আমার শহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-০৮

0
3614

#আমার_শহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৮
আলো এসে চোখে পড়তেই খুব বিরক্তি নিয়ে চোখ খুললাম।চোখ খুলেই অবাক হলাম। অনেকটা বেলা হয়েছে। এই প্রথম আমি এতো বেলা করে উঠেছি। তাতেই মনে পড়ল কাল রাতের কাহিনি। খানিকটা লজ্জা পেলাম। পাশেই দেখলাম জারিফ ঘুমাচ্ছে। তাই আসতে করে উঠে গেলাম। আমি নাস্তা রেডি করছিলাম তখনি জারিফ এসে বলল বাসায় যাওয়ার কথা। অফিস থেকে কল এসেছে জরুরী কাজ আছে। এখন বের হলে বিকেলের মধ্যে পৌঁছে যাব। ফুপুরা যেতে দেরি হবে তাই আমরা আগে রওনা দিলাম। যাওয়ার সময় মা খুব কাদছিলেন। আমারও একটু কান্না পাচ্ছিলো কিন্তু তার চেয়ে জারিফের সাথে যাওয়ার আনন্দটাই মনে হয় বেশি।মানুষ যখন প্রেমে পড়ে তখন সেই ভালবাসার মানুষটার সানিদ্ধ্য পেতে কাছের মানুষ গুলোর এই অবাধ আবেগও তুচ্ছ মনে হয়। আমারও এখন তেমন মনে হচ্ছে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম।

বাসায় পৌঁছে জারিফ আমাকে নেমে দিয়ে সোজা অফিসে গেলো। আমি বাসায় ঢুকে সবার সাথে অনেক গল্প করলাম। অনেকটা সময় গল্প করার পর রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর খেয়ে শুয়ে পড়লাম। অনেক রাত হয়ে গেছে এখনও জারিফ আসেনি।আমি শুয়ে শুয়ে জারিফের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। একটু চোখটা লেগে আসতেই কলিং বেলের আওয়াজ পেলাম। দৌড়ে গিয়ে গেট খুললাম। খুলতেই জারিফ কে দেখে মুখে হাসি চলে এলো। “কি ব্যাপার! মিসেস জারিফ রহমান। কারও জন্য অপেক্ষা করছিলেন বুঝি।” সে হাসি মুখে আমাকে জিজ্ঞেস করলো। কি অদ্ভুত! তার মুখে নিজের নামটা এভাবে শুনে মনের মাঝে একটু ভালো লাগা কাজ করলো। আমি চাইতেও নিজের সেই ভাললাগার আবেগময় হাসি আটকাতে পারলাম না। “এতো দেরি হল যে?” আমি স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করলাম। “একটা মিটিং ছিল।” সে ঢুকতে ঢুকতে বলল। “আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি খাবার দিচ্ছি।” “খেয়ে এসেছি। উপরে এসো।” বলেই চলে গেলো। আমিও উপরে গেলাম। জারিফ ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখল আমি বিছানায় বসে আছি। সে এসির টেম্পারেচার অনেকটা কমে দিলো। “কি করছেন? ঠাণ্ডা লাগছে তো?” আমি বিরক্ত হয়ে বললাম। “কিন্তু আমার তো গরম লাগছে। তুমি কম্বল উড়ে শুয়ে পড় তাহলেই আর ঠাণ্ডা লাগবেনা।” বলেই উনি একটু বাকা হাসলেন। আমি তার হাসি দেখতে পেলাম ঠিকি কিন্তু মানে বুঝতে পারলাম না। আমি কোন কথা না বলে কম্বল নিয়ে শুয়ে পড়লাম। পরিবেশ টা কিন্তু বেশ লাগছে। ঘরটা হালকা ঠাণ্ডা। তার মাঝে কম্বল নিয়ে ঘুমানো। ঘুম টা বেশ হবে।

বারান্দায় দাড়িয়ে সিগারেট টানছি আর পিচ্চি টাকে দেখছি। এতক্ষণে মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। আমিও সিগারেট টা শেষ করে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কম্বল টা উড়ে মাঝখান থেকে কোল বালিশ টা সরিয়ে ফেললাম।খানিক্ষন পিচ্চি টাকে দেখলাম মন ভরে। তারপর দুই হাতে তাকে জড়িয়ে নিলাম। আর এসির ঠাণ্ডায় সে একটু উষ্ণতা পেতে আমার বুকের মাঝে এসে ঢুকে পড়ল। আমিও তাকে জড়িয়ে নিলাম শক্ত করে। কাল অনিচ্ছাতেই আমার হাত তোমার গায়ে লেগে যাওয়ায় তুমি সিন ক্রিয়েট করেছিলে তাই তো আজকে নিজে থেকেই তোমাকে আমার সাথে জড়িয়ে ঘুমাতে বাধ্য করলাম। আমি এতো সহজে ছাড়ার পাত্র নই। যা করবে তার ফল তুমি খুব তাড়াতাড়ি পাবে। আমি ভেবেই একটু হেসে ঘুমিয়ে গেলাম।

