আমার শহরে তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব-১৫ এবং অন্তিম পর্ব

0
4554

#আমার_শহরে_তোমার_নিমন্ত্রণ
লেখক- এ রহমান
শেষ পর্ব

আমি চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলানি দিয়ে আছি। দরজায় নক করতেই বললাম “কামিং।” বলে চোখ তুলে তাকাতেই আমার চোখ থমকে গেলো। ফারিয়া নীল রঙের একটা সুতি শাড়ী পরেছে। চোখে হালকা কাজল। ঠোঁটে পিংক লিপস্টিক। চুল গুলো সাইডে সিথি করে ছেড়ে দেয়া। কপালে নীল টিপ। কি অদ্ভুত লাগছে। আমি হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছি। এর মাঝে কখন সে এসে সোফায় বসে পড়েছে আমি খেয়াল করিনি। আমার ঘোর কাটল তার কথা শুনে। “ওখানে বসে আমাকে দেখলে কি পেট ভরবে না এখানে এসে খেতে হবে।” আমি তার কথা শুনে টেবিলে তাকালাম। খাবার এনেছে আমার জন্য। সেগুলা সব সাজিয়ে রাখছে। আমি কোন কথা বলছিনা। শুধু তার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছি সে কি করতে চাচ্ছে। আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল “কি হল কথা বলছি শুনতে পাচ্ছনা।” তার কথা শুনে আমি এবার একটা হাত টেবিলে রেখে তার দিকে ভালো করে তাকাই। এই প্রথম সে আমাকে তুমি বলেছে। আমাকে তার দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু না। অনেক হয়েছে। আমি বারাবার তার আচরনে সব ভুলে তার দিকে ছুটে যাই। কিন্তু সে বারবার আমাকে কোন না কোন কারনে অবহেলা করে। আমার কষ্ট সে বুঝতে চায়না। কিন্তু এবার আমার কষ্ট তাকে বুঝতেই হবে। আমার চুপ করে থাকা দেখে সে আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। আমি কিছু না বলে তার সাথে গিয়ে বসলাম। সে খাবার হাতে তুলে আমার মুখের সামনে ধরল। আমি আবারো অবাক হয়ে গেলাম। মনে মনে একটু হেসে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলাম। সামনে আরও অনেক কিছু অপেক্ষা করছে। ফারিয়া আরও এমন অনেক কাজ করবে যাতে আমি বারবার অবাক হব। তাই এই মুহূর্তে আমি নিজেকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করে নিলাম। কোন কথা না বলে মুখ খুলে খাবার মুখে নিলাম। সে পরম যত্নে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে। খাওয়া শেষ করে সে একটু রেগে বলল “আমি খেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করলেনা?” আমি কিছু না বলে উঠে একটু এগিয়ে গিয়ে ঘুরে বললাম “কেন এসেছ?” খাওয়ার পরে আসলে এরকম প্রশ্ন শুনে ফারিয়া কি ধরনের রিয়াকশন দেবে তা ভেবে পাচ্ছেনা। কোন কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো অসহায় হয়ে। আমার বুকের ভিতরে কষ্ট হলেও আমি তা চেপে রাখলাম। তাকে বুঝতে দিলাম না।

আমি ঘরে গিয়ে দেখি জারিফ বারান্দায় দাড়িয়ে আছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। সে আমাকে বুঝতে চাইছেনা। কিন্তু আমি হাল ছাড়তে চাইনা। আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। সে একবারও আমার দিকে তাকালনা। তাকালে হয়তো আমার কষ্টটা বুঝতে পারতো। আমি আর নিজেকে আটকাতে পারলাম না। তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম। সে একটু চমকে উঠলো। হয়ত ভাবতেও পারেনি আমি এমন কিছু করবো। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। সে আমার হাত ধরে আমাকে সামনে টেনে এনে বলল “কেন করছ এসব?” আমি কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে কাঁদতে লাগলাম। সে এবার খুব শান্ত কণ্ঠে বলল “ভালোবাসা মানে কি জানো? ভালবাসা মানে হচ্ছে একজনকে নিজের সুখ দুঃখ সব কিছুর সঙ্গী করে নেয়া। ভালোবাসার মানুষের সাথে নিজের জিবনের সব কিছু ভাগ করে নেয়াই ভালবাসা। তোমার যখন সুখ আসবে তখন শুধু মানুষটাকে সুখে ভরিয়ে দিবে আর যখন দুঃখ আসবে তখন সেই মানুষটার কথা না ভেবে শুধু নিজের দুঃখটাকে প্রাধান্য দিবে সেটা কিন্তু ভালবাসা না। স্বার্থপরতা। তুমি একবারও আমার কথা ভাবলে না। তোমার জন্য আমি কষ্ট পাচ্ছি সেটা দেখলেনা। কেন পারতেনা আমার সাথে তোমার সব দুঃখ ভাগ করে নিতে। আমি কি পারতাম না তোমার কষ্ট একটু কমাতে। কিন্তু আফসোস তুমি তো আমাকে সেটার যোগ্যই মনে করনি। আমি সত্যিই ব্যর্থ তোমার মনে জায়গা করে নিতে।“ বলেই সে চলে যাচ্ছিলো। আমি তার হাত টেনে ধরি। সে আমার দিকে ঘুরে তাকায়। আমি হাঁটু ভাঁজ করে মেঝেতে তার সামনে বসে পড়ি। আমি হাত জোর করে তার সামনে ধরে বললাম “আমাকে মাফ করে দাও জারিফ। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি তোমাকে বুঝতে চাইনি। আমি তোমার ভালবাসাকে অসম্মান করেছি। তোমার চাওয়া পাওয়া সব কিছুকে ছোট করেছি। সব কিছুর উপরে নিজের আবেগ অনুভুতিকে প্রাধান্য দিয়েছি।“ সে আমাকে টেনে তুলে খুব শান্ত ভাবে বলল “বুঝতে পেরেছ এটাই আমার জন্য অনেক।” বলেই সে চলে যেতে নিলে আমি এবার তাকে টেনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। তার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকি। তারপর আমার মুখ তুলে তার দিকে একবার তাকিয়ে তার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট মিশিয়ে দেই। কিছুক্ষন পর ঠোঁট সরিয়ে নেই। আমার কাজে সে অবাক হয়ে যায়। আমি লজ্জায় তার দিকে তাকাতে পারছিনা। তার থুতনিতে নিজের কপাল ঠেকিয়ে নিচের দিকে চেয়ে আছি। সে আমার মুখটা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসে। তারপর আমাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দেয়।

