাখোনি
চলে গেছো সুখের মোহে,
আমার কান্না পায়ে মাড়িয়ে।
হারিয়ে, হারিয়ে
গেছো ঐ সুদূরে,
হারিয়ে, হারিয়ে
গেছো কোন সুদূরে।
অহেতুক তুমি ছুটেছো
মিঠি স্বস্তি খুঁজেছো,
তোমার আমার ব্যবধান
এখনো সর্বোচ্চ।
আয়নায় চেয়ে দেখো
চোখ কী বলে,
ঠোঁটে হাসি নেই তোমার
আমি আজ নেই বলে।
বিষাদের দুপুর
গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে,
চাঁদ নামেনি এখনোও
প্রাণহীন সন্ধ্যাতারা ফুটেছে।
ইচ্ছে ও স্বপ্ন
মিশে গেছে আঁধারে,
তোমার চলে যাওয়া
বদলে দিয়েছে আমাকে, আমাকে।
__________
কেটেছে বেশ কিছুটা দিন। অরুনিকা বেশ খানিকটা এভোইড করেই চলার চেষ্টা করে আদাভানকে, কিন্তু মাঝে মাঝে অনুভূতির কাছে হেরে বসে। চাইলেও নিজেকে বের করতে পারেনা এই অনুভুতির মায়াজাল থেকে।
কিছুদিন পরেই ফাইনাল এক্সাম হওয়ায় পড়াশোনা নিয়ে বেশ চেপে আছে অরুনিকা। আদাভানও সমান তালে সাহায্য করে যাচ্ছে প্রতিটা বিষয়ে। আদাভানকে দেখে মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যায় অরুনিকা। কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা সেদিনের আদাভানের কথাগুলো। একটা মানুষের এতোটা নিখুঁত অভিনয় করার ক্ষমতা আছে বুঝি? একদম খুঁত বিহীন অভিনয়ে তাজ্জব বনে যায় অরুনিকা। স্যালুট জানাতে ইচ্ছে করে আদাভানকে।
লিখতে লিখতে পেনের কালি শেষ হয়ে যাওয়ায় আদাভানের ব্যাগ হাতড়ে পেন বের করতে গিয়ে হাতের মাঝে একটা গোল কিছু উঠে আসে। বিরক্তিতে সেটা রেখে দিতে গেলে সেদিকে তাকিয়ে চমকে ওঠে।
“এএএ এটা তো বর্ষা আপুর লকেট। এটা আদাভানের কাছে কেনো? তবে কি সত্যিই আদাভানই বর্ষা আপুর সেই প্রেমিক আদাভান! যার জন্য আপুকে আত্মহ*ত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছিলো।”
এতোদিন মনের কোণে যে ক্ষীণ আশা ছিলো এসব মিথ্যে প্রমাণ হওয়ার আজ সেটুকুও শেষ হয়ে গেলো। আদাভানের প্রতি রাগ, ঘৃণা, ভালোবাসা, বিশ্বাস সব একত্রিত হয়ে কেমন এক দমবন্ধকর অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে। মাথায় হাত চেপে ধরে বেডের গা ঘেঁষে মেঝেতে বসে পড়ে হাঁপাতে থাকে অরুনিকা।
চলবে?
#Fiza_Siddique
#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(32)
ঘৃণায় রি রি করে উঠছে অরুনিকার সারা শরীর। ভাবলেই ঘৃণা হচ্ছে যে তার শরীরের মাঝে একটা খুনির স্পর্শ। নিজেকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে।
রাতে আদাভান বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে বাসায় ফিরেছে। বেশ কিছু তথ্য ইতিমধ্যে সংগ্রহ করে ফেলেছে সে। আদাভান নিজেকে বর্ষার থেকে সরিয়ে নেওয়ার পর কেউ একজন কাছাকাছি এসেছিলো। যাকে বর্ষা আদাভান ভাবতো। তবে এটা কিভাবে সম্ভব কিছুতেই তার হিসেব মেলাতে পারছেনা। বর্ষার মতো এতো বিচক্ষণ মেয়ে কিভাবে অন্য কাউকে আদাভান ভাবতে পারে, সেই চিন্তায় সারাদিন কোনো কাজে মন বসাতে পারেনি। তবে শেষটুকু বেশ বেদনার ছিলো আদাভানের জন্য। চিঠিতে লেখা ছিলো আদাভানের প্রতি কঠোর অভিযোগ।
“কি ভুল করেছিলাম আমি! শুধু জানতে চেয়েছিলাম আমার চোখের অশ্রুর কোনো সত্যিকারের সার্থকতা ছিল কি না। তুই আমার সত্যিকারের প্রেমিক ছিলি কি না। খেলেছিলিস কিনা? একদিন, দুদিন নয়, বছরের পর বছর কেঁদেছি।
আমি কি প্রথম তোর কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম? মনে তো হয় না। কিন্তু যখন ভালোবেসে ফেলেছি, সেটা আমি প্রথম বলি বা তুই, ফারাক কোথায়? ভালো তো বেসেছিলি। খুব বোকা ছিলাম কিনা, তোর চালাকি আর জীবনের কাঠিন্য বুঝতে পারিনি।
আমার জীবনটা নষ্ট করায় তোর কখনো খারাপ লাগেনি? দায়িত্ববোধ ছিল? আমি অবশ্য উড়নচণ্ডী রাগটাই দেখেছিলাম। সঙ্গে আমাকে ছোট করার প্রবণতা। মরমে মরে যেতাম প্রতিটি ক্ষণ তোকে ভালোবাসার কষ্টে। সেটা যে কী কষ্ট। আমি হয়তো কখনোই তোর জীবনে সে রকম গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিলাম না।আমার ভালোবাসা আমাকে কী ভীষণ উপেক্ষা করেছে। অপমান করেছে। এই অনুভূতি যে কেমন হয়, তা বোঝার জন্যই বুঝি তোকে দরকার ছিল। প্রতিটি মুহূর্ত যেন চামড়ার নিচে নুন আর লংকাবাটার। রক্তক্ষরণ দেখেছিলি? খুব আনন্দ হতো তোর তাইনা? পৈশাচিক আনন্দ।
আনন্দ? আমার কষ্ট লোকদেখানো বলে মনে হতো তোর? নাকি এ চেহারায় কষ্টটা ঠিকমতো ফুটে ওঠেনি কখনোই?কী প্রবলভাবেই না চেয়েছিলাম, চেয়েছিলাম আমার জানা মিথ্যে হোক, চেয়েছিলাম আমি ভবিতব্য পাল্টে নেব। শুধু তুই যদি পাশে থাকিস। হাজার কূটকাচালিতে তোকে আঁকড়ে ধরে কী ভীষণভাবে বাঁচতে চেয়েছিলাম। তুই আমাকে মরতে ফেলে গেলি। কী ধীরগতির সে মৃত্যু, প্রতিটি ক্ষণ চেয়েছিলাম একবারে মরে যেতে। ভেবেছিলাম একটিবার নিজের দোষ স্বীকার করবি। স্বীকার করবি নিজের ভুল, মেনে নিবি আমাদেরকে। কিন্তু নাহ! আমি ভুল ছিলাম। তুই পাল্টে গেছিস আদাভান, ভীষণ রকম পাল্টে গেছিস। তোর প্রতি অভিযোগ আমার আমরণ থাকবে।
বড্ড অভিমান হচ্ছে তোর উপর আমার, কেনো বলতো! তুই তো স্বার্থপর। তারপরও কি অভিমান মানায়? কিন্তু এই অভিমান যে আমার একার নয় আরও একজনের তোর উপর।”
চিঠির প্রতিটা শব্দে যে ঠিক কি পরিমান অভিমানে রাঙ্গা তা স্পষ্ট। প্রতিটা অক্ষর যেনো স্বর্ণাক্ষরে মুদ্রিত হয়ে জানান দিচ্ছে,#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে। চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে মাথার মধ্যে ভীষণ পীড়া দান করছে। যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাওয়ার মতো অবস্থায় সামনে অরুনিকাকে দেখে হালকা করে চোখ খুলে তাকালো।
