আমার শহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-০৪

0
4927

#আমার_শহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
লেখক- এ রহমান
পর্ব ৪

বারান্দায় দাড়িয়ে কফি খাচ্ছি। পিছনে ঘুরতেই পিচ্চি টার দিকে চোখ পড়ল। টেবিলে বসে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। বাতাসে সিল্কি চুল গুলো থেমে থেমে উড়ছে। কি স্নিগ্ধ লাগছে। এভাবে কখনও দেখা হয়নি। কিন্তু আজ চোখ আটকে যাচ্ছে। অপূর্ব! আমি নিজে কাউকে খুজে নিলে হয়তোবা এমনি একজনকে খুজে নিতাম। আমি আসলে তার দিকে সেভাবে কোনদিন তাকাইনি। তাই তার সৌন্দর্য সেভাবে আমার কাছে ধরাও পড়েনি। বিয়ের পরে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার আমি তার দিকে তাকালাম। তার প্রতি একটা অন্য রকম অনুভুতি কাজ করছে। কিছু একটা আজ আমাকে তার কাছে টানছে। আমি কফি টা হাতে নিয়ে গেলাম তার কাছে। কাপটা টেবিলে রেখে হেলানি দিয়ে দাড়িয়ে “খাও।“ আমার কথা শুনে সে একটু অবাক হয়ে তাকাল আমার দিকে। তারপর কাপটার দিকে মাথা বাড়িয়ে একবার দেখে নিয়ে বলল “এটা তো আপনার কফি।“ “তো?” একটু ভ্রু কুচকে বললাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল “আমি কেন খাব?” “বেশি কথা না বলে খাও।“ আমি গম্ভীর ভাবে বললাম। “এখন খেতে ইচ্ছা করছেনা। আপনি খান।“ আমার দিকে না তাকিয়েই বলল। “কফি খাবা না থাপ্পড় খাবা? খেতে বলেছি খাও” আমি ধমক দিয়ে বললাম। সে আমার ধমকে ভয় পেয়ে এক নিমিষেই কফি শেষ করে কাপটা টেবিলে রেখে বইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তার মাথায় হাত দিয়ে একটু হেসে বললাম “পড়।“ সে কোন কথা না বলে পড়তে শুরু করলো।

বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছি। কিন্তু আমার চোখ সেই পিচ্চি পরীটার দিকেই আটকে যাচ্ছে। আমার পিচ্চি পরী। আমার পরী মানে? কি বললাম এটা।মুহূর্তেই ঠোটের কোণে একটা হাসি চলে এলো। আমি কি তার প্রেমে পড়েছি? কি থেকে কি হয়ে গেলো। কিছুই বুঝলাম না।অদ্ভুত একটা অনুভুতি হচ্ছে। তার মায়াবি চেহারা আমাকে টানছে।

ভীষণ মাথা ব্যাথা করছিলো। কফিটা খেয়ে মাথাটা ছেড়ে দিলো। মানুষটা খারাপ না। একটু মুচকি হেসে বইটা বন্ধ করে উঠে গেলাম। সব ঠিক করে রেখে পানি খেয়ে শুয়ে পড়ব। পানি গ্লাসে ঢালতে একটু খানি মেঝেতে পড়েছে। পানিটা খেয়ে তারপর মুছে দিবো। পানি খেয়ে গ্লাস টা রেখে ঘুরতে যাব তখনি পানিতে পা পড়ল। আর পা পিছলে পড়ে গেলাম। কিন্তু মেঝেতে না। জারিফ আমার পিছনে দাড়িয়ে ছিল। তার গায়ের উপরে। দুজন মিলে গিয়ে পড়লাম বেডে। আমি জারিফের উপরে পড়লাম আর আমার ঠোঁট জারিফের ঠোঁট স্পর্শ করলো। কিছুক্ষনের জন্য থমকে গেলাম। এ কেমন অনুভুতি হল। এরকম তো আগে কখনও হয়নি। আমি নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে উঠতে গিয়ে পারলাম না। কারন জারিফ আমাকে দুই হাতে জড়িয়ে রেখেছে। সে তার হাত আমার পিঠে স্লাইড করছে। নেশা ভরা চোখে তাকিয়ে আছে। আমি তার চোখের দিকে তাকাতেই আমার গলা শুকিয়ে গেলো। আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। সে আমাকে ছেড়ে দিয়ে মাথার নিচে একটা হাত দিয়ে শুয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁটে বিশ্বজয়ের হাসি। আমার অস্বস্তি হতে লাগলো। এভাবে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলে অস্বস্তি তো হবেই। কি করবো কিছু বুঝতে না পেরে ওয়াশ রুমে চলে গেলাম।

আমি একটু মুচকি হেসে উঠে বসলাম। আমি ওকে যতটা পিচ্চি ভেবেছিলাম ততটাও না। নিজের ঠোঁটে হাত দিয়ে স্লাইড করছি। তখনি ফারিয়া ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আমাকে দেখেই থমকে দাঁড়ালো। আমি তার দিকে একটু সিরিয়াস লুকে তাকালাম। আমার তাকানো দেখেই তার গলা শুকিয়ে গেলো সেটা বেশ বুঝতে পারলাম। উঠে বারান্দায় চলে গেলাম। বারান্দায় দাড়িয়ে প্রথম প্রেমের প্রথম অনুভুতি সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে উড়িয়ে প্রকৃতির সাথে ছেলিব্রেট করছি। আসলেই প্রেমের এক অদ্ভুত অনুভুতি হয়। এটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। অবশেষে আমিও প্রেমে পড়লাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানায় শুয়ে দেখছি আমার পিচ্চি কলেজে যাবার জন্য রেডি হচ্ছে। আমিও উঠে ওয়াশ রুমে গেলাম। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে দেখি ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। চোখে কাজল। কপালে টিপ। এই মেয়েটাকে সেদিনই বলেছিলাম এভাবে কলেজে না যেতে। সকাল সকাল মেজাজ টাই খারাপ করে দিলো।ওর কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে টেনে সামনে এনে ধমক দিয়ে বললাম “বলেছিলাম না এভাবে সং সেজে কলেজে যাবেনা। তবুও কেন সেজেছ? মুছে ফেল।“ সে ভয় পেয়ে মাথা নিচু করে নিলো। “সোজা কথা সোজা ভাবে না শুনলে থাপ্পড় দিয়ে শোনাবো।“ সে ভয়ে সব কিছু মুছে ফেলে একদম সাধারন ভাবে নিচে গেলো।

এতদিন শুধু রাগ দেখাত এখন মারতেও চায়। কি আজব মানুষ। একটু মন ভরে সাজতেও পারবোনা। সকাল বেলাতেই মুড টা খারাপ করে দিলো। সে আমাকে আজ একাই কলেজে নামিয়ে দেয়নি। আমার সাথে সেও গিয়েছে কলেজে তার বন্ধুর সাথে আড্ডা দিতে। আজ নাকি অফিসে তেমন কাজ নেই তাই অফিসে যাবেনা। আমি ক্লাসে চলে গেলাম। আর সে তার বন্ধুর রুমে।

“কি রে এতক্ষনে এলি? সাইফ ও প্রায় চলেই এসেছে। আজ জমিয়ে আড্ডা দিবো।“ শাওন বলল। আমি গিয়ে একটা চেয়ারে বসতেই সাইফ ভিতরে ঢুকে বলল “ফারিয়ার কি হয়েছে রে? ওর মন খারাপ দেখলাম?” আমি চেয়ারে আরাম করে বসে তার দিকে তাকিয়ে বললাম “ওর সেজে গুজে কলেজে আসাটা আমার একদম পছন্দ না। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেলো। সাজতে নিষেধ করেছি মন খারাপ করছিলো। তাই থাপ্পড় মারতে চেয়েছি।“ সাইফ আর শাওন দুজনেই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। সাইফ তার হাত আমার কপালে লাগিয়ে বলল “তুই সুস্থ আছিস তো?” “কি যা তা বলছিস” আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম। শাওন বলল “বন্ধু প্রেমে পড়েছে!” বলেই দুজন হাসতে শুরু করলো। আমিও তাদের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে বললাম “প্রেমে তো পড়তেই হতো। ওরকম একটা কিউট সারাদিন চোখের সামনে ঘুরে বেড়ালে প্রেম না হয়ে কি পারে।“ “তোর সেই কিউট জানে প্রেমে পড়ার কথা?” শাওন বলল। “মাথা খারাপ! এখনি ওকে জানাবোনা। আর একটু বড় হোক। সেও আমার মতো আমার প্রেমে পড়ুক আগে তারপর।“ আমি একটু মুচকি হেসে বললাম। সাইফ বলল “দেখিস আবার দেরি যেন না হয়ে যায়। সময়ের কাজ সময়ে করে নিস বন্ধু।“ বলেই সবাই হাসতে লাগলাম। “পিচ্চিটা আসলেই অনেক কিউট! খুব মায়াবি চেহারা।“ আমি কোথাও একটা যেন হারিয়ে গিয়ে কথাটা বললাম। “তাই বলি আনটি বিয়ে করতে বলল আর বন্ধু আমার রাজি হয়ে গেলো। আমিও বেশ অবাক হয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারছি আসল কারন। ” সাইফ শাওনের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল। আমি সামনে থাকা একটা কাগজ সাইফের গায়ে ছুড়ে মেরে হাসতে লাগলাম।