ঘুম থেকে উঠে দেখি ফারিয়া আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল আছড়াচ্ছে। সদ্য গোসল করে বেরিয়েছে। চুল থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে। আমি বিছানা থেকে উঠে গিয়ে তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম। সে একটু হেসে বলল “ফ্রেশ হয়ে নিচে এসো। আমি নিচে যাচ্ছি।” “সব কথা শুনব আগে একটু আদর কর।” সে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। আমি তাকে আমার দিকে ঘুরিয়ে নিলাম। সে আলতো করে আমার গালে চুমু দিলো। তার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললাম “যাও আসছি।” বলেই ওয়াশ রুমে চলে গেলাম।

সকাল থেকেই শরীরটা খারাপ লাগছিলো। সারাদিন ঘরেই শুয়ে ছিলাম। দুপুরে খাবার জন্য নিচে গেলাম। মার সাথে টেবিলে খাবার রেডি করছিলাম। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠলো। আমি টেবিলটা ধরে নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না।

চোখ খুলে দেখি সবাই আমার সামনে দাড়িয়ে আছে আর ডাক্তার আমাকে দেখছে। আমার মাথায় হাত দিয়ে ডাক্তার বললেন “এখন কেমন লাগছে?” “ভালো লাগছে।” বলেই আমি উঠতে গেলাম। কিন্তু উনি বললেন “তোমার এখন রেস্ট দরকার।” সবাই ডাক্তার এর দিকে তাকাল। বাবা জিজ্ঞেস করলেন “কেন? ওর কি হয়েছে?” ডাক্তার হেসে বললেন “আপনি দাদা হতে যাচ্ছেন। ও প্রেগন্যান্ট।” কথাটা শুনেই সবাই খুব খুশি হলেন। মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। বাবা মা দুজনেরি চোখে পানি। বাবা বললেন “আমি আজ সব থেকে খুশি হয়েছি। তুমি আমাকে আমার জিবনের সব চেয়ে বড় খুশি এনে দিয়েছ মা।” এই সব কিছু জারিফ পিছনে দাড়িয়ে দেখছিল। মা ঘুরে তার দিকে তাকিয়ে বললেন “ওখানে কেন দাড়িয়ে আছিস? ভেতরে আয়।” মার কথা শুনে সে আসতে আসতে ভেতরে এলো। কিছুক্ষন পর সবাই বের হয়ে গেলেন। জারিফ আমার পাশে বসে আমাকে দেখছে। কিছুক্ষন পর আমাকে তার সাথে জড়িয়ে নিলো। আমি বুঝতে পারছি সে কাঁদছে। হয়ত মানুষ সব থেকে কষ্ট আর আনন্দের দিনে নির্বাক হয়ে যায়। তাই আজ সে কোন কথা বলছেনা। নিরবে চোখের পানি ফেলে এই মুহূর্ত টা অনুভব করতে চাইছে। এটা তার জিবনের সব থেকে সুখের মুহূর্ত। আমি তাকে কোনদিন কাঁদতে দেখিনি। কিন্তু আজ আমি তাকে বাধা দিচ্ছিনা। তার জিবনের সমস্ত সুখ নিজের মতো করে অনুভব করতে দিচ্ছি।
(আপনাদের সবার প্রতি আমি অনেক কৃতজ্ঞ। আপনারা আমার গল্পটি ভালবেসেছেন। সবাইকে মন থেকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। খুব তাড়াতাড়ি আপনাদের জন্য নতুন গল্প নিয়ে আসবো)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে