#আমার_শহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৬
জারিফ বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। আমি কফি নিয়ে গিয়ে তার পিছনে দাড়িয়ে আছি। সে বুঝতে পেরে আমার দিকে ঘুরে দাড়িয়ে হাত থেকে কাপটা নিয়ে আমার দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। “আপনার সাথে আমার কথা আছে!” আমার কথা শুনে সে কপাল ভাঁজ করে দাড়িয়ে থাকলো আমার দিকে তাকিয়ে। “আপনি কেন নিলা কে বললেন আমি আপনার উত্তর টা দিবো? আমি তো জানিনা আপনার কি উত্তর?” আমি একটু আসতে করে কথাটা বললাম।উনি সেই কঠিন দৃষ্টি নিয়ে এক পা এক পা করে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। আর আমি তার কাছ থেকে পিছিয়ে যেতে লাগলাম। উনি পাশের টেবিলে কাপটা রাখলেন আমার দিকে তাকিয়েই। আমি পিছাতে পিছাতে দেয়ালে ঠেকে গেলাম। উনি আমার দুই পাশে দুই হাত রেখে আমার দিকে ঝুকে গেলেন। ওনার নিশ্বাস আমার মুখে পড়ছে। ওনার হার্ট বিট আমি শুনতে পাচ্ছি। তার চোখের মাঝে আমি হারিয়ে যাচ্ছি। তার মাতাল করা পারফিউমের ঘ্রান আমাকে তার কাছে টানছে। এতদিনে তৈরি হওয়া সমস্ত আবেগ ছুটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। “তুমি কি উত্তর দিয়েছ?” উনি নেশা ভরা কণ্ঠে বললেন। তার কথা শুনে আমি একটু চোখ বন্ধ করে সাহস সঞ্চয় করে নিলাম। তারপর চোখ খুলে “আমি না বলে দিয়েছি। বলেছি আপনি এসব নিয়ে ইন্টারেস্টেড না।” এক নিঃশ্বাসে বলে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলাম। উনি খুব শান্ত কণ্ঠে বলল “কেন বলেছ?”। এবার আমি একটু রেগে গেলাম। একটু চিৎকার করেই বললাম “কেন বলেছি মানে কি? আপনি তো বিবাহিত। তাহলে ওর সাথে কেন প্রেম করবেন?” উনি এবার একটু রাগি স্বরে বললেন “তাহলে কাজিন কেন বলেছিলে?” আমি এবার ভয় পেয়ে যাই। কিছু না বলে মাথা নিচু করে নেই। “উত্তর দিবা না থাপ্পড় খাবা?” ওনার ধমকে আমি কেঁপে উঠি। এবার উনি সত্যি সত্যি অনেক রেগে গেছেন। প্রথম বার ওনার রাগ দেখে ভয়ে চোখ থেকে পানি পড়ছে। চোখের পাতা পিটপিট করে পানি আটকাতে চেষ্টা করছি। কিন্তু আমার সব চেষ্টা ব্যর্থ করে তারা অঝরে নিচে নামছে। “স্টপ ক্রায়িং!” এতোটা শান্ত গলায় বলল যে শুধু আমার কান পর্যন্তই কথাটা পৌঁছালো। আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল “মিথ্যা বলে অন্যায় করেছো। কিন্তু কেন বলেছ জানতে পারি?” তার শান্ত কণ্ঠ শুনে আমি সাহস পেলাম। মাথা তুলে বললাম “ওরা ভাববে এতো ছোট মেয়ে বিয়ে করেছে। তাই বলতে চাইনি।” “কেন ছোট মেয়েরা বিয়ে করেনা?” “করে। কিন্তু ওই সময় কিছু না ভেবেই বলে ফেলছি।” আমার কথা শেষ হতেই উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে কাপটা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট জালালেন। বেশি কিছু না বুঝলেও এটা বুঝতে বাকি রইলনা যে উনি আমার কাজে একটু হলেও কষ্ট পেয়েছেন। আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। উনি বুঝতে পেরে একটু আড় চোখে আমাকে দেখে সিগারেট টা ফেলে দিলেন। আমি মাথা নিচু করে কাদো কাদো কণ্ঠে বললাম “আপনি আমার উপরে রাগ করেছেন? সরি! আমি আর কখনও মিথ্যা বলবনা।“ “ইটস ওকে! যাও শুয়ে পড়।” উনি সামনে তাকিয়েই বললেন। আমি আর কথা না বাড়িয়ে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।