“অরু একটু কড়া করে চা এনে দাওনা, ভীষণ মাথা ধরেছে।”
অন্য সময় হলে অরুনিকা ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে প্রথমে দুই কোমল হাতে আঁকড়ে ধরতো আদাভানের মাথা। বেশ আয়েশ করে কড়া করে চা এনে দিতে টিপে দিতো মাথা। তবে আজ তার কিছুই হলোনা। কিচেনে গিয়ে চা বানিয়ে প্রাপ্তিকে দিয়ে রুমে পাঠালো আর নিজে চলে গেলো ছাদের উদ্দেশ্যে।
ছাদের রেলিংএর ধার ঘেঁষে একমনে আকাশ পানে তাকিয়ে ভাবছে অতীতের মধুর স্মৃতিগুলো। ভাবনার মাঝেই হাতের মুঠোয় থাকা ফোনটা কেঁপে উঠতেই সাথে সাথে রিসিভ করে অরুনিকা। বর্তমানে এই একটা মানুষের কাছে এসেই কিছুটা স্বস্তি পায়। চারিদিকের দমবন্ধকর অনুভূতি গুলো থেকে একটু রেহাই পায়। বেশ কিছুক্ষন কথা বলার পর ফোন রেখে তাকায় আঁধারের মাঝে। দূর দূরান্ত পর্যন্ত থাকা আঁধারের মাঝে খুঁজে চলেছে নিজের জীবনের গতিপথ। ব্যর্থ মন, মস্তিষ্ক নিয়ে পা বাড়ালো রুমের উদ্দেশ্যে।
“কোথায় ছিলে এতক্ষন?”
নীরবতার মাঝে হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে চমকে ওঠে অরুনিকা। নিজেকে স্বাভাবিক করে তাকায় আদাভানের দিকে। একহাত কপালের উপর আর এক হাত পেটের মাঝে রেখে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উত্তর দিলো,
“ছাদে”
“এতো রাতে ছাদে কি কাজ ছিল?”
“ছিলো কিছু”
“পুরোনো প্রেমিকের সাথে কথা বলা?”
আদাভানের তাচ্ছিল্য সুরে বলা কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকায় অরুনিকা।
“এসবের মানে কি?”
“সেটা তো তোমার বলা উচিত?”
“অযথা তর্ক আমার স্বভাবে নেই।”
অরুনিকার কথায় চোখ খুলে তাকায় আদাভান। দুজনের দৃষ্টির মিলনপর্বে চমকে ওঠে অরুনিকা। রক্তিম চোখের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলানোর সাহস যুগিয়ে উঠতে পারলোনা। দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকাতেই উঠে বসলো আদাভান।
“আমার স্বভাব খারাপ? এটাই কি বোঝাতে চাইছো?”
“…………”
“হাহ! জানা ছিলো। এখন আমার স্বভাবে খুঁত লাগাটাই স্বাভাবিক। তা বেশ তো আছো আমার থেকে দূরে দূরে থেকে। এতো দূরত্ব বুঝি তার কথায়? তো কবে ছাড়ছো আমায়?”
আদাভানের কথায় মোচড় দিয়ে উঠলো অরুনিকার হৃদয়ের অংশে। আদাভানকে অসম্ভব রকম ভালোবাসে সে। সেখানে মুক্তি! মুক্তি জিনিসটা ভাবলেই কষ্টে বুক ফেটে আসছে। বারবার মনে হচ্ছে, কোথাও ভুল হচ্ছেনা তো? আদাভানের কথা আর কাজে এতো অমিল কেনো? খুনি, প্রতারকরা কখনও এতো শান্ত হয় বুঝি? তাদের চোখে তো এক খাদ সমান বেদনা থাকার কথা নয়। তবে আদাভানের চোখে এতো বেদনার ছাপ কেনো? কেনো এই চোখের ভাষা বলছে সব ভুল, তার জানা সবকিছুই ভুল।
আজ প্রথমবারের মতো আদাভান জোর করে নিজের শান্তি খুঁজে নেয়নি। নেয়নি জোর করে অরুনিকাকে নিজের বুকে লেপ্টে। শেষরাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে কোনক্রমে দুচোখ বুজলো অবশেষে।
“বেধে রাখবো তোমায় আমার ভালোবাসার শিকলে, পালাতে পারবেনা তুমি আমায় ছাড়া সময়ের অন্তরালে।
আমাকে ভালো রাখে তোমার হাসি, জানো কি প্রিয় আমার থেকে আমি তোমায় বেশি ভালোবাসি।“
চলবে?
#Fiza_Siddique