নিজের উপরে একটা চাপ অনুভব করতেই চোখ খুললাম। খুলেই দেখলাম আমি জারিফের সাথে লেপটে আছি। এক ঝটকায় আমার প্রেসার নিল হয়ে গেলো। হাত পা অবস হয়ে আসছে। আমি ঘামছি। কারন জারিফ আমাকে দু হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে আর তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আমার মুখে পড়ছে। সেই নিশ্বাসের উষ্ণতা আজ আমার কাছে ১০০ ডিগ্রির চেয়েও বেশি মনে হচ্ছে। এই উত্তাপ আমি আর সহ্য করতে পারছিনা। কিন্তু নিজেকে ছাড়াতেও পারছিনা। কারন জারিফ আমাকে অনেক শক্ত করে ধরে আছে। মনে মনে দোয়া পড়ছিলাম। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে কিছুক্ষন পর জারিফ নিজে থেকেই ছেড়ে দিয়ে উলটে ঘুমিয়ে গেলো। আমি একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। যাই হোক এই লোকটা তো আর আমাকে এই ভাবে দেখেনি। ঘুমের মধ্যেই ধরেছিল কিন্তু বুঝতে পারেনি। আমি তাড়াতাড়ি করে ওয়াশ রুমে চলে গেলাম।

ফারিয়ার ওয়াশ রুমে যাওয়ার পর আমি চোখ খুলে তাকে দেখে হাসলাম। খুব শাস্তি হয়েছে আজ। আমি কারও জন্য শাস্তি বাকি রাখিনা। আমিও উঠে পড়লাম। ফারিয়া ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আমাকে বিছানায় বসে ফোন চাপতে দেখে একটু থমকে গেলো। লজ্জায় নাকি ভয়ে আমি বুঝতে পারলাম না। আমি তার দিকে তাকালাম না। আজ ছুটি তাই ফ্রেশ হয়ে বিছানায় ল্যাপটপে কাজ করছিলাম। ফারিয়া দুই কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। আমি ভালো করে তার দিকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলাম। তারপর বললাম “তোমার সামনে পরিক্ষা। সময় নষ্ট না করে পড়তে বস।” সে কিছু না বলে আমাকে কাপটা দিয়ে টেবিলে বসে পড়ছে। মেয়েটার অনেক ধৈর্য। একবার পড়তে বসলে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে। কোন দিকে তার আর খেয়াল থাকেনা। তার চুল গুলো খুব বিরক্ত করছিলো। তাই চুল গুলোকে উঠিয়ে খোপা করে নিলো। পেছন থেকে তার ফর্সা পিঠ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আমি নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চেয়েও পারছিনা। এই মেয়েটা এভাবে আমার সামনে থাকলে আমি কিভাবে নিজেকে কন্ট্রোল করবো। নিজের মন আর ব্রেনের সাথে রীতিমতো চতুর্থ বিশ্ব যুদ্ধ করছি। কিন্তু অবশেষে ব্রেইনকে পরাজিত করে মনের টানে আমি উঠে গেলাম। পিছনে দাড়িয়ে তার পিঠে স্লাইড করছি।