ভালবাসা বড়ই অদ্ভুত। ভালবাসলে মানুষ স্বার্থপর হয়ে যায়। পাশের মানুষটার কথা চিন্তা করেনা। আমি শুধু নিজের ভালবাসার কথা ভেবে তাকে আমার প্রতি দুর্বল করার চেষ্টা করছি। কিন্তু একবারও তার কথা ভাবিনি। সে কি আমাকে মেনে নিতে পেরেছে। নাকি শুধু সবার চাপেই বিয়েটা করেছে। আমি বারান্দায় দাড়িয়ে ভাবছি। সেকি আমাকে ভালবাসতে পারবে? তার মনে কি আমাকে জায়গা দিতে পারবে? ও অনেক ছোট। সবে মাত্র ওর জীবন শুরু। ভালবাসা ভাললাগা এই সময়ে তার জিবনে আসতে শুরু করবে। তখন যদি সে আমাকে মেনে নিতে না পারে? মা কি আমাকে তার সাথে বিয়ে দিয়ে তার উপর জোর করে চাপিয়ে দিলো? আমি তাকে ভালবেসেছি তাই বলে আমার ভালবাসা তার উপরে চাপিয়ে দিতে পারিনা। নাহ! আমাকে তার কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। আমি গিয়ে তার পাশে বিছানায় বসলাম। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। আমি তাকে কোন রকম জোর করতে চাইনা। সব কিছু তার উপরে ছেড়ে দিলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুয়ে পড়লাম।
আজ কলেজ ছুটি তাই বাড়ির কাজ করছিলাম। জারিফ সকাল সকাল উঠে রেডি হয়ে নিচে নেমে এলো। কি যেন কাজ আছে তাই তাড়াতাড়ি করে না খেয়েই বাইরে চলে গেলো। আমার দিকে একবারও তাকাল না। মনে হয় তার রাগ এখনো কমেনি।আমি তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। কিন্তু সে সেই দিকে না তাকিয়েই চলে গেলো।
“তোর কি হয়েছে ঠিক করে বলত?” সাইফ আমাকে জিজ্ঞেস করলো। আমি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে গান শুনছিলাম। তার কথায় চোখ খুলে বললাম “কিছুনা।” সে আমার কথা বিশ্বাস করলো না। শাওনের দিকে তাকিয়ে বলল “তুই আমি আর জারিফ আমরা ঠিক কবে থেকে এক সাথে আছি বলতে পারিস?” শাওন একটু ভেবে বলল “সেই ছোট বেলার কথা। এতদিনে কি মনে আছে?” এবার সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল “এতো দিনে একটা মানুষ কে এতোটা চেনা সম্ভব যে সেই মানুষ টা মিথ্যা বলছে না সত্যি বলছে।” আমি কোন কথা না বলে উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়ালাম। একটা সিগারেট জালিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। “ফারিয়া কে বিয়ে করে আমি ভুল করিনি তো?” অসহায় ভাবে বললাম। দুজনি একসাথে বলে উঠলো “কি বলছিস এসব?” সাইফ আমার কাধে হাত রেখে বলল “কি হয়েছে খুলে বল।” “ফারিয়া অনেক ছোট। ও নিজের পছন্দ অপছন্দ ভালো করে এখনো বোঝেনা। যখন বুঝতে পারবে তখন যদি আমাকে মেনে নিতে না পারে?” আমি একটা বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম। শাওন আমার কথা শুনে বলল “আমার মনে হয় কোন কিছু ভাবার আগে তোর ওকে একটু সময় দেয়া দরকার। তারপর সব কিছু ভেবে দেখা যাবে কি করা যায়।” আমি কোন কথা না বলে মাথা নাড়ালাম। সাইফ বলল “তোর যদি তাই মনে হয় তাহলে কিছুদিন ওর কাছ থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখ। তাহলেই অন্তত ওর আচরনে বুঝতে পারবি ও কি চায়। কারন ও যেই পরিবেশে বড় হয়েছে সেখান থেকে ভালবাসাটা বোঝা ওর জন্য একটু কঠিন।” আমি বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছি।
অনেক রাত হয়ে গেছে জারিফ এখনো আসছেনা।সে সন্ধ্যা বেলায় বাড়িতে চলে আসে। কিন্তু আজ এতো রাত হয়ে গেলো তার কোন খবর নেই। আমি তাকে ফোন দিলাম। প্রথম বার ফোনটা বেজে গেলো কিন্তু ধরলনা। দ্বিতীয়ও বার ফোনটা বাজতেই ধরে ফেলল “হ্যালো।” “কোথায় আপনি? কখন আসবেন?” আমি একটু বিচলিত হয়ে বললাম। উনি একটু ভেবে বললেন “আসছি।” বলেই ফোনটা রেখে দিলেন। আমি ফোনটা রেখে দিয়ে নিচে গিয়ে সোফায় বসে টিভি অন করে দিলাম। বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছি। বেশ কিছুক্ষন পর কলিং বেল বাজলো। আমি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। জারিফ দাড়িয়ে আছে। তাকে দেখে আমার মনটা খুশি হয়ে গেলো। আমি হেসে বললাম “এতো দেরি হল যে?” উনি ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন “একটু কাজ ছিল।” বলেই উপরে চলে গেলেন। আমিও উপরে গিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছি। আর উনি ওয়াশ রুমে ফ্রেশ হচ্ছেন। বের হয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল ঠিক করছেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম “খাবার দিবো?” উনি চুল ঠিক করতে করতেই বললেন “আমি খেয়েছি।” বলেই এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আমি তার আচরনে একটু অবাক হলাম। প্রায় ৬ মাস হল আমি এই বাড়িতে এসেছি। কিন্তু কখনও এরকম আচরণ সে করেনি। আমি একটু বসে থেকে শুয়ে পড়লাম।
কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে জারিফের জন্য অপেক্ষা করছি। জারিফ ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে বলল ”আমার একটা মিটিং আছে। তোমাকে ড্রাইভার কলেজে নামিয়ে দিবে।“ আমি অবাক হয়ে তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলাম। ওনার শত ব্যস্ততা থাকলেও অফিসে যাওয়ার সময় আমাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে যায়। এমন কি কাজ আছে যে আমাকে নামিয়ে দিতে দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু সেই দিকে তার কোন খেয়াল ছিলোনা। ড্রাইভার আমাকে কলেজে নামিয়ে দিলো। মন টা ভীষণ খারাপ। কিছুই ভালো লাগছেনা। ক্লাসে মন বসছেনা। বুকের মাঝে কেমন যেন শুন্যতা কাজ করছে। কেমন জানি একটা অনুভুতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা নাই। কিন্তু কেন তা বুঝতে পারছিনা। কলেজ থেকে ফিরে দেখি ফুপু এসেছে। আমি দৌড়ে গিয়ে ফুপু কে জড়িয়ে ধরলাম। “কেমন আছিস মা?” “ভালো। তুমি কেমন আছ ফুপু?” “ভালো আছি। শোন! তোর বাবা ফোন করেছিলো। আমাদের যে একটা মিলাদ মাহফিল হয় সেটা হবে আগামি পরশু। তাই আমি গ্রামে যাচ্ছি। তোকে নিয়ে যেতে বলেছে।” গ্রামে যাওয়ার কথা শুনে আমি খুব খুশি হলাম। কিন্তু কি একটা মনে করে সবার দিকে তাকালাম। মা বলল “জারিফ কে আমি বলেছি। ওর কাজ আছে তাই আসতে পারবেনা। তোমাকে যেতে বলেছে। ও গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবে।” আমি খুশি হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলাম। সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে ফুপুর সাথে রওনা হলাম। বাড়ি যাওয়ার খুশি তে আমার কিছুই মাথায় থাকলোনা।
বেশ কয়দিন থাকলাম বাড়িতে। এই কয়দিনে জারিফের সাথে আমার কথাই হয়নি। অফিসের কাজে নাকি খুব ব্যাস্ত। সাইফ ভাইয়ার সাথে তার কথা হয় আর আমি সেখান থেকেই তার খবর নিয়েছি। কাল সাইফ ভাইয়া রা চলে যাবে। কিন্তু আমি যেতে পারবোনা। কারন জারিফ বলেছে সে এসে আমাকে নিয়ে যাবে। সে কবে আসবে আমি জানিনা। আমার আর ভালো লাগছেনা। মনে হচ্ছে জারিফের কাছে ছুটে যাই। তার প্রতি আমার সমস্ত অনুভুতি আজ যেন উপচে পড়ছে। তার কথা মনে পড়তেই আমার চোখ থেকে পানি বেয়ে পড়ল। নিজের বাড়ি ছেড়ে যেদিন তাদের বাড়ি গিয়েছিলাম সেদিনের থেকেও বেশি কষ্ট হচ্ছে আজ জারিফ কে ছেড়ে থাকতে। নিজের বাড়ি আর বাড়ির মানুষ গুলোকেও আজ তেমন আপন মনে হচ্ছেনা। সবার মাঝে থেকেও কেমন যেন একটা অপূর্ণতা আমাকে গ্রাস করছে। সেটা এক মাত্র জারিফই পারে পুরন করতে। কিন্তু সে কি আসবে আমাকে পূর্ণ করতে।
চলবে……