#আমার_শহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৭
আমি বাসায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলাম। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে নাম্বার টা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। ফারিয়া! এতো রাতে? ওর তো এতক্ষণ জেগে থাকার কথা না। কোন সমস্যা হল না তো। আমি ফোনটা ধরতেই ও পাশ থেকে ফিকরে ফিকরে কান্নার আওয়াজ পেলাম। “কি হয়েছে? কাদছ কেন?” আমি একটু বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম। সে কাদতেই থাকলো। “কথা বল।” আমি খুব শান্ত গলায় বললাম। “আপনি আমাকে কবে নিতে আসবেন?” সে কাঁদতে কাঁদতে বলল। আমি কথা শুনে খুব অবাক হলাম। ফারিয়া আমাকে এমন কথা বলবে তা আমার ধারনা ছিলোনা। আমি খুব শান্ত ভাবে বললাম “কেন?আর থাকতে ইচ্ছা করছেনা?” “না। আমি আপনার কাছে যাব।” বলেই সে জোরে কেদে ফেলল। “ঠিক আছে। এখন ঘুমাও।” বলেই আমি ফোনটা রেখে দিলাম। ফোনটা রেখে কিছুক্ষন ভাবলাম। তারপর শুয়ে পড়লাম।
আমি গোসল শেষ করে ভেজা কাপড় মেলে দিচ্ছিলাম উঠোনে। হঠাৎ সীমা আর ছোট মা এসে আমার সামনে দাড়িয়ে গেলো। আমি একটু ভ্রু কুচকে তাকাতেই বলল “জামাই এসেছে।” বলেই ছোট মা চলে গেলো। এতো খুশির কারন হচ্ছে সে কাউকে না জানিয়েই এসেছে। তাই তার আগমনের সেই খুশি সবার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে। আমার মুখেও একটা হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু কেন সেটা আমি বুঝতে পারলাম না। সীমা আমার কাছে এসে বলল “তোকে সবাই বারান্দার সাথের ঘর টাতে ডাকছে।” আমি দেরি না করে সীমার পিছনে পিছনে চলে গেলাম। সবাই ডেকেছে। কোন জরুরী কথা হবে মনে হয়। ঘরে ঢুকেই দেখি জারিফ একা দাড়িয়ে আছে। আবার সেই কঠিন দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে আমার দিকে এক পা করে এগিয়ে আসছে আর আমি পিছিয়ে যাচ্ছি। আমার সেই দিনের কথা মনে পড়ে গেলো। আমি আর একটু পিছাতেই দেয়ালে আটকে গেলাম। জারিফ আমার কাছে এসে আমার সামনে থাকা চুল গুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে দিলো। আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। “কোন অনুভুতি হয়?” আমি তার কথায় চোখ খুলে তার দিকে তাকালাম। তার চোখ আজ অন্য কথা বলছে। সেই ভাষা বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে। আমি লজ্জায় আবার চোখ বন্ধ করে নিলাম। কিছুক্ষন পর তার কোন অনুভুতি না পেয়ে আমি চোখ খুলে দেখি সে আমার থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে। আমি এবার চলে যেতে নিলে তার পাশ কাটতেই সে আমার হাত ধরে ফেলে। আমি দাড়িয়ে যাই। “ভালবাস আমাকে?” তার কণ্ঠের আবেগ আমাকে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু আমি তার কাছ থেকে পালাতে চাইছি। আমার কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে আমার হাত ছেড়ে দিলো। তারপর আমার উলটা দিকে তাকিয়েই খুব শান্ত গলায় বলল “ তুমি এতটাও ছোট না যে আমার কথা বুঝতে পারনি।তুমি নিজেকে আমার কাছ থেকে গুটিয়ে রাখতে পার কিন্তু তোমার চোখের ভাষা আমার প্রতি তোমার সমস্ত আবেগ আমার কাছ থেকে গোপন করতে পারবেনা। তোমার চোখ স্পষ্ট বলে দিচ্ছে আমার প্রতি তোমার অনুভুতি। যার টানে আমাকে এতদুর নিয়ে এলে।” তার কথা গুলো আমার বুকের মাঝে এক অনুভুতি তৈরি করলো। কিন্তু এই অনুভুতি আমার চেনা। জারিফ আমার আশে পাশে থাকলেই শুধু এই অনুভুতি হয়। আর আমি এই অনুভূতির নামটাও জানি। ভালবাসা! হ্যা আমি জারিফ কে ভালবাসি কিন্তু এই অনুভুতি তার সামনে প্রকাশ করার সাহস আমার নাই। আমি সব সময় তার কাছ থেকে পালিয়ে এসেছি যাতে সে আমার এই অনুভুতি বুঝতে না পারে। জিবনে প্রথম ভালবাসার অনুভুতি তার সামনে লজ্জায় প্রকাশ করতে পারছিনা। আজ আমার আবেগ অনুভুতি লজ্জার কাছে হার মেনে দমে যাচ্ছে। কিন্তু অবশেষে সে বুঝেই নিলো। “তুমি যতদিন না নিজেই আমাকে তোমার ভালবাসার কথা বলবে ততদিন আমি অপেক্ষা করবো।” জারিফের কথায় আমি বাস্তবে ফিরলাম। “আমার ভালবাসার শহরে তোমার নিমন্ত্রণ রইল। যেদিন নিমন্ত্রণ গ্রহন করবে সেদিন তোমাকে সাদরে গ্রহন করবো। সেদিন আমার ভালবাসা পূর্ণ হবে।” তার কথায় আমার মনে প্রেমের জোয়ার উঠল। আমি আর তার সামনে থাকতে পারলাম না। এক দৌড়ে চলে গেলাম।
দুপুরে খাওয়া শেষ করে জারিফ আর সাইফ ভাইয়া বারান্দায় বসে কি নিয়ে খুব হাসাহাসি করছিলো। আমি চা নিয়ে গেলাম। সাইফ ভাইয়ার ফোন বাজতেই সে উঠে গেলো। জারিফ আমার দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। আমি না তাকিয়েও বুঝতে পারছি। কিন্তু তার এই চাহুনি আজ আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। তাই আমি সেখানে দাড়াতে চাইলাম না। চলে আসতে নিলেই জারিফ আমার ওড়না টেনে ধরে। আমি সামনের দিকে ওড়না ধরে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছি। নিমেষেই সব কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেলো। আমার হার্ট বিট এতোটা বেড়ে গেলো যে তার শব্দে নিজের কান ফেটে যাচ্ছে।অসহনীয় এক ভাললাগা আবার ভয়। কোন অনুভুতি টাকে প্রাধান্য দেয়া উচিৎ আমার জানা নেই। “কি সমস্যা তোমার?” তার ধমকে ঘোর কাটে। “কো…কোন সমস্যা নেই।” কাপা কাপা গলায় বললাম। “তাহলে আমার কাছে আসছনা কেন?” “কা… কাজ করছিলাম।” “আমি এতদুর থেকে শুধু তোমার জন্য এসেছি।” ওড়না টা ছেড়ে দিয়ে চাপা অভিমান নিয়ে বলল। বুকের ভিতরে কেমন যেন চাপা কষ্ট নাড়া দিয়ে গেলো। তার দিকে ঘুরে বললাম “কিছু লাগবে?” “তোমাকে!” একটু হেসে বলল। লজ্জায় মাথা নামিয়ে নিলাম। সাইফ ভাইয়া চলে আসলো। আমি আর না দাড়িয়ে চলে আসলাম।
রাত ১০ টা মানে গ্রামে অনেক রাত। চারিদিকে সব স্তব্ধ। শুধু ঝি ঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দুই একটা জোনাকি পোকা উড়ে যাচ্ছে। আমি জানালার পাশে বসে দেখছি। “ওখানে বসে কি করছ?” জারিফের কথায় ভয় পেয়ে যাই। আমাকে ওভাবে ভয় পেতে দেখে সে শব্দ করে হেসে উঠলো। আমি রাগ করে তার দিকে তাকালাম। “হাসার কি হল?” “কি ভেবেছিলে ভুত?” বলেই আবার হাসল। আমি তার দিকে রাগ করেই তাকিয়ে থাকলাম। “তুমি ভুতে ভয় পাও?” “কেন আপনি পান না?” “না। ভয় পাওয়ার কি আছে?” “সামনে ওই যে তাল গাছটা আছে। ওই টাতে ভুত আছে।” সে আমার কথা শুনে জানালার কাছে এলো তাল গাছটা দেখার জন্য। “তুমি দেখেছ?” তাল গাছের দিকে তাকিয়ে বলল। “না অনেকেই দেখেছে।তারা গল্প বলেছে আমি শুনেছি।” “এসব ভুত বলে কিছু হয়না। সবই মানুষের সাব-কনসাচ মাইনডের খেলা। তুমি তো সাইন্সে পড়। তবুও কিভাবে ভুত বিশ্বাস কর।” “ভুত বিশ্বাস করার জন্য পড়ালেখার প্রয়োজন হয়না। যারা দেখেছে তারা গল্প শোনালে আপনিও বিশ্বাস করতে বাধ্য হবেন।” “আমার এসব বিশ্বাস করে লাভ নাই। আমার উপরে এমনিতেই তো একটা পেত্নি ভর করে আছে।” “তাই নাকি?” কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকালাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে খুব শান্ত ভাবে বলল “কিন্তু আমার পেত্নি কে আমি ঘাড় থেকে নামিয়ে সারাজিবনের জন্য বুকে রাখতে চাই।” আমি তার কথা বুঝতে পেরে উলটা দিকে ঘুরে একটু হেসে জানালা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। সেও আর কথা না বলে বিছানায় শুয়ে পড়ল।
শরীরে কারও একটা শিতল হাত অনুভুত হতেই আমি চিৎকার করে বসে পড়লাম। জারিফ ঘুম থেকে চমকে উঠলো আমার চিৎকারে। উঠেই দেখল তার হাত আমার গায়ে পড়েছে। আর এই জন্যই আমার এই জঘন্য চিৎকার। “সরি! আসলে ঘুমের মধ্যে বুঝতে পারিনি।” বলেই সে মাঝখানে কোল বালিশ টা দিয়ে উলটো দিকে ঘুরে শুয়ে পড়ল। আমি এরকম একটা কাণ্ডে ভীষণ লজ্জা পেলাম। পুরো বাড়ি হয়ত শুনে ফেলল। আর তাছাড়াও জানিনা সে কি ভাবল। কিন্তু ঘুমানোর আগে ভুতের গল্প করায় আমি ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। তাই ঘুমের মাঝেই এমন হওয়াতেই ভয় পেয়ে চিৎকার দেই। কি একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। ধুর! মাঝে মাঝে এমন সব কান্ড করে বসি। আগে চোখ খুলে দেখে নেয়া উচিৎ ছিল। তারপর তার হাত টা আলতো করে সরে দিতে পারতাম। শুয়ে শুয়ে ভাবছি। ঘুম আসছেনা কিছুতেই। জারিফ কি ভাবল সেটাই বার বার মাথায় ঘুরছে।
চলবে……