বাবা তাকে ডাকছিল তাই ডাকতে এসে দেখি উনি বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে আছেন। ভেবেছিলাম ঘুমিয়েছে। তাই আসতে করে কাছে বসে বললাম “জারিফ ভাইয়া।“ উনি আমার ডাক শুনে চট করে চোখ খুলে কঠিন ভাবে আমার দিকে তাকালেন। তার সেই দৃষ্টি দেখে আমি ঢোক গিলতে শুরু করলাম। আমার হাত টা জোরে চাপ দিয়ে ধরে বলল “আবার ভাইয়া।“ আমি মাথা নিচু করে সরি বললাম।হাতে ব্যাথা লাগছে। নাড়াতেও পারছিনা। জোরে চেপে ধরার কারনে অনুভুতি শুন্য হয়ে যাচ্ছে। “আমি কে?” তার কথায় চমকে উঠলাম। উত্তর দিতে পারছিনা। নিচে তাকিয়ে থাকলাম। এবার ধমক দিয়ে “কি হল? মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না কেন?” আমি ভয় পেয়ে এবার কেদে দিবো। “বাবা ডাকছে” কাপা কাপা গলায় বললাম। “যতক্ষণ না বলতে পারছ আমি কে ততক্ষন কোথাও যাবেনা।“ চাপা ধমক দিয়ে বলল। কেমন পরিক্ষায় পড়লাম। সব নষ্টের মুল ওই ভাইয়া! আর কখনও কাউকেই ভাইয়া ডাকবোনা। কিন্তু এখন কি করি? “কি হল?” আবার ধমকে চমকে বলে ফেললাম “বর!” “কি বললে জোরে বল।“ “বর।“ “কার বর?” ’”আ…আ…মার বর” ভয়ে কাপতে কাপতে বললাম। হাতটা ছেড়ে দিয়ে উঠে বাইরে চলে গেলো। আমি কয়েকবার জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে হাতের দিকে তাকালাম। চমকে উঠলাম। সব কয়টা আঙ্গুলের দাগ! লাল হয়ে আছে।কি নিষ্ঠুর। ভাইয়া বলেছি তাই এভাবে শাস্তি দিতে হবে। আমি মন খারাপ করে একটু সময় বসে থাকলাম। তারপর নিচে নামছি সিঁড়ি দিয়ে। সবাই বসে সোফায় গল্প করছে কিন্তু জারিফ নেই। আমি অমনোযোগী হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচে নামছি। জানিনা ভুল করে কোথায় পা দিলাম। কি হল বুঝতে পারলাম না। চোখ বন্ধ করে ফেললাম।

আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠবো তখনি পিচ্চি টা লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে নামতে পা পিছলে পড়ে গেলো। আর আমি তাকে ধরে ফেললাম। নিজের সাথে তাকে জড়িয়ে নিলাম দু হাতে। সে ভয় পাওয়ার কারনে চোখ বন্ধ করে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আমিও তাকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। দুজনেই খানিক্ষন চুপ করে থাকলাম। সে ভয় কাটাতে চেষ্টা করছে আর আমি তাকে অনুভব করছি গভীর ভাবে। বুকটা যেন ভরে গেলো। একটু সময়ের জন্য মনে হল আমার সারাজীবনের অপূর্ণতা আজ পূর্ণ হল। “তোমরা ঠিক আছ তো?” মায়ের কথায় আমার ঘোর কাটল। পিচ্চি চোখ খুলে এই অবস্থা দেখে আমাকে ছেড়ে দিয়ে উপরে চলে গেলো। অনেকটা লজ্জা পেয়েছে। আমি হাসলাম। কিন্তু মা আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল “আমিও পড়ে গেলে কি এভাবে ধরতে?” আমি তার কথা শুনে অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। মা বাবা দুজনে এবার দুজনের দিকে তাকিয়ে মুখ চেপে হাসছে ।এবার মনে হচ্ছে আমি সত্যিই লজ্জা পেলাম। আমার দাড়িয়ে থাকা দেখে মা মুখ চেপে হাসি আটকে আমাকে ইশারা করে উপরে যেতে বলল। আমি সামনে তাকিয়ে চলে গেলাম।

চলবে………

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে