#আমার_শহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৫
গত আধা ঘণ্টা যাবত সেই প্যানপ্যানানি ইংলিশ গান শুনছি। মাথাটা ধরে এলো। একে তো জ্যাম। তারপর সেই গান! অসহ্য লাগছে। মাঝে মাঝে জারিফ গুন গুন করে গান গাচ্ছে। তার গানের গলা কিন্তু বেশ! ইংলিশ গান হলেও শুনতে ভালই লাগছে। জানালার কাচ টা উঠিয়ে দিয়ে তাতে মাথাটা ঠেকিয়ে রাখলাম। জারিফ আমার দিকে তাকিয়ে বলল “কোন সমস্যা?” আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম। সে গাড়ি চালাতে মনোযোগ দিলো। কলেজের সামনে আমাকে নামিয়ে দিয়ে অফিসে চলে গেলো।
“আচ্ছা তোকে ওই যে হ্যান্ডসাম ছেলেটা প্রতিদিন নামিয়ে দিয়ে যায় আবার নিয়ে যায় ওটা কে রে?” জারিফের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল নিলা। আমিও তার আঙ্গুলের দিকে তাক করে জারিফের দিকে তাকালাম। সামনের দিকে গাড়ির উপরে বসে হেলানি দিয়ে শাওন ভাইয়ার সাথে কথা বলছে আর হাসছে। তার হাসি দেখে মনে হল দৌড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরি। কি সুন্দর সেই হাসি। মেয়েদের মনে জন্মের পর থেকেই তার বিয়ের জন্য একটা ছবি তৈরি হয়ে থাকে। সেটা সাধারণত প্রকৃতি গত ভাবেই হয়।তাতে কারও কোন হাত থাকেনা। সেখানে নিজের বউ সাজার ছবি আর পাশে বরের একটা আবছা ছবি থাকে। যখন মনের মানুষটা বাস্তবে খুজে পায় তখন তাকে সেই ছবিতে আলতো করে বসিয়ে দেয়। এটাও প্রকৃতির নিয়ম। আমার সেই ছবিতেও যেন জারিফ আজ জায়গা করে নিলো। “কি রে বল না কে হয়?” আবার নিলার কথায় ঘোর কাটল। আমি নিলার দিকে তাকিয়ে একটু ভেবে নিলাম। এখনি ওদেরকে বিয়ের কথা কিছুই বলা যাবেনা। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবে বললাম “আমার কাজিন।” কথাটা শুনেই কেন জানি নিলা খুব খুশি হল। সেই খুশির কারন আমি বুঝতে পারলাম না। তাকে কিছু বলার আগেই জারিফ আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি একবার হাতের দিকে তাকিয়ে জারিফের দিকে তাকালাম। সে মুচকি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি একটু মুচকি হেসে তার হাতে হাত দিলাম। সে আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আর আমি তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার হাত কাঁপছে। আর কেমন যেন একটা অনুভুতি হচ্ছে। এই অনুভূতিটার নাম কি তা ঠিক আমি জানিনা। কিন্তু আমার শরীরে যে শিহরণ হচ্ছে আর বুকের ভিতরে শিতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে তা আমি বেশ উপলব্ধি করতে পারছি। আর এটাও বুঝতে পারছি যে এই মুহূর্ত টা আর এই অনুভুতি টাকে কোন ভাবেই আমি হারাতে চাইছিনা। গাড়ির সামনে এসে দরজা খুলে আমাকে ভিতরে বসিয়ে দিয়ে হাত ছেড়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। তারপর পাশের সিটে গিয়ে বসে পড়ল। তার মুখে হাসি লেগেই আছে। আমি সেই হাসির মায়ায় পড়ে গেছি। তার দিকে নিস্পলক তাকিয়ে আছি। সে আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বলল “কি দেখছ?” “আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে!” আমি তার দিকে তাকিয়েই বললাম। সে আমার কথায় অবাক হয়ে হাসি টা বন্ধ করে দিলো। তার সেই হাসি বন্ধ হওয়ার সাথেই আমি বাস্তবে ফিরে আসলাম। চোখ বড় বড় করে তাকালাম। কি বলেছি তা বুঝতে পেরে কথা ঘোরানোর জন্য বললাম “আমার বন্ধু নিলা বলছিল।” সে একটু সময় কপাল ভাঁজ করে তাকিয়ে থেকে গাড়ি চালাতে মনোযোগ দিলো। কি বলতে কি বলে ফেললাম। কেন যে তার দিকে তাকাতে গেলাম। না তাকালেই এমন হতনা। একটা মেয়ে কখনও একটা ছেলেকে বলে যে তাকে সুন্দর লাগছে? ছি ছি! ভাগ্যিস বুঝতে পারেনি পারলে কি হতো। আমি তার সামনে যেতেই পারতাম না। আর উনি আমাকে ধমক দিত এমন উলটা পাল্টা কথা বলার জন্য।
ক্লাসের ফাকে বসে গল্প করছিলাম সবাই। প্রেম করলে কি কি করতে হয় তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। মনোযোগ দিয়ে সবটা শুনছিলাম। এমন সময় আমাকে উদ্দেশ্য করে নিলা বলল “ফারিয়া তোর কাজিনের কোন গার্ল ফ্রেন্ড আছে নাকি?” “নেই” তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললাম। “কাল যেভাবে তোর হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছিল দেখে তো মনে হচ্ছিল তোর প্রেমে পড়েছে?” সে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল। আমি একটু রাগ করে তার হাতে আলতো করে মেরে বললাম “আমার প্রেমে কেন পড়বে?” সে ভয় পেয়ে আর কিছু বলল না। কিন্তু তার কথাটা আমার মাথায় ঘুরছিল। আমি কঠিন ভাবনায় ডুবে গেলাম।
বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছি। পিচ্চি টা ঘরের এক বার এদিকে যাচ্ছে তো আরেকবার ওদিকে যাচ্ছে। আমি একটু মাথা তুলে তার দিকে তাকালাম। মুখে আঙ্গুল দিয়ে কি যেন ভেবে হাঁটাহাঁটি করছে। আমি আবার চোখ নামিয়ে নিলাম। “আপনি কি আমার প্রেমে পড়েছেন?” সে সামনে দাড়িয়ে ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল। আমি তার কথা শুনে হা হয়ে গেলাম। এটা কি বলল? ও কিভাবে জানলো এসব? সাইফ কি ওকে কিছু বলেছে? না ও তো কখনই বলবে না। তাহলে? আমি তাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে খুব স্বাভাবিক ভাবে বললাম “প্রেম কি তুমি বোঝ?” “বুঝি।” “বল দেখি প্রেম করলে কি হয়?” আমি তাকে ইশারায় সামনে বসতে বলে জিজ্ঞেস করলাম। সে বসতে বসতে বলল “সারাদিন ঘুরে বেড়ায়, এক সাথে থাকে, ফুচকা খেতে যায়, সুন্দর সুন্দর কথা বলে।” “আমি কি এরকম কিছু করেছি?” সে মাথা নাড়িয়ে না বলল। “তাহলে?” “কিছুনা। এমনিতেই জানতে ইচ্ছা করলো তাই জিজ্ঞেস করলাম।” বলেই সে উঠে গেলো। আমি তার যাওয়ার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ভাবলাম এতদিনে যতটুকু চিনেছি এটা তার কথা না। কেউ তো তাকে এসব বলেছে? তা নাহলে তার মাথায় এসব আসার কথা না। কাল একটু দেখতে হচ্ছে বিষয়টা!
আমি আজ একটু আগেই গিয়েছিলাম কলেজে ফারিয়াকে আনতে। শাওনের সাথে গল্প করে বের হয়ে দেখি ফারিয়া সব ফ্রেন্ডরা মিলে মাঠে বসে বাদাম খাচ্ছে। “কি হচ্ছে?” আমার কথায় সবাই পিছনে ঘুরে তাকায়। আমি কথাটা বলে তাদের মাঝখানে বসে পড়লাম। তার এক বন্ধু আমার দিকে বাদাম এগিয়ে দিলো। “থ্যাঙ্কস!” বলে কয়েকটা বাদাম হাতে নিয়ে ছিলতে লাগলাম। আমি একটা বাদাম মুখে দিতে যাব এমন সময় নিলা বলল “আপনি ফারিয়ার কাজিন হলে তো আমাদেরও ভাইয়া হচ্ছেন।” তার কথা শুনে আমি হা করে মুখের সামনে বাদাম টা ধরে ফারিয়ার দিকে একবার কঠিন দৃষ্টিতে তাকালাম। তার মানে আমাকে সে নিজের কাজিন বলে পরিচয় দিয়েছে। তোমাকে যতটা ইনোসেন্ট ভেবেছিলাম ততটা তুমি নও। আমাকে তুমি এখনো চিনতে পারনি। আমি এতো সহজে ছেড়ে দেইনা বেবি। আমি বাদাম টা মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে নিলার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বললাম “আমি ফারিয়ার যেই হই। তুমি আমাকে কি বলবে সেটা তুমিই ডিসাইড কর।” আমার কথায় মেয়েটা রীতিমতো ক্রাশ খেল। সব কয়টা দাঁত বের করে আমার দিকে তাকাল। আমি একটু কপাল ভাঁজ করে বাকা হেসে এটিটীঊট নিয়ে তার সাথে আই কন্ট্যাক্ট করলাম। সে আরেক দফা ক্রাশ খেল আমার উপরে। সেও আমার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে।এসব দেখে ফারিয়ার গায়ে আগুন লেগে গেলো। আমি তার দিকে না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারছি। সেই মুহূর্ত টাকে নষ্ট করতে ফারিয়া চেচিয়ে বলল “বাসায় যাব দেরি হয়ে যাচ্ছে।” আমি একটু বিরক্ত ভাব দেখিয়ে তার দিকে তাকালাম। ফারিয়া এবার চরম রেগে গেলো। আমি একটা ইনোসেন্ট লুক নিয়ে নিলার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললাম “আজ আসি। দেখা হবে।” বলেই ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম “চল।“ সে আমার পিছনে পিছনে এসে গাড়িতে বসে পড়ল। আমি গাড়ি স্টার্ট দিয়েই একটা হিন্দি রোমান্টিক গান চালিয়ে দিয়ে গুন গুন করে গাইতে গাইতে গাড়ি চালাতে লাগলাম। ফারিয়া মুখটা কাল করে সামনে তাকিয়ে থাকলো। আমি তার দিকে একবারো তাকালাম না।
দুই হাতের কনুইয়ের উপরে ভর দিয়ে বারান্দায় দাড়িয়ে সামনে তাকিয়ে আছি। “খাবেন না?” আমি পিছনে ঘুরে দেখি পিচ্চি টা দাড়িয়ে আছে। আমি তার কথার উত্তর না দিয়ে এক হাত ভাঁজ করে আরেক হাত থুতনিতে রেখে বললাম “তুমি না আমাকে জারিফ ভাইয়া বলতে?” সে আমার কথায় কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আমি আবার বললাম “বলনা কেন?” সে ভ্রু কুচকে বলল “আপনি তো বলতে নিষেধ করেছেন।” “ওহ আচ্ছা আজ থেকে আবার বলবে।” আমি কথাটা শেষ করেই নিচে গেলাম। আর সে আমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
আমি রেডি হচ্ছি। পিচ্চি টা সেই তখন থেকে আমার রেডি হওয়া দেখেই যাচ্ছে। আমি আয়নায় হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে আয়নায় তার দিকে একবার দেখে নিলাম। সে আজ কোন কারনে আমার উপরে ভীষণ বিরক্ত। এক রাশ বিরক্ত নিয়ে মুখ গোমড়া করে তাকিয়ে আছে। তার সেই বিরক্ত ভাবকে পাত্তা না দিয়ে আমি ফোন টা নিয়ে নিচে গেলাম। সে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে নিচে নেমে এলো। আমি কাল থেকেই তার সাথে কিছুটা অদ্ভুত আচরণ করছি যেটা তার পছন্দ হয়নি। কিন্তু আমি তার সেসব পাত্তা না দিয়েই নিজের মতই চলছি। গাড়িতে আমরা একটা কথাও বললাম না। প্রতিদিনের মতো ইংলিশ গান শুনতে শুনতে কলেজের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি আর ফারিয়া গাড়ি থেকে নেমে সামনা সামনি দাড়িয়ে আছি। এমন সময় নিলা কোথা থেকে এক গুচ্ছ গোলাপ আমার সামনে ধরে আমাকে আই লাভ ইউ বলল। সেখানে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। একবার ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে নিলার দিকে তাকালাম। আমার উপরে ক্রাশ খেয়েছে সেটা বুঝতে পেরেছিলাম কিন্তু এমন কিছু করবে টা আন্দাজও করতে পারিনি। আমি একটু হেসে তার হাত থেকে ফুল গুলো নিয়ে বললাম “এভাবে আগে কখনও কেউ প্রপোজ করেনি। এটাই প্রথম তো তাই একটু ভাবতে হবে। আমি তোমাকে পরে উত্তর দিবো কেমন। ” সে একটু লজ্জা পেয়ে ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে চলে গেলো। আমি ইনোসেন্ট ফেস নিয়ে ফারিয়ার দিকে তাকালাম । কিন্তু ফারিয়া যেন তার দৃষ্টি দিয়ে আমাকে খেয়ে ফেলবে। কিছু না বলেই রাগ করে চলে গেলো। দূর থেকে এসব শাওন দেখছিল। সে কাছে এসে বলল “কি সব নাটক চলছে? কিছুই বুঝলাম না।” আমি একটু হেসে বললাম “বউ আমার তার বন্ধুদের বলেছে আমি কাজিন। তাই বউ কে একটু শেখাচ্ছি মিথ্যা বলার বিপদ কি হতে পারে।” বলেই দুজনে হাসতে লাগলাম।
সেই সকাল থেকেই মাথাটা গরম হয়ে আছে। আরও বেশি গরম হয়ে যাচ্ছে জারিফ কে দেখলেই। এই জন্যই আমি জারিফের কাছ থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে চলছি। যাতে আরও বেশি মাথাটা গরম না হয়ে যায়। লোকটা কেমন অদ্ভুত। একটা মেয়ে এসে প্রপোজ করলো আর উনি হাসি মুখে ফুল নিয়ে নিলো। উনি তো বিবাহিত। বললেই পারতো। কেন বলল্না? আর কি দরকার ছিল কাল অতো হাসাহাসি করার। সেই জন্যই তো এমন হয়েছে। ওদের সাথে অতো কথা না বললেই কিছুই হতনা। বাজে লোক একটা।
নিলার ওই ঘটনার পর থেকে ফারিয়া আমার সাথে খুব ভালো আচরণ করছেনা। এমন একটা ভাব ধরছে যেন এই সব কিছুর জন্য আমিই দায়ি। সব কিছু বুঝতে পেরে আমিও তাকে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছিনা। তবে ও আমার উপরে এতোটা রেগে আছে যে স্বাভাবিক কোথাও বলছেনা। কিন্তু এখানে আমার কি দোষ। সত্যি কথাটা বললেই তো এমন হতনা। তার একটু শিক্ষা পাওয়া উচিৎ। পরের দিন আমি ফারিয়াকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠতে যাব ঠিক তখনি নিলা এসে সামনে দাঁড়ায়। তারপর আমার কাছে জানতে চাইলো আমিকি ভেবেছি। আমি একটু হালকা হেসে তাকে বললাম “আমার কাজিন তোমাকে উত্তর টা দিবে। আমি তাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি।” বলেই আমি ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম ”ওকে ভালো করে বুঝিয়ে দিও কেমন।” সে আমার দিকে এমন ভাবে তাকাল যেন আমি তার উপরে ১০০ কেজি ওজনের বস্তু চাপিয়ে দিয়েছি। আমি আর না দাড়িয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম।
চলবে…