হঠাৎ ই কোন হাত আমার শরীরে স্পর্শ করায় আমি কেঁপে উঠলাম। চোখ বন্ধ করে ফেললাম। কিন্তু ওনার স্পর্শ আরও গভীর হতে লাগলো। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। উনি বুঝতে পেরে আমার দিক থেকে উলটো ঘুরে গেলেন। তার উলটা ঘুরায় আমি সাহস পেলাম আর তার দিকে ফিরে তাকালাম।উনি উলটা দিকে ঘুরেই বললেন “সরি!”। কিন্তু এই শব্দটা আমার ভেতরটা খত বিক্ষত করে দিলো। কিছুক্ষনের জন্য ওনার কষ্টটা আমি উপলব্ধি করতে পারলাম। হয়ত খুব বেশিই ভালবেসে ফেলেছে আমাকে। যার কারনে আমার কাছ থেকে দূরে থাকতে পারছেনা। কিন্তু আমার কি উচিৎ। আমি বুঝতে পারছিনা।তার দিকে তাকিয়ে আছি করুন দৃষ্টিতে। কিন্তু সেই দৃষ্টি তিনি ফিরেও দেখলেন না। দেখলে হয়ত বুঝত। উনি বারান্দায় গিয়ে সিগারেট জালালেন। আমি আবার টেবিলে বসে পড়লাম। বই খুলেও কিছুই পড়তে পারছিনা। সেই ছোট কথাটা বার বার কানে বাজছে। আমি টেবিলে বসেই বুঝতে পারছি উনি একটার পর একটা সিগারেট জালিয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু তার এই সিগারেটের আগুন মনে হচ্ছে আমার বুকে জলছে। আমি সহ্য করতে না পেরে উঠে বারান্দায় যাই। উনি এতোই গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলেন যে আমার উপস্থিতি বুঝতেও পারলেন না। আমি তার পাশে গিয়ে তার ঠোঁট থেকে সিগারেট টা নিয়ে ফেলে দেই। উনি চমকে আমার দিকে তাকালেন। জিবনেও বোধ হয় কারও কাজে এতোটা অবাক হননি। আমি রাগি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি। এতো কিছুর পর তার সাথে এরকম আচরণ টা মনে হয় উনি হজম করতে পারছেন না। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল “কিছু বলবে?” “এতো বেশি সিগারেট কেন খান?”। আমার কাছ থেকে এরকম প্রশ্ন উনি আশা করেন নি। “জানিনা।” এক রাশ হতাশা নিয়ে ছোট করে উত্তর দিলো। “কোন কারন ছাড়া কেউ কিছুই করেনা।” “তাই। তাহলে আমার হাত থেকে সিগারেট ফেলে দেয়ার কারণটাও নিশ্চয় তুমি জানো।” আমার দিকে তাকিয়ে বলল। আমি তার কথার কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে ফেলি। “সিগারেট খেলে ক্যান্সার হয়।” আমি মাথা নিচু করেই বললাম। “আমি মরে গেলে তো তুমি বেচেই যাবে।” উনি সামনে তাকিয়ে বললেন। কিন্তু আমার বুকের ভিতরে কেমন যেন একটা কষ্ট নাড়া দিলো। কষ্টের চাপে চোখের পানি বাধ মানলনা। উপচে বেরিয়ে এলো। আমি উলটো দিকে ঘুরে চোখের পানি মুছে নিলাম। উনি বারান্দায় দাড়িয়ে থাকলেন। আমি ঘরে বসে ভাবছি এই দূরত্ব টা কি আসলেই ওনার প্রাপ্য। আমি কি নিজের লজ্জা সংকোচের কাছে ওনার ভালবাসাকে অসম্মান করছি। ছোট করছি তার অনুভুতি গুলোকে।

দুই হাতে মাথাটা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে আছি। খুব ব্যাথা করছে। “মাথা ব্যাথা করছে?” জারিফের কথায় চোখ খুলে দেখি উনি বাইরে যাবার জন্য রেডি হয়ে সামনে দাড়িয়ে আছে। আমি কথাটাও ঠিক মতো বলতে পারছিলাম না তাই মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললাম। “রেডি হয়ে নাও বাইরে যাব।” আমি তার কথায় অবাক হয়ে তাকালাম। আমার মাথা ব্যাথা করছে আর উনি এসব কি বলছেন বাইরে যাবে মানে। আমি মাথা নেড়ে না বললাম। উনি আমার হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আর বলছেন “থাক রেডি হতে হবেনা। এভাবেই চল। রাতের বেলা কেউ তেমন খেয়াল করবেনা।” আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। নিচে যেতেই মা বলল “কি রে ওভাবে ওকে টেনে কই নিয়ে যাচ্ছিস?” “একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি”। ওনার কথা শুনে মা একটু মুচকি হেসে মাথা নেড়ে যেতে বললেন। আমি দরজা থেকে বের হওয়া অব্দি মার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। উনি আমাদের এভাবে যেতে দেখে খুব খুশি হলেন। আমরা দুজন দুজন কে যে এভাবে মেনে নিবো তা হয়ত ভেবেই তিনি এতো খুশি।রাস্তায় হাঁটছি কিন্তু উনি আমার হাত টা এখনো শক্ত করে ধরে আছে যেন ছেড়ে দিলে আমি পালিয়ে যাব। আমি কিছু বলছিনা। বেশ ভালই লাগছে।তার সাথে এভাবে রাতে রাস্তায় হাঁটব তা আমি কখনও ভাবিনি । “ব্যাথা কমল?” জারিফ সামনে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো। আমি তার দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেলো। রাস্তার নিয়ন আলোয় জারিফকে আজ একেবারে অন্য রকম লাগছে। আমার চোখ আজ বড্ড বেহায়া হয়ে উঠেছে। “আমাকে দেখা শেষ হলে আমার প্রশ্নের উত্তর টা মনে করে দিয়েন ম্যাডাম!” তার কথায় আমি লজ্জা পেয়ে সামনে তাকালাম। খেয়াল করলাম সত্যি তো মাথা ব্যাথা একে বারেই নেই। “এভাবে রাস্তায় হাটলে মাথা ব্যাথা ঠিক হয়?” আমি প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম তার দিকে। সে আমার দিকে না তাকিয়েই বলল “যা শুনতে চাই তা তো কখনই বলনা। উলটা প্রশ্ন করে বস।” তার কথাটার চেয়ে তার গলার কষ্টটা আমাকে বেশি ঘায়েল করলো। আমি অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে ফেললাম।
